মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১২২
রামেশ্বর ভট্টাচার্য (মধ্যযুগের কবি, যদুপুর, ঘাটাল)
ভাস্করব্রত পতি
'পশুপতি অনুমতি সতী নাঞি পায়্যা।
চলিলা পিতার প্রতি কোপবতী হয়্যা।।
যেন কেহ কার প্রাণ লয়্যা যায় কাড়া।
চলিলেন চন্দ্রমুখী চন্দ্রচূড়ে ছাড়্যা।।
প্রদক্ষিণ প্রনিপাত হয়্যা প্রাণনাথে।
বেগবতী যান সতী কেহ নাঞি সাথে।।
ব্যগ্র হইলা উগ্র আর উগে নাঞি কিছু।
নফর নন্দীরে নাথ পাঠাইলা পাছু।।
এমনি একত্র হইয়া নন্দীর সহিত।
মনদুঃখে মায়ের মন্দিরে উপস্থিত'।।
(সতীর দক্ষালয়ে গমন, রামেশ্বর ভট্টাচার্য)
মধ্যযুগের কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য তাঁর 'সত্যপীরের পাঁচালী'তে বলেছেন তাঁর সাকিন বরদাবাটি যদুপুর গ্রাম। ১৬৭৭ এ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বর্তমানে যা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল থানার অন্তর্গত। তখন বরদা পরগণার অধীনে ছিল এই গ্রাম। কবির পিতা ছিলেন লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য এবং মাতা ছিলেন রূপবতী। দারিদ্র্যকে নিত্য সঙ্গী করেই কবি নিজের গ্রামে বসবাস করছিলেন।
কবির বিখ্যাত কাব্য শিবায়ন লেখা হয়েছিল 'মেদিনীপুর অধিপতি' যশোমন্ত সিংহের কর্ণগড় রাজসভায়। সেজন্যই উল্লেখ করেছেন -- 'পূর্ববাস যদুপুরে হেমন্ত সিং ভাঙে যারে'। যদুপুরে রামেশ্বরের পরবর্তী পুরুষদের বাস রয়েছে। এখানে রামেশ্বরের নামে বৈশাখী পূর্ণিমাতে এখনো মেলা হয় এবং তাঁর নামে ঐ গ্রামে একটি বিদ্যালয়ও রয়েছে। কবি ছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের একজন সুপণ্ডিত দিকপাল ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান।
যদুপুর গ্রামে থাকার সময়েই কবি রামেশ্বর লিখেছিলেন 'সত্যপীরের পাঁচালী'। এছাড়াও জীবদ্দশায় তিনি লিখেছেন শিবায়ন, শীতলামঙ্গল, আখোটি পালা, গোবিন্দমঙ্গল, মহাভারতের রাজধর্ম ইত্যাদি। শীতলামঙ্গল কাব্যে তিনি উল্লেখ করেছেন -- 'শীতলামঙ্গল দ্বিজ রামেশ্বর গায় / হরি হরি বল সবে পালা হৈল সায়'।৷
কিন্তু এই যদুপুর থেকে তাঁর ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে উৎখাত করে দেয় হেমন্ত সিং। গবেষক নগেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, 'বরদা ও তৎসংলগ্ন চেতুয়া পরগণাগুলির তৎকালীন জমিদার ছিলেন ইতিহাসখ্যাত শোভাসিং ও তাঁর ভ্রাতা হেমন্ত সিং। দুজনেই দুরাচারী ও অত্যাচারী শাসক বলে ইতিহাসে পরিচিত। কবি