জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে / ৪৮তম পর্ব / দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে  
৪৮তম পর্ব   
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী 

উপসংহার               

সাধারণ মানুষের মনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দুই রূপ। মহাভারতের যুদ্ধকুশলী অর্জুনসখা কৃষ্ণ। দক্ষ রাজনীতিবিদ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিধর, কূট যুদ্ধে পারদর্শী, মেধাবী, যুক্তিবাদী শ্রীকৃষ্ণ। পার্থসারথি কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করতে উৎসাহ দিয়েছেন, যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছেন। বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে অর্জুনকে মোহাবিষ্ট করেছেন। মহাভারতের এই কৃষ্ণ গীতার প্রবক্তা। গীতার বাণী শুধু ভারতবর্ষে নয়, বিশ্বের তাবড় যুক্তিবাদী মানুষকেও আবিষ্ট করে, ঘুরে দাঁড়ানোর পাঠ দেয়। আমাদের দেশের অগ্নিযুগের তরুণ বিপ্লবীরাও গীতা থেকে মানসিক শক্তি অর্জন করেছেন। যে কোন মননশীল মানুষের কাছে গীতা সম্ভবত অবশ্যপাঠ্য।              

আবার আরেকদিকে শ্রীকৃষ্ণ হলেন যশোদাদুলাল বালগোপাল ননীচোরা কৃষ্ণ। বৃন্দাবনে শ্রীরাধার সাহচর্যে শ্রীকৃষ্ণের লীলা। ভারতের প্রায় সর্বত্র রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি প্রেমের পূজা পায়। যুগলপ্রেমের নয়ন ভোলানো রূপে সকলেই মুগ্ধ। দেবত্বের মহিমায় মানবিক রূপ। প্রেম রসে সিক্ত হয় মন। কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ নন সাধারণ মানুষের হৃদয়ে কিন্তু শ্রীরাধিকার বাহুলগ্ন শ্রীকৃষ্ণেরই অধিষ্ঠান। কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ অন্তরে শক্তি যোগান, জীবন যুদ্ধে পথ চলার দিশা দেখান, আর বৃন্দাবনের কৃষ্ণকে ঘিরে অন্তরে ভক্তি রসের প্লাবন বয়ে যায়, মন পুষ্ট হয়, তৃপ্ত হয়। বাংলার গানে-সংকীর্তনে রাধাকৃষ্ণ অমর। দু'চোখ প্লাবিত হয়ে ওঠে কৃষ্ণ নামে, মন পরিশুদ্ধ হয়, অন্তরে আসে প্রশান্তি। ধর্ম অনুরাগী সকল মানুষের পরম সুহৃদ শ্রীকৃষ্ণ। তিনি প্রকৃতই সখা-কৃষ্ণ। জীবন পথিককে সৎ পথে, ধর্ম পথে চলতে সাহায্য করেন।                                    
🍂

