গল্প
চিঠি
মিলি ঘোষ
অন্ধকারটা ক্রমশ ঘনাচ্ছে। আকাশের অনেক উঁচুতে একটা হালকা গুরুগুরু শব্দ। সঙ্গে পর্দা ওড়া হওয়া। না গরম, না ঠান্ডা। তবু স্নিতার ভালো লাগছে না। দিনের শুরুতে সন্ধ্যা নামার দৃশ্য মনকে অকারণ বিষাদময় করে তুলছে। বারান্দায় গিয়ে একবার দাঁড়াল। রূপক আসছে না কেন এখনও? ভাবতে ভাবতেই রূপক এসে হাজির।
বাজারের সঙ্গে রজনীগন্ধার মালা হাতে রূপককে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে তাকাল স্নিতা। ওর হাত থেকে বাজারের ব্যাগ দুটো নিয়ে রান্না ঘরে গেল।
একবার পিছন ফিরে রূপকের হাতের মালাটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "হঠাৎ?"
রূপক জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, "তোমার কী মেঘ দেখে মনেও পড়ল না, আজ ছিল বাইশে শ্রাবণ?"
স্নিতা দেওয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের ছবিটার দিকে একবার তাকিয়ে রান্না ঘরে ঢোকার সময় বলে গেল, "জয় গোস্বামী।"
রূপক বেশ হতাশ হলো। আশা ছিল এমন একটা লাইন বলে বউকে চমকে দেবে। অবাকও হলো। কবিতা টবিতা পড়তে তো দেখি না কখনও। জানল কী করে?
তখনই পৃথিবীর মাটিকে ফাটিয়ে ফেলার মতো ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি নামল। দুধ সাদা বৃষ্টি। সে এমন বৃষ্টি, সামনের বাড়ি ঘর দেখা যায় না।
মিনিট দশেক পরে রূপক উঠে এসে ডাইনিংয়ের জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখে বলল, "এর মধ্যে আজ আর বেরোনো সম্ভব নয়।"
বৃষ্টির শব্দে স্নিতা কি শুনতে পেল না? রূপক গলা না চড়িয়ে সোজা রান্না ঘরের দিকেই গেল। কিন্তু রান্না ঘরে পা দিতে গিয়ে থমকে গেল রূপক। গ্যাসের ওপর হাঁড়িতে টগবগ করে ভাত ফুটছে। এদিকে রান্না ঘরের নালা দিয়ে কিছুটা জল ঢুকেছে। অল্পই, পায়ের পাতা ডোবার মতো। সেই জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে স্নিতা।
🍂
আরও পড়ুন 👇
স্নিতার বাবা অনিকেত রায় টাটা স্টিল লিমিটেডে উচ্চপদে কাজ করেন। জামশেদপুরে কোম্পানির দেওয়া সাজানো গোছানো কোয়ার্টারে থাকেন স্ত্রীকে নিয়ে। স্নিতার জন্ম ওখানেই। প্রাচুর্যের মধ্যেই বেড়ে উঠেছে। কনভেন্ট থেকে পাস করা স্নিতার বাংলা উচ্চারণে জড়তা আছে। প্রথম প্রথম শুনে হাসত রূপক। তবে এই নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করেনি কখনও। বরং ওর প্রতি একটা সম্ভ্রম ছিল ভেতরে ভেতরে। দুই পরিবারের আর্থিক পরিকাঠামোয় আকাশ পাতাল প্রভেদই এর একমাত্র কারণ। দিনগত পাপক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সম্ভ্রমও এখন কৌলিন্য হারিয়েছে।
রূপকের বাবা কবিতা লিখতেন। দাদুও লিখতেন। দাদুর বাবাও। এর আগের পূর্ব পুরুষদের কবিতা প্রেম ছিল কিনা জানা যায়নি। তবে রূপক লেখে না। কিন্তু পড়ে। কবিতা গল্প সব। এরকম সাহিত্যের আবহে মেয়েকে বিয়ে দিতে দুবার ভাবেননি অনিকেত। অফিসের এক সহকর্মীর মাধ্যমে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। রূপক হাবড়ার একটি বেসরকারি স্কুলে আজ তেরো বছর শিক্ষকতা করছে।
রূপকের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন মেয়েকে অনিকেত, "ছেলেটি কিন্তু সুপুরুষ। তাছাড়া ওই পরিবারে তুই দিবারাত্র সাহিত্যের ঘ্রাণ পাবি। আমরা তো নীরস লোক। পারবি তো, মফঃস্বলে গিয়ে থাকতে?"
