জ্বলদর্চি

অন্তর যাপন /পুলককান্তি কর

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
অন্তর যাপন
পুলককান্তি কর 

জীবনে আমার সবচেয়ে বড় কাল হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতা পড়ে- ‘আমি এমনভাবে পথ চলি, যেন ঘাসের বুকেও আঁচড়টি না লাগে, আমার তো কাউকে দুঃখ দেওয়ার কথা নয়’। এই বাক্যটি যে কখন মন্ত্র হয়ে আমার জীবনের খুঁটিনাটি সবকিছুকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে, প্রথম প্রথম খেয়ালই করিনি। যখন রামকৃষ্ণদেবের বাক্যটি কানে এল, ‘ওরে ঢোঁড়া সাপ হোসনা, না কামড়াস, ফোঁস করিস’ তখন বড় দেরী হয়ে গেছে। ফোঁস করার উদ্যমটুকুই পাইনা, যদি বা কখনও করি তা এত কমজোর এবং বিকৃত হয়ে অন্যের কানে পৌঁছায়, ওতে আমার দুর্গতি হয় আরও বেশী। মামার বাড়ীতেই মূলত মানুষ; দাদু-দিদার আদরের ঘাটতি ছিল না, কিন্তু মামীদের নিজেদের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বড় কুঁকড়ে দিয়েছিল আমায়। আমি মুখ ফুটে কিছু চাইতে পারিনা, খিদে পেলে বুঝতে পারিনা, মনে মনে শুধু গুমরাই। দিদা আদর করে গোপাল সোনা ডাকতেন, সারা জীবন কেবল হাঁটু মারা গোপালের মতোই রয়ে গেলাম। দাদু মাঝে মাঝে আমার কোমল স্বভাব দেখে দিদার উপর খাপ্পা হয়ে বলতেন, ‘আঁচলে বেঁধে রেখে ছেলেটারে লেডিস বানাইয়া ফেললা’!
মা অনেকক্ষণ চা দিয়ে গেছে খাটে, উঠে মুখ ধুয়ে আসার ইচ্ছেটুকু হচ্ছে না এতক্ষণ। মা তাড়া দিয়ে বলল, ‘কীরে, চা যে জুড়িয়ে গেল’!
যাই মা।
কী এত ভাবিস সারাক্ষণ?
কী যে এত ভাবি সত্যিই জানি না। কতকিছুই তো ভাবছিলাম এতক্ষণ। জানলার চৌকাঠে প্রজাপতিটা বসেছিল – সেটা কোন ফুলে ছিল এতক্ষণ কে জানে? আবার উড়ে চলে গেল কোথায় সুরভির মতো? সুরভিকে কাল দেখলাম একটা মোটা মতো ছেলের বাইকে চড়ে কোথায় উড়ে গেল। ওড়ার তো কত জায়গা! পৃথিবীটা তো আকাশের মতো শূন্য নয় – কত মল আছে, সিনেমা রেষ্টুরেন্ট আছে, কত নিভৃত অবসর আছে – কোথায় গেল কাল, কে জানে? মা বলল, ‘খোকা বিয়ে কর একটা, চাকরী তো হল, আমি আর কতদিন হেঁসেল ঠেলবো’?
এই তো করি!
করি বললেই কি আর বিয়ে হয় বাবা! তার জন্য মেয়ে দেখতে হবে তো! তুই কি কিছু দেখে রেখেছিস?
  আমি তো মনে মনে সুরভিকেই দেখে রেখেছি মা, কিন্তু তোমায় বলি কী করে? ওকে ঠিক বউ করবো বলে দেখিনি; ও আমার বউ হতে চাইবে না বোধহয় কোনোদিন; ও তো শুধু উড়ে বেড়ায় শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত! ও কি কোথাও একটু জিরোবার মেয়ে?
কীরে? উত্তর দিলিনা যে? আমি কি আর আগের মতো সক্ষম আছি যে ঘটক-ফটক জোগাড় করব? তোর বাবা বেঁচে থাকলে না হয় কিছু একটা করতো!