রামেশ্বরের সঙ্গে এই দুই ভ্রাতার দুষ্কার্যের বিরোধ বেধেছিল। সঠিক বিবরণ কিছু পাওয়া যায়নি। তবে কতকগুলি গল্পকথা প্রচলিত আছে। এক, শোভাসিং এর প্রতিষ্ঠিত বিশালাক্ষী দেবীর পূজক হতে অস্বীকৃত হওয়ায়, রামেশ্বর নিপীড়িত হন। দুই, রামেশ্বরের সুন্দরী স্ত্রী সুমিত্রাদেবীকে স্নানের ঘাট থেকে অপহরণ করে শোভা সিং, কিন্তু পরে পরিচয় জেনে তাঁকে ছেড়ে দেন'।
জন্মভূমি যদুপুর থেকে থেকে বাধ্য হয়ে পালিয়ে এসে রামেশ্বর ভট্টাচার্য আশ্রয় নেন কেশপুরের কাপাসটিকরী গ্রামে নিজের মামাবাড়িতে। ইতিমধ্যেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল 'সত্যনারায়ণের পাঁচালী' লিখে। কবি তাঁর শিবায়ন কাব্যে লিখেছেন --
'পূর্ববাস যদুপুরে হেমন্ত সিং ভাঙ্গে যারে রাজা রামসিংহ কৈল প্রীত।
স্থাপিয়া কৌশিকী তটে বরিয়া পুরাণপাঠে রচাইল মধুর সংগীত'।
রাজা রামসিংহ তাঁকে কৌশিকীতটে কোনও এক জমিতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই কৌশিকীকে অনেকে আসলে কাঁসাই নদী বলে। তবে এখানে কর্ণগড় রাজবাড়ি সংলগ্ন যেখানে তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন সেখানে পারাং নদী রয়েছে। কাঁসাই এখান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তাই পারাংকে সম্ভবত কৌশিকী নামে অভিহিত করেছেন। প্রাথমিকভাবে এখানে থাকার পর অযোধ্যানগরে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন।
'ভট্টনারায়ণ মুনি সন্তান কেশরকুনি যতি চক্রবর্তী নারায়ণ।
তস্যসুত কৃতকীর্তি গোবর্ধন চক্রবর্তী তস্যসূত বিদিত লক্ষ্মণ ।।
তস্য সূত রামেশ্বর শম্ভুনাথ সহোদর সতী রূপবতীর নন্দন
সুমিত্রা পরমেশ্বরী পতিব্রতা দুই নারী অযোধ্যানগর নিকেতন'।।
এই ভনিতা থেকে জানা যায় কবির দুই পত্নী বর্তমান ছিলেন। তাঁরা হলেন সুমিত্রা ও পরমেশ্বরী। যখন তিনি কাব্যরচনা করতেন, তখন তাঁরা দুজনেই বেঁচে ছিলেন। তবে অনেকের অভিমত, কর্ণগড়ে এসে বসবাসের পর তিনি সুমিত্রাকে বিয়ে করেন। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কয়েকদিন পরে সুমিত্রার মৃত্যু হলে তিনি মনের কষ্ট লাঘবের জন্য দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুরে এসে পরমেশ্বরীকে বিয়ে করেন। যদিও এই তথ্যের সুপ্রমান মেলেনি। তবে প্রথম স্ত্রীর কোনও সন্তান না হওয়ায় তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীকে বিয়ে করেন। যদিও তাঁরও কোনও সন্তান হয়নি। কবি তাঁর কাব্যে 'শিবের বরযাত্রা' কি রকম হয়েছিল, তার ছবি তুলে ধরেছেন এভাবে --