আজ পৃথিবীর অনেক দেশই আস্তিনের নীচে পরমাণু অস্ত্র সাজিয়ে রেখেছে। একবার যুদ্ধ শুরু হলে যেকোনো মুহূর্তে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। মুখে শান্তির বারতা কিন্তু প্রতিবছর অস্ত্র খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে। সব দেশই অস্ত্র বানায় কিংবা অস্ত্র কেনে, আর দেশে দেশে লাঞ্ছিত হয় মানবতা। মানুষই মানুষকে পীড়ন করে, মানুষই মানুষকে মারে, খুন করে। আধুনিক পৃথিবীতে নিত্য খুন, নিত্য সন্ত্রাস। এই সময়ে একজন শ্রীকৃষ্ণের বড় প্রয়োজন। শ্রীকৃষ্ণ থাকলে এখন কি করতেন? শ্রীকৃষ্ণ অন্যায়ের প্রতিকার চেয়েছেন কিন্তু প্রথমেই যুদ্ধ চাননি। সত্য, ন্যায় ও ধর্মের প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। এজন্য যদি চূড়ান্ত যুদ্ধেরও প্রয়োজন হয় মেনে নিয়েছেন এবং যুদ্ধে সত্য ও ধর্মের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। যুদ্ধে জয় চেয়েছেন কৃষ্ণ কেননা তিনি সত্য ও ধর্মের জয় চেয়েছিলেন ক্ষমতা ভোগ কিংবা যশ ও খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা তাঁর কোনদিনই ছিল না। তিনি নিষ্পৃহ, কিন্তু কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানির দৃশ্য তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন, তাই যুদ্ধ চাননি। পরম দয়াময় শ্রীকৃষ্ণের জীবনের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।                                 
শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে অনেক লেখকই কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য শ্রীকৃষ্ণকে দায়ী করেছেন। তাদের বক্তব্য শ্রীকৃষ্ণই এই যুদ্ধের কলকাঠি নেড়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন বলেই যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'কৃষ্ণ চরিত্র' নিবন্ধে নানা উদ্ধৃতি উল্লেখ করে দেখিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ বরাবরই যুদ্ধ এবং হিংসার বিরুদ্ধে। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কাছে জানতে চেয়েছিলেন সত্য না অহিংসা কার স্থান উপরে। শ্রীকৃষ্ণ নির্দ্ধিধায় বলেছিলেন সত্যের ঊর্ধ্বে অহিংসা। প্রাণরক্ষার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া অধর্ম নয়, কিন্তু কোনোভাবেই জীবহত্যা বা প্রাণীহত্যা করা উচিত নয় এবং হিংসাকেও প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। তবে শ্রীকৃষ্ণ আরেকটি কথা বলেছেন 'সবার উপরে হলো ধর্ম। এই ধর্ম রক্ষার জন্য প্রয়োজনে অস্ত্রধারণেও আপত্তি নেই'। গীতার শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করার জন্য উদ্দীপ্ত করেছেন। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় সাংখ্যযোগ পড়ে কেউ কেউ শ্রীকৃষ্ণকে যুদ্ধবাজ বলে মনে করেন। কিন্তু এই মূল্যায়ন ঠিক নয়। দুষ্টের দমনে শ্রীকৃষ্ণ কঠিন হৃদয়। অন্যায় অত্যাচার মেনে নেওয়াতো কাপুরুষতা। তাঁর বিশ্লেষণে শ্রীকৃষ্ণ যথার্থ ধার্মিক ও মানবতার পূজারী।                                

শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর লিখিত 'কৃষ্ণ চরিত্র' গ্রন্থের উপসংহারে আরও বলেছেন "কৃষ্ণ সর্বত্র সর্বসময়ে সর্বগুণের অভিব্যক্তিতে উজ্জ্বল। তিনি অপরাজেয়, অপরাজিত, বিশুদ্ধ, পূণ্যময়, প্রীতিময়, দয়াময়, অনুষ্ঠেয় কর্মে অপরাঙ্মুখ - ধর্মাত্মা, বেদজ্ঞ, নীতিজ্ঞ, ধর্মজ্ঞ, লোকহিতৈষী, ন্যায়নিষ্ঠ, ক্ষমাশীল, নিরপেক্ষ, নির্মম, নিরহঙ্কার, যোগযুক্ত, তপস্বী। তিনি মানুষী শক্তির দ্বারা অতিমানুষ চরিত্রের বিকাশ হইতে তাঁহার মনুষ্যত্ব বা ঈশ্বরত্ব অনুমিত করা বিধেয় কি না, তাহা পাঠক আপন বুদ্ধিবিবেচনা অনুসারে স্থির করিবেন। যিনি মীমাংসা করিবেন যে কৃষ্ণ মনুষ্যমাত্র ছিলেন, তিনি অন্তত Rhys Davids শাক্যসিংহ সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, কৃষ্ণকে তাহাই বলিবেন, ' The wisest and greatest of the Hindus'। আর যিনি বুঝিবেন যে এই কৃষ্ণচরিত্রে ঈশ্বরের প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়, তিনি যুক্তকরে বিনীতভাবে এই গ্রন্থ সমাপনকালে আমার সাথে বলুন: নাকারণাৎ কারণাদ্বা কারণাকারণান্ন চ। শরীরগ্রহণং বাপি ধর্মত্রাণায় তে পরম্।"                    

সর্বগুণের অধিকারী শ্রীকৃষ্ণ ইতিহাসের অন্যতম এক উজ্জ্বল চরিত্র। একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রচারের জন্যই এই পৃথিবীতে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মনুষ্যশরীর অবলম্বন করেই সারা জীবন ধরে অজস্র মানবিক কাজ সম্পাদন করেছেন, দেবত্বে উন্নীত হয়েছেন।                                              

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ‘‘অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে। তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।’’ অর্থাৎ যে ভক্তগণ অনন্যচিত্তে আমাকে সর্বদা নিষ্কামভাবে ভজনা করেন সেই নিত্য-সমাহিত মুমুক্ষুগণের যোগক্ষেম আমি স্বয়ং বহন করি।      
                              
                             সমাপ্ত।

Post a Comment

0 Comments