    বাবা বেঁচে থাকতে যে কী করতো, মা-ই জানে। সারা জীবন মদ খেয়ে জীবনটা শেষ করে ফেলল, স্ত্রী পুত্র কারোর দিকে দৃষ্টি ফেরায় নি। প্রতিদিন বাড়ী ফিরে মায়ের ওপর অত্যাচার - লাঠি দিয়ে, জুতো দিয়ে … চড় থাপ্পড় – কিছুই তো বাদ থাকতো না। আমার তখন দশ বছর বয়স, একদিন ঘুম ভেঙে দেখি বাবা মায়ের চুলের মুঠি ধরে নাগাড়ে জুতোর বাড়ি মেরেই চলেছে .... আমি ‘মা’ বলে কেঁদে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। এই দেখে বাবা মদ কিংবা মার কোনটাই ছাড়েনি, বরং আমার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল মামার বাড়ী। অথচ বাবা যেদিন মারা গেল, মায়ের লুটোপুটি কান্না দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম বড় ! জানিনা জীবনে আপদের থেকেও শিলমোহরের প্রয়োজন বেশী কিনা!
            সুরভিকে আমি বড় ভালোবাসি। মনে মনেই বাসি; কোনও প্রত্যাশা না নিয়েই বাসি। আমার মতো অকিঞ্চিতকর …. আমার কি কোনওদিন সাহস হবে ওকে বলার, ‘তুমি আমার প্রজাপতির পাখা, সাতরঙা রামধেনু / তুমি আমার একলা অমোঘ বাঁচা, অস্তরাগের রেণু!‘ কোনদিনই ওর উড়ন্ত বাইকের সামনে এসে দুহাত প্রসারিত করে বলতে পারবো, সুরভি, আমি তো মনে মনেই উড়িয়ে দেবো তোমায়, সাত সমুদ্রে যেখানে যত খুশী? প্রতিদিন বরং পাগল গতির হাওয়ায় দু-পা পিছিয়ে এসে বলি, দুগ্‌গা, দুগ্‌গা, সাবধানে ঘুরে এসো সুরভি। তাড়াতাড়ি ফিরো … যেন ফিরতি পথে আর একবার দেখা হয়ে যায়!
            আমি কোনওদিন কাউকেই কোনও কথা বলতে পারিনি। লোকে বলে, ভালোবাসার কথা না বললে উল্টোদিকের মানুষটা বুঝবেই বা কীভাবে? আমি ভাবি, বুঝিয়েই বা কী লাভ! সুরভিকে বললে ও যদি মনে মনে কষ্ট পায়! তার চেয়ে থাকুক না নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে! আমার ভাবনাকে অকারণ বিড়ম্বিত করে কী লাভ! আমার ভাবনায় তো কেউ বাধা দিতে আসছে না! কেউ তো এসে বলছে না, না হে অচিন, এটা বড় গর্হিত কাজ! আমি মনে মনে ভেবে রেখেছি, যদি সুরভির বিয়ে হয়ে যায়, তখন না হয় ভাবার কাজে লাগাম দেব। ততদিন একটু ভাবি, ভেবে নিই আমার শ্বাসবায়ুর নড়াচড়া, আমার ভালোবাসার স্রাব!
বেশ কয়েকদিন স্বপ্নে এসে সুরভি আমায় এটা ওটা বলে, প্রেমের প্রস্তাব দেয়। আমি ভয় পেয়ে গুটিয়ে যাই। সাহস করে বলতে পারিনা, বাসি, বাসি, বাসি! অনন্ত সে ভালোবাসা … প্রত্যেকবার ও জানতে চায় আমার সম্মতি, আমি ভয়ে লুকিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙলে ভাবি, স্বপ্নেই তো সই, কেন বলতে পারি না আমি? এবার স্বপ্নে এলে বেশ করে প্রত্যাখ্যান করবো, দাঁতে দাঁত চেপে বলবো, ‘না’! বলতে পারবো  কি? ভয় হয়, কষ্ট পায় যদি!
এ পাড়ায় বড় হইনি বলে, সমবয়সীদের আড্ডায় আমার খুব একটা আহ্বান নেই। ক্বচিৎ কখনও যাই, অনেকে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। আজকাল পাড়ায় রাজনৈতিক বিভাজন বড় বেশী। সকলে মতামত দেয়। আমি দিতে পারিনা, কেউ বিশেষ শুনতে চায়, তাও নয়। আমারই সমবয়সী এক ছেলে ফাল্গুন, বলল, ‘কী রে অচিন, আজকাল বিকেল হলে রাস্তায় এত ঘোরাঘুরি করিস, ব্যাপার কী? কোনও মাল তোলার চক্করে আছিস নাকি রে’?
