পর্ব -১৬
সৌমেন রায়
চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি
কার নাম দুন্দুভি , কারে কয় অরণি
শিক্ষাক্ষেত্রের যাবতীয় ব্যর্থতার দায় শিক্ষকের উপর ফেলে হাত ধুয়ে ফেলাই রীতি। কিন্তু তার সমস্যাটাও শোনা দরকার। আমাদের দেশে তো অপরাধীরও কথা শোনার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু শিক্ষকের কথা কেউ শুনতে চায় না। দেখা যাক শিক্ষকের পাঠদান সংক্রান্ত সমস্যাগুলি কি? আগামী তিনটি পর্বে থাকছে সেই আলোচনা।
প্রধান সমস্যা হল ছাত্র-ছাত্রীদের পূর্বজ্ঞানের অভাব। ছাত্র-ছাত্রীরা যে শ্রেণীতে পড়ছে তার উপযুক্ত জ্ঞান সে সংগ্রহ করে উঠতে পারেনি। কেন পারেনি প্রবন্ধ গুচ্ছ গুলির উদ্দেশ্যটাই এই কেনো’র খোঁজ। আগের পর্বগুলিতে কিছুটা বোঝা গেছে নিশ্চয়। পূর্বজ্ঞান কিভাবে শিক্ষাকে ব্যাহত করে উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। এক উৎসাহী বিজ্ঞান শিক্ষক নিচু ক্লাসে গণিত পড়ান ।তিনি একবার পরিসীমা,ক্ষেত্রফল অধ্যায় ভালো করে বোঝালেন, হাতে ধরে অঙ্ক করালেন দুদিন ধরে। তারপর তৃতীয় দিন একটি সহজ সমস্যার সমাধান দিলেন। কিছু ছাত্র-ছাত্রী সেই সমাধানের শেষ ধাপে এসে পৌঁছাল। কিন্তু তারপর আটকে গেল। কারণ সে কাটাকাটি করতে জানে না, নামতা মুখস্ত নেই। নবম শ্রেণীতে গিয়ে দেখা যায় প্রতিবছর কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী নতুন করে ভৌত বিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের কাঙ্খিত পূর্বজ্ঞান নেই। সামান্য চিহ্ন সংকেত জানেনা। নবম শ্রেণীতে আবার সবকিছু হাতে ধরে শেখানো সম্ভব নয়। খুব বেশি হলে দু একটা বাড়তি ক্লাস করা যায়। কিন্তু দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক ঘাটতি দু-এক দিনে পূরণ হয় না। এই সমস্ত ছেলেরা কিছুদিন চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দেয়।শুধু বিজ্ঞান বা গণিত নয় ইংরেজি সহ সব বিষয়ের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি। বাংলা, ইতিহাস, ভূগোলে হয়ত এই ধরনের পূর্ব জ্ঞান কম দরকার । কিন্তু শ্রেণীভিত্তিক পরিণমন স্তরটি তৈরি না হলে পরের শ্রেণীতে পড়ানো মুশকিল হয়। এক স্কুলে এক ভূগোল শিক্ষকের পোস্ট খালি হয়েছে। পোস্টটি প্যারা টিচারের। সুতরাং তা আর পূরণ হবে না সরকারি নিয়মে। অন্য একজন আছেন উঁচু ক্লাসের জন্য। আলোচনা হচ্ছে নিচু ক্লাসে কারা বিষয়টিকে পড়াবেন। এক গণিত শিক্ষক ঘরোয়া কথায় বললেন, ‘আমি পড়াবো ‘। অনেকে নিজের ক্লাসটাই কষ্ট করে নেয়। তা ইনি ---! খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন। বলছেন ক্লাসে যখন পড়াই মনে হয় ভূতের মত নিজেই নিজেকে পড়াচ্ছি। ভূগোল হলে দু’চারটে গল্প অন্তত করা যাবে। এই না - জানা ছেলে মেয়েরা ক্লাসে বসে অনর্থক সময় ব্যয় করে। এই বয়সের একটা ছেলে ৪-৫ ঘন্টা শুধু শুধু বসে থাকতে পারে না। তারা ক্লাসে ব্যক্তিগত ‘পাঠক্রম’ এর গ্রুপ স্টাডি করে। গোলমালের সংক্রমণ ঘটে। ক্লাসটা ক্রমশ অকার্যকর হয়ে ওঠে। দশম শ্রেণীর ভগেন কে একবার জিজ্ঞেস করা গেল, ‘মন দিয়ে তো শুনিস। কিন্তু লিখতে পারিস না কেন? বুঝিস কিছু?’ স্যার, বুঝতে পারিনা ।চেষ্টা করি, বসে থাকি। চেষ্টা করেও বুঝতে পারে না, কেন না শুরুই করেছে অনেক পরে। আবার বলি ধারাবাহিক শিক্ষার ঘাটতি দু-একদিনের পূরণ করা যায় না। শৈশবে ভগেনদের খানিক পরিবেশ দিয়ে,খানিক ধরে বেঁধে পড়ানোর দরকার ছিল।কিন্তু কাজটি আমরা কেউ করে উঠতে পারিনি।এই সমস্যাটি যদি তুলে ধরেন সরকারী দপ্তর, শিক্ষাবিদ সবাই শিক্ষকের উপর দোষ চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেন। বলেন এটাই তো শিক্ষকের চ্যালেঞ্জ। ক্লাসে বিভিন্ন মানের ছেলে মেয়ে থাকবে তাদের নিয়ে চলাই তো ভালো শিক্ষকের গুণ। কথাটা সত্য। সবাই এক মানের তো হবে না। সবাইকে নিয়ে ক্লাস করতে হয়। এগিয়ে থাকা ও পিছিয়ে পড়া সবাই যেন তার জ্ঞান ক্ষুধার কিছুটা পরিতৃপ্তি ক্লাসের মধ্যে পায় সেদিকটা দেখতে হয়। তার জন্য শিক্ষকের বাড়তি খেয়াল রাখা উচিত। কিন্তু সেভেন এইটের ছেলে মেয়েরা নামতা না জানলে, অক্ষর না চিনলে তাদের সঙ্গে প্রথম দিকের ছেলেমেয়েদের আকাশ পাতাল তফাৎ হয়ে যায়। এই দুই শ্রেণীর স্টুডেন্ট নিয়ে কিভাবে ক্লাস করা যাবে? জাদু দন্ড ছাড়া কি কিছু করা সম্ভব? কেউ উত্তর দেবেন না, কারণ উত্তর নেই। তাহলে শিক্ষক কি করেন? তিনি এই না পারা অংশটাকে ভুলিয়ে, ধমকে চুপ রাখেন। পড়ান ক্লাসের একটা খুব ক্ষুদ্র অংশকে। বাকিদের কানে কিছু শব্দ ঢোকে। ওরা সেটাকেই পড়া ভাবে। পরীক্ষার খাতায় ঐ সকল শব্দ সমাহারের অনর্থক প্রয়োগ দেখে সেটা বোঝা যায়।
এখানেই অনেকে পাস ফেলের কথা বলেন। বলেন পাশ ফেল উঠে যাওয়াতেই নাকি এমন সমস্যা। কিছু না শিখে উঠে যাচ্ছে পরের ক্লাসে। কথাটা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। পাশ ফেল থাকলেই সমস্যার সমাধান হত এমন নয়। ফেল করা ছেলেমেয়ে গুলি স্কুলছুট হয়ে যেত। তাতে সমাজের আরো ক্ষতি হত। কারণ স্কুল না এলে তাদের বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেত। তবে ভেতরে আরো কথা আছে। পাসফেল তো মাত্র কয়েক বছর উঠেছে। আগে কি তাহলে সবাই উপযুক্ত মানের ক্লাসে পড়তো, মানে পূর্ব জ্ঞান নিয়ে ক্লাসে বসত। মোটেও না। তখনও না জানা ছেলে মেয়েরা পাশ করত। তখন পাস করাতে হত ক্লাস রুমে বেঞ্চের সংখ্যা দেখে। ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যাক। প্রকৃতপক্ষে প্রতি শ্রেণিতে গড়ে পাস করে কুড়ি থেকে ত্রিশ শতাংশ ছেলে মেয়ে।