জ্বলদর্চি

পাঁচটি কবিতা /মলয় সরকার

পাঁচটি কবিতা 
মলয় সরকার

অচেনা মুখ

আমি আজ খুঁজে পাই না নিজের মুখ;
খুঁজে যদি বা পাই, 
চিনতে পারি না।
চারিদিকে দেখি অবেলার বিষন্ন শরীর
ছেঁড়া শাড়ি কিংবা সুতো কাটা ঘুড়ি
কেউ বা এসে এরই মাঝে, মেপে যায় জল,
খোজ নেয় কতটা গভীর-

আমি দেখি আষাঢ়ের নিকষ কালো সন্ধ্যা
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের তুলোর মাঝে
কখনও বা এক ফালি চাঁদ,
কিন্তু রাস্তার বড় বড় বিজ্ঞাপনে ঢেকে যায়
রাকা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাটুকুও,
রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ড্রেনের পাইপের
ভিতর জেগে ওঠে রাত্রির অন্ধকারের
পর্দাঢাকা চুপিসারের ঘর সংসার -

এর মাঝে কোথায় যেন খাঁচাছাড়া হয়ে
ঘুরে বেড়ায় সব বিশ্বাসের তোতাপাখিরা,
কিছুতেই খাঁচায় ফেরে না তারা-

ভোর রাতে চেয়ে দেখি
সবুজ শিশিরে ভিজে পড়ে আছে
বাসী মড়ার মত 
আমার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মুখ, 
চেনার অযোগ্য হয়ে-


দ্বিখণ্ডিত


আমরা এই শতকের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা
দাদু ঠাকুমা, মাসীমা পিসীমারা
সবারই হৃদয় আজ তীক্ষ্ণ ছুরিতে
সম্পূর্ণ দ্বিখণ্ডিত-

আমাদের সন্তান সন্ততিরা,
স্নেহের আত্মজারা, নাতি নাতনী
কিংবা তাদের সমগোত্রীয়রা
সবাই আজ স্বদেশ কিংবা
স্বভূমি ছেড়ে পরভূমে-
তাই তাদের টানে 
কখনও সবাই সেখানে পাড়ি জমাই,
কখনও ফিরি স্বদেশের, স্বভূমের 
প্রিয় পাড়া, বন্ধু-মাটি-বাড়ির 
কিংবা সবুজ বাঁশের ঝাড়, পানা পুকুর
নিস্তব্ধ তুলসী গাছ আর সন্ধ্যা প্রদীপের টানে।
সারা জীবনই চলে হিসাবের টানাপোড়েন-
পাল্লা ভারি কোন দিকে!
কখনও জেতে এদিক, কখনও ওদিক-
এর বাঁটোয়ারা কখনই সঠিক হয় না-

আমরা আসলে আমাদের সব সত্বা নিয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়েই বাঁচি, 
ভুগতে থাকি অতৃপ্তি আর অপূর্ণতায়-


বন্ধুর খোঁজে

আমি সঙ্গী খুঁজি আমার ছায়াটির মত,
যে থাকবে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী:
আমি বন্ধু খুঁজি আমার চোখের জলের মত,
যে আমার বেদনায় এসে দেখা দেয়;
আমি বন্ধু খুঁজি আমার স্বেদের মত
যে আমার ক্লান্তিতে দেয় শীতলতার আশ্বাস-

সত্যি কি কেউ আমার বন্ধু হবে,  
বাড়িয়ে দেবে তোমার
কলমী লতার মত ভালবাসার হাত?


শূন্যতায়

আমরা কি এক শূন্যতাকেই 
বুকে পুরে পথ চলি!

আমাদের হৃদয় শূন্য
আমাদের মস্তিষ্ক শূন্য
আমাদের বোধ শূন্য
আমাদের বিবেক শূন্য
শুধু শূন্যতারই জয়পতাকা তুলে
রাস্তা হাঁটি আমরা-

আমরা কি শূন্যতার দিকেই তাকাই!
আমাদের লক্ষ্য শূন্য
আমাদের দৃষ্টি শূন্য
আমাদের সৃষ্টি শূন্য
আমাদের কৃষ্টি শূন্য
আমরা কি শূন্যতার মধ্যেই জন্মাই!

তবু মনেপ্রাণে অন্ততঃ যেন
বিশ্বাস করতে চেষ্টা করি,
শূন্যতার মধ্যেই
শূন্যতা থেকেই
শূন্যতা সঙ্গে নিয়েই
নতুনের সৃষ্টি-

এরই মধ্যে সেই আশাটাকে অন্ততঃ
বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করি।


 বিদ্যাপতি 


ক্লাশ রুমের জানালায় হঠাৎ যেন
দেখতে পাই মেঘকে,
স্যরের ইতিহাসের পাতা ছিঁড়ে গিয়ে
উড়তে থাকে আমার চারিদিকে-
আমার চোখে, অতীতের পাতা ভেদ করে
ফুটে ওঠে বর্তমান-

আমায় সে হাত দিয়ে ডাকে ইশারায়-
উধাও হয়ে যাই নদীর ধারে ধারে;
দুজনে বসি ঝরা পাতার বিছানো আসনে,
জিজ্ঞাসা করি,  তুমি ডাকো কেন আমায়?
বড় বড় দীঘল চোখ তুলে তাকায়
নিঃশব্দ উত্তরে,
হঠাৎ গভীর ভালবাসায় 
জড়িয়ে ধরে আমার গলা-
আমি বুঝতে পারি তার নীরব অশ্রুর উপস্থিতি।
ঊষ্ণ গড়িয়ে পড়া অশ্রু ফোঁটায়
আমি ভিজতেই থাকি ভিজতেই থাকি-

দূর আকাশে লক্ষ্য করি
ধীর সঞ্চারে কবি বিদ্যাপতির আনাগোনা-

Post a Comment

0 Comments