আমি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলি, ‘কী যে বলিস’!
না রে, তোর থোবনা ফোবনা তো খুব ভালো। সরকারী স্কুল মাষ্টারিও জুটিয়ে নিয়েছিস, লেগে থাকলে ভালো মাল পটাতে পারবি। তবে কিনা, আমাদের পাড়ায় আর ভালো মাল ফাল ফাঁকা নেই, সব বুকড।
আমি আবার লজ্জার ভাব ফুটিয়ে তুলি মুখে।
ফাল্গুন একটু চোখ টিপে বলল, ভাবগতিক দেখে মনে হয় - তুই লেপ্টার বোনের পেছনে ফাত্‌না ফেলেছিস!
আমি গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলাম। সুরভি লেপ্টার বোন। এত সাবধানে থাকি, তাও লোকের নজর এড়ায় না?
ফাল্গুন বলল, ‘মালটা খাসা, লেগে থাক, হয়ে যেতে পারে। ওই ভোঁতকাটা ব্যাটা খোদার খাসি, বাপের পয়সায় বাইক ফটকে বেড়ায়, মেয়েরা এসবে ভোলে না’!
আমি চুপ করে থাকি। ছেলেটা ভালো নয় যখন, তুমি মিছিমিছি কেন ওর সাথে ঘুরে বেড়াও সুরভি? মলে কেনাকাটা করে রেস্তোঁরায় খেলে বুঝি জীবন চলবে? তোমার মতো মেয়ে একটু ভেবে চিন্তে প্রেমে পড়বে না? তুমি কষ্ট পেলে আমি কী করে ভালো থাকবো সুরভি?
ফাল্গুন বলল, ‘লেপ্টার পছন্দ নয় ছেলেটাকে জানিস? ও বলছিল, বাড়ীতে নাকি টুকটাক সম্বন্ধ দেখা চলছে মেয়েটার।
তাহলে বাড়ীর লোকে ওকে বারণ করে না কেন?
তা তো জানি না।
মেয়েটা কি বেয়াড়া টাইপ?
না বোধহয়। আমার বোনের সাথে পড়তো তো। যদ্দূর জানি, ভালো; বাকি আমাদের দেখে বুঝিস না – এই বয়সের ছেলে ছোকরাদের মন তো! একটু উড়ে না বেড়ালে মন ঠিক থাকে না। ভয় পাস না, বাড়ীর সংষ্কার আছে! পোকাকে কাটার সুযোগ দেবে না নিশ্চয়! অবশ্য গ্যারেন্টী দিয়ে কিছুই বলা যায় না! কেউ শালা বিশ্বাস করবে, নন্দার বোনটা অলরেডী তিনটের সাথে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হোটেলে যায়?
খুব খারাপ লাগে, জানো সুরভি। বিয়ের আগে তুমি কারো সাথে হোটেল টোটেলে যেও না প্লীজ! কেউ যদি তোমাকে কষ্ট দেয়!

🍂

(২) 
    বসন্ত বিগত প্রায়। শেষ চৈত্রের তীব্র দাবানলে এখনও সব কিছু পুড়িয়ে দেওয়ার মায়া বুনে বিকেল বেলায় দখিনা হাওয়া বয়। বেশ কয়েদিন সুরভিকে আর দেখতে পাই না রাস্তায়। শরীর খারাপ হল? নাকি বাড়ীতে অশান্তি! রোজ রোজ ব্যর্থ পথচাওয়া নিয়েও তীব্র আশ্লেষ নিয়ে বাড়ী ফিরি … ভালোবাসা আরও গভীর হয়। মা বলল, ‘লেপ্টার বোনটাকে চিনিস’? ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করে উঠল, মা-ও ঘরে থেকে আঁচ পেয়ে গেল সবকিছুর? ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘হুঁ’। মা হাসিহাসি মুখে বলল, ‘তোর পছন্দ’?
কেন মা?
