জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ২৭/স্বপন কুমার দে

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ২৭


স্বপন কুমার দে

মল্লিকার পাড়ার সকলে জানল, মল্লিকা এবার অনেক বড় ডিগ্রি পেল, অনেক বড় শিক্ষিতা হল। মল্লিকার টিউশন বাড়ির লোক বুঝল অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী তাদের বাড়ির গৃহশিক্ষিকা। একে হাতছাড়া করা চলবে না।

মল্লিকার মনখারাপ হয় তার বাবার জন্য,তার মায়ের জন্য। আজ যদি তারা বেঁচে থাকত তাহলে কত ভালো হত, আনন্দ হত, নিজের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মত আপনজন থাকত। খুব একা লাগে, খুব আনন্দের সময় এবং খুব দুঃখের সময়। এই সময়ে কেউ পাশে থাকলে ভালো হয়। অন্য সময় এতটা একা লাগে না। নিমাইকাকুর সঙ্গে তো সব সুখ দুঃখ ভাগ করা যায় না। আবার প্রতিবেশি বা অন্য কারও সঙ্গে এগুলো ঠিক মত শেয়ার করা যায় না।

মনের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি জাগে। কখনও সাফল্যের একটা তৃপ্তি মনকে দুলিয়ে দেয়, দীর্ঘ যন্ত্রণার মাঝে কিছু একটা প্রাপ্তির আনন্দ মনে নতুন স্বপ্নের জাল বোনে। কখনও আবার সেই রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ কালো মেঘে ঢাকা পড়ে। মনে হয়, কী এমন প্রাপ্তি ঘটেছে ,তার জন্য এত হৈ চৈ। কাঙ্খিত সাফল্য এখনও ধরা দেয়নি," আই অ্যাম ফার অ্যাওয়ে ফ্রম মাই ডেস্টিনেশন্।" আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তার মাঝখানে আনন্দ নেই, আয়েশ নেই, বিশ্রাম নেই। " চলো এবং আরও চলো, " নিজেকেই নিজে তাড়া দেয়।

পরদিন মন্টিকে পড়াতে গিয়ে মল্লিকাকে নানারকম সুস্বাদু খাবার খেতে হল। নিজের প্রশংসা শুনতে শুনতে মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। পড়ানোর মাঝেও মন্টির দাদু, মা মল্লিকার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন বৃদ্ধ অমরেশবাবু। মন্টির জানাল যে, সে আজ গর্বভরে সবাইকে বলে দিয়েছে তার অংক ম্যাম একজন বিরাট মেধাবিনী।
" থাক্ থাক্, তোমাকে আর পাকামো করতে হবে না।"
মল্লিকা হেসে ফেলল মন্টির কথা শুনে। এই মল্লিকাকে নিয়ে কত বিদ্রূপ করেছে মন্টির সহপাঠীরা এবং তাদের বাবা মায়েরা। মল্লিকা বস্তির মেয়ে, তার কালচার, স্টেটাস সবই নিম্নমানের ইত্যাদি। মল্লিকা এসব কথা শুনেছে মন্টির মুখ থেকে।
অনেকদিন পর বাড়ি ফিরেছেন মণিদীপা, এতক্ষণ ঠাকুরঘরে ছিলেন, এখন নীচে নেমেছেন। সোজা ঢুকলেন নাতনির পড়ার ঘরে। শিক্ষিকাকে অভিনন্দন জানালেন, খোঁজ নিলেন স্বাস্থ্যের। জানতে চাইলেন, পি এইচ ডি করতে করতে নাতনিকে পড়াতে পারবে কিনা।
" আমি আগে যেমন পড়াচ্ছিলাম, পরেও পড়াব। আপনাদের কোনও চিন্তা নেই।"
" তোমার ছাত্রী তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছে,' আমার মিস দারুণ ট্যালেন্টেড।' সবাইকে তোমার কথা বলছে।"
" হ্যাঁ তাই তো দেখছি। মেয়ে খুব পাকা হয়ে গেছে। মন্টি, তোমাকেও অনেক বড় হতে হবে। সামান্য প্রশংসায় গলে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে সামনের পাহাড়টাকে ডিঙোতে হবে। অর্ধেক উঠে হাঁপিয়ে গেলে চলবে না। অর্ধেক কাজের দাম কেউ দেবে না। পরিশ্রম করতে হবে, আরও আরও।"
শুধু মন্টি একা নয়, তার সাথে মন্টির মা, ঠাকুমাও মন দিয়ে শুনছিল মল্লিকার কথা।

