জ্বলদর্চি

দু'টি গানের মর্মবাণী /দিলীপ কুমার ঘোষ

দু'টি গানের মর্মবাণী
             
দিলীপ কুমার ঘোষ


 ১৩০৯ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের বয়স একচল্লিশ বৎসর, এর মধ্যে তিনি হারিয়েছেন কমপক্ষে বারোজন নিকটাত্মীয়কে, যার মধ্যে রয়েছেন তাঁর গর্ভধারিণী মা এবং স্ত্রী--- তাঁর সন্তানের গর্ভধারিণী। 
 ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে চোদ্দো বৎসরে পদার্পণ করার আগেই রবীন্দ্রনাথ হারিয়েছিলেন মাকে। তারপর একাদিক্রমে তাঁর জীবন থেকে চলে গিয়েছেন ভ্রাতুষ্পুত্র গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভগ্নীপতি সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, বৈবাহিক কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী, ভ্রাতুষ্পুত্রী অভিজ্ঞা চট্টোপাধ্যায়, ভগ্নীপতি সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ভ্রাতুষ্পুত্রী ঊষাবতী চট্টোপাধ্যায়, ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভ্রাতুষ্পুত্র নীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ১৯০২-এ মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। এই মৃত্যু-মিছিল তাঁকে স্থিতধী করেছে, করেছে মৃত্যুঞ্জয়। তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে ঔপনিষদিক ঋষির প্রজ্ঞাপারমিতা। তাঁর অন্তর্জগতে কেলাসিত স্ফটিকস্বচ্ছ বোধ গানের আকারে হয়েছে সুসংবদ্ধ।

পূজা                   আশ্বাস     ৮
-------                  -----------------
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।।
তবু প্রাণ নিত্যধারা,   হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
        বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।।
        তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
        কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়,  নাহি শেষ,  নাহি নাহি দৈন্যলেশ
        সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।।
 ১৩০৯

 জীবনে দুঃখ আছে, থাকবে। কখনওই দুঃখ বোধ করেন না, দুঃখিত হন না এমন মানবজীবন বিরল। প্রাজ্ঞ ঋষিপ্রতিম দার্শনিক দুঃখে অনুদ্বিগ্ন থাকতে পারেন, কিন্তু দুঃখকে অস্বীকার করতে পারেন না। দুঃখের মতোই মৃত্যুও জীবনের শাশ্বত সত্য, অনিশ্চিত মানবজীবনের পরম নিশ্চিত পরিণতি। এই ধ্রুব সত্য অলঙঘণীয়, অমোঘ। বিচ্ছেদ যন্ত্রণা, বিয়োগব্যথা জীবনকে দগ্ধ করে--- সেই দহনজ্বালার হাত থেকে কারোরই রেহাই নেই। প্রিয়কে হারানোর বেদনা ক্ষেত্রবিশেষে অসহনীয়, মর্মান্তিক; কিন্তু তা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায়ও নেই। সুতরাং, বলা যেতে পারে দুঃখ, মৃত্যু, বিরহযাতনার ঊর্ধ্বে কারোর পক্ষেই ওঠা সম্ভব নয়। 
 কিন্তু এগুলিই কি জীবনের একমাত্র সত্য? না, কক্ষণও নয়। এগুলির মতোই জীবনে শান্তির ধারাসিঞ্চন, আনন্দের নির্ঝরিণীও সত্য। শত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার মধ্যেও মানবপ্রাণ মাঝে মাঝে চরম শান্তি লাভ করে, পরিপূর্ণ আনন্দে তৃপ্তি লাভ করে। এক অনন্তের বোধ জাগ্রত হয় তার মধ্যে, যা পার্থিবতার সীমা ছাড়িয়ে অপার্থিবতার অলোকলোকে মানবজীবনের উত্তরণ ঘটায়।
🍂
 প্রাণের প্রবাহ কখনও থেমে থাকে না। অনাদি অতীত থেকে চলে আসা প্রাণপ্রবাহে কোনও ছেদ নেই। চিরাভ্যস্ত গতিতে বয়ে চলেছে এই জীবনধারা। ঊর্ধ্বাকাশে চন্দ্র-সূর্য-তারা একই রকম ভাবে বিরাজমান। হাস্যমদির ঔজ্জ্বল্যপ্রকাশে তারা ধারাবাহিক।
  প্রকৃতির বুকে ধারাবাহিক ছন্দে আবর্তিত হতে থাকে ঋতুবৈচিত্র্য। আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফুলের ডালি সাজিয়ে ঋতুরাজ বসন্ত আসে। তার এই আগমন নিয়মিত, নিশ্চিত। সমুদ্রে ঢেউ ওঠে, আবার ঢেউ কূলে এসে মিলিয়ে যায়। এর কোনও ছেদ নেই। প্রথমাবধি এমনই ঘটে আসছে। উদ্ভিদ ফুল ফোটায়, সেই ফুল ক্রমপরিণতির শেষে ফল হয় অথবা হয় না, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরালে ঝরে পড়ে। এদিকে আবার নতুন কুঁড়ি থেকে ফুল ফুটে ওঠে।
 আসলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অক্ষয়-অশেষ। এখানে সবকিছুই নিত্যতা সূত্র মেনে চলে। পরিবর্তনও এখানে নিয়মিত, বিধিবদ্ধ, সুনির্দিষ্ট। কোনও শূন্যস্থানই এখানে পরম শূন্য নয়। এখানে শাশ্বত অভাব, চরম দীনতা বলে কিছু নেই। এখানে স্থায়ী কেবল পূর্ণতাবোধ। অভাবী মন, দুঃখী মন, বিরহদগ্ধ মন সেই পূর্ণতাকেই ছুঁতে চায়। আর তা যদি ছুঁতে পারে, তাহলে সেই মনও পূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন সেই মন উপলব্ধি করে--- আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।।
           