'ত্রিদশদুন্দুভি বাদ্য বাজয়ে রসাল।
বীণা বেণু মন্দিরা মৃদঙ্গ করতাল।।
ঢাক ঢোল কাঁসড় দগড় দামা ভেরী।
মঙ্গল মুরলী যত মোহন মোহরী।।
কিন্নর গন্ধর্ব্বগণ গান করে তারা।
আগে আগে নৃত্য করে ইন্দ্রের অপ্সরা।।
ব্রহ্মা বরযাত্রী দেবগণের সহিত।
ব্রহ্মাণী বৈষ্ণবী লৈয়া হৈয়া হরষিত।।
ঐরাবতে ইন্দ্রাণী সহিত দেবরায়।
ত্রিদশ তেত্রিশ কোটী আগে পাছে ধায়।।
অষ্ট বসু নব গ্রহ দশ দিগপাল।
ষোড়শ মাতৃকা চলে সুরের মিশাল।।
মার্কণ্ডেয় চলিলেন ষষ্ঠীর সহিতে।
চেদিরাজ এলেন চাপিয়া দিব্য রথে।।
বৃহস্পতি আদি চলে ব্রাহ্মণের ঘটা।
দিব্য বস্ত্র পরিধান ভালে ঊর্ধ্বৎ ফোঁটা।
চলে কোটী যোগিনী ডাকিনীগণ লৈয়া।
সর্ব্বভূত শীঘ্র আইল সমাচার পায়্যা।।
দীপ্ত করে দিগান্তরে দেউটী ধরে দানা।
ভূতগুলা মারে ঢেলা নাহি শুনে মানা।।
খোসাল হইয়া পেতি মশাল যোগায়।
কৌতুকে কুষ্মাণ্ডগণ গড়াগড়ি যায়।।
দিব্য দিব্য দীপক জ্বালিছে ধুনামড়া।
হাজার হাজার চলে হইয়া হাতী ঘোড়া।।
চরকি হইয়া কেহ চলে সাথে সাথে।
হাউই হইয়া কেহ ধায় শূন্য পথে।।
অনেক আতস বাজি করিলেক ভূত।
শঙ্কর সাবাসি দেন বটে মোর পুত।।
বরযাত্রশব্দ শুন্যা স্তব্ধ হিমালয়।
আপন অমাত্য সনে আগে হয়্যা রয়'।।
এই বর্ণনায় তিনি কল্পনার সাথে বাস্তবের দৃশ্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন সুচারুভাবে। তেমনি 'গৌরীর রন্ধন' অংশে তিনি লিখেছেন --
'প্রেমময়ী পার্ব্বতী পাইয়া প্রাণনাথে।
পাখালিয়া পদ পাদোদক লৈল মাথে।।
বসাইল বৃষধ্বজে বিচিত্র আসনে।
বাসুলি বাতাস করে বিনোদ ব্যজনে।।
শিব বলে শুন শিবা সেবা কর কি।
ভাঙ্গ বিনে ফাক্কা উড়ে ভাক্কা হয়্যাছি।।
ঘরে ছিল ঘোটনা ঘর্ষণে গেল ফাট্যা।
দিন দুই দানবদলনী দেহ বাট্যা।।
পার্ব্বতী বলেন প্রভু পারি নাঞি যাও।
পুড়া ভাঙ্গ্যা গুঁড়া সিদ্ধি ফাঁকি কর্যা খাও।।
গিরীশ বলেন গৌরি গুড়া সিদ্ধি আছে।
গুড়া খায়্যা বুড়া লোক পড়্যা থাকি পাছে।।
এই পাকে বলি গৌরি বাট্যা দিলে ভাল।
ভগবতী ভাই এর ভাবুক' কর্যা ফেল।।
ভার্য্যার অনেক ভাগ্য ভাঙ্গী যার ভর্তা।
মুখসাট মার্যা তার মাগী হয় কর্তা।।
আঁচ কর্যা পাঁচ কথা কটু যদি কয়।
ভাঙ্গ খাইলে ভাস্কা হল্যে ভাল মন্দ সয়।।
হরবাক্যে হৈমবতী হাসে খল খল।
গৌরী গর্গরী হইতে গড়াইল জল।।
গাঁজা ঝাড়া তাজা সিদ্ধিত ভিজাইয়া তাকে।
মহিষমর্দিনী মদ্যা দিল মুহূর্তেকে'।।
'ভীমের ভোজন' এর চিত্র তুলে ধরতে তাঁর কলমের ছোঁয়ায় উঠে এসেছে --
'অপ্সরী কিন্নরী বিদ্যাধরী ধরাধর।
