জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প ২০৭—পর্তুগাল (ইউরোপ)রাজকুমারির বিয়ে /চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
দূর দেশের লোকগল্প ২০৭—পর্তুগাল (ইউরোপ)
রাজকুমারির বিয়ে
চিন্ময় দাশ

এক ছিল রাজা, আর তার এক ছেলে। দেখতে দেখতে ছেলের বয়স হচ্ছে। রাজা ছেলেকে ডেকে বলল—এবার তো তোমাকে বিয়ে করতে হবে, বাপু। পছন্দের কেউ আছে তোমার?
--না, তেমন কেউ নাই আমার। 
ছেলের জবাব শুনে, রাজা বিরক্ত—কেমন যুবক তুমি? এত বয়স হোল, একটা বউ বেছে উঠতে পারলে না? বলিহারি যাই তোমাকে। 
ছেলে বলল—না, মানে ঠিক অতটা খারাপ নয় বিষয়টা।
শুনে, রাজার মুখে আলো ফুটল—খুলেই বলো না বাপু, কে সেই মেয়ে?
ছেলে বলল—বিয়ে যদি করতে হয়, নেপলসের রাজার মেয়েকেই বিয়ে করব আমি। অন্য কাউকে নয়।
রাজার তো থতমত খাওয়ার জোগাড়। বলে কী, এ ছেলে? নেপলসের রাজকুমারি? কত্তো দূরের দেশ। কত্তো বড় রাজা সে। তার মেয়েকে বিয়ে করবে? কানে গেলে, সে রাজাই না কী ঝামেলা লাগিয়ে দেয়।
নিজেকে সামলে নিয়ে, রাজা বলল—নেপলসের রাজার আদৌ কোনও মেয়ে আছে কি না, জানো তুমি? 
--না, বাবা। তা আমি জানি না। সোজা-সাপটা জবাব ছেলের।
রাজা তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল— তা হলে, আগে খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, মেয়ে আছে কি না রাজার।
ছেলে বেরিয়েছে রাজধানিতে। একে শুধোয়, ওকে শুধোয়। সবাই মাথা নেড়ে চলে যায়। কেউ জানে না সে খবর। কেউ বা বিরক্ত হয়—আদার ব্যাপারি আমরা। জাহাজের খবরে দরকারটা কী আমাদের? 
শেষ রাজা বলল—তাহলে, আর দেরি কেন? বেরিয়ে পড়ো। সোজা নেপলসে যাও। নিজেই খোঁজ নিয়ে এস। 
ছেলে বলল—বলো কী? নেপলস চলে যাব?
--জানি, ইতালি দেশটা কি আর এখানে? অনেকটা দূরের পথ। দু’তিনটা সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে তোমাকে। কিন্তু তাছাড়া উপায় কী? সেই রাজার মেয়েকেই তো বউ করবে ঠিক করেছ। সেখানে যাওয়া ছাড়া, খবর পাবে কী করে?
লোকলস্কর খাবার-দাবার নিয়ে জাহাজে চড়ে বসল ছেলে। অনেক ঝড়ঝাপটা সয়ে, নেপলসে এসে পৌঁছালোও একদিন। সবে জাহাজ ভিড়েছে। সাথে সাথে এক পাল ভিখিরি এসে ঘিরে ফেলল ছেলেকে—দাও, দাও। কিছু সাহায্য করো। 
ভালোয় ভালোয় একেবারে নেপলসে আসা গেছে। ছেলের তখন মন বেশ দরাজ। সবাইকে ভিক্ষে দিয়ে, জানতে চাইল-- নেপলসের রাজার কোন মেয়ে আছে কি না, জানো তোমরা?
