জ্বলদর্চি

বাংলদেশ ভ্রমণ/পর্ব ৯/রোশেনারা খান

শিলাইদহের কুঠিবাড়ির মিউজিয়ামে।

বাংলদেশ ভ্রমণ
পর্ব ৯

রোশেনারা খান


এবার আমরা শিলাইদহর উদ্দেশ্যে যাত্রা সুরু করলাম। পথ অনেকখানি দুপাশে সবুজ শস্যক্ষেত, আম-কাঁঠালের গাছ, ক্ষেতের আলে পেঁপে গাছের সারি, ঘরবাড়ি, জলাশয় দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহে।  কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার অন্তর্গত এই শিলাইদহ একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।এই গ্রামটির পূর্বের নাম ছিল খোরশেদপুর। টোটো আমাদের নিয়ে এসে হাজির করল রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির সামনে।মস্ত গেটের ফাঁক দিয়ে দূরে কুঠিবাড়িটি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখনি ভিতরে প্রবেশ করা যাবে না।কারণ টিকিট লাগবে, এদিকে টিকিট কাউন্টার এখনো খোলেনি। ১০টার আগে খুলবে না। ১০টা বাজতে এখনো মিনিট ১৫ বাকি আছে। অগত্যা আমরা গেটের দুপাশে যে স্টলগুলি রয়েছে, সদলবলে সেখানেই হানা দিলাম।সব জায়গাতেই সবাই কিছু না কিছু শপিং করলেও গৌতম বাবুকে কিছু কিনতে দেখিনি। ওনার স্ত্রীর জন্য একখানা শাড়ি নিলাম ওনাকে পছন্দ করিয়ে। অনেকেই অনেককিছু কেনায় ব্যস্ত। সবাই ভিতরে যাবেন না শুনে আমরা কয়েকজন কাউন্টারে লাইন  দিয়ে টিকিট কাটলাম। আমাদের জন্য, মানে বিদেশীদের জন্য প্রতিটি টিকিট ২০০/= টাকা। দেশের মানুষের জন্য টিকিটের দাম কম।  কত কম, সেটা জানা হয়নি। কারণ এই পার্থক্যটা পরে জেনেছি।

🍂

     গেটে টিকিট দেখে বলা হল কুঠিবাড়ির ভিতরে আর একবার টিকিট দেখাতে হবে। টিকিট হাতে এগিয়ে গেলাম।ভিতরে প্রাচির ঘেরা এরিয়ার পরিমাপ ১১ একর। কুঠিবাড়ি ছাড়াও এই ১১ একরের মধ্যে রয়েছে পুকুর ও বাগান।  বামদিকে দেখতে পাচ্ছি ‘রবীন্দ্র মঞ্চ’, মঞ্চের ছাদের ওপর দিয়ে গাছেদের মাথা উঁকি দিচ্ছে। বামদিকে সামনে তাকিয়ে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পরলাম। আমার থেকে কিছুটা দূরে বিবর্ণ কুঠিবাড়িটি ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুলের গাছ।এখানকার  মাটিতে মিশে আছে বিশ্ব কবির চরণধূলি। মন্ত্রমুগ্ধের মত কম্পিত পায়ে এগিয়ে গেলাম কুঠিবাড়ির দিকে।ভিতরে প্রবেশ করে আবার টিকিট দেখালাম। নীচতলায় রয়েছে রবীন্দ্রনাথের নানা সময়ের ছবি। সন্তানদের সঙ্গে পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে যেমন ছবি রয়েছে, তেমন কিছু ছবির মধ্যে বিশেষ বিশেষ মানুষের সঙ্গে বিশেষ মুহূর্তগুলিও ধরা আছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রমথ  চৌধুরী ও আরও অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আশ্চর্য হলাম মটির তৈরি কালো রঙের ওয়াটার ফিল্টার দেখে। ওপর নীচ ঘুরে ঘুরে দেখছি আর ভাবছি এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবপরিবারে  বসবাস করতেন। চোখের সামনে রয়েছে তাঁর খাট, ডাইনিং টেবিল, টি-টেবল, চেয়ার, সোফা আরও কত কি। দোতলার বারান্দায় রাখা আছে দুটি আস্ত  বোট, রবীন্দ্রনাথ এই দুটিতে চড়ে পদ্মার বুকে নৌকোবিহার করতেন।তাঁর  ব্যবহৃত বজরার একটি সুন্দর মডেলও রাখা আছে।

