জ্বলদর্চি

ইস্কুল ফিস্কুল /পর্ব-১২/সৌমেন রায়

ইস্কুল  ফিস্কুল 

পর্ব-১২

সৌমেন রায় 

চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি

পা পিছলে আলুর দম (২)

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

গত পর্ব পড়ে বোধহয় ভেবেছিলেন বাঁচা গেল বাবা শেষ হয়েছে। আজ্ঞে না আরো আছে।  বছরের  নানা  সময়ে  আয়োজিত  হয়  নানাবিধ  শিবির। যেমন একটা হল স্বাস্থ্য শিবির। তার মধ্যে আবার ভাগ আছে সাধারণ স্বাস্থ্য , চোখ পরীক্ষা, মানসিক কাউন্সেলিং। এই সমস্ত শিবির থেকে অনেক সমস্যা বেরিয়ে আসে। দরিদ্র পরিবার গুলি বিনা পয়সায় চিকিৎসা পায়, চশমা পায় । কাউন্সিলিং শিবিরে এমন সব সমস্যা বেরিয়ে আসে যা ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের বলবে না কোনওকালে। শিক্ষক সমাধানও করতে পারবেন না। দিন দিন যখন জীবনে জটিলতা বাড়ছে, আত্মহত্যা বাড়ছে তখন এ ধরনের কাউন্সিলিং খুব দরকারি।

   এখন আবার শনিবারটি সরকার থেকে নো বুক ডে বলা হয়েছে। এটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে আনন্দ পরিসর হিসাবে। ছেলে মেয়েরা আসবে। খেলাধুলা, গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, কুইজ এই সমস্ত আনন্দদায়ক জিনিস নিয়ে শনিবারটা কাটাবে। স্কুল যেন কোনো ভাবেই তার কাছে বিরক্তিকর কিছু বলে মনে না হয়।কর্তার ইচ্ছাই কর্ম। কন্যাশ্রী ক্লাবের একটিভিটি আগের পর্বে বলা হয়েছে। ছেলেদের নিয়ে আবার আছে বন্ধুমহল ( Boy’s Club )। তাদেরও নানাবিধ একটিভিটি থাকে। স্কুল পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। এলাকায় পরিবেশ, স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা গড়ে। নাবালিকা বিয়ে রোধ করে। তবে নাবালিকা পড়ার থেকে বিয়ে পছন্দ করলে কারও কিছু করার থাকেনা। যতগুলি বিয়ে আটকানো হয় তার বেশিরভাগ কিছু দিন চুপ থাকার পর চুপচাপ বিয়েটা সেরে নেয়। একদিনতো নাইন এর এক মেয়ে এসে উদ্ভাসিত মুখে প্রণাম করল। কিরে কি ব্যাপার? আজ স্কুল আসিসনি কেনো? প্রায় নাচতে নাচতে বলল, স্যার আমার বিয়ে। বোঝা গেল মুখের হাসিটি বর্তমানের গারদ থেকে মুক্তি জনিত। ভবিষ্যতের গারদটির সম্পর্কে এখনও স্পষ্ট ধারণা তার নেই।

 মাঝে মাঝে আবার কিছু কিছু সচেতনতা শিবির করার ডাক পড়ে। যেমন ধরুন ডিজিটাল অ্যাওয়ারনেস, ফিনান্সিয়াল অ্যাওয়ারনেস, জলসম্পদ দপ্তর থেকে জল বিষয়ক সচেতনতা, পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ, থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক সচেতনতা, ইলেকশন কমিশন থেকে নতুন ভোটারদের ভোটদান বিষয়ক সচেতনতা, সরকারী অফিস দেখতে নিয়ে যাওয়ার প্রোগ্রাম, ব্লাড ডোনেশন  ক্যাম্প, ডেঙ্গু সচেতনতা  ইত্যাদি ইত্যাদ। সব মনে রাখাই মুশকিল। স্কুলে স্কুলে দেওয়া হয়েছে ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন। যাতে ছাত্রীরা কোন অসুবিধায় না পড়ে। সে ন্যাপকিনের হিসাব-নিকাশ রাখতে হয়।একটি স্কুল আবার দেখলাম মাশরুম প্রজেক্ট করছে। ছাত্র ছাত্রীরা চাষ করছে,বাজারে বিক্রি হচ্ছে। গান্ধীজি এমন স্বনির্ভর স্কুলের কথাই বলেছিলেন বুনিয়াদি শিক্ষা নীতিতে। তবে স্কুলের স্পেশাল ক্লাস, ওয়ার্ক এডুকেশন, ফিজিক্যাল এডুকেশনের ক্লাস গুলি নিয়মিত হলে এসব কিছুই দরকার হত না ।এই ক্লাসগুলি স্টুডেন্টদের স্কুলমুখী যেমন করতে পারত তেমন জীবনমুখী শিক্ষাও দিতে পারত। স্পেশাল ক্লাসের ব্যাপারটি আগে  একবার আলোচিত হয়েছে।