এক বুড়ি বলল—রাজার মেয়ে কি না, ঠিক জানি না, হুজুর। তবে, একদিন রাজবাড়ির পাশ দিয়ে আসবার সময়, একটি মেয়েকে দেখেছি। আহা, কী সুন্দর মুখখানি।
ছেলে বলল—সঠিক খবর এনে দাও। হাত ভর্তি পুরষ্কার পাবে। 
পুরষ্কারের কথায় বুড়ির তো তর সয় না। পা নেচে উঠল আনন্দে। রাজবাড়ির রাস্তায় গিয়ে হাজির। কপাল ভালো, সেই একই মেয়েকে চোখে পড়ে গেল। 
বুড়িকে আর পায় কে? গলা তুলে চেঁচিয়ে উঠল—শোন গো, সুন্দরী মেয়ে। খুব জরুরী একটা কথা ছিল বলবার। 
কেন জানি, সেদিন মন খারাপ করছিল রাজকুমারির। তাই বাইরের ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল। কথা বলার জন্য, বাইরের একজনকে পাওয়া যাবে, এই ভেবে সে বলল—কী কথা বলবে, বুড়িমা? 
--তুমি কি রাজকুমারি?
--হ্যাঁ, আমিই রাজকুমারি। কেন গো? 
বুড়ি ভারি চালাক। সে জবাব দিল—ভালো ভালো কিছু জিনিষ ছিল তোমাকে দেখাবার মতো। একদিন নিয়ে আসব তাহলে।
রাজকুমারী বলল—একদিন কেন? কাল বিকেলেই চলে এসো। আমি সদর দেউড়িতে বলে রাখব। কেউ আটকাবে না তোমাকে।
বুড়ি তো আহ্লাদে আটখানা। ছেলেকে এসে বলল— মেয়ে আছে রাজামশাইর। ভারি সুন্দরী সে মেয়ে। 
ছেলের মনেও বেশ আনন্দ। মুঠো ভরে টাকা দিল বুড়ির হাতে। দেখে বুড়ির চোখ ছানাবড়া। এত টাকা একসাথে দেখেনি সে। বলল—আরও একটা কাজ করে এসেছি, হুজুর। কিছু জিনিষ দেখাব বলে, কাল বিকেলে গিয়ে দেখা করব, বলে এসেছি। 
আবার এক মুঠো টাকা বুড়িকে দিয়ে ছেলে বলল—খুব ভালো কাজ করেছ। কাল আমি যাব তোমার বদলে।
পরের দিন । বণিকের পোষাক পরে, রাজার বাড়িতে গিয়ে হাজির হোল ছেলে। দেউড়ির সেপাই বলল—তোমার আসবার কথা বলা আছে আমাকে। চলো, পৌঁছে দিয়ে আসি।
রাজকুমারির মহলে ছেলেকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল সেপাই। রাজকুমারি জানত একজন বুড়ি আসবে। কিন্তু সামনে একজন যুবক এসে হাজির হবে, এটা জানা ছিল না। 
কিন্তু কিছু প্রশ্ন করবার আগে, ঝকঝকে একটা থালা মেলে ধরেছে ছেলেটি। নিজের দেশ পর্তুগাল থেকে অনেক জিনিষই এনেছে জাহাজে চাপিয়ে। তারই সেরা কিছু রাজকুমারীর সামনে তুলে ধরেছে এখন। 
অনেক জিনিষের মধ্যে জরির কাজ করা ফিতে, জপের মালা, কবজ ছিল থালায়। সেগুলোই মনে ধরেছে রাজকুমারির। বেছে নিয়ে বলল—বলো, কী দাম লাগবে এগুলোর?
