জ্বলদর্চি

আজহারউদ্দীন খান (নজরুল গবেষক, মেদিনীপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১২০
আজহারউদ্দীন খান (নজরুল গবেষক, মেদিনীপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

সেদিনটা ছিল ১৯৩৯ এর ১৬ ই ডিসেম্বর। মেদিনীপুর শহরে বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করবেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন মেদিনীপুরের জেলাশাসক ছিলেন বিনয়রঞ্জন সেন। তাঁর স্ত্রী চিরপ্রভা সেন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্রী। মূলত তাঁর উদ্যোগেই মেদিনীপুর শহরে এসেছিলেন কবিগুরু। আর আজহারউদ্দীন খান ছিলেন কলেজিয়েট স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। নেহাতই বাচ্চা। মাত্র নয় বছর বয়স। স। সেসময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শশধর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সব ছাত্রদের পঞ্চুরচক থেকে গোলকুঁয়াচক পর্যন্ত রাস্তার দুদিকে দাঁড় করিয়ে দেন। কবিগুরু যখন এই পথ দিয়ে যাবেন, তখন ঐ ছাত্রদের প্রতি নির্দেশ ছিল ফুলের পাপড়ি ছুঁড়ে দেওয়ার। নাবালক আজহারউদ্দীন খান সেদিন কবিগুরুকে লক্ষ্য করে ছুঁড়েছিলেন ফুল। কবিগুরু চলে যেতেই ফের ছুটলেন বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের দিকে। শিশুমনে তখন অন্যরকম উন্মাদনা। সেখানে আরও কাছ থেকে দেখলেন নোবেলজয়ী বিশ্বকবিকে। আর কবিগুরু দেখলেন ছাত্রদের সমবেত ব্যায়াম প্রদর্শণী। কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখার স্মৃতি আমৃত্যু ভুলতে পারেননি নজরুল গবেষক আজহারউদ্দীন খান। সেই ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে লিখেছিলেন 'মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ'। 
আজহারউদ্দীন খান সম্পাদিত 'শব্দের মিছিল' পত্রিকা

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল কলেজ পড়ুয়া থাকাকালীনই। নজরুল তাঁর কাছে বিপ্লবের প্রতীক। প্রতিবাদের মুখ। কাজী নজরুল ইসলাম আকৃষ্ট করেছিল এই 'তরুণ'কে। সেই আকর্ষণের বেড়াজাল ছিঁড়ে কখনও বেরিয়ে আসতে পারেননি মেদিনীপুরের প্রখ্যাত সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান। দুই বঙ্গের মানুষ এক ডাকে তাঁকে চেনেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন 'নজরুল গবেষক' হিসেবে। নজরুলের জীবনের নানা দিক উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁরই কলমে। 

কাজী নজরুল ইসলামের 'মায়ামুকুর' পড়তে পড়তেই নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৪৯ এর ২৮ শে জানুয়ারি কলকাতার মানিকতলার বাড়িতে অসুস্থ নির্বাক কবিকে দেখতে যান তিনি। সে এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা। সেদিন কোনও কথা হয়নি অবশ্য। বিমূঢ় এবং ভাববিহ্বল আজহারউদ্দীন খান সেদিন কাজী নজরুলের সান্নিধ্যে এসে মনের মধ্যে আরও বেশি করে তাগিদ অনুভব করলেন নজরুকে জানার ও চেনার। সেসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে অনেক বই ছিল, কিন্তু নজরুলকে নিয়ে ছিলনা। ১৯৫০ সালের ২৯ শে জানুয়ারি 'যুগান্তর' পত্রিকার রবিবার সাময়িকীতে তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে লেখেন অসুস্থ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেখা নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা 'কবি দর্শনে'। 
সম্পাদিত বই 'সারস্বত সাধনায় মেদিনীপুর'

কয়েক বছর পরেই ১৯৫৪ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ক্যালকাটা ক্লাব থেকে প্রথম বই প্রকাশিত হয় আজহারউদ্দিন খানের। বইটি ছিল 'বাংলা সাহিত্যে নজরুল'। যা কিনা আটটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় সেসময়। সেসময় সহায়তা পেয়েছিলেন নজরুলের জীবন ও সাধনার প্রত্যক্ষদর্শী পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এবং অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের। পাঠককুল চমকিত হয়ে ওঠে এক ২৪ বছরের লেখকের লেখনী দেখে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, নজরুলকে নিয়ে কাকাবাবু মুজফফর আহমেদের লেখা 'কাজী নজরুল প্রসঙ্গে' (১৯৫৯) এবং 'কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিকথা' (১৯৬৫) প্রকাশিত হয়। তার আগেই প্রকাশিত হয়েছে নজরুলকে নিয়ে আজহারউদ্দীন খানের বই। তাই বলা যায়, মেদিনীপুরের আজহারউদ্দীন খানই কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থের প্রথম স্রষ্টা। তিনি লিখেছেন প্রায় ১৬ টি বই। সম্পাদনা করেছেন আরও ১৪ টি সংকলন গ্রন্থের। প্রতিটি বইতেই খোঁজ মেলে এক যথার্থ গবেষক মনের আলাপন। অধ্যাপক প্রভাত মিশ্র লিখেছেন, "সত্যনিষ্ঠ গবেষণাধর্মী সাহিত্যের সাধক আজহারউদ্দীনের অলঙ্কারহীন সাবলীল ও একান্তভাবে অকৃত্রিম গদ্যশৈলী অনেককেই আকর্ষণ করে"। 
লিটল ম্যাগাজিন 'পুণ্যিপুকুর' এর রাবণ সংখ্যা নিয়ে আজহারউদ্দীন খান

