দ্বিতীয় রিপু
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
পরম রমণীয় এক কাননমধ্যে কাকচক্ষু এক সরোবরে স্নানরত সুন্দরী তরুণীদল পরিধেয় বস্ত্রগুলো নদীতীরে রেখে সহাস্য জলক্রীড়ায় মগ্ন। দেবতার কৌতুকে বস্ত্রগুলো উড়ে স্থানচ্যুত হয়ে গেল এবং সেখান থেকেই এই কাহিনীর শুরু!
নগ্ন দেহে জল থেকে উঠে এসে কন্যারা হাতের কাছে যে যা বস্ত্র পেলেন পরিধান করলেন। শর্মিষ্ঠা লক্ষ্য না করেই পরে ফেললেন দেবযানীর বস্ত্র। দেবযানী ক্রোধান্বিতা হয়ে বললেন, আমি গুরুকন্যা। আমার বস্ত্র পরিধান করতে তোমার সাহস হয় কিরূপে?
আমার পিতা যখন বিশ্রামে রত থাকেন, তখন নিম্নাসনে বসে তাঁর স্তুতি করেন তোমার পিতা। আমার পিতার অনুগ্রহেই তাঁর জীবিকানির্বাহ হয়। এত ভয় তোমাকে আমি করি না!
উভয়ের কলহের ক্রোধানল এত ব্যাপক আকার ধারণ করল যে কুপিতা শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে সম্মুখস্থ কূপে নিক্ষেপ করলেন এবং দৃকপাতমাত্র না করে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। দেবযানী কূপমধ্যে পড়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। এই সময়ে মৃগয়াবিহারী রাজা যযাতি পানীয় জলের সন্ধানে কূপের নিকট উপস্থিত হলেন। দেবযানীর আর্তি শুনতে পেয়ে কূপের ভেতরে লক্ষ্য করে তিনি অগ্নিবর্ণা পরমাসুন্দরী এক তরুণীকে দেখতে পেয়ে বিস্মিত হলেন। তারপর তরুণীর অনুমতিসাপেক্ষে তাঁর দক্ষিণ পাণি ধরে তাঁকে কূপ থেকে উত্তোলন করলেন।
হে ভদ্রে, আপনার পরিচয় কী?
আমি দেবযানী, মহর্ষি শুক্রাচার্য্যের কন্যা।
যযাতি নিজের পরিচয় প্রদান করে বললেন, তিনি নহুষপুত্র রাজা যযাতি এবং পরস্পর কিছু কথোপকথনের পর তিনি রাজপুরীর দিকে যাত্রা করলেন। দেবযানী আর গৃহে ফিরে গেলেন না, সেখানেই বসে বসে ক্রন্দন করতে লাগলেন। কন্যার অন্বেষণ করতে করতে শুক্রাচার্য্য বনের মধ্যে উপস্থিত হলেন এবং কন্যার সকল কথা শ্রবণ করে বললেন,
হয়তো কখনও কোনও অন্যায় কর্ম করেছ কন্যা, তাই এই শাস্তি!
দেবযানী একথা অস্বীকার করে আরও বিপুল বেগে ক্রন্দন করতে লাগলেন। পিতা বললেন,
কন্যা, যে ব্যক্তি উদ্রিক্ত ক্রোধানলে ক্ষমাবারি সেচন করতে পারেন, এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগতে তাঁরই জয় হয়। ক্ষমা কর।
কিন্তু দেবযানী কিছুতেই শান্ত হতে পারলেন না, তিনি শর্মিষ্ঠার বিষয়ে পিতার কাছে নানাবিধ অনুযোগ করতে লাগলেন এবং বললেন যে তিনি কিছুতেই রাজা বৃষপর্বার রাজ্যে আর বাস করবেন না। শর্মিষ্ঠার প্রতি দেবযানীর অপরিমেয় ঈর্ষা! অগত্যা নিরুপায় পিতা রাজা বৃষপর্বাকে গিয়ে বললেন,
তোমার কন্যা শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে যেরূপ অপমান করেছে, তাতে এখানে থাকবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমাদের। আজই এই রাজ্য ত্যাগ করে চলে যাব অন্য কোথাও!