🍂

পনের দিন পরে মল্লিকা ইউনিভার্সিটি গিয়ে দেখল, লিস্টে তার নাম নেই। তাদের ব্যাচ থেকে যে পাঁচজনকে এ বছর পি এইচ ডি'র সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেই লিস্টে মল্লিকার নাম নেই। এতে  শুধুমাত্র অবাক হয়ে গেল বললে কম বলা হবে, একসঙ্গে ভয়, হতাশা, ক্ষোভ, দুঃখ তাকে বিহ্বল করে দিল। প্রথমে অফিসে জানতে চাইল। অফিস জানাল," যা করার ডিপার্টমেন্ট করেছে। আমাদের কাছে যে সমস্ত অ্যাপ্লিকেশন জমা হয়েছিল সেসব ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।"
ওখান থেকে মল্লিকা ছুটল ডিপার্টমেন্টে। সেখানে গিয়ে জানতে পারল, দোষটা নাকি মল্লিকার। ফর্মের সঙ্গে যেসব ডকুমেন্টস্ চাওয়া হয়েছিল সেগুলো সব দেয়নি। তাই স্ক্রিনিংয়ের সময় অ্যাপ্লিকেশনটি রিজেক্ট হয়ে গেছে।

মল্লিকা বিধ্বস্ত শরীরটাকে নিয়ে ডিপার্টমেন্টের বাইরে রাখা বেঞ্চে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তার মনে আছে সব ডকুমেন্টস্ মিলিয়ে সাজিয়ে স্টিচ করে আবার একবার দেখে কোন্ কোন্ ডকুমেন্টস্ দেওয়া হয়েছে তার বিবরণ দিয়ে ফর্ম জমা দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও কোন্ অজ্ঞাত কারণে এমন অঘটন ঘটল। এবার সে কী করবে? তার এতদিনের স্বপ্ন এভাবে ভেঙে যাবে? করার কি কিছুই নেই? এইচ ও ডি-র কাছে অনুরোধ করবে যদি তাকে সুযোগ দেওয়া হয়। তাই-ই করল, এইচ ও ডি'র কাছে গেল কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, তাঁর করার কিছু নেই।

শরীর টলছিল, মাথা ঘুরছিল, মুহূর্তেই শরীরের সব শক্তি উধাও হয়ে গেছে যেন। একটা গাছের তলায় বাঁধানো চাতালে বসে পড়ল। শরীর, মন অবশ করে দেওয়া একটা প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, হেরে যাবে সে? নাহলে কোথায় যাবে? কে তাকে ভরসা দেবে? চিন্তা করতে থাকে সে।

মনে পড়ল, কলেজের এইচ ও ডি ডঃ বি এন সিংহের কথা। তিনি একসময় বলেছিলেন, যদি কখনও দরকার হয়, তাহলে মল্লিকা যেন তাঁর কাছে যেতে দ্বিধাবোধ না করে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে স্যার কি কিছু করতে পারবেন? হয়তো বলবেন, তারও করার কিছু নেই। তখন? তখন কী হবে? তবুও একবার যাওয়া দরকার। দেখি না ,কী হয়।

পড়ন্ত বিকেল। তখনও সন্ধ্যা নামেনি। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ওপরের ব্যালকনি থেকে প্রফেসর সিংহের স্ত্রী দেখলেন, একটি মেয়ে বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওপর থেকে জিজ্ঞেস করলেন," কাকে চাই?"
" স্যার আছেন?"
" হ্যাঁ আছেন।"
" আমি ওনার ছাত্রী। একবার ওনার সাথে দেখা করতে চাই।"
" কী নাম বলবো।"
" চন্দ্রমল্লিকা সামন্ত "
ভেতরে গিয়ে গিন্নি বললেন ," শুনছো, কে একটি মেয়ে, নাম চন্দ্রমল্লিকা, তোমাকে ডাকছে।"
" হ্যাঁ বলো কী? চন্দ্রমল্লিকা? ওকে ভেতরে আসতে বলো। ওঃ দাঁড়াও, আমিই দরজাটা খুলে দিই।" বলে তিনি নীচে নেমে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মল্লিকাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে বললেন," তোমাকে এই মেয়েটির কথাই আগে বলেছিলাম। খুব ভালো মেয়ে।যেমন পড়াশোনায় , তেমনই আচরণে। ম্যাথে মাস্টার্স করছে।" তারপর মল্লিকাকে বললেন," তোকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। ওখানে বাথরুম আছে, হাত মুখ ধুয়ে আয়। তারপর টিফিন করতে করতে তোর কথা শুনবো।"