বাবা ছিলেন নাসরুল্লাহ খান এবং মা কামরুননেসা বিবি। এক ভাই এক বোনের মধ্যে তিনিই বড়। মুসলিম পরিবারভুক্ত হয়েও শিক্ষার আলোর পথ থেকে নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি। বি এ থেকে বি লিব পাস করেছিলেন। আগ্রহ ছিল সাহিত্যচর্চায়। অচিরেই প্রেমে পড়েছিলেন বিদ্রোহী কবির। যে কবি ছিলেন তাঁর জীবনের অন্তরাত্মায়। তাঁর কলমের অন্যতম শক্তি। 

প্রাথমিক স্কুল শিক্ষার জন্য মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৬ এ ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর মেদিনীপুর কলেজ থেকে আই.এ. উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন বি.এ. পড়ার জন্য। তবে সাহিত্যের প্রতি প্রবল ঝোঁক এবং অনুরাগের জন্য তাঁর পড়াশোনা আর বেশিদূর এগোয়নি। সাহিত্য সেবাকেই বেছে নিয়েছিলেন নিজের জীবনের জন্য। 

পেশায় তিনি ছিলেন গ্রন্থাগারিক। সারা জীবন কাটিয়ে গেলেন বই নিয়েই। মেদিনীপুর জেলা গ্রন্থাগারে সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৫৭ সালে। পরবর্তীতে জেলা গ্রন্থাগারিক পদে উন্নীত হন। যদিও তার আগে প্রথম শিক্ষকতায় যুক্ত হন। মেদিনীপুর শহর থেকে অনেক দূরে চন্দ্রকোনার আঁধারনয়ন জুনিয়র হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে তা ছেড়ে দেন। গ্রন্থাগারে কাজ করতে করতেই সাহিত্য ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। 
'ময়নাগড়ের রাসমেলা' বই নিয়ে আজহারউদ্দীন খান

তিনি লিখেছেন, 'বাংলা সাহিত্যে নজরুল' (১৯৫৪), 'বঙ্কিম চন্দ্র : অন্য ভাবনায়', 'বিলুপ্ত হৃদয়' (শাহাদাত হোসেন, মীর মশাররফ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, আবদুল করিম, কায়কোবাদ, জসিমউদ্দিন, মোজাম্মেল হক, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, বন্দে আলি মিঞা, মোহাম্মদ নজিবর রহমানদের জীবন ও সাহিত্যকীর্তি), 'বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল'(১৯৬১), 'দীপ্ত অলোর বন্যা', 'অফুরন্ত রুদ্রের তিমির' (শাহাদাৎ হোসেনের জীবন ও কর্ম), 'মনের কোণের বাইরে' (শেখ গোলাম মকসুদ, হিলারি মহম্মদ, এনামুল হক, মুজফফর আহমেদ, সেলিনা জাহান, মহম্মদ মজিরউদ্দিন মিঞা, আবদুল হক চৌধুরী, হুমায়ুন কবির, কাজী আবদুল মান্নান, আহমদ শরীফ, সৈয়দ মোতায়ের হোসেন চৌধুরীদের জীবন ও সাহিত্য), 'বাংলা সাহিত্যে মহম্মদ শহীদুল্লাহ' (১৯৬৮), 'মাঘনিশীথের কোকিল' (আবদুল করিমের জীবন ও সাহিত্য), 'রক্তাক্ত প্রান্তর', 'বিষণ্ণ নায়ক' (মুনির চৌধুরীর জীবন ও সাহিত্য), 'বাংলা সাহিত্যে মহম্মদ আবদুল হাই' (১৯৭৬), 'মেধাবী নীলিমা'(মহম্মদ শহীদুল্লাহর সাহিত্য ও প্রতিভা), 'গ্যেটে ও বাংলা সাহিত্য', 'দীপ্ত আলোর বন্যা' (আবদুল করিম, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনির চৌধুরী এবং আবদুল হাইয়ের জীবন, শিল্প প্রতিভা ও সাহিত্য), 'মুহম্মদ শহীদুল্লাহ' (১৯৮১), 'রক্তে রাঙ্গানো দিন' ইত্যাদি। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত এই 'বাংলা সাহিত্যে মহম্মদ শহীদুল্লাহ' বইটির মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। 