বৃষপর্বা দুঃখিত হয়ে শুক্রাচার্য্যের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। তিনি সাড়া দিলেন না। অতঃপর দেবযানীর কাছে গিয়ে রাজা করজোড়ে বললেন, হে চারুহাসিনী, তুমি শর্মিষ্ঠার প্রতি যেরূপ শাস্তিবিধান করবে, তাই মেনে নেব। প্রসন্ন হও!
শর্মিষ্ঠা আমার দাসী হোক তবে!
তাই হোক।
শর্মিষ্ঠাকে আহ্বান করে আনা হল। দেবযানী বললেন, রাজনন্দিনী হয়ে পারবে তো দাসীর মত সাধারণভাবে থাকতে?
জ্ঞাতিকুলের বিপদ ঘটলে যে কোনও উপায় দ্বারা তার প্রতিকার করা কর্তব্য, আমি তোমার দাসীবৃত্তি স্বীকার করলাম তাই। শর্মিষ্ঠা ভয় পাবার পাত্রী নন।
এরূপে কিছুকাল কাটল। একদিন সেই একই স্থানে এ সকল তরুণীগণ যখন আনন্দে বনবিহার করছেন, যযাতি জলের অন্বেষণে পুনর্বার ওই স্থানে উপস্থিত হলেন। দেবযানী তাঁকে সাদর সম্ভাষণ করে মধুর স্বরে আলাপ করতে লাগলেন এবং তাঁর পাণিপ্রার্থী হলেন। যযাতি ক্ষত্রিয়, তিনি ব্রাহ্মণকন্যার পাণিগ্রহণে অসমর্থ, একথা জানালে দেবযানী বললেন, রাজা পূর্বেই তাঁর দক্ষিণ পাণি ধারণ করে কূপ থেকে তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন। সেদিন থেকেই দেবযানী তাঁকে মনে মনে পতিত্বে বরণ করেছেন। এসব কথা কন্যার কাছে শুনে মহামতি শুক্র পরম প্রীত হয়ে সাদরে যযাতিকে কন্যা সম্প্রদান করলেন। যযাতি দেবযানীকে সাথে নিয়ে প্রাসাদে যাত্রা করলেন যখন, তাঁদের সঙ্গে গেলেন দাসী শর্মিষ্ঠা। দেবযানীর সেরকমই শর্ত ছিল।
আরও কিছুকাল গেল। শর্মিষ্ঠা যযাতির প্রতি প্রণয়াসক্ত হলেন। তিনি গোপনে রাজাকে প্রণয়ের কথা জানালে যযাতি বললেন,
তুমি অতুলনীয়া, কিন্তু শুক্রাচার্য্য বলেছিলেন, তুমি কদাচ বৃষপর্বাতনয়া শর্মিষ্ঠাকে শয্যায় আহ্বান কোরো না।
🍂
আরও পড়ুন 👇
শর্মিষ্ঠা অভয় দিয়ে বললেন, মহারাজ! পরিহাসে, স্ত্রীর মনোরঞ্জনে, বিবাহে এবং প্রাণসঙ্কটে মিথ্যা কথা বলা কখনও পাপ নয়। সাক্ষ্যপ্রদানে এবং বিচারস্থলে মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ। সুতরাং আপনার ভীত হবার কোনও কারণ নেই। আপনি আমাকে প্রেমপূর্ণভাবে গ্রহণ করুন। আপনার প্রেমালিঙ্গনপাশে জীবন সার্থক হোক আমার।
বিদুষী রূপবতী শর্মিষ্ঠা, যযাতির মনেও তাঁর প্রতি প্রেমের উন্মেষ ঘটেছিল ধরে নেওয়া যায়, সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া সেকালে রাজপুরুষদের বহুবিবাহ স্বীকৃত ছিল। সুতরাং শর্মিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর রসায়ন পরিপক্ব হল, কিন্তু সবই দেবযানীকে লুকিয়ে। কিছুকাল পরে দেবযানী শর্মিষ্ঠাকে অন্তঃসত্ত্বা দেখে বিস্মিত হলেন।
শর্মিষ্ঠা বললেন, এক ধর্মপরায়ণ ঋষি নিজে আমার কুটিরে এসে পুত্রবতী হবার অভিলাষ পূরণ করেছেন আমার।
দেবযানী সেকথা বিশ্বাস করলেন। সংসারের কালচক্র যথানিয়মেই চলতে লাগল। একদিন দেবযানী পতিসহ নিকটস্থ বনে ভ্রমণে গেছেন, ঘন বনের ভেতরে একস্থানে তিনি দেবোপম তিনটি শিশুকে ক্রীড়া করতে দেখলেন। কৌতূহলী হয়ে তিনি নিকটে গেলেন এবং স্নেহার্দ্রকণ্ঠে শুধোলেন,
তোমাদের পিতার নাম কী? মাতা কে?