আন্যা অন্ন ব্যঞ্জন পূর্ণিত কৈল্যা ঘর।।
নানা রস রসায়ন রাখিয়া সাক্ষাতে।
যথাক্রমে বসিলা বন্দিয়া বিশ্বানাথে।।
নারদাদি সভে আইল্যা হইল জ্ঞান-গোষ্ঠ।
ভূতনাথ ভাত দিয়া ভীমে কৈল্য তুষ্ট।।
গণ্ডশৈল সমান নির্মাণ কর্যা গ্রাস।
দেব দৈত্য দানব দেখিয়া পাইল ত্রাস।।
অল্পভাতে এমতে কেমতে ধরে টান।
অন্নপূর্ণা অন্নের উপরে অধিষ্ঠান'।।
আবার 'গৌরীর বিবাহসম্বন্ধ' লিখতে গিয়ে প্রাঞ্জল ভাবে উপস্থাপন করেছেন --
'ঘট্টা কর্যা ঘটকে পূজিল গিরিরাজ।
আস্যা গিয়া আপনি প্রসন্য কর্যা কাজ।।
অচলের কথা কভু চলিবার নয়।
পূর্ব্বের সাবিত্রী যদি পশ্চিমে উদয়।।
ইহা জান্যা আপনে থাকিবেৎ অনুকূল।
নারদ বলেন শুন ভবিতব্য মূল।।
বিবাহ জনম মৃত্যু আল্যে শুভোদয়।
যাহা হৈতে যখন যেখানে যাহা হয়।।
তথাপি তাহাতে সুচেষ্টিত আছি আমি।
কন্যার মায়ের সঙ্গে কথা কহ তুমি।।
পুরন্ধ্রীর প্রগল্ভা বিবাহেতে বাড়ে।
বর দেখ্যা দোষ দেই ঘটকের ঘাড়ে'।।
ড. সুকুমার সেন তাঁর 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থে বলেছেন, 'সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতাব্দীতে (যেমন পূর্বতন কালে) শিবের গান লোক সমাজে গ্রাম্যতাদুষ্ট ছিল। রামেশ্বরের প্রধান কৃতিত্ব এই যে তিনি সমসাময়িক গ্রাম্যগাথাকে ভদ্রবেশ দিয়ে সাহিত্যের সভায় পরিচিত করাইয়াছেন। তাঁহার এ দাবি মানিতেই হয় -- ভবভাব্য ভদ্রকাব্য ভনে রামেশ্বর। রামেশ্বর সংস্কৃত শিক্ষিত ছিলেন। ফারসীও তাঁহার জানা ছিল। ভাষা অত্যন্ত সহজ। তৎসম শব্দবাহুল্যতা নাই, এবং কথ্য ভাষার পদ ও ইডিয়াম প্রচুর আছে। গ্রাম্যতা নাই, তবে কোনো কোনো কাহিনী আদিরস বিবর্জিত নয়। যে রাজসভার জন্য রামেশ্বর শিবসংকীর্তন রচনা করিয়াছিলেন, তাহা বিলাসী নাগরিকের নয় -- শ্রমাসক্ত বোদ্ধা ভক্তিমান সরল বিশ্বাসী হাসিখুশী জনপদবাসীর। সে হিসাবে তাঁহার রচনা সর্বরসময় ও অত্যন্ত সার্থক'।
বাংলার কৃষিবৈচিত্র্য কবির কাব্যের মধ্যে দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে। যা আজও প্রাসঙ্গিক। সেসময়ের কৃষক এবং কৃষি জীবনের চিত্র তিনি চিত্রায়িত করেছেন তাঁর কাব্যে। দেবতা শিব আর গৌরীকে নিয়ে সার্থক কাব্য রচনা করেছেন তিনি। দেবতা হলেও শিবকে তিনি তাঁর কাব্যের মধ্যে দরিদ্র চাষী বলে বর্ণনা করেছেন। গৌরী হয়েছেন চাষীর ঘরনী! আর ভীমকে করেছেন তাঁর সহকারী। শিব আর গৌরীকে নিয়ে লেখা এই কাব্যে গরীব বাঙালি চাষী পরিবারের নিত্যকার ছবি ফুটে উঠেছে। এজন্য 'ব্রাত্য জনগনের কবি' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁকে। 'শিবের কৃষি'র বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন --
'পৃথিবীতে প্রবেশ করিয়া পশুপতি।
দেবীচক দ্বীপের উপরে কৈল্য স্থিতি।।
মনে জান্যা মঘবান্ মহেশের লীলা।
মহীতলে মাঘ শেষে মেঘেরস দিলা।।
দিন সাত বইবাত পাইয়া ঈশানে।
হৈল্য হল-প্রবাহ শিবের শুভক্ষণে।।
আরম্ভে উগালা গেল একশত কুড়া।
পড়্যা গেল পাশে যেন পর্ব্বতের চূড়া।।
হাল ছাড়্যা দু দণ্ডে হালুয়া আইল ঘরে।
বাঁধ আলি বৈকালে বান্ধিল একং পরে।।
চৌক হান্ধ্যা হুঙ্কারে চোটায়্যা' তোলে চাপ।
শঙ্কর সাবাসি বলে বটে মোর বাপ।।
হাল্যা চরাইতে হাল্যা বাঁন্ধিলেক বাড়ি।
লোকালোক পৰ্ব্বত প্রমাণ হৈল আড়ি।।
মধ্যখানে খানিক খসায়্যা দিল চাল্যা।
দক্ষিণ মোহানা হল জল যাত্যে নালা।।
শর আরোপিয়া পগারের চারি পাশে।
সাঁজে শিব সেবক সহিত আইল বাসে।।
বাঘছাল বিছায়্যা বসিল বৃষকেতু।
ভীমের ভাবনা হল্য ভক্ষণের হেতু।।
ক্ষেতে খাট্যা ক্ষুধা বড় খাব কিহে মামা।
বিশ্বনাথ বলে বাপু আজি কর ক্ষেমা।।
শিববাক্য শুনিঞা সর্ব্বাঙ্গ গেল জ্বল্যা।
ডাক্যা উঠে ডাকাতে মারিল মোকে বল্যা।।
সারাদিন সর্ব্বকাল কর্ম করি তবু।
পেট ভর্যা ভাত মোকে দেহ নাঞি কভু।।
মামীর সহিত মামা যুক্তি কর্যা ঘরে।
ভোকে মোকে মারিতে আন্যাছে তেপান্তরে।।
জঠর অনলে যেন জীউ জ্বলে মোর।
কর্ণগড়ে কবির সমাধিস্থল
কাব্যের শেষে কবি তাঁর আশ্রয়দাতা রাজা যশমন্ত সিংহের ('অজিত সিংহের তাত যশমন্ত নরনাথ রাজা রাম সিংহের নন্দন / সিদ্ধ বিদ্যা রাজঋষি তাঁহার সভায় বসি রচে রাম গনেশবন্দন') আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, আশ্রিতজন, অনাত্মীয় বন্ধু, ভাগিনেয়, ভাগিনেয়ী পুত্র, ভাইবোন, দুই পত্নী সহ দুই বন্ধু পরমানন্দ ও হৃদয়রামের (পরমানন্দের কর পরম আনন্দ / হৃদয়রামের কর সকল স্বচ্ছন্দ) জন্য প্রার্থনা করেছেন আকুলভাবে --
'শম্ভুরাম ভায়ার ভরন কর প্রভু
পদছায়া দিও দয়া না ছাড়িহ কভু।। গৌরী-পার্বতী-সরস্বতী স্বসাত্রয়
দুর্গাচরনাদি করি ভাগিনেয় ছয়।।
ভগিনেয়ী পুত্র কৃষ্ণরাম বন্দ্যোঘটি
এসকলে কুশলেতে রাখিবে ধূর্জটি'।।
আবার আরেকটি অংশে কবি শিবের কাছে তাঁর দুই পত্নীর পরকালের জন্যেও কল্যাণ প্রার্থনা করেছেন এইভাবে -- 'সুমিত্রার শুভোদয় পরেশির প্রিয় / পরকালে প্রভু পদতলে স্থান দিও'। এখানে 'পরেশি' হল কবিপত্নী পরমেশ্বরী। এ প্রসঙ্গে নগেন্দ্রনাথ রায় উল্লেখ করেছেন, 'এর থেকে অনুভব করা যায় কবির হৃদয় ছিল কত কোমল, স্নেহপ্রবণ ও উদার। আত্মীয় স্বজন ছাড়াও রাজার আশ্রিতজনের জন্য, অনাত্মীয় বন্ধুদের জন্য এত ভালোবাসা ও প্রেম, তাঁর সুগভীর সমাজকল্যাণ সচেতন মনের বিশালতা আমাদের বিস্ময়াভূত করে'।