🍂

 সবাই সব শিক্ষা স্কুলে দিতে চায় । কেউ কেউ আবার বলেন যারা পড়ছে না মানে পড়তে পারছে না তাদের সন্ধি, সমাস শিখিয়ে কি হবে? তাদের টোটো চালানো, ক্যাটারিং এর শিক্ষা দেওয়া যায় না? যাবে  না  কেন, নিশ্চয় যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হল সেটা কি স্কুলের কাজ হওয়া উচিত? এখন বৃহত্তর  বাতাবরণে কেউ কারো কথা শোনে না। ভুল হল, রাজনৈতিক নেতা ছাড়া কারও কথা কেউ শোনে না। স্কুল  বাঁধা ছাগল। যখন খুশি, যেদিকে খুশি কাটা যায়।  তাই সব স্কুলেই হচ্ছে। 

তবে নিরপেক্ষভাবে দেখলে উপরোক্ত বিষয়গুলির প্রয়োজনীয়তা আছে। কোনটি ফেলে দেওয়ার মত নয়। কোনটিকে অপ্রয়োজনীয় বলা যাবে না। এবং তা সব আয়োজন হচ্ছেও। শিশু না শিখে যাবে কোথায়! এর জন্য ক্ষতি যে হয় না তা নয়। তা খুব ‘সামান্য  ক্ষতি ‘। সেটা হল পড়াশোনাটা ছাগলের তৃতীয় ছানা হয়ে গেছে। তার স্থান সংকুচিত হয়ে গেছে। শিশু মন এমনিতেই আনন্দ চায় । এমন আনন্দের লহরীর পর লহরী যদি উঠতেই থাকে স্কুলে তাহলে স্টুডেন্টরা সুস্থিত হতে পারবে?  পড়াশুনা শেখা এক নিবিড় সাধনার বিষয়। অনেক নিষ্ঠা, শ্রম এবং চর্চা লাগে। তার জন্য একটু সুস্থিতি প্রয়োজন। তা কি তারা পাচ্ছে? এরপর যদি পাড়ার অনুষ্ঠান, পারিবারিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান যোগ করেন তাহলে অবস্থা আরো ঘোরাল হয়ে উঠবে। স্টুডেন্ট যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ না হয়, অভিভাবক যদি সচেতন না হয় তাহলে এই পরিবেশে কি একজন শিশু শিক্ষা অর্জন করতে পারবে? ক্ষতিটা হচ্ছে কিন্তু দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের, যাদের আবার অভিভাবক সচেতন নন তাদের তো  আরো। কারণ শহুরে, আর্থিকভাবে সচ্ছল, সচেতন অভিভাবক সন্তানকে আগলে রাখতে জানেন। কতটুকু আনন্দ লহরীতে তার সন্তান স্নান করবে, আর কতটুকু এড়িয়ে যাবে তা তার ইচ্ছার অধীন। যেটুকু স্কুলে হল না সেটুকু উচ্চ মূল্যে কিনে নেওয়ার ক্ষমতাও তার আছে । দরিদ্র, অল্প শিক্ষিত অভিভাবকের  পক্ষে  আনন্দ লহরী পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আর তার কেনার ক্ষমতাও সীমিত। প্রতি বছর  দরিদ্র ও স্বল্প  শিক্ষিত  পরিবারগুলির  কিছু   স্টুডেন্ট অন্ধকার বৃত্ত থেকে  আলোক বৃত্তে প্রবেশ করে। সেটাও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে  এমন  চলতে থাকলে। স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা অজান্তেই অসাম্য বাড়াচ্ছে। সংশ্লিষ্ট গণ্য মান্য ব্যক্তিরা কি জানেন না? এই ধারাবাহিক লিখতে গিয়ে অনেকবারই ছোট মুখে বড় কথা বলতে হচ্ছে, গুণীজন মাপ করবেন। শিক্ষাবিদরা হয়তো জানেন কিম্বা হয়তো জানেন না। তবে সর্বাধিক যে সম্ভাবনাটা মনে হচ্ছে তা হল তারা তাদের ছোটবেলা ভুলে গেছেন। নিজেকে লেখাপড়া শিখতে কি পরিমাণ শ্রম করতে হয়েছে, কত কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে তা  তার মনে নেই। এবং বর্তমানে পরিস্থিতিকে তিনি একটি ছাত্রের অবস্থান থেকে না দেখে বিচ্ছিন্নভাবে দেখছেন। ভাবছেন যা কিছু চলছে সবই শিক্ষার অঙ্গ এবং সেই সব স্কুলের মধ্যেই শিখিয়ে দিতে হবে। ভারসাম্যের কথা মাথায় নেই। আবার কেউ কেউ বলেন লেখাপড়া শিখিয়েও তো সবাই শিখছে না। তাহলে সকলকে বিভিন্ন বিষয়ে মাতিয়ে রাখা যাক। এসব থেকে কিছু তো  শিখবে। সমস্যা হচ্ছে সারাবছর মেতে থাকলে এবং মাতিয়ে রাখলে পড়াশোনা করা স্টুডেন্ট দলটা ক্রমশ ছোট হচ্ছে। আশঙ্কা হয় যে দলটা ছোট হতে হতে বিলীনও হয়ে যেতে পারে।ঘটনাক্রম দেখে মনে হয় এটাই কালের গতিপথ। রোধ করা মুশকিল।