তারা সচকিত হয়ে তর্জনী দ্বারা দূরে দণ্ডায়মান যযাতিকে দেখিয়ে দিল,
উনি আমাদের পিতা, আমাদের মাতার নাম শর্মিষ্ঠা।
দেবযানীর কিছুই আর বুঝতে বাকি রইল না। তিনি মহা কুপিত হয়ে শর্মিষ্ঠাকে অনুসন্ধান করে তাকে তিরস্কার করতে লাগলেন। শর্মিষ্ঠা বললেন,
তুমি মহারাজকে পতিত্বে বরণ করেছ, তাতে আমারও বরণ করা হয়েছে। কারণ, সখীর পতি ধর্মত নিজ পতিও হতে পারেন। এতে আমার অন্যায় হয়নি।
এরপর দেবযানী রোষকষায়িত অশ্রুপূর্ণ লোচনে যযাতিকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করলেন এবং উন্মাদের মত ক্রন্দন করতে করতে পিতার কাছে গমনে উদ্যত হলেন। যযাতি নানা প্রবোধবাক্যে তাঁকে সান্ত্বনা দিলেও তিনি নিরস্ত হলেন না। দেবযানীর ক্রোধ উপস্থিত হলে কিছুতেই সংযত হতে পারেন না তিনি, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যান। তাঁর ক্রোধের কারণেই বাল্যসখী শর্মিষ্ঠা চিরকাল দাসী। শর্মিষ্ঠা রাজদুহিতা, যযাতির সঙ্গে তাঁর বিবাহ সমাজে স্বীকৃত। দেবযানীরও দুটি পুত্র আছে, এখন তিনি শুধু রাজরাণী নন, মাতাও। কিন্তু তিনি পূর্বাপর কিছু বিবেচনা না করে ভীষণ ক্রোধে পিতার কাছে ছুটে চললেন। তাঁর পশ্চাৎ পশ্চাৎ যযাতিও তখন শুক্রাচার্য্যের গৃহের দিকে ধাবিত হলেন। শুক্র ক্রন্দনরতা দেবযানীর মুখে সব শুনে ক্রোধভরে যযাতিকে অভিসম্পাত করলেন,
দুর্জয় জরা আক্রমণ করুক তোমাকে, যৌবন বিনষ্ট হোক।
তাই হল, জরাভারাতুর যযাতিকে দেখে তাঁর পুত্রেরা ক্রন্দন করে উঠল, শর্মিষ্ঠা মূর্ছা গেলেন আর সকল রাজ্যবাসী শোকসন্তপ্ত হল। রাত্রিকালেও যেই রাজ্যে সূর্যসম আলোক প্রতিভাত হয়, সেই রাজ্য অন্ধকারে ডুবে রইল। এই সমস্ত ঘটনার পশ্চাতে খলনায়কের ভূমিকা নিয়েছে মানুষের দ্বিতীয় রিপু ক্রোধ, আর এই ক্রোধের সহযোগী ছিল ঈর্ষা। এই দুই-এর অভিঘাতে ধ্বংস হয়ে গেল তিন যুবক-যুবতীর সুখের ভুবন।
0 Comments