রাজার ছেলে বলল—তোমার পছন্দ দেখছি অন্য রকম। এরকম আরও অনেক ভালো জিনিষ আছে আমার কাছে। কাল এনে দেখাতে পারি।
রাজকুমারীও খুশি—সে তো ভারি ভালো কথা। কাল ঠিক এই সময়েই এসো। দেউড়িতে বলা থাকবে।
পর দিন আবার এসেছে ছেলেটি। সেদিন বণিকের পোষাকের তলায়, নিজের রাজকুমারের পোষাক পরে রেখেছে সে। দেউড়ির সেপাই পৌঁছে দিয়ে ফিরে যেতেই, ঝটপট বণিকের ছদ্মবেশ খুলে ফেলেছে। 
রাজকুমারীর সামনে যখন হাজির হোল, মুখে কথা নাই সে মেয়ের। থাকবে কী করে? আসবার কথা হয়েছিল এক বুড়ির। তার বদলে এল এক বণিক। আর, আজকে এখন সুদর্শন এক তরতাজা যুবক। পরণে লাল মখমলের দামী পোষাক। মাথায় মহার্ঘ টুপির সাথে, নিশান দেওয়া মানানসই ছড়ি তার হাতে। 
রাজকুমারি অবাক। বলল—কে তুমি? কালকের বণিক নিশ্চয় নয়। 
খুলে ফেলা বণিকের পোশাক দেখিয়ে রাজকুমার বলল—আমিই এসেছিলাম গতকাল। 
এরপর নিজের সমস্ত কথা এক এক করে বলে গেল ছেলেটি। শুনে সে মেয়ে ভারি অবাক। মনে মনে বেশ খুশিও হয়েছে। বলল—আমার খোঁজে গভীর সমুদ্রে এতখানি পথ পাড়ি দিয়ে এসেছ তুমি? আমি তো ভাবতেই পারছি না। 
রাজার ছেলের মুখে মিষ্টি হাসি—কিন্তু যে আশা নিয়ে এসেছি, তা পূর্ণ হবে তো?
হাসি রাজকুমারির মুখেও—কী তোমার আশা, খুলে বলো, শুনি।
--আমি বিয়ে করতে চাই তোমাকে। তুমি রাজি?
রাজকুমারীর গলায় কৌতুক—রাজি না হয়ে কী করি, বলো? সারা জীবন তুমি তো আর কাউকে বিয়েই করবে না বলছ। 
রাজার ছেলে জানতে চাইল—কিন্তু তোমার বাবা? তিনি মত দেবেন তো?
রাজকুমারি বলল—সাহস আছে তোমার? বলো। তাহলে, পালাই চলো দুজনে।
সেটাই স্থির হোল শেষ পর্যন্ত। পরের দিন পেছনের সিঁড়ির নীচে এসে দাঁড়াবে রাজার ছেলে। রাত গভীর হলে, রাজকুমারি নেমে আসবে চুপিসারে। 
বাবার একমাত্র মেয়ে সে। আদরের দুলালী। চোখের আড়াল হতে দেয় না বাবা। সব সময় পাহারাদার ঘুরে বেড়ায় সারা মহলে। নিঃসঙ্গ বন্দী জীবনে হাঁফিয়ে উঠেছে মেয়েটি। মুক্তির এমন একটা ছক, তাকে বেশ উৎফুল্ল করে তুলেছে। সবার অগোচরে পালিয়ে, পালতোলা জাহাজে সাগর পাড়ি দিয়ে, অজানা কোন দেশে পাড়ি দেওয়া যাবে, জীবনে এর চেয়ে রোমাঞ্চকর আর কিছু হতেই পারে না।
পরের দিন। রাজার ছেলের তো ধৈর্য ধরে না যেন। রাত গভীর না হতেই, ঘোড়া হাঁকিয়ে সিঁড়ির তলায় এসে হাজির। জাহাজে চেপে এতটা পথ এসেছে দেশ থেকে। তার পর গত তিন দিনে কম ধকল যায়নি। ঘোড়ার পিঠে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা।
এদিকে রাজকুমারি তো আর চাইলেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। গোটা রাজবাড়ি ঘুমে এলিয়ে পড়বে, তবে না তার বেরুনো। সে বসে আছে নিঝুম রাতের অপেক্ষায়। 
হয়েছে কী, এক চোর বেরিয়েছে রাস্তায়। একটা লোক ঘোড়ায় বসে ঘুমোচ্ছে, চোখে পড়ে গেছে তার। ভাবল, নিশ্চয় পাহারাদার হবে। পিছন দিকে এসে দিব্বি ঘুম লাগিয়ে দিয়েছে। 
চোরের মন। খলবল করে উঠল দেখে। লোকটাকে নামিয়ে ঘোড়াটা নিয়ে পালাতে হবে। এমন দাঁও ছাড়া যাবে না।
কাছে এসে চোখ চকচক করে উঠেছে তার। কী দামি জিন ঘোড়ার পিঠে। এটা বেচেই অনেক দিন পেট চলে যাবে আমার। এই ভেবে, যত্ন করে রাজকুমারকে নামাল চোরটা। খানিক দূরে, একটা গাছের তলায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল সাবধানে। রাজকুমার তখন ঘুমিয়ে কাদা। চোরের মনে আহ্লাদ, এবার ঘোড়ায় চেপে সরে পড়তে হবে।
ফিরে আসতে গিয়ে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। চোরের চোখে খর দৃষ্টি। সিঁড়ি দিয়ে কেউ যেন নামছে। চট করে গাছের আড়ালে চলে গেল সে। তাড়াহুড়ো করা যাবে না এক্কেবারে। দেখা যাক, ব্যাপারটা কি? 