   রবীন্দ্রনাথ প্রথম এই কুঠিবাড়িতে এসে ছিলেন জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে।  পরবর্তী সময়ে ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখানে আসেন বাবার নির্দেশে জমিদারী দেখাশোনা করার জন্য। কুঠিবাড়ির দুইদিকে দুই নদী পদ্মা ও গরাই, এখানকার শস্য-শ্যামল প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। সে ভাবে দেখলে শতস্ফূর্তভাবে তাঁর প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল এই শিলাইদহেই।পদ্মার বুকে তিনি একা নৌকো বিহার করতেন না।তাঁর ধ্যানে-জ্ঞানে-মনে তাঁর সর্বক্ষণের সাথী ছিল ‘কবিতা’।এই কবিতাকে নিয়ে তিনি মগ্ন থাকতেন সারা সারা দিন, এমন কী রাত ও কেটে গেছে।এখানেই তিনি রচনা করেছিলেন সোনার তরী, চৈতালি, চিত্রা, এমনকি গীতাঞ্জলীও তিনি এখানে লিখেছিলেন বা গীতাঞ্জলীর কিছু অংশ লিখেছিলেন।   

     ভাবনা থেকে আবার বাস্তবে ফিরে আসি পালকি দেখে। যা এই কুঠিবাড়ির মিউজিয়ামে সযত্নে রাখা আছে। কুঠিবাড়ি থেকে পদ্মা বেশ কিছুটা দূরে। কবি এই পাল্কিতে চড়ে নদীঘাট যাতায়াত করতেন। এখানে প্রতিটি দেওয়ালে অসংখ্য ছবি রয়েছে।কবির কিশোর বেলার সাথী, প্রেমিকা, তাঁর গুণমুগ্ধ শ্রোতা কাদম্বরী দেবীর ছবি। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বালিকাবধূ মৃণালিনী দেবীর ছবি। একফ্রেমে রয়েছে কবির ছোট থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত নানা বয়সের ছবি। এছাড়াও রয়েছে ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে লেখা তাঁর চিঠির বাঁধানো ছবি, তাঁর লেখা গানের স্বরলিপির ছবি। রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের একটি ছবির নিচে লেখা রয়েছে, ‘একজন রাজপুত্র জন্মে ছিলেন এখানে। আমরা কেউ তাঁকে দেখিনি। শুনেছি তাঁর গায়ের রঙে ছিল কনকচাঁপার আভা। আর সে কি চেহারা! ছফুটেরও বেশি দীর্ঘ শরীর।হাতের কব্জি  যেন পাঠানের।গায়ে আংরাখা, শুভ্র দাড়ি যেন তাপসের, ললাট কি দিব্য জ্যোতিষ্মান’।

    সময় তাড়া করছে, কুঠিবাড়ি থেকে বেরোনোর সময় কেয়ারটেকার কিছু লিখতে বললে, অল্প কথায় আমার অনুভবের কথা লিখে বেরিয়ে এলাম। কুঠিবাড়ির ডান দিকের বাঁধানো রাস্তা ধরে একটি গেট পার হয়ে পুকুরের  শানবাঁধানো ঘাটে এসে দাঁড়ালাম।ডান দিকে পুকুরের পাড়ে কয়েকজন বাউল আস্তানা গেড়েছে। একজন বললেন রবি ঠাকুর এখানে বসেই লিখেছিলেন, ‘যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিনহ এই বাটে......’ গানখানি। আবারও একবর রোমাঞ্চিত  হলাম এই ভেবে, এখন যে ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি সে ঘাট কবি ব্যবহার করতেন কত বার তাঁর পদচিহ্ন আঁকা হয়েছে এই ঘাটের সিঁড়িতে। আমার সৌভাগ্য আমি এই সমস্ত কিছু দেখার, স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছি। পুকুরের চারপাশে নারকেল ও অন্যান্য গাছ রয়েছে। আর দেরি করা যাবে না। বেরিয়ে পড়লাম। মন ভরেনি, আরও কিছুটা সময় পাওয়া গেলে ভাল হত। পুকুরপাড়ের বাউলরা গান শোনাতে চাইছিলেন, সেটাও শোনা হলনা।