সোফাটায় বসে মল্লিকা বলল," স্যার, আমি কিছু খাবো না। আজ আমি খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি, আপনি যদি কিছু করতে পারেন।"
প্রফেসর সিংহ অবাক, মিসেস সিংহ কৌতূহলী, তথাপি বললেন," মল্লিকা, আমি একটু চা করে নিয়ে আসছি। তারপর তুমি নাহয় তুমি তোমার স্যারকে বলো।"
" না কাকিমা, এখন কিছু খাবো না। আপনিও বসুন।" তারপর একে একে সব ঘটনা বলে গেল।
ডঃ সিংহ এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। এবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন," তোর সমস্ত ডকুমেন্টস্ তোর কাছে আছে?"
" হ্যাঁ স্যার, আমার অ্যাকাডেমিক ফাইলটা সঙ্গেই আছে। ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে গেছলাম।"
তুই ওগুলোর ছবি তুলে আমাকে ফরওয়ার্ড কর্।আমি ততক্ষণ আমার এক বন্ধুকে ফোন করছি।" বলেই মোবাইলটা তুলে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। এদিকে মল্লিকা তার সমস্ত কাগজপত্রের ফটো তুলে স্যারের হোয়াটস্ অ্যাপে সেন্ট করলো।

দশ মিনিটের মধ্যে স্যার পাশের ঘর থেকে ফিরে এলেন, " একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। কলকাতায় আমার বন্ধু ডঃ ডি কে বরাটকে তোর কথা বলছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে তোর ডকুমেন্টস্ গুলো পাঠিয়ে দিয়েছি। তোর রেজাল্ট দেখে আশা করি ও না করতে পারবে না। প্রতি বছর ওর কাছ থেকে বহু ছাত্রছাত্রী পি এইচ ডি করে।"
" তা উনি কী বললেন, তাই বলো। মেয়েটা কখন থেকে মুখ শুকনো করে বসে আছে।" মিসেস সিংহ বেশ জোরের সঙ্গে কথাগুলো বললেন।
" ডঃ বরাট বললেন, দু'দিন পরে বলবেন। ওঁর ওখানে না হলেও অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। তবে বরাট হলে ভালো হয়। আমার বন্ধু তো, তাছাড়া ওইরকম টিচার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।"
" তাহলে খুব ভালোই হয়।" স্যারের স্ত্রী বললেন। " মল্লিকা, এখন টেনশন ফ্রি হলে তো। এবার কিছু খাওয়া দাওয়া হোক।"
" না কাকিমা, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমারই বরং ভুল হয়ে গেছে।" বলেই স্যার ও কাকিমাকে প্রণাম করল মল্লিকা।

একটু পরেই মুড়ি, শশা, পেঁয়াজ, চানাচুর মাখিয়ে তিনটে জায়গায় নিয়ে এলেন কাকিমা। তারপর খেতে খেতে গল্প করতে লাগলেন। একে একে মল্লিকার ঘরের কথা, তার পড়াশোনার কথা শুনতে লাগলেন। তারপর চা খেয়ে ওখান থেকে বেরোতে বেরোতে রাত আটটা বেজে গেল। যাবার আগে স্যার বললেন," তুই চিন্তা করিস না। ডঃ বরাট জানালেই আমি তোকে ফোন করবো।"

বাড়িতে গিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা সরিয়ে রেখে মল্লিকা রাতে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন বিকেল বেলায় স্যারের ফোন এল। মল্লিকা ডঃ বরাটের তত্ত্বাবধানে পি এইচ ডি করার সুযোগ পেল। তবে এজন্য তাকে সপ্তাহে দু- তিন দিন সেখানে যেতে হবে এই দিনগুলি জেলা শহর থেকে কলকাতা যাতায়াত করতে হবে। তাছাড়া কোনও উপায় নেই।
 

Post a Comment

0 Comments