অতি সুন্দরী একটি মেয়ে নেমে এসেছে ওপর থেকে। ঘোড়াটার কাছে পৌঁছে, মেয়েটি বলল—আমি এসে গেছি, প্রিয়। 
চিরিক করে উঠল চোরের মাথার ভিতর। ওহ, তাহলে এই ব্যাপার। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে, ঘর পালাবার মতলব?
আর এক মূহুর্তও দেরি নয়।
তাড়াতাড়ি ঘোড়ার কাছে হাজির হয়ে গেল লোকটা। ফিসফিসে গলায় বলল—আমিও তৈরি।
মেয়েটিকে পেছনে তুলে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। 
খানিক গিয়ে মেয়েটি বলল—তোমার জাহাজ কোথায়? কত দূরে সেটা?
এবার আরও ভালো করে বোঝা গেল। জাহাজে চড়ে সমুদ্রে ভেসে পড়বার মতলব। তাহলে, সহজে কারও চোখে পড়বে না। লোকটা ভাবল, ফন্দিটা খারাপ নয়। চোখে ধুলো দিতে গেলে, সমুদ্রই ভালো। 
লোকটা জবাব দিল—আরও খানিকটা দূরে। জাহাজ কি আর যেখানে সেখানে ভেড়ানো যায়।
ঘোড়া ছোটাচ্ছে জোর গতিতে। যতটা দূরে সরে পড়া যায়, এই মতলব। রাজকুমারি আবার বলল—আরও কত দূর? 
--এই তো এসে গেলাম। বলে, ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল লোকটা। তুমি এখানে থাকো। আমি আসছি। বলে চলে গেল সেখান থেকে। সমুদ্রের ধারে, নৌকা একটা জুটে যাবে নিশ্চয়। 
ফিরেও এলো খানিক বাদে। সাথে একটা ডিঙি নৌকা। বলল—উঠে পড়ো চটপট। জাহাজ তৈরি আছে। 
মেয়েটির চোখমুখ ফ্যাকাশে। চেয়েই আছে লোকটার দিকে। এ মানুষটা কে? সেই সুন্দর যুবক চেহারা, সেই সুন্দর চোখমুখ, সেই মিষ্টি গলার স্বর কোথায় গেল? এ তো সে নয়। এ কার সাথে চলে এসেছি আমি? হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল রাজার মেয়ে। এ কী সর্বনাশ হোল আমার? 
ভালো করে মেয়েকে দেখে, চোরও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। এ তো রাজবাড়ির ঝি-চাকরানি নয়। কে এ?
জিজ্ঞেস করল—সত্যি করে বলো তো, তুমি কে? 
মেয়েটি বলল—কে আবার রাজার মেয়ে। কিন্তু তুমি কে? আমাকে নিয়ে পালাচ্ছিলে কেন?