 ১৩১৬ বঙ্গাব্দ। রবীন্দ্রনাথের জীবনে অতিক্রান্ত হয়েছে আরও সাতটি বৎসর, কিন্তু প্রিয়জনের বিয়োগব্যথার অবসান ঘটেনি। এই সময়পর্বে তিনি হারিয়েছেন মামাতো ভাই বিমানেন্দ্রনাথ রায়, ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্যম কন্যা রেণুকা, ১৯০৫-এ পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯০৭-এ কনিষ্ঠ সন্তান শমীন্দ্রনাথ, ১৯০৮-এ ভ্রাতুষ্পুত্র হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রেণুকার স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে। তাই ১৩০৯ বঙ্গাব্দে দুঃখ-মৃত্যু-বিরহদহনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে শান্তি-আনন্দ-অনন্তের অনুধ্যানে নিজেকে নিয়োজিত করলেও সাত বৎসর পরে ১৩১৬ বঙ্গাব্দে এসে কবিকে পরমপ্রাণের কাছে আবার প্রার্থনানম্র হতে হয়েছে।

   প্রার্থনা                            ৪
   ----------                          ---
   জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।
   সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,    গীতসুধারসে এসো।।
কর্ম যখন প্রবল-আকার    গরজি উঠিয়া ঢাকে চারিধার 
   হৃদয় প্রান্তে, হে জীবননাথ,    শান্ত চরণে এসো।।
আপনারে যবে করিয়া কৃপণ    কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন
  দুয়ার খুলিয়া, হে উদার নাথ, রাজসমারোহে এসো।।
বাসনা যখন বিপুল ধূলায়   অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়,
  ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো।।
  [ ২৮ চৈত্র ১৩১৬ ]