লেপ্টার মা হারুর মা-কে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে, আমরা যদি রাজী থাকি, সম্বন্ধটা এগোতে পারে।
ভয় পাই আমি। আবার তীব্র আনন্দে বুকটা ভরে যায়। আমি আকাশে উড়তে থাকি। স্বপ্ন থেকে বের করে আনি অনন্ত আনন্দ-কোলাজ। মা বলল, ‘কীরে, হ্যাঁ বলব’? আমি তখনও স্বপ্নে ভাসতে থাকি। আমার চোখ মুখ দেখে মা কিছু বুঝে নেয়, মুখে কিছু বলে না। কদিন আগেই নন্দিতা বলছিল, ‘অচিনদা একটা কথা বলব’?
বলো!
আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।
এটা কি ঘটা করে বলার কথা? খুব নরম করে বললাম, পাছে ও লজ্জা পায়!
না বললে তো আপনি বোঝেন না!
বোঝানোর কি খুব দরকার?
হ্যাঁ, আমি চাই আপনিও আমায় ভালোবাসুন।
এমন কথা জীবনে শুনিনি। এভাবে নিষ্পাপ মুখে এমন একটা  চাওয়া বলা যায় কাউকে? হয়তো যায়! নন্দিতাই হয়তো বলতে পারে এমন কথা। বললাম, চাইলেই বুঝি কাউকে ভালোবাসা যায়?
আপনি কাউকে বাসেন?
মুখ ফুটে বলতে পারলাম না কিছু। শুনলে হয়তো কষ্ট পাবে ও। নন্দিতা বলল, বাসলেও কোনও সমস্যা নেই। আপনি বিয়ে করবেন না?
মা দেখাশোনা করছে।
বেশ তো। আমার তাতেও কোনও সমস্যা নেই।
কী বলতে চাইছো নন্দিতা, আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।
জানেন অচিনদা, আমি সবসময় অবচেতনে ভাবি আমাকে কেউ এমন ভালোবাসুক যেখানে কোনও চাওয়া পাওয়া থাকবে না, নিত্যদিনের দাবী থাকবে না কোনও … না বৈবাহিক, না কোনও সর্ম্পকের … পৃথিবীর চারদিকে যেমন আয়ন মণ্ডল জড়িয়ে থাকে ঠিক তেমনি … আমার যেকোনও কষ্টে, যেকোনও শূন্যতায় আমি যেন ভাবতে পারি সে তার ভালোবাসা দিয়ে সেই শূন্যতাগুলো ভরিয়ে দিতে পারবে।
তার জন্য তুমি আমায় বাছলে কেন?
আপনি তেমনই মানুষ অচিনদা। আমি বুঝতে পারি আপনি আর পাঁচজনের মতো নন। আপনার মধ্যে চাওয়া ছাড়াই ভালোবাসার রঙ ফুটে ওঠে। তাছাড়া আপনি আমায় পছন্দ করেন, বুঝি।
নন্দিতাকে কি এভাবে ভালোবাসা যায়? ও আমার স্কুলেরই কলিগ, সদ্যবিবাহিতা। আমার ভালো বন্ধুও। স্বামীর সঙ্গে কি কোনও কষ্টে আছে সে? তাই বা কেন? কোনও কষ্টবোধ থেকেই কি শুধু বিকল্প ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা জাগে? বললাম, তুমি ভালো আছো তো নন্দিতা?
হ্যাঁ। আমার বর খুব ভালো।
আমি বললাম, সুখে থাকো আজীবন। তোমার এমন চাওয়া তোমার বরকে দিয়েই পূর্ণ হবে।
তা হয়না অচিনদা। স্বামী-স্ত্রীর সর্ম্পকটা বিনিময়ের। ভালোবাসাও সেখানে নিশ্চিত থাকে বা থাকা উচিৎ। কিন্তু বিনিময়টা আপনি ওখানে অস্বীকার করতে পারবেন না।
তোমার বর কী করে যেন?
ইঞ্জিনিয়ার। টিসকো তে চাকরী করে।
বাঃ।
নন্দিতা বলল, আমি যেমনটা ভাবি, তেমনটা আপনার মনে হয়না অচিনদা? 