কে দেবে জবাব? এত্তোবড় আকাশটা তখন ভেঙে পড়েছে চোরের মাথায়। বুক ঢিপঢিপ। নির্ঘাত শূলে চড়াবে রাজামশাই। একটাও কথা নয়। এক মূহুর্ত দেরিও নয়। টেনে দৌড় লাগাল চোরটা। কোন রকমে সরে পড়তে পারলে, প্রাণটা যদি বাঁচানো যায়। 
সমুদ্রের কিনারা ধরে পালাচ্ছে লোকটা। একটু একটু করে মিলিয়েই গেল তার চেহারা। ভোর হতে তখনও বাকি। জনহীন সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজার মেয়ে। যত দূর চোখ যায়, কেউ কোত্থাও নাই। 
দেখতে দেখতে সকাল হোল। জলের গায়েই পাহাড়। পাথরে বসে আছে রাজার মেয়ে। গাল মুখ ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে।
খানিক বাদে এক জেলেনি এসেছে মাছ ধরতে। সাথে তার মেয়ে। তারা দেখতে পেল মেয়েটিকে। তারা তো অবাক। এই  সকাল বেলায় নির্জন সাগরের পাড়ে এলো কোথা থেকে একটা মেয়ে। কাপড়-চোপড় শুকনো। জাহাজ ডোবার ঘটনা নয়। ব্যাপারখানা কী। 
কাছে গিয়ে তো তাদের চোখ চকচক করে উঠেছে। হায় মাগো, কে এই মেয়ে? দামী কাপড়-জামা। কত গয়নাগাঁটি গায়ে। জেলেনির মাথায় ফন্দি এসে গেল। যেভাবেই হোক, একে ঘরে নিয়ে যেতে হবে। 
মিষ্টি গলা করে বলল—কে তুমি বাছা? এখানে এলে কী করে? 
দু’-দুটো মেয়েকে দেখে, একটু সাহস এলো রাজকুমারির মনে। বলল—মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে একটা। ভারি বিপদে পড়েছি। 
জেলেনি দেখল ভারি মওকা। মেয়েকে বলল—যা তো মা, একে বাড়িতে নিয়ে যা। হাজার রকম লোকের আসা-যাওয়া সাগরের পাড়ে। চোর-বাটপাড়ের অভাব নাই। সর্বস্ব লুট করে নেবে। ঘরে নিয়ে যা একে। লুকিয়ে রাখ। কারও চোখে না পড়ে। 
রাজকুমারিকে বলল— আমরা বাছা গরীব মানুষ। তেমন কোন যত্নআত্তি করতে পারব না তোমার। তবে থাকবে নিরাপদেই। আঁচড়টিও লাগতে দেব না গায়ে। আমি কাজ সেরে, খানিক বাদেই ফিরে আসছি। 
ছিল রাজার অট্টালিকায়। এখন এক জেলেনির ঘরে গিয়ে ঠাঁই হোল রাজার মেয়ের।
সেদিন একটু তাড়াতাড়িই ঘরে ফিরে এল জেলেনি। রাজকুমারিকে বলল—গরীব-গুরবো মানুষের পাড়া আমাদের। সব চোর-ছ্যাঁচ্চোড়। তোমার জামাকাপড়, গয়নাগাঁটি খুলে ফেলো সব। সেসব একটা পুঁটলি বেঁধে রাখো। এসব গায়ে চড়িয়ে বেরুলে বিপদে পড়তে হবে।
রাজকুমারির বিশ্বাস হোল জেলেনিকে। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল—আমাকে রাজবাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। অনেক পুরষ্কার দেওয়া হবে তোমাদের। 
এ কথা শুনে তো ফূর্তি ধরে না মা-মেয়ের। মা বলল—সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে, পাঁচ কান হতে দেওয়া যাবে না। পুরষ্কারের লোভে সবাই এসে টানা-হেঁচড়া করবে তোমাকে। আমরা দুটিতে কি আর আটকাতে পারব তাদের?