স্কুল বিশেষে সামান্য ইতর বিশেষ হতে পারে ( কিছু বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে হিসাবের বাইরে রাখছি)। কিন্তু অতজনকে ফেল করালে অনেক দিক দিয়ে অসুবিধা। বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে আসতে পারে। তাই আরো কিছু পাস করাতে হয়। সে সংখ্যাটা কত তা নির্ধারিত হয় কোন ক্লাসরুমে কতগুলি বেঞ্চ আছে তা দেখে। যেমন ধরুন দেখা হবে এইট থেকে নাইনে কতজন তুলে দিলে রুমে বসা যাবে। আবার সেভেন থেকে পাশ করে এইট ভরবে কিনা সেটাও দেখতে হত ।এইসব দেখতে গিয়ে কখনো কখনো পনের শতাংশ নম্বর পাওয়া ছেলেমেয়েদেরও প্রমোশন দিতে হতো। অনেকেই ব্যাপারটাকে ঠাট্টা করে বেঞ্চ সহ পাশ বলতেন। বুঝতেই পারা যাচ্ছে পাশ ফেল ফিরিয়ে আনলেও সমস্যার সমাধান হবে না । তবে হ্যাঁ একটা ভয় থাকবে যে পড়তে হবে, না পড়লে ফেল করে যাব। সরকারিভাবে পাশ ফেল উঠে যাওয়ায় এখন সেই ভয়টা আর নেই। ভাবটা এমন পড়লেও হয় না পড়লেও হয়। তাহলে না পড়াই ভালো,কারণ কষ্ট কম।
শহরাঞ্চলের সমস্যা একটু ভিন্ন। সেখানে পূর্ব জ্ঞান থাকা ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা একটু বেশি। তবে না থাকা নেই এমন ভাববেন না। যথেষ্ট সংখ্যাতেই আছে। পূর্বজ্ঞান না থাকা ছাত্র ছাত্রীরা গ্রামাঞ্চলে ছাত্র-ছাত্রীদের মতোই গোলমাল করে। এই গোলমাল করা ছেলেদের সঙ্গে যোগ দেয় পড়াশোনা করতে পারা ছেলেমেয়েরা। তার কারণটা আগেই আলোচনা হয়েছে। তারা টিউশনে পড়ে, স্কুলে আসে মনোরঞ্জন করতে। টিউশনে পয়সা দিয়ে পড়ে তাই সময় নষ্ট করে না। স্কুল তো মাগনার ধন। লে পচা কোমর নাচা। এক একটি টিউশনে শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী পড়ে। বইয়ের লেখা বিষয় আবার নোট আকারে লেখায়। বিস্তারিত আগেই লেখা হয়েছে। এই সমস্ত সাপ্লিমেন্ট খেতে খেতে এখন এমন অবস্থা যে এই শহরেই শুনতে পাই এমবিবিএস এর জন্য টিউশন পড়ছে। এরপর চিকিৎসা করার টিউশনও হতে পারে। অ্যাপও বেরিয়ে যেতে পারে। এদের দোষ দিয়ে খুব একটা লাভ নেই। এরা প্রবল চাপে থাকে। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চাপ। বাড়ি এবং টিউশনের মারাত্মক নজরদারি। ক্রমাগত পরীক্ষা।অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চাপ। সেই সব কথা বিশদে অন্য কোন পর্বে হবে। সেই সমস্ত অবসাদ এরা উগরে দেয় স্কুলে এসে। এই সমস্ত বাঁধা গরুরা ছাড়া পেলে কি হয় তা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গুলিতে গেলে ভালো বোঝা যায়।
শহরাঞ্চলে যে সমস্ত শিক্ষকরা পড়াতে চান তারাও সর্বমুখী চাপে বীতশ্রদ্ধ। কারণ ছেলে মেয়েরাই স্কুলে পড়তে চায় না। গ্রাম থেকে শহরের ট্রান্সফার নেওয়া এক নবীন শিক্ষক বলছেন , ‘স্যার এখানের বদমাইশিটা মনে গিয়ে বেঁধে, গেঁথে যায়। এরা তো আমাদের শিক্ষক বলেই মনে করে না। গ্রামে তো পড়তে পারতো না তাই বদমাইশি করত। বড় ভুল করেছি ট্রান্সফার নিয়ে’। এই সমস্ত শিক্ষকরা কি করেন? এরা কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে যান কিভাবে স্কুলের কথা না ভেবে ছেলে মানুষ করা, ঘরবাড়ি তৈরি করা ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করতে হয়।