 জীবন নদীস্বরূপ। জীবননদ নিত্য বহমান। হর্ষ-বেদনা, আনন্দ-বিষাদ, সুখ-দুঃখের স্রোতধারা তাকে করে রাখে প্রাণচঞ্চল স্রোতস্বিনী। কিন্তু জীবনে কখনও এমন সময়ও আসে যখন জীবনধারা অবরুদ্ধ শুষ্ক বলে প্রতীয়মান হতে থাকে। কোনও অনুভূতিই তার মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সে-সময় এই ঊষর নিষ্করুণ জীবনে পরমপ্রাণের কাছ থেকে শান্তিপ্রদায়িনী যে-উপশম, সেই করুণার বড় প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই। করুণাধারায় তাঁর আগমনের আহ্বান হয়ে ওঠে শুষ্ক-বদ্ধ-ঊষর মানবপ্রাণের ঐকান্তিক প্রার্থনা।
 জীবন থেকে মিষ্ট কমনীয়তা, করুণার সৌন্দর্য অপসৃয়মান হলে জীবন তার সম্পদ-সমৃদ্ধি হারিয়ে ক্লেশদায়ক হয়ে ওঠে। সাঙ্গীতিক মূর্ছনা, সুরলহরী, তানের বিস্তার অমৃতবারির স্বাদবাহী হয়ে এসে নিষ্করুণ বিশুষ্ক জীবনে তাল-লয়-ছন্দ ফিরিয়ে আনতে পারে। পরমানন্দকে তাই গীতসুধারসে আসার আহ্বান।
 জীবনের অপর নাম কর্ম। কর্মহি জীবনম্। পরিস্থিতি অনেক সময় এমন হয় যে জীবনের জন্য কর্ম, না কর্মের জন্য জীবন মানুষ সেটা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে না। কর্মের দাবি তার কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে উঠে তাকে চারদিক থেকে আবদ্ধ করে ফেলে। কর্মের জাঁতাকলে পড়ে সে পিষ্ট হতে থাকে, কর্মের প্রবল বেগ স্রোতের মতো এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি করার অবসর-অবকাশ তার থাকে না। সেই অশান্ত সময়ে হৃদয়ে শান্তির স্নিগ্ধবারি সিঞ্চনের জন্য জীবননাথের আগমনের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
 মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার মন। মনের ঐশ্বর্য অসীম। সেই ঐশ্বর্যশালী মনকে অকৃপণ করার পরিবর্তে মানুষ দীনহীন কৃপণ করে ফেলে। সবটাই যে নিজের অজান্তে তা হয়তো নয়। কিন্তু এটাই যেন তার ভবিতব্য! উদার মনের যে বিস্তার, সেই বিস্তারের যে প্রশান্তি, তা থেকে বঞ্চিত মানুষ ক্লিষ্ট হতে থাকে। রাজৈশ্বর্যের অধিকারী যে-মন তার ঔদার্য্যের উড়ান হয়ে উঠতে পারত, সেই মন-ই অহেতুক কার্পণ্যের কারণে গণ্ডিবদ্ধ রুদ্ধদ্বার হয়ে ওঠে। তাকে দ্বার উদ্ঘাটন করে মুক্ত করার জন্য পরম উদার মহাপ্রাণের রাজসমারোহে আগমনের বড় প্রয়োজন। একমাত্র তাঁর রাজকীয় ঔদার্য্যের প্রাণস্পর্শেই অনুদার, অতি দরিদ্র মনের হত-কুৎসিত গ্লানিমা দূরীভূত হওয়া সম্ভব।
 বাসনা সর্বস্ব আমাদের এ জীবন। বাসনার বশবর্তী মানুষ ক্রমশ বোধহীন হয়ে উঠতে থাকে। বাসনা যত বাড়তে থাকে তত সে বোধশূন্য হতে থাকে। বোধসম্পন্ন মানুষ থেকে সে পর্যবসিত হয় অবোধ মানুষে। বাসনার ঘূর্ণিঝড় তার অন্তর্লোককে ধূলিধূসরিত করে, তার অন্তর্লীন দৃষ্টিক্ষমতা লোপ পায়। সে হারিয়ে ফেলে তার বোধ-মনন-সত্তা। প্রবল বাসনা তার হুঁশ-সতর্কতাকে নিদ্রাতুর করে । কোথাও যেন পঙ্কিল মলিনতা এসে গ্রাস করে তাকে। এমতাবস্থায় পূতপবিত্র স্পর্শের, অতি সতর্ক-সচেতন তীক্ষ্ণ শলাকাসম সদাজাগ্রত অনুভবের সম্যক প্রয়োজন। মোহান্ধ মানুষের মন থেকে বাসনার অন্ধকার দূর করার জন্য আবশ্যক সত্যসন্ধানী আলোকের। সেই আলোর রুদ্ররূপ এসে একমাত্র দূরীভূত করতে পারে তামসিক বাসনাকে। 
 এইভাবে দু'টি গানের মধ্যে একটিতে জাগতিক মৃত্যু এবং অন্যটিতে আধ্যাত্মিক মৃত্যুকে স্বীকৃতি দিলেও কবি কিন্তু মৃত্যুকেই শেষ সত্য বলে স্বীকার করেননি। একদিকে অপার শান্তি, চিরন্তন আনন্দ এবং জাগ্রত অনন্তর মধ্যে নিষ্কৃতি খুঁজে পেয়েছেন, অন্যদিকে সঙ্কটমোচনের জন্য পরম প্রাণকে আহ্বান করেছেন। কিন্তু দু'টি ক্ষেত্রেই কবির প্রত্যয় এবং আনন্দঘন শাশ্বত জীবনদেবতার প্রতি প্রবল আস্থা লক্ষণীয় এবং তা তাঁর গভীর বোধেরই পরিচায়ক।

                

Post a Comment

0 Comments