অগত্যা জেলেনির মেয়ের পোষাক উঠল রাজকুমারির গায়ে। সেই বাড়িতেই থাকতে হোল তাকে। রাতে মা-মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে, বসে বসে চোখের জল ফেলে রাজকুমারি।
ওদিকে হয়েছে কী, এক সময় তো ঘুম ভেঙেছে রাজকুমারের। চোখ কচলে দেখল, একটা গাছের তলায় শুয়ে আছে সে। মাথায় কিছু ঢুকল না প্রথমে। ঘোড়াটাও নাই আশেপাশে। নিশ্চয় ও ব্যাটা আমাকে এখানে ফেলে, পালিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু রাজকুমারি এখনও আসছে না কেন? সে এলে তো, যেভাবেই হোক, জাহাজের কাছে পৌঁছে যাওয়া যেত। সিঁড়িটার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
ধীরে ধীরে আলো ফুটে উঠতে লাগল। রাজকুমারির দেখা নাই। ভাবল, নিশ্চয় এভাবে পালাতে মন সায় দেয়নি মেয়ের। মনের দুঃখে জাহাজে ফিরে চলল রাজকুমার। 
🍂
জাহাজ ভাসিয়ে, দেশে ফিরছে রাজকুমার। এখন মন বদলেছে খানিক। ভালোই হয়েছে। খবর তো জানা গেছে, নেপলসের রাজার একজন সুন্দরী মেয়ে আছে। এবার বাবা নিশ্চয়ই ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করবে। কারও মেয়েকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে, যোগাযোগ করে বিয়ে করা অনেক ভালো।
এই সব স্বপ্নে বিভোর রাজকুমার। এমন সময় ঝড় উঠেছে হঠাৎ। সমুদ্রের ঝড় মানে ভয়ানক বিপদ। ভাগ্যিস বেশি দূর এগোন হয়নি। দাঁড়ি-মাঝি তাড়াতাড়ি করে জাহাজ এনে ভিড়িয়েছে একটা পাহাড়ের গায়ে। 
এটা সেই পাহাড়, যেখানে বসে চোখের জল ফেলছিল রাজকুমারি। সেদিনও হয়েছে কী, রাজকুমারিও এসেছে সমুদ্রের পাড়ে। মা-মেয়ে মাছ ধরতে এসেছে। সেও এসেছে তাদের সাথে। 
আহা, কী সুখেরই না দিন সেটা। জাহাজ থেকে নেমেছে রাজকুমার। সামনে তিনজন মেয়ে। গায়ে গরীবের পোষাক থাকলেও, রাজকুমারিকে আলাদাই লাগছে দেখতে। রাজকুমার এগিয়ে গেল মেয়েগুলোর দিকে।
আস্ত একখানা জাহাজ পাড়ে এসে ভিড়েছে। তিন জনেই সেদিকে তাকিয়ে দেখছিল। রাজকুমারকে নামতে দেখে, রাজকুমারির তো আনন্দ ধরে না। এখন আর এই মানুষকে চিনতে কোনও অসুবিধা নাই। 
অনেক কান্নাকাটি অনেক কথাবার্তা হোল দুই রাজার দুলাল দুলালির। জেলেনি ভারি ধুরন্ধর। সে বলল—প্রভু যীশু কত দয়ালু। কত তাড়াতাড়ি মিলন করিয়ে দিয়েছেন তোমাদের দুজনের। তবে বাপু, আর একটুও দেরি নয়। জাহাজের খবর পেয়ে, গোটা গ্রাম এসে ভেঙে পড়বে এখানে। হই-হট্টগোল শুরু হয়ে যাবে। এটা দাও, ওটা দাও। হাজারো বায়নাক্কা। দেরি না করে, তোমরা বরং জাহাজে উঠে পড়ো।
মা-মেয়ের হাতে এক মুঠো করে টাকা তুলে দিল রাজকুমার। রাজকুমারির গয়নার পুঁটলি তো ঘরেই থেকে গেছে। আবার বাড়তি দু’মুঠো টাকা পেয়ে, আনন্দের সীমা রইল না মা-মেয়ের।
রাজকুমারিকে নিয়ে আবার জাহাজ ভাসল সাগরে।
গল্পটা এখানেই শেষ নয়। বিয়েবাড়ির কথাটাও বলে নেওয়া দরকার। 
ছেলে জাহাজ নিয়ে গিয়েছিল নেপলসের রাজার মেয়ে আছে কি নাই—সে খবর জোগাড় করতে। কিন্তু রাজার মেয়েকেই তুলে নিয়ে এসেছে ছেলে। রাজার তো আকাশ ভেঙে পড়েছে মাথায়। যদিও অনেক দূরের দেশ। কিন্তু মেয়ে চুরি গেছে। অত বড় রাজা। সে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? নিশ্চয় বড়সড় বিপদ আসছে পিছন পিছন। 
ছেলে বলল—বাবা! পাঠিয়ে ছিলে মেয়ের খবর আনতে। মেয়েকেই নিয়ে এসেছি আমি। এবার বিয়েটা সেরে ফেলার ব্যবস্থা করো। 
নিজের মেয়ে নাই সে রাজার। এমন পরীর মতো একটি মেয়ে এসেছে ঘর আলো করে। রাজার তো আনন্দ ধরে না। কিন্তু ভয়ও যে যায় না মন থেকে। হাসি মুখ করে বলল—এ মেয়ে এখন আমারও মেয়ে। বিয়ে বললেই, হুট করে বিয়ে দেব না কি? মহা ধুমধামের সাথে বিয়ে হবে আমার মেয়ের। সময় লাগবে তার জন্য।
ছেলের দেরি সয় না। সে বলল—কত সময় লাগবে তোমার? 