কিভাবে শেয়ার কেনাবেচা করতে হয়,জায়গা জমিতে ইনভেস্ট করতে হয়। স্কুলে এরা ‘ কার নাম দুন্দুভি ,কারে কয় অরনি ? /বলবে কি! তোমরা তো আমার কাছে টিউশন পড়োনি।‘ গোছের প্রশ্ন করে ছেলেমেয়েদের ওপর প্রতিশোধ নেন।
6 Comments
আজকের পর্বে সৌমেন আলোচনা করছেন যে বিষয়টি নিয়ে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক পড়াচ্ছেন, ধরে নিলাম বোঝাচ্ছেন প্রাণপাত করে কিন্তু ওপার থেকে সাড়া পাচ্ছেন না। এমন অবস্থা আগ্রহী শিক্ষকদেরও ধীরে ধীরে অনাগ্রহী করে তোলে,পরান্মুখ করে নিজেদের কর্তব্য পালনে। এমন অবস্থার দরুন গোটা ব্যবস্থাপনাই একসময় পঙ্গু হয়ে যায়। এখানে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে পারি। মনে রাখবেন শিক্ষকদের প্রতিদিন সামনে বসা মানবদের মনোরঞ্জনের আয়োজন করতে হয়। প্রতিদিনের পরিবেশনে কি একটু একটু করে নতুন ধাঁচের সংযোজন ঘটানো যায়? আসলে ওদের চাগিয়ে রাখতে হবে। ভিত মজবুত না হলে ভিতরে কিছু জমা করা কঠিন তাই একটু পিছিয়ে
ReplyDeleteথেকে শুরু হোক লড়াই। খাটতে হবে। তবে বিশ্বাস করি একদিন একটা আকাশছোঁয়া ইমারত গড়তে বেগ পেতে হবেনা। মনোরঞ্জক কীভাবে মনোহরক হয়ে উঠবে তা স্বপ্নেও বুঝে উঠতে পারবেন না। কথা চলুক।মন্থন হোক। নিজের কথা নিয়ে নিজেকেই সরব হতে হবে।
ReplyDeleteপ্রতিটি লেখা আপনি মনোযোগ সহকারে পড়ছেন সেজন্য ধন্যবাদ। এত অন্ধকারের মধ্যেও আপনি আশার আলো দেখছেন এটাই সবচেয়ে বড় আশার কথা।বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা তো জারি আছে। উল্টো দিক থেকেও সাড়া তো অবশ্যই মেলে। না হলে তো ব্যবস্থাটাই ধ্বংস হয়ে যেত। সেসব কথা আসবে নিশ্চয়ই ।আগে দুঃখের কথাগুলো শেষ হোক।
ReplyDeleteদুঃখ কিসে যায়
ReplyDeleteমাস্টার যদি বইয়ের বাইরে
বাহির হয়।
শেখানেও অশেষ দুঃখ দাদা। আগের পর্বতেই তার দু একটা কথা বলেছি। পদে পদে অনুভব করি নাটক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময়।মোটিভেট করতে করতে করতে নিজেই ডি মোটিভেটেড হয়ে যাই।
ReplyDeleteআপনার বক্তব্য ঠিক ।অন্তত শ্রেণীকক্ষের মধ্যের অবস্থা থেকে ভালো।
প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা আদি কাল থেকেই অবহেলিত থেকে গেছে। তার খেসারত দিতে হয়েছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিকে। বুনিয়াদি শিক্ষাকে নিয়ে হয়ত ইদানিং কিছু অন্যরকম ভাবনা ও উৎসাহী কিছু মানুষের উদ্যোগ গড়ে উঠেছে। কিন্তু তা সার্বিক ভাবে সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট নয়।
ReplyDelete