মুখে কিছু বললাম না। কিন্তু আমি তো সুরভীকে এমনি করেই ভালোবাসি নন্দিতা। ভালোবাসা তো এমনটাই হওয়া উচিৎ।
ফাল্গুন বলল, অচিন, তোর পাখি তো এবার তোর খাঁচায় ঢুকবে রে! বোনের মুখে শুনলাম, বাড়ীতে নাকি হেব্বি ঝামেলা চলছে, ওই কুমড়ো পটাশের সাথে বেরোনো ওড়া সব বন্ধ!
ভারী দমে গেলাম আমি। ফাল্গুন খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, খুশি হলি না মনে হল!
বললাম, সুরভি নিজে কী চায়?
ওসব নিয়ে তুই মাথা ঘামাছিস কেন বোকা? মেয়েরা তো ঠিক ছেলেদের মতো নয়! চট্‌ করে মন সিফ্‌ট করতে পারেনা। একটু সময় লাগবে তোর তারে বাজতে ... সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবি।
ফাল্গুন তুই ঠিক করে বল, সুরভী কী চায়!
এটা তোর জন্য চাপ বস। বোন বলছিল, সুরভী বলেছে, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিলে ঘুমের বড়ি খাবে।
তাই?
ও সব মেয়েলি কথায় তুই ঘাবড়াস না অচিন। মেয়েরা বিয়ের আগে এরকম বলে। আর একটা কথা মাথায় রাখবি, যে আত্মহত্যার কথা মুখে বলে, কাজে কর্মে তারা করে উঠতে পারে না। দেখবি ছাদনা তলায় সুড়সুড় করে গিয়ে বসে পড়বে নাকি কান্না কেঁদে। 
বড্ড গুমোট লাগছে বুকে। সব বাতাসের মুখ আটকে কি দখিন দুয়ারে দাঁড়িয়ে পড়েছে মস্ত এক দৈত্য? সমস্ত গাছের পাতা থেকে কি এক প্রশ্বাসে সব বায়ু টেনে নিয়েছে বিষাক্ত কোন কাল সাপ? ব্যর্থ পায়চারির মধ্যেও যে আনন্দ বেদনা, তা যেন শ্বাসকষ্টের মতো পাথর চাপা পড়ে গিয়েছে বুকে। সন্ধের আগে আগে বাড়ী ফিরতে মা খুশী হয়ে বলল, ‘হাতমুখ ধুয়ে আয়, চা বসাই’।
এখন চা খেতে ইচ্ছে করছ না মা। পরে বসিও।
  মা একটু মুচকি হেসে বলল, আমার হতে আর কদিন? বৈশাখটা পড়লেই চার হাত এক করে দেব। তখন বৌয়ের হাতে চা খাস। মা উঠে সি.এফ.এল.টা জ্বালিয়ে দিল। এবার ঠাকুর ঘরে গিয়ে সন্ধে দেবে, শাঁখ বাজাবে। ঠাকুর ঘরের উত্তরাধিকার ঠিক করে মনে মনে সে উল্লসিত। আমি বাইরের বারান্দায় এসে একমনে আকাশ দেখতে লাগলাম। মা বলল, ‘তোর বাবা বেঁচে থাকলে কী ভালোটাই না হ’ত! পরশু সকালে তোকে দেখতে আসবে মেয়ের বাড়ীর লোকজন। সারাজীবন ঘরের বাইরে গিয়ে তো কিছুই দেখিনি, কিছুই বুঝিনি। তোর বাবাই দেখে শুনে রাখতো সবকিছু! এসব জোগাড় যন্ত্র কি আমি বুঝি? মানী মানুষ ওরা।
   আচ্ছা মা কি মনের জগতে বাবার আদলে অন্য কাউকে ভালোবাসে? তার কথা ভেবে সুখ পায়? তার মধ্যে আরোপ করে প্রকৃত বাবার চরিত্র? কে জানে!
খোকা কালই সকাল সকাল উঠে বাজার টাজার করে রাখিস কিন্তু। কাজকর্ম কালকেই কিছুটা এগিয়ে রাখব। আর পুরুতমশাইকেও খবরটা দিয়ে আসিস আজই।
আমি চুপ করে রইলাম। মা কিছু ভেবে বলল, তোর মুখটা এত গোমড়া কেন বাবা? আমি তো তোর অমতে কিছু করিনি!
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে বললাম, হারুর মাকে এখুনি খবরটা দিয়ে এসো মা। পরশু দিন ওদের আসার দরকার নেই!

Post a Comment

0 Comments