--বিয়ে বলে কথা। হাজারো কাজ। হাজারো বন্দোবস্ত তার। মাসখানেক তো লাগবেই। সারা রাজ্যকে নেমন্তন্ন করব আমি। অধৈর্য হয়ো না তুমি।
সেদিনই নেপলসের রাজার কাছে লোক পাঠিয়ে দিয়েছে রাজা। সঙ্গে লম্বা একটা চিঠি। ভুল-ত্রুটি স্বীকার করে, বিয়েতে মত চেয়েছে বিনয়ের সাথে। 
দিন কয় গেলে। খবর আসে না। রাজা হা-পিত্যেস করে বসে থাকে উত্তরের আশায়। খবর যেদিন এলো, সারা রাজধানি ভেঙে পড়ল সাগরের পাড়ে।
পেল্লাই দু’খানা জাহাজ এসে ভিড়েছে বন্দরে। এক দল সৈন্য নেমেছে তা থেকে। সামনে তাগড়াই চেহারার একটা লোক। হাতে তার দেশের রাজার একটা নিশানদণ্ড। নেপলসের রাজার নিশান পতপত করে উড়ছে বাতাসে। 
পুরো বাহিনী কুচকাওয়াজ করে চলেছে রাজার বাড়ির দিকে। বিউগল, ড্রাম, শিঙার বিকট শব্দে আকাশ-বাতাস, রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি সব কাঁপছে থরথর করে।
আর রাজামশাই? থরথর করে নয়, তার বুক কাঁপছে ঠকঠক করে। কী সর্বনাশই না দোরগোড়ায় এসে হাজির হোল!
কিন্তু কোথায় কী? ঝুড়ি ঝুড়ি জিনিষ পাঠিয়েছেন নেপলসের রাজা। বাহিনীর সর্দার সেসব এনে দরবারে নামিয়ে দিল। শেষে একখানা চিঠি ধরিয়ে দিল রাজার হাতে।
তাতে  লেখা—অজানা অচেনা বিদেশের এক বাজার বাড়িতে আমার আদরের মেয়ের বিয়ের আয়োজন? কক্ষণো না। দুটো জাহাজ পাঠালাম। একটাতে আমার মেয়েকে ফেরত পাঠাবে। আর একটা জাহাজ আমার জামাইয়ের জন্য। সাজপোষাকও সব পাঠালাম। তোমার জন্যও পোষাক দিয়েছি। বেয়াই মশাইর পোষাক উপযুক্ত নাহলে, মান থাকবে না আমার। এটা যেন ভুলে যেও না। নইলে-… হা-হা-হা।
চিঠি পড়ে রাজার কী হোল?
রাজা ভুলে গেল দরবারে বসে আছে। ঘর ভর্তি লোক। বিদেশের লোকেরাও আছে সেখানে। সব স-অ-ব ভুলে মেরে দিল রাজা। আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছে। তার পর? তার পর আর কী। ধেই ধেই করে নাচতে লেগে গেছে। 
কত বড় বিপদ কেটে গেছে তার। ছেলেটার বিয়েও হয়ে যাচ্ছে। 
তার চেয়েও বড় কথা আছে একটা। অমন ফুটফুটে একটা মেয়ে আসছে তার ঘর আলো করে। আনন্দ হবে না? আনন্দে বুক ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে রাজামশাইর।

Post a Comment

0 Comments