    বেরিয়ে এসে দেখলাম, সরস্বতীদি, মায়াদি অঙ্কনা অনেককিছু শপিং করেছেন। এদিকে আমাদের টোটো  চিনতে পারছি না।কারণ ড্রাইভার নেই। জানিনা কোথায় ছিল, কিছুক্ষণ পর দুজনে  উদয় হলে আমরা কুষ্টিয়া রওনা হলাম। এখান থেকে কুষ্টিয়ার দূরত্ব সাত কিলোমিটার হবে। কুষ্টিয়া পৌঁছেই আমরা আকটুখানি রেস্ট নিয়ে আবার সেই টোটোতে চড়লাম। এখান থেকেই শুরু হল ভুলভাল জার্নি। পিছনের টোটো অনেক পিছনে থেকে গেল।আবার আমরা ব্যাক করে ওদের অনুসরণ করে ঠা ঠা রোদ্দুরে ভরা দুপুরের সময় যে রেল স্টেশনে পৌঁছালাম, তার নাম ‘ভেড়ামারা’। ঘোড়ামারা, গরুমারা শুনেছি, এখানে এসে ভেড়ামারা শুনলাম।

    এখানেই খাওয়া সারলাম। কারণ ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে শুনি ট্রেন ২ ঘণ্টা লেট। কি আর করা যাবে? অপেক্ষা করলাম। ট্রেন এসে পৌঁছালে, ভিড়ের মধ্যে চড়তে বেশ কষ্ট হলেও পরের স্টেশনে অনেকটা খালি হয়ে গেল। পরে জানলাম সাহদাতদা ও সেরিনা ভিড়ের কারণে ট্রেনে চড়তে পারেননি, ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আমরা স্টেশন থেকে ভ্যান রিক্সায় করে যখন গেদে বর্ডারের উদ্দেশ্যে চলেছি। তখন  রক্তরাঙ্গা সূর্য পাটে বসেছে। রাস্তার দুপাশে ধান ক্ষেত, তিল ক্ষেত। পাকা ধানের গন্ধ ভেসে আসছে। সাকিল চেনাল, কোন অংশটা বাংলাদেশ আর কোনখান থেকে ভারতভূমি শুরু হচ্ছে। গেদে লোকাল স্টেশনেই  দাঁড়িয়ে ছিল। সিকিউরিটি চেকিংয়ের পর আমরা ট্রেনে উঠলাম। ফ্লাইটে যাতায়াত করলে কষ্ট কম হত ঠিকই, কিন্তু সাকিলের সঙ্গে না গেলে কক্সবাজার থেকে ঢাকা হয়েই ফিরতে হত। এত জায়গা দেখা সম্ভভ হত না। ঢাকার অনেক বন্ধু তাদের বাড়িতে ওঠার জন্য বলেছিলেন।তাঁদের বলেছি ওটা পরের বারের জন্য রইল।  বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা ও ব্যবহার, ভোলার নয়। বিশেষ করে হুমায়ুন কবির, পারভেজ চৌধুরী,বরিশালের SP সাহেব, আমিনা রহমান লিপি, কক্সবাজারের কামরুল হাসান, হুমায়ুন সিদ্দিকী, পারভেজ চৌধুরী ও আরও   অনেকের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এই অল্প কয়েকদিনেই  আমরা বাঙ্গালিরা একই সুরে ছন্দে গাঁথা পড়েছি এই ভ্রমণের জন্য সাকিল ও গৌতম বাবুকে ধন্যবাদ জানাই। একবর নয়, আমি বারবার যেতে চাই বাংলাদেশ।

                               সমাপ্ত

Post a Comment

0 Comments