স্নিতা ঘাড় নেড়েছিল, "পারব।"
সেই থেকে রয়ে গেছে এই আধা গ্রাম আধা শহরে রূপকের সঙ্গে। অনিকেত জানেন মেয়ের আত্মসম্মানবোধ কানায় কানায় পূর্ণ। টাকা দিতে চাইলে নেবে না। তাই মেয়ের সঙ্গে যে জয়েন্ট একাউন্ট আগেই করেছিলেন, প্রতি মাসে সেখানে ঘড়া উপুর করেন অনিকেত। মেয়ের বাড়ি গেলে ঘুরে দেখেন জায়গাটা। রূপকের বইপত্র নেড়েচেড়ে দেখেন। ভেতরের বিষয়বস্তুর মর্ম উপলব্ধি করতে না পারলেও ছুঁয়ে দেখতে অনিকেতের ভালোই লাগে। তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রূপক ভেতরে ভেতরে গর্বিত হয়। সে সময় ওর কথা বলার ধরনে হাঁটাচলায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। নিজের আর্থিক দীনতা ঢাকার হয়তো একটা ছোট্ট প্রয়াস।
স্নিতা সপ্তাহ খানেকের জন্য ছেলেকে নিয়ে জামশেদপুরে গেছে মায়ের কাছে। বাসন মাজার দিদিকে বলে এসেছে, "কাজ হয়ে গেলে দাদার জন্য একটু রান্না করে দিও।"
কিন্তু রূপক মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। সব সময় কি আর বই পড়তে ভালো লাগে? অফিস থেকে ফিরে একটা কথা বলার লোক নেই। পাড়া কালচার তো উঠে গেছে সে কবেই। কী গ্রাম কী শহর। সব জায়গাতেই আধুনিকতার ছোঁয়া। ব্যস্ততার আবরণে একটাই বাক্য -- ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট এ তরী। আজ অফিস থেকে ফিরে সেদিনের কথা মনে পড়ল ওর। সেদিন মানে বাইশে শ্রাবণ। আচ্ছা, স্নিতা জানল কী করে ওটা জয় গোস্বামীর কবিতা? পড়ে মনে হয়। বাড়িতে তো বইয়ের অভাব নেই।
চা খাওয়া শেষ করে স্নিতার আলমারির দিকে তাকাল রূপক। বিত্তবান শ্বশুর বিয়েতে দুটো আলমারি দিয়েছিলেন। মেয়ে জামাইকে আলাদা আলাদা। কী মনে করে চাবি নিয়ে স্নিতার আলমারিটা খুলে ফেলল রূপক
নিজের মনেই বিড়বিড় করল, "বাবাহ্! এ তো জামাকাপড়ের পাহাড়! বড়লোক বাবার দান নিশ্চয়ই। পরে কখন? পরতে তো দেখি না খুব একটা।"
রূপকের সাবধানী হাত ঘুরে বেড়ালো জামাকাপড়গুলোর গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে। লকারটাও খুলল। জানে ধনসম্পদ কিছুই নেই এখানে। যা আছে সব ব্যাঙ্কে। কয়েকটা ছোট গয়নার ব্যাগ পেল। বেশিরভাগই ফাঁকা। একটাতে কয়েকটা ভাঙ্গা কানের দুল। একদম পেছনের ব্যাগটায় মনে হলো কিছু আছে। চেন খুলে একটা খাম পাওয়া গেল। ফাঁকা বাড়িতে অনুসন্ধান যখন চলছে খামের ভিতরেও যে হাত যাবে, না বললেও চলে। চটপট খুলে ফেলল রূপক কাগজটা। চিঠি? কার লেখা? এত অস্পষ্ট! তবু চোখ গেল একদম তলায়। মৃণাল দাশগুপ্ত?
