জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য 
           
নির্মল বর্মন 

কথাকার গৌরিশঙ্কর ভট্টাচার্য বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, স্বনামধন্য সাংবাদিক ও প্রকাশক হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলেন। সাংবাদিক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য এর  ''ইস্পাতের স্বাক্ষর'' উপন্যাস  চিরস্মরণীয়। কবে বয়সেই আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য  বই ক্যানভাসিংয়ের কর্মে মনোনিবেশ  করেছিলেন । মাত্র তিরিশ বছর বয়সেই ''মিত্রালয়'' নামে প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করে গর্ব বোধ করেছিলেন। বহু বিখ্যাত,নামী,নবীন ও  প্রবীণ কবি সাহিত্যিক ও লেখকদের বই ছেপেছেন । এবং নিজেও লেখালেখি ধীরে ধীরে শুরু করেন। বস্তুতঃ মৌলিক সরস সুরম্য লেখার সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদেও যথেষ্ট সাবলীল দক্ষতা ছিল। 
কথাসাহিত্যিক গৌরিশঙ্কর ভট্টাচার্য ১৯৭২ থেকে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ অবধি   আনন্দবাজার পত্রিকা'র সঙ্গে নিবিড় ভাবে সংযুক্ত ছিলেন। কথাকার গৌরিশঙ্কর  বার্ণপুর লৌহনগরী কে  নিয়ে লিখে ফেললেন ''ইস্পাতের স্বাক্ষর''। ফলতঃ পঞ্চাশ দশকের শেষ লগ্নে  বাঙালি পাঠককুলের  সাড়া জাগানো আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছিলেন। সঙ্গে সমাজ আলোড়ন আজোও অম্লান । "ইস্পাতের স্বাক্ষর" উপন্যাসটিতে কথাসাহিত্যিকের "রাজনৈতিক সচেতনতার" গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও পরিচয় চিত্রিত। এছাড়াও উপন্যাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শ্রমিক-মালিক বিরোধাভাব  এবং শ্রমিকদের চাওয়া পাওয়া আন্দোলনের প্রেক্ষিত প্রস্ফুটিত।  বিস্তৃতভাবে যন্ত্রশিল্পের  প্রচার ও প্রসারে জীবন ও সাহিত্যে বিরাট বৈচিত্র্য এসেছিল, তাকেই ঔপন্যাসিক কালজয়ী উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন যা খুবই সাড়া জাগানো।
           "ইস্পাতের স্বাক্ষর"বিখ্যাত উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ মূলতঃ তিনটি পর্বে পরিবেশিত। 
     ১.শ্রমিক আন্দোলনের নানাবিধ রূপ। চির প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রমিক  মালিক দ্বন্দ্ব  সেই সঙ্গে শ্রমিকদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নানা দলের সাংগঠনিক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থার মধ্যে তীব্র মতবিরোধ-সংঘর্ষের রোমহর্ষক কাহিনি এই পর্যায়ে সুবিন্যস্ত। এই পর্বে  শ্রমিক বা অন্যান্য চরিত্র চিত্রনাট্যের যে পরিচয় ফুটে উঠেছে, তাতে  মানবিক পরিচয় ক্ষীণ  বললেই তাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ''রক্তকরবী'' র যক্ষরাজার 'সোনার তাল' খোঁড়ার দক্ষ শ্রমিক সম্বলমাত্র। আবার রবীন্দ্রনাথের ''মুক্তধারা''-র যন্ত্ররাজের চামচা অনুচরদের মতোই  এই আলোচ্য উপন্যাসে  রামঅওতার সিং, অবিনাশ,পটলা ও জিলানী চরিত্রচিত্রণগুলি যন্ত্রশক্তির কেবল মাত্র উপাদান ।
🍂
               ২." ইস্পাতের স্বাক্ষর" উপন্যাসে সাংবাদিক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য 'যন্ত্রশক্তির সঙ্গে মনুষ্যশক্তির  মেলবন্ধন দেখিয়ে পাঠক ভাবনাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ফলতঃ অনিরুদ্ধ মল্লিক এর প্রথম যৌবনের জ্বলা যন্ত্রনার ব্যর্থ স্মৃতি তাকে শ্রমিককুলের  প্রতি জটিল নৃশংস শকুন আচরণে বিরাট  উৎসাহ দান করতে বাধ্য। কিন্তু উপন্যাসের "নায়ক দেবজ্যোতি আদর্শবাদী হওয়ার জন্য, তার কপালে   অভিসপ্ত ফুলগোধারা নেমেছে । আসলে দেবজ্যোতি'র প্রতি অমলার দুর্নিবার প্রণয়প্রীতি  নায়ক চরিত্রে  অসহায়তার প্রকট দিকটিকে প্রকাশিত।
                ৩.বার্ণপুরের  বিরাট শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বহু শ্রমিক জনতা মানুষের শান্ত মন্থর সুসংগঠিত জীবনধারার পরিচয় প্রকটিত। বস্তুতঃ সীতানাথ, দীনদয়াল  চরিত্রচিত্রণ বলিষ্ঠ রেখায় সুচিত্রিত।
উপন্যাস প্রসঙ্গে জনৈক সমালোচকের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য --
      "'ইস্পাতের স্বাক্ষর' বিশুদ্ধ রাজনৈতিক উপন্যাস নয়। কারণ লেখকের রাজনৈতিক ভাবাদর্শের অস্বচ্ছতা, শ্রমিক মালিকের বিরোধে মালিকের শোষণের রূপ ও শ্রমিকের শ্রেণি চরিত্রের দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। বরং শ্রমিকদের নানা ধরনের রূপের চিত্রণে ঔপন্যাসিক সফল হয়েছেন"। 
                     ‌কথাকার গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য মহোদয়ের কলকাতা কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত "কফি হাউস" নিয়ে লেখা  ''অ্যালবার্ট হল'' উপন্যাসটিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।এছাড়াও 'ভূগোলসার','অগ্নিসম্ভব','মেরু তুষার জয়ী নটিলাস','এর নাম সমাজ দেহ','আনা করোনিনা'।
গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য অনুদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ:- ''ওয়ার অ্যান্ড পিস'', ''আনা কারেনিনা'', ''কশাকস্'', ''দি আমেরিকান'', ''গ্র্যান্ড হোটেল'', ''মবি ডিক'' ইত্যাদি। কিন্তু আজ বিরাট সাফল্য অর্জন করলেও কালের অমোঘ আকর্ষণে ও পাঠকমন আধুনিক যন্ত্রে মনোনিবেশে অবগাহন করার জন্য  সাংবাদিক "বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য " হিসেবে পরিগণিত কিনা দর্শক দরকার ভাববেন।

Post a Comment

0 Comments