শিবায়ন কাব্য লেখা শুরু হয় ১৭০৫ এ। এবং শেষ হয় ১৬৪৩ শকাব্দ বা ১১২৮ বঙ্গাব্দ বা ১৭২১ খ্রিষ্টাব্দে। রাজা যশমন্তের সভায় শিবায়ন প্রকাশ পেয়েছিল। কবির কথায়, 'যশমন্ত সিংহ সিংহবাহিনীর দাস / সে রাজসভায় হৈল সঙ্গীত প্রকাশ'। ড. পঞ্চানন চক্রবর্তী তাঁর 'রামেশ্বর রচনাবলী' গ্রন্থে কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য সম্পর্কে মূল্যায়ন করে লিখেছেন, 'তাঁহার কাব্যে তাঁহার সহজাত কবি প্রতিভার সহিত শাস্ত্রজ্ঞান ও অধ্যবসায়ের প্রচুর নিদর্শন পাই। বহু প্রচলিত শ্রুতকে তিনি আপনার মৌলিকতা দিয়া একান্তভাবে আপন করিয়াছিলেন। তাই বাংলা সাহিত্যে বহু কবির শিব কাহিনী থাকিতেও এই ভদ্রকাব্য খানি -- 'অক্ষরে অক্ষরে মধু' ঝরাইয়া বঙ্গবাসীর চিত্তে অক্ষয় আসন বিস্তার করিয়াছে। শিবের গান এপর্যন্ত পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন ছিল, তাহাকে তিনি সত্যই গ্রামজীবনে ভদ্রকাব্য করিয়া তুলিয়াছেন'।
রাজা রামসিংহের মৃত্যু হলে ১৭১১ তে রাজা হন যশোমন্ত সিংহ। তিনি মারা যান ১৭৪৮ এ। কবি তাঁর কাব্যে কর্ণগড়ের এই রাজাদের পরিচয় লিখেছেন এভাবে --
'রঘুবীর মহারাজা রঘুবীর সমতেজা ধার্মিক রসিক রণধীর।
তাঁহার পুণ্যের ফলে অবতীর্ণ মহীতলে। রাজা রামসিংহ মহাবীর।
তস্য সুত যশোমন্ত সিংহ সর্বগুণ যুত সুখ্যাত অজিত সিংহের তাত।
মেদিনীপুরাধিপতি কর্ণগড়ে অবস্থিতি ভগবতী যাহার সাক্ষাৎ।।
রাজা রণে ভৃগুরাম দানে কর্ণে রূপে কাম প্রতাপে প্রচণ্ড যেন রবি।
শত্রুর সমান শোভা জ্বলন্ত অনল প্রভা সুবেষ্টিত পণ্ডিত সৎকবি।।
দেবীপুত্র নৃপবরে স্মরণে পাতক হরে দরশনে আনন্দ বর্ধন।
তস্য পোষ্য রামেশ্বর তদাশ্রয়ে করয়া ঘর বিরচিল শিবসংকীর্তন'।।
কবির রচনার দিনক্ষন অনুযায়ী বলা যায়, কবি ১৭৪৪ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নিশ্চিত বেঁচে ছিলেন। কারও মতে কবির মৃত্যু সম্ভবত ১৭৪৬ - ১৭৪৭ এর মধ্যে হয়েছিল। তবে ড. পঞ্চানন চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন কবির মৃত্যু হয়েছিল ১৭৪৪ এ শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন। কর্ণগড় মন্দিরের পেছনে কবি রামেশ্বর এবং রাজা যশোমন্ত সিংহের সমাধিস্তম্ভ পাশাপাশি রয়েছে এখনও।
0 Comments