 আপনি এত দূর পর্যন্ত পড়তে পড়তেই বোধহয় ক্লান্ত হয়ে গেছেন। এবার শিক্ষকের অবস্থা  ভাবুন। এমনিতেই পাঠ দান করা, উদ্বুদ্ধ করা, মনের সঙ্গে মনের সংযোগ ঘটাানো কঠিন কাজ। সেটা পারলে অপার আনন্দ কিন্তু না পারলে অত্যন্ত ম্যাড়মেড়ে। এই সমস্ত কিছু সামলে তার কি সে জটিলতায় প্রবেশ করার ইচ্ছে হবে? সে তো এসব করতে করতে এখন ইভেন্ট ম্যানেজার হয়ে গেছে। অনায়াসে গতবারের ছবি এডিট করে এবারের অনুষ্ঠান সফল করে দিতে পারে। পাকে চক্রে সেও ভাবতে শুরু করেছে এগুলোই শিক্ষা। এগুলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করাই তার কাজ। এইগুলি  ঠিক ঠাক  উতরে দিলে সে কৃতিত্ব পায়, প্রশংসা পায়। মন দিয়ে পড়ালে তার প্রশংসা কেউ করে না। বরং সবাই আড়ালে টিপ্পনি  কাটে। তাহলে সে  সেই জটিলতায় ঢুকবে কেন?

  এক গণিতের শিক্ষক বন্ধু  একবার কাউন্সেলিং এর জন্য তার ক্লাসটি ছেড়ে দিতে চাননি। তিনি বলেন ওটা পরে হবে। কাউন্সিলাররা  সরকারি  লোক, ছাড়বেন কেন? অগত্যা গণিত শিক্ষক গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এসে প্রধান শিক্ষককে বললেন , ‘স্যার এত প্রোগ্রাম হলে পড়াবো কখন? অংক করলে ওসব কাউন্সেলিং লাগেনা । মন এমনিতেই ভালো থাকে‘। এইচ  এম পুরো বিষয় অবগত। তিনি ওই স্যারকে শ্রদ্ধাও করেন। কিন্তু তার কিছু করার নেই। তাই তিনি মজার আশ্রয় নেন। বলেন, ‘এই তো স্যার আপনার সব ভালো, একটাই রোগ। আপনি এখনও পড়াতে চান’!

উদ্দেশ্য ভালো ,  ছাত্র-ছাত্রীর সার্বিক বিকাশ ঘটানো সেই মহৎ উদ্দেশ্যে। চলার পথটি ঠিক আছে তো? উদ্দেশ্য স্থির করা যেমন জরুরি, পথটি নির্বাচন করা সমান জরুরি । সে পথের সবকিছু মসৃণ করতে গিয়ে একটু বেশি মসৃণ হয়ে যাচ্ছে না তো? অভিভাবক, শিক্ষক ছাত্রছাত্রী সবাই  যদু মাস্টারের মত পা পিছলে আলুর দম হয়ে যাচ্ছে না তো?

