মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১২৩
সুশীল কুমার বর্মণ (অধ্যাপক, গবেষক, প্রবন্ধকার, ঝাড়গ্রাম)
ভাস্করব্রত পতি
কথায় বলে, 'বানিজ্যে বসতে লক্ষ্মী'! তিনি নিজে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন এবং এম ফিল পেয়েছেন। কিন্তু বানিজ্য বিষয় তাঁর কাছে অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি মাত্র। শিক্ষাদানের সাবজেক্ট। কিন্তু এসবের বাইরে গিয়ে তাঁর কাজে প্রাধান্য পায় মেদিনীপুরের সংস্কৃতি, ইতিহাস, সভ্যতা, স্থাপত্য, জনজাতি এবং সাহিত্য।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং ব্লকের নোনামাধবচক গ্রামে ১৯৬০ এর ১৯ শে জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেনকরেন সুশীল কুমার বর্মন। প্রাথমিক স্তরে প্রথাগত শিক্ষার জন্য যেতে হয়েছিল নোনামধবচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর বিষ্ণুপুর ইউনয়ন হাইস্কুল হয়ে ইজমালিচক ময়না যোগদা সৎসঙ্গ ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ এ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭৮ এ কাঁথি প্রভাতকুমার কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ তে বি কম (অনার্স) ডিগ্রি প্রাপ্ত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ এম কম করার পর এই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৯৭ এ এম ফিল উপাধি লাভ করেন।
ডুলুং কবিতা উৎসবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে সুশীল কুমার বর্মনকে
প্রথমে ১৯৮৪ - ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত একব্বরপুর জে এন পাঁজা শিক্ষানিকেতনে শিক্ষকতায় যোগ দেন। জীবনের প্রথম চাকরি। সেখান থেকে উত্তরণ ঘটে তাঁর। ১৯৮৭ - ২০১৭ পর্যন্ত কলকাতার গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্স অ্যাণ্ড বিজিনেস এডমিনিস্ট্রেশনে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে আসীন ছিলেন। এরপর ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ এবং পুরুলিয়া গভর্ণমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদে অধ্যাপনা করেন। গত ২০১৭ থেকে বর্তমানে রানী ইন্দিরা দেবী সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত।
পুরুলিয়া শহরের সাধুডাঙার মাহালি বস্তিতে খেলাইচণ্ডী নামে যে মূর্তিটি পূজিত হয় সেটি আসলে একটি দেবমূর্তি। মূর্তিটি জৈন ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর আদিনাথ বা ঋষভনাথের। প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতার প্রস্তর নির্মিত ঋষভনাথকেই মাহালিরা লোকায়ত দেবী খেলাইচণ্ডী জ্ঞানে পুজো করেন। প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান পূর্ণাবয়ব দিগম্বর ঋষভনাথ মূর্তি উত্তমরূপে তেল সিঁদুরে প্রলিপ্ত। পাদবেদিতে খোদিত যণ্ড। পুরুষাঙ্গ ছেদিত। সেই মূর্তি দেখেই বাঙলায় জৈন ধর্মের অবশেষ বিষয়ে কৌতুহলী হয়ে ওঠেন। এছাড়া ঝাড়গ্রামের উড়লিডাঙা গ্রামে ধন্বন্তরী দেবী নামে যে মূর্তি পুজো করা হয় সেটি আসলে জৈন ধর্মের ত্রয়োবিংশতিতম তীর্থঙ্কর ভগবান পার্শ্বনাথের। তাঁর চোখে ধরা পড়ে এই রহস্য। এরপর ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নানা স্থানে দেখা পেয়েছেন জৈন দেউল, তীর্থঙ্কর ও যক্ষ যক্ষিণীর মূর্তি। পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া গিয়েও খুঁজে পেয়েছেন বেশ কয়েকটি জৈন দেউল, অসংখ্য তীর্থঙ্কর ও জৈন যক্ষ যক্ষিণীর মূর্তি। সেসব একত্রিত করেই প্রাচীন বাঙলায় বিশেষত রাঢ়বাঙলায় প্রবল প্রভাব বিস্তারকারী জৈন ধর্মের অপরিমেয় অবশেষ নিয়ে তৈরি করলেন অসাধারণ একটি বই -- 'রাঢ়বাঙলায় জৈন অবশেষ'।
তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে জেলা এবং রাজ্যের উল্লেখযোগ্য পত্র পত্রিকায়। আনন্দবাজার পত্রিকার জেলার পাতা, ভূমধ্যসাগর, তথ্যকেন্দ্র, এবং সায়ক, সংহতি, অভিযাত্রী, তীতীর্ষু, মেঘের বাড়ি, কন্দমূল, গ্রামীণ পুঁথি, ঋভাষ, দীপ্রকলম, সবুজ কথা, সাহিত্যের আড্ডা, ভাঙন ও অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। উজ্জ্বল করেছেন মেদিনীপুরের ঐতিহ্য। তাঁর গবেষণাঋদ্ধ বিভিন্ন বই আলোকিত করেছে মেদিনীপুরের মাটি। সম্পাদনা করেছেন সুধৃতি পত্রিকা। এছাড়াও পৃশ্নি (কবি বার্ণিক রায়ের সঙ্গে), ঋতিছন্দ (কল্যাণী ঘোষের সঙ্গে) সম্পাদনা করেছেন। সেইসাথে শুকতারা সহ অন্যান্য অনেক পত্রিকাতেও লিখেছেন গল্প এবং ভ্রমণকাহিনী।
রাঢ়বাঙলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি লক্ষ্য করেছিলেন অধিকাংশ জনপ্রিয় দেবস্থান বা ঠাকুরথানে পূজারি হিসেবে রয়েছেন অব্রাহ্মণ পুরোহিত। কোথাও রয়েছেন লোধা শবর পুরোহিত, কোথাও বা বাগদি, কোথাও বাউরি, কোথাও লোহার, কোথাও জেলে কৈবর্ত, তো আবার কোনও থানে রয়েছেন কুড়মি পুরোহিত। কোনও কোনও থানে রয়েছেন একই সঙ্গে শবর ও ব্রাহ্মণ পূজারি উভয়েই। আবার কোন থানে পুরোহিতই নেই। ভক্তরাই সেখানে পুরোহিত।
সবাই জানতো যে দেবস্থানে পূজারি বা পুরোহিত হবেন ব্রাহ্মণ। কিন্তু ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও যে দেবস্থানের পুরোহিত হতে পারেন তা ছিল অজ্ঞাত। বেশিরভাগ লোকজনই অব্রাহ্মণ পুরোহিত বিষয়টি জানতো না। এই অব্রাহ্মণ পূজিত ঠাকুরথানগুলিতে কেবল এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ পুজো দেন, তা কিন্তু নয়। এই থানগুলিতে অব্রাহ্মণ পূজারির মাধ্যমে দেবতাকে অর্ঘ্য প্রদান করেন ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ, অ আদিবাসী, আদিবাসী সকল সম্প্রদায়ের মানুষ। এই পুরোহিতদের জানা নেই কোন মন্ত্র, জানা নেই শাস্ত্রীয় নিয়মবিধি। যুগ যুগ ধরে পালন করে আসা নিজেদের রীতি নিয়মে এঁরা দেবতার স্তুতি করেন, নিজেদের ভাষায় দেবতাকে আহ্বান করেন, নিজেদের ভাষায় যজমান ও ভক্তের আপদ বিপদের কথা, আশা আকাঙ্ক্ষার কথা দেবতাকে নিবেদন করেন। এই থানগুলি নিয়েই তিনি লাগাতর ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে পাঠককূলকে উপহার দিলেন 'অব্রাহ্মণ পুরোহিত' বইটি।
সুশীল কুমার বর্মনের এ পর্যন্ত প্রকাশিত প্রবন্ধের বইয়ের সংখ্যা ৬ টি। সেগুলি হল মেঘবিলাসী (২০১৪) মেইনস্ট্রিম পাবলিকেশন, ভূতরঙ্গ (২০১৭) মেইনস্ট্রিম পাবলিকেশন, ঝাড়গ্রাম জেলা প্রত্ন পরিক্রমা (যৌথ রচনা, ২০২০), উপ্তবেলার সুপ্তকথা (সম্পাদনা, ২০২০), রাঢ়বাঙলায় জৈন অবশেষ- সম্পাদনা, ২০২২) এবং অব্রাহ্মণ পুরোহিত (২০২৩)।
সম্প্রতি ঝাড়গ্রামের ডুলুং কবিতা উৎসবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে সুশীল কুমার বর্মনকে। এই ঝাড়গ্রামের পূর্ব পুকুরিয়া গ্রামে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন 'চুনী কোটাল পাঠশালা'। এখানে প্রতিদিন সকালে দু’ ঘন্টা লোধা শিশু, কিশোর কিশোরীদের শিক্ষাদান এবং অন্যান্য সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁর সাথে যুক্ত হয়েছেন রাণী ইন্দিরা দেবী সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শিক্ষক এবং অন্য কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী। আসলে কাজের মধ্যেই থাকতে ভালোবাসেন তিনি। তাঁর কাজ হল নিবিড় পর্যবেক্ষণ। যা ঋদ্ধ করেছে সমগ্র মেদিনীপুর জেলাকে। নীরবে কাজ করে চলেছেন প্রান্তিক এলাকার মানুষ জনের সাথে।
0 Comments