চিঠিটা নিয়ে বিছানায় এসে ধপাস করে বসে পড়ল রূপক। মাথা কাজ করছে না একেবারেই। আবার পড়ল চিঠিটা। এ কি কবি মৃণাল দাশগুপ্ত? তিনি তো কিছুদিন হলো মারা গেছেন। বাড়ি তো শুনেছি বাঁকুড়ার দিকে কোথায় একটা।
চটপট খামের উল্টো দিকটা দেখল রূপক। এই তো বাড়ির ঠিকানা দেওয়া। বাঁকুড়াই তো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল রূপক। তারপর নিজের মনেই বলল, স্নিতা কবিতা লেখে!
পরদিন স্কুল ছুটি নিয়ে বাঁকুড়ার উদ্দেশে রওনা হলো রূপক। ট্রেন থেকে নেমে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গেল মৃণাল দাশগুপ্তের বাড়িতে। ভাঙাচোরা কয়েকশো বছরের পুরোনো বাড়ি। ঝোপ লতা পাতা বাড়িটাকে যেতে নাহি দিব ভঙ্গিতে পরম মমতায় জড়িয়ে রয়েছে। পুরো বাড়িটার দেওয়ালে কোথাও সিমেন্টের চিহ্ন মাত্র নেই। ইটগুলো দাঁত বের করে তাকিয়ে আছে। বাড়িটার সামনে কিছুটা খোলা জমি। সেখানেও নানারকম গাছ। অযত্নে বেড়েছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রূপক চোখ বন্ধ করে বনজ গাছপালার ঘ্রাণ নিল। একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল রূপক।
কাছে গিয়ে বলল, "বাবু বলতে পারবে, এটা কি মৃণাল দাশগুপ্তর বাড়ি?"
ছেলেটা একবার মুখ তুলে রূপককে দেখে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। একটু বাদে একজন মহিলা এলেন মাথায় ঘোমটা টেনে।
রূপক বেশ একটু বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইল, "আচ্ছা, এই বাড়িতে কি কবি মৃণাল দাশগুপ্ত থাকেন?"
"কিন্তু তিনি তো আর নেই। প্রায় পাঁচ ছয় মাস হলো মারা গেছেন। আমার শ্বশুর হন।"
"ওহ্, মারা গেছেন!"
"আপনার কি কিছু দরকার ছিল বাবার কাছে?"
তখনই ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন।
"কে এসছে? কার সঙ্গে কথা বলছ?"
"বাবাকে খুঁজছেন উনি।"
রূপক ভদ্রলোকের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে যতটা সম্ভব রেখেঢেকে মূল বিষয় উত্থাপন করল। বলল, পোস্ট অফিসের গাফিলতিতে এই চিঠি এসেছে অনেক বছর পরে। ভদ্রলোক খুব খুশি হয়ে রূপককে ভেতরে নিয়ে গেল, একদম বাবার ঘরে। স্তম্ভিত রূপক। টেবিলের ওপর ছবিটা দেখেই চিনতে পারল কবি মৃণাল দাশগুপ্তকে। হাত জোড় করে প্রণাম করল। ঘরময় শুধু বই। বেশ কয়েকটা বইয়ের তাক, টেবিল, বিছানা সর্বত্র বই।
ভদ্রমহিলা বলল, "পত্রিকাগুলো সব খাটের তলাতেই রাখা আছে। আপনি যদি একটু দেখে নেন।"
রূপকের চোখ পড়ল গিয়ে খাটের তলায়। আলোহীন একটি বই খাতার গুদাম। এখান থেকে কী করে পত্রিকা বের করবে?