তাঁর অনেকগুলি সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে 'নজরুলের নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ', 'মোহিতলালের পত্রগুচ্ছ'(১৯৬৯), 'সারস্বত সাধনায় মেদিনীপুর' (২০০১), 'অগ্নিবীণা', 'নজরুলের জন্মশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ', 'প্রত্যহ নবীন', 'অরূপরতন', 'বিদ্যাসাগর স্মারক গ্রন্থ' (১৯৭৪), 'বিক্ষণী' (১৯৫৮), 'শেকড়ের খোঁজে', 'একুশের চেতনা', 'মহৎ মহীয়ান', 'নিত্যকালের যাত্রী', 'শরৎবীক্ষা' (১৯৭৯), 'বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ শতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ' (১৯৭২) প্রণিধানযোগ্য। তাঁর প্রতিটি বই সংগ্রহে রাখার মতো। এগুলি বাংলা সাহিত্যের সজীব মণিমুক্তো, আকরগ্রন্থও বলা চলে। কী নিদারুণ পরিশ্রম ও অধ্যবসায় মিশে রয়েছে এইসব বইগুলিতে। তাঁর প্রাঞ্জল ভাষার অনুরণন পাঠককে ঋদ্ধ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান লিখেছেন, "সুখপাঠ্যতাই তাঁর (আজহারউদ্দীন খানের) রচনার গুণ। আধুনিক গবেষণায় তথ্যের নানা চুলচেরা বিচার থাকে, দৃষ্টিভঙ্গির বা মতবাদের পার্থক্য উপস্থাপনায় নানা জটিলতা ও অস্বচ্ছতা দেখা যায়, আজহারউদ্দীন সেদিক থেকে ব্যতিক্রমী গবেষক। কৃত্রিম বৈদগ্ধমন্যতার ভাঁড়ামো যেমন তাঁর মধ্যে নেই, তেমনি পাণ্ডিত্যাভিমানের অহঙ্কার প্রকাশ করতেও তাঁকে দেখিনা। মূল বিষয়টিকে উপলব্ধির চেষ্টা করেন এবং তার যথাযথ প্রকাশরূপটি আপাতত সহজ মনে হলেও এর ভিত্তিমূলে রয়েছে স্বচ্ছ ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা এবং যুগচিরন্তনতার প্রতি আস্থা"। 

১৯৫৩ সালে অমর ষড়ঙ্গী, সত্যেন ষড়ঙ্গী এবং প্রভাকর মাজীদের সঙ্গে সম্পাদনা শুরু করেন 'পিয়াসী' সাহিত্য পত্রিকা। যা ছিল মেদিনীপুরের প্রথম সত্যিকারের লিটল ম্যাগাজিন। অনেকেই এটিকে 'সবুজপত্র'র সাথে তুলনা করে। ১৯৮৩ থেকে আমৃত্যু ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের মেদিনীপুর শাখার সভাপতি। তাঁরই হাত ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হত 'শব্দের মিছিল' পত্রিকা। যা আজও প্রকাশিত হয়। ঘাটালের 'সৃজন প্রকাশনী' (সম্পাদক -- অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকার) থেকে অশোক পালের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে 'সাহিত্যসাধক আজহারউদ্দীন খান' বইটি। 'গ্রন্থ' নিয়েই তাঁর জীবনের নানা ওঠাপড়া। এ পর্যন্ত ৩৩ টি গ্রন্থের মুখবন্ধ তথা ভূমিকা লিখে দিয়েছেন তিনি। 

চলার পথের যাবতীয় ঝড়ঝঞ্ঝা তিনি ঠেলে দিতে পেরেছেন মানুষকে আপন করার ক্ষমতার জোরে। তাই জীবনের কোনো ওঠাপড়াই সহজে গায়ে লাগতে দেননি এই মানুষটি। মৃত্যুর পরেও এই 'খান' আজও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে পেরেছেন তাঁর লেখনীর গুণে। আজও তাই কলমের তীক্ষ্ণ মুখে খান খান করে দিতে সমানভাবে বলীয়ান তাঁর প্রতিটি রচনা। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৩ সালে আজহারউদ্দিন খানকে দেয় 'মুহম্মদ আব্দুল হাই সাহিত্য পুরস্কার'। এই নজরুল গবেষককে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৩ সালে দিয়েছে 'নজরুল পুরস্কার'। ২০০৭ এ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই মহান গবেষক পেয়েছেন সাম্মানিক 'ডিলিট'। 

মেদিনীপুর শহরের মীরবাজারে ১৯৩০ এর ১ লা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এই কৃতি মানুষটি। অবশ্য তাঁর জীবনের একটা সময়ে বয়ে গেছে ভয়ানক ঝড়। স্বজন হারানোর বেদনা তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে আমৃত্যু। পথ দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন ছোট বৌমা ও আদরের নাতনিকে। তবুও তিনি প্রকাশ্যে দুমড়ে মুচড়ে যাননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ করে গিয়েছেন। ২০২১ এর ২২ শে জুন তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু আজও তিনি বেঁচে আছেন সকলের হৃদয়ে। সকলের মনে।

🍂

Post a Comment

0 Comments