পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড . আলফাজউদ্দিন থানডার, আমার সেই সুহৃদ যিনি মেদিনীপুরে আমাকে বাসস্থান খুঁজে দেন
শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬৭
সালেহা খাতুন
মেদিনীপুর কলেজ প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় দিন এসে, জয়েন করার পর প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, “আমাদের বাংলা বিভাগে এক বিখ্যাত সাহিত্যিক পড়ান। তুমি তাঁকে চেনো কিনা দেখো”। বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক অশোক ভট্টাচার্যকে ডেকে পাঠালেন। অত্যন্ত সুশীল,ভদ্র এবং নম্র মানুষ তিনি। স্যার আমাকে সঙ্গে করে স্টাফরুমে নিয়ে এলেন। সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। তখন একটাই স্টাফরুম। সব বিভাগের অধ্যাপকরা এক সঙ্গে বসেন। আন্তরিক সজ্জন সব মানুষজনের দেখা পেলাম। সেদিনই নিয়ে গেলেন কলেজের লাইব্রেরিতে। কৌতূহলী হয়ে অশোকবাবুকেই জিজ্ঞেস করলাম, স্যার বাংলা বিভাগের অধ্যাপকদের সবার নামই তো জানলাম ; বিখ্যাত সাহিত্যিক তাহলে কে? বিনয়ের সঙ্গে বললেন না না তেমন কিছু নয়, আমিই লিখি বীতশোক ভট্টাচার্য নামে। কর্মজগতে প্রবেশের আগেই যথারীতি তাঁর কবিতা আমার পড়া ছিল এবং “জেন গল্প” নিজস্ব সংগ্রহে ছিল।
ছোট্ট সুন্দর একটি কাগজে আমাকে রুটিন দিলেন। তিনি প্রথম দিনেই আমাকে তৃতীয় বর্ষের একটি ক্লাসে পাঠালেন। সেদিন মেদিনীপুর কলেজে আমার প্রথম ছাত্ররূপে আমি পেয়েছিলাম ভাগবত শীটকে। ও এখন একটি স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। চলতে ফিরতে আমাকে নানান প্রশ্ন করে ভাগবত অনেক বেশি পড়িয়ে নিত। বার বার বলতো, “ম্যাডাম, বিদ্যাসাগর আর তাঁর মা ভগবতী দেবীর কথা সবাই বলেন কিন্তু তাঁর স্ত্রী দীনময়ী দেবীর কথা লোকে প্রায় বলেই না। এর কারণ কী?”
প্রথম ক্লাস নিয়েছিলাম গ্যালারি হলে। যেটির বর্তমান পরিচয় এখন সেমিনার হল। কলেজের হাল হকিকত সব বুঝিয়ে দিলেন স্যার। বীতশোকবাবু কলিগ হলেও তাঁকে স্যারই বলি। বাংলা বিভাগের তখনকার অধ্যাপকদের কাকে কী সম্বোধন করবো, বলে দিলেন অধ্যাপক শ্রুতিনাথ চক্রবর্তী। তাঁকে স্যার বলতে তিনি বললেন, “এই না না তুমি শ্রুতিনাথদা বলো। শুধু অশোকবাবু/বীতশোকবাবুকেই স্যার বলো”। শ্রুতিনাথবাবুকে কলিগ হিসেবে মাত্র তিনমাস পাই। সেপ্টেম্বর মাসেই তিনি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। যাক মুগবেড়িয়া কলেজে যাঁর পোস্টে জয়েন করতে গিয়ে ফিরে আসি, মেদিনীপুর কলেজে তাঁকে ধরে ফেললাম। পৃথিবী সত্যিই গোল। বিভাগের আর দুই অধ্যাপককে সুস্নাতদা, মাধবীদি বলি। বিভাগে আমি তখন কনিষ্ঠ সদস্য। সবার আদর স্নেহ যথেষ্ট পেয়েছি।
কর্মক্ষেত্রে কীভাবে চলবো প্রথম দিনেই স্যার আমায় পুরোটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় কর্তৃপক্ষের কুনজরে পড়ে প্রাণিবিদ্যা এবং সংস্কৃতের দুই অধ্যাপক কতটা বিপর্যস্ত হয়েছিলেন সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল করেন। পরের দিনের টিচার্স কাউন্সিলের মিটিংয়ে থাকতে বারণ করেন। ফলে এখন যেমন টিচার্স কাউন্সিলে নতুন অধ্যাপক এলে তাঁকে স্বাগত জানানো হয় পুষ্পস্তবক সহযোগে, আমার কোনোদিন তা পাওয়া হয় নি।
পুষ্প না জুটুক কণ্টকাকীর্ণ আর হতে চাই না। গার্লস হোস্টেলে জুলাই মাসটা কাটিয়ে দিলাম। বীতশোকবাবু বললেন, “আমি একান্নবর্তী পরিবারে থাকি; সেখানে তোমার থাকার ব্যবস্থা করতে পারছি না। এজন্য আমি অত্যন্ত লজ্জিত।তবে আমাদের কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগে এক নতুন অধ্যাপক জয়েন করেছেন কয়েক মাস আগে। ড. আলফাজউদ্দিন থানডার। ওঁর সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। তোমার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।”