সব শিক্ষাই কি বিদ্যালয় দিতে হবে? দিতে চাইলেও সেটা কি সম্ভব? নাকি বিদ্যালয়ে যুক্তি বোধ, চিন্তা করার ক্ষমতা, সাধারণ জ্ঞান, হিসাব-নিকাশের ক্ষমতা, আত্মসম্মান  বোধ  আর  একটি  সংবেদনশীল মন তৈরি করে দিলে আর সব শিক্ষা সে নিজেই নিয়ে নিতে পারে  ? পরিবার ও সমাজেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে নাকি? পরিবার গুলির একটা অংশ চা দোকানে আড্ডা দেবে, রাজা উজির মারবে। আর একটা অংশ সিরিয়াল দেখবে। তার সম্পূর্ণ ভার স্কুল কি নিতে পারবে? সমাজের অবস্থা কি? সমাজের অস্তিত্বই তো  রাজনীতিতে  বিলীন হয়ে গেছে। রাজনীতির কচকচি , পরস্পরের পিছনে লাগা ছাড়া আলোচ্য বিষয় হিসেবে আর কিছু স্থান পায় ? আদৌ কি আমরা শিক্ষা নিয়ে  চিন্তিত? আদৌ  কি  চাই  ছেলেমেয়েরা  লেখাপড়া  শিখুক? 

পূর্বে উল্লেখিত সেই দম্পতি তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন তোদের পাড়ায় এত মাইক বাজে কেন রে? ওরা বলেছিল আমাদের  পাড়ায় দুটো কেলাব। একটা তো মামা ( বাচ্চা গুলি মামা মামী বলে ডাকে সেই দম্পতিকে) তুমার নামে। পুলকে ভদ্রলোকের বুক ফুলে হাই প্রেসার কন্ডিশন।  সামাজিক কাজ করে এখনই তার নামে ক্লাব  হয়ে গেল!! কি এমন  করেছেন এই প্রশ্নকে পাত্তা না দিয়ে গদগদ  হয়ে  জিজ্ঞাসা করলেন কি নাম রে  ক্লাবের? বলল মামাটি মানুষ। মুহূর্তে  পতন, বুঝলেন শব্দ তিনি এখনো শেখাতে পারেননি। হতাশ হয়ে  জিজ্ঞাসা করলেন আরেকটার নাম কি? বলল  বেজরেঙ্গ ।  বুঝলেন ওটা বজরং। ছেলেটি আরো বলল দুটো কেলাবই মাঝে  মাঝে  আমাদের খাওয়ায় । তোরা কোনটাতে যাস? যেটা যখন খাওয়ায় সেটাতে। খাওয়া দুপুরে হোক বা সন্ধ্যায় অনিবার্য ভাবে এরা সারাটা দিন বই থেকে দূরে থাকে। শুধুমাত্র খাবারের বিনিময়ে অনুগামী তৈরি করার সুযোগ কেই বা ছাড়বে!!

Post a Comment

9 Comments

  1. 🙏🙏🙏🙏🙏🙏

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Soumen RoyAugust 27, 2024

      ধন্যবাদ 🙏

      Delete
  3. সমাজের ঔদাসীন্যে যখন সরকারি স্কুলে ঘন আঁধার নামছে তখন সৌমেন দুখিনী মায়ের মতো পিদিম জ্বেলে বসে আছেন কবে আলোর উদ্ভাসে সব ভেসে যাবে। ঠাকুরের কথায় সবাইকে এখন রসেবশে রাখার চেষ্টা চলছে। তাতে পড়াশোনার কথা কেন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. Soumen RoyAugust 27, 2024

      মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়।জানি লিখে হয়তো কিছু হবেনা। এ একধরনের আত্মসুখ। আপনারা অনেকেই পড়ছেন।তাতে যদি কিছু পাল্টায়।

      Delete
  4. সংবেদনশীল শিক্ষক তথা মানুষের কষ্ট পাওয়াটাই খুব
    স্বাভাবিক। স্কুলগুলোতে একটা সমবেত ভাবনা ও কর্মোদ্যোগের আশু প্রয়োজন। খণ্ড খণ্ড ভাবে ভাবলে স্থায়ী উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া সত্যিই মুশকিল।যে স্বপ্ন নিয়ে একসময় এই সব স্কুলগুলোর স্থাপনা হয়েছিল, সেই স্বপ্নগুলো উবে গেছে।

    ReplyDelete
  5. 🙏🙏🙏🙏🙏

    ReplyDelete