ভদ্রমহিলা বললেন, "আমি বার করে দিচ্ছি। আপনি দেখে নিন। যা লাগে নিয়ে যান না।"
ভদ্রলোকও উৎসাহ দেখালেন, "আমার ব্যাগ আছে বড়ো বড়ো। আপনার যত বই লাগে নিন না।"
রূপক বুঝল বাবার বই বিদায় করে ঘর খালি করার চেষ্টা। হাত লাগাল রূপক ভদ্রমহিলার সঙ্গে।
বারোটা পত্রিকা একটা ব্যাগে ভরে রূপক যখন বেরোল, তখন গাছের লম্বা ছায়া ভূমি স্পর্শ করেছে। সরু পথ ধরে ও এগিয়ে চলল স্টেশনের দিকে। ট্রেনে যেতে যেতেই একটা পত্রিকা বার করল। উদ্ভাস। সম্পাদক মৃণাল দাশগুপ্ত। স্নিতার লেখাগুলো পড়তে লাগল রূপক। ট্রেনে জানলার ধার। হাওয়ায় চুল এলোমেলো। তবু রূপকের সারা শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম হচ্ছে। রূপক পকেট থেকে রুমাল বার করল।
আজ স্নিতা জামশেদপুরে থেকে ফিরবে। রূপক পত্রিকাগুলো একটা প্যাকেটে ভরে ওর টেবিলের নিচের ড্রয়ারে রেখে চাবি ঘুরিয়ে রেখেছে। চিঠিটাও স্নিতার আলমারির লকারে গয়নার ব্যাগে ভরে একদম পেছনে। একবার ভালো করে দেখে নিল, সব ঠিকঠাক আছে কিনা।
রাতের দিকে আলমারি খুলে স্নিতা থমকে গেল। একটু যেন অন্য লোকের হাতের ছোঁয়া। রূপক ও ঘরেই মুখের সামনে একটা বই ধরে খেয়াল রাখছিল স্নিতাকে। একবার মুখ ঘোরাল স্নিতা। রূপকের চোখ বইয়ে। লকার খোলার শব্দ। রূপক হৃদপিণ্ড হাতে নিয়ে বসে রইল।
স্নিতা একদম রূপকের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল, "কিছু খুঁজছিলে?"
"হ্যাঁ, .... না, মানে ওই আর কী।"
"চিঠিটা ভুল ব্যাগে রেখেছ তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।"
রাতে শোবার আগে ড্রয়ার থেকে পত্রিকাগুলো বার করে স্নিতার সামনে রাখল রূপক।
বলল, "আমাকে বলোনি কেন, তুমি কবিতা লেখো? আমি কি বারণ করতাম? কবে থেকে এগুলো মৃণালদার বাড়িতে পড়ে আছে বলো তো?"
অভিযোগের সঙ্গে আলমারি ঘাঁটার জন্য দুঃখ প্রকাশও করল রূপক। কিন্তু স্নিতার কবিতার বিষয়ে একটিও প্রশংসাসূচক শব্দ ব্যয় করল না। স্নিতা উত্তর দেয়নি। পত্রিকাগুলো দেখে প্রথমে একটু বুকটা কেঁপেছিল। তারপরেই স্থির হয়ে যায়।
ছেলেকে নিয়ে পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে স্নিতা। রূপকের চোখে ঘুম নেই। বাথরুমের কল থেকে জল পড়ার টপ টপ শব্দটা কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? একাকীত্বের? প্রতিহিংসার? নাকি, পরাজয়ের?
আচ্ছা, 'মৃণালদা' বলাতে স্নিতা কি ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসল? নিজের কাছেই হাজারো জিজ্ঞাসা রূপকের। কেন হাসল স্নিতা? ও কি বুঝেছে? আমার মনের সবটাই কি ও পড়তে পেরেছে?
0 Comments