🍂
আরও পড়ুন 👇
আলফাজদা ও তাঁর স্ত্রী রেশমী মির্জাবাজারে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। কাছাকাছি আর একটি বাড়িতে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানে সপরিবারে থাকতেন ভট্টর কলেজ, দাঁতনের অর্থনীতির অধ্যাপক ড.আব্দুর রহিম। ফলে আমাদের তিনটি পরিবারের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। রহিমদা প্রকৃত অর্থে আমার অভিভাবক হয়ে যান। বন্ধ কানোরিয়া তখন চালু হয়ে গেছে। সালাউদ্দিন ফুলেশ্বরে আর আমি মেদিনীপুরে একাই থাকি। সপ্তাহে একদিন আমাদের দেখা হয়।
সেপ্টেম্বরের কুড়ি তারিখ রহিমদা আমাকে নিয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. লায়েক আলি খান মহাশয়ের সঙ্গে আলাপ করাতে। একই পাড়ায় যেহেতু আমরা থাকি, তাই এক সন্ধেতে স্যারের বাড়িতেই নিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য আমার পিএইচ.ডি-র গবেষণা শুরু করানো। অনেক গল্পগাছা হলো। লায়েকবাবু উপহার দিলেন তাঁর ‘বন্দীর বন্দনা ও কবি বুদ্ধদেব’ গ্রন্থটি।
চাকরিতে জয়েন করার পর প্রথম তিনমাস কোনো ছুটি নিতে পারলাম না। ফলে বোনের বিয়ের পাকাকথার দিন উপস্থিত থাকতে পারলাম না। তৎকালীন টিচার-ইন-চার্জ অধ্যাপক ড. পূর্ণেন্দু কুমার ঘোষ নিজেকে ল অ্যাবাইডিং ম্যান বলে পরিচয় দিতেন সব সময়। অতএব তিনি নিয়ম ভেঙে একটি দিনেরও সি এল আমাকে দিলেন না।
এদিকে মেদিনীপুর কলেজে তখনও নিয়মিত ক্লাস টেস্ট, হাফ ইয়ারলি, অ্যানুয়াল বিভিন্ন পরীক্ষা চলতো। জয়েন করার কয়েকদিনের মধ্যেই বিভাগ থেকে আমার রিকশায় প্রায় সাড়ে ছশো অ্যাডিশনাল বেঙ্গলীর খাতা চাপিয়ে দেওয়া হলো। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোলার সেকশনের সঙ্গে টেলিফোনিক কনভারসেশনের মাধ্যমে টিচার-ইন-চার্জ আমাকে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিলেন। উপহার জুটলো পাহাড় পরিমাণ উত্তরপত্র। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইভালুয়েট করে দিতে হবে।
বীতশোকবাবুর কাছ থেকে অনেক প্রাপ্তির একটি নিদর্শন
আংশিক সময়ের অধ্যাপক থাকাকালীনও অনেক উত্তরপত্র মূল্যায়নের ভার নিতে হয়েছে। হেড এক্সামিনারের বাড়ি থেকে উত্তরপত্র আনা আর পৌঁছে দেওয়া নিয়ে কত গল্প যে লিখে ফেলা যায়! উত্তরপত্ররা আমার সঙ্গে সঙ্গেই যে কত ট্রেন বাস নৌকা রিকশা চড়েছে গুণে শেষ করা যাবে না। শিয়ালদহ থেকে শ্যামনগর, শ্যামনগর থেকে রামরাজাতলা, ফুলেশ্বর থেকে চেতলা, সাহাপুর থেকে শিবপুর ইত্যাদি।
চেতলায় অধ্যাপক গৌরী পুরকায়স্থ ম্যাডামের বাড়ি খাতা পৌঁছে দিতে গিয়ে শুনি তিনি এম.এ.পড়াকালীন আমারই এক সহাধ্যায়ীর মা। তিনিই খবর দিলেন আমাদের শান্তিপুরের বন্ধু উদয়ের অকাল মৃত্যুর।“বাংলা ছোটগল্প প্রসঙ্গ ও প্রকরণ” এর লেখক বীরেন্দ্র দত্তকেও হেড এক্সামিনার রূপে পেয়েছি।
অজস্র হেড এক্সামিনারের সঙ্গে কাজ করেছি। শিখেছি অনেককিছু। পরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পট ইভালুয়েশনে গিয়ে আলাপ হয়েছে অজস্র মানুষের সাথে। পাঁশকুড়া বনমালী কলেজের অপুদার কাছ থেকে শিখেছি সুন্দর করে কেজিং করতে। খড়্গপুর কলেজের রনজিৎবাবু একবার সরাসরি আলাপ হতে আমাকে বললেন, “আপনাকে মনে রেখেছি একটি কারণে, যে আপনার খাতায় আমি একটিও যোগে ভুল পাই নি”। প্রশংসা পেতে কার না ভালো লাগে। অবশ্য সে প্রশংসা সৎ হওয়া প্রয়োজন। সৎ প্রশংসা কাজে উৎসাহ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।
0 Comments