জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন/ পর্ব -২১/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

 ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব -২১
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

 পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়...                      
                           
              
দুজনকে নিয়ে পারবে না বলেই মহুলকে হেম কলকাতায় রেখে এসেছে এবার। দাদু ঠাকুমা বাবা পিসির কাছে সে বেশ থাকতে পারে এখন। তাছাড়া হেম নাকি রেলে চাকরিও পেয়েছে। মাস তিন চারের মধ্যেই তাকে থাকতে হবে চিত্তরঞ্জন বলে একটা জায়গায়।সানাকে নিয়ে ওখানে কোয়ার্টারে থাকবে হেম। মহুল সাউথ পয়েন্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছে।তাই সে কলকাতায় রাঙা মেসোর সঙ্গে থাকবে।শুক্রবার করে হেম কলকাতার বাড়িতে ফিরবে। মহুলকে মাকে ছাড়া থাকার অভ্যেস করছে তারা।
          ভাই বেচারার জন্য কষ্ট হয় ঝিনির। তাদের বাড়িতে এলে আর কলকাতায় ফিরতেই চায় না। যাবার দিন খাটের তলে লুকিয়ে বসে থাকে। এত মায়া করে তার যখন ফিসফিস করে ভাই বলে,দিদি আমায় লুকিয়ে রাখ শিগগিরই বাবা নিয়ে যাবে নাইলে। ভাইয়ের কথায় কান্না পায় ঝিনির।
     এবার  ভাইকে না আনায় রাগে গরগর করছিল সে। হেম তার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে আমার কি কষ্ট হচ্ছে না তোর ভাইকে ছেড়ে এসে?দেখেছিস তো যা দুরন্ত। মামাবাড়ির চারদিকে নদী নালা পুকুর।মেয়েটাকে নিয়েই হিমসিম,খালে পড়ে না জলে পড়ে কত আর দেখবো বল । তাছাড়া ওর স্কুলের ছুটিও দশ দিন পর থেকে। ততদিনে আমরা ফিরে যাব।ভাইকে দেখার মতো বড় অবশ্য তুই হয়েই গেছিস।ভাবছি তোর কাছে রেখে আমি নিশ্চিন্তে চিত্তরঞ্জন চলে যেতে পারব। তবে ওর স্কুলটাতো আবার কলকাতায়। খালি খালি হেম যে এসব ভোলানোর জন্য বলছে বেশ বুঝতে পারে ঝিনি। বড়দের মতো কেমন অদ্ভুত হয়ে গেছে হেম।ঝিনি আর। ঝিনি  জলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে।
           ফ্লাক্স থেকে গরম জল নিয়ে হেম সানার টিনের খাবার গুলে দেয়। টিনের গায়ে লেখা ফ্যারেক্স। ওটা বোনের বেবী ফুড।
মা তার লেদার বক্স খুলে একটা বড় পুঁটলি বার করল।পুঁটলির তলায় আমসত্ত্বের কৌটো। তারপর আমসত্ত্বের টুকরো,কুচো নিমকি আর নকুল দানা  দিয়ে মুড়ি দিল সবাইকে।  
      ঝিনির ভারি লোভ রঙিন কাপড়ের টুকরো দিয়ে বাঁধা পুঁটলিটা খুলে  জিনিসপাতি গোনা গাঁথা করার। কারণ ওটার মধ্যে প্রচুর রোলগোল্ডের হার,দুল,সিঙ্গার কুমকুমের শিশি, পাউডার কৌটো,সাবান, সিঁদুরকৌটো আলতার শিশি, নানা রঙের রিবন আর রঙিন প্লাস্টিকের প্যাচানো চুড়ি  এবার নাকি সিনেমার নামে যে চুড়ির নাম হয়েছে হরে কৃষ্ণ হরে রাম চুড়ি,রুপোলি রঙের নানা সাইজের রূপদস্তার ববি চুড়ি। শাদা আর রঙিন পুঁতির মালা, অনেক কটা কলম আর উড পেনসিল ইরেজার। মা আর হেম আত্মীয় কুটুমদের ছেলেপুলে বোন বৌদিদের জন্য এইসব বাজার করেছে।
        শাড়ি জামা কাপড়ও কিনেছে কিন্তু সেগুলো নিয়ে  নয় ওই গয়নাগাঁটি সাজগোজের 
জিনিসগুলো কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগে একসাথে দেখতে।  ঝকমক করে পুঁটলি। রঙিন টুনি বালবের জ্বলা নেভা কিংবা পাতলা বেলূনের ভেতরকার বাতাসের মধ্যে এক মনে খানিকক্ষণ তাকিয়ে দেখলে যেমন রঙ আর আবছা চকমকের ঘোর লাগে লাগে যেন ঠিক বাস্তব নয় ওসব। জোছনার আলোয় রূপকথা থেকে নেমে কোনো রাজকন্যে চুপিচুপি খুলে রেখে গেছে তার গয়না পোশাক। কিংবা মাটি খুঁড়ে উঠেছে এক আশ্চর্য বাক্স খুললেই বেরিয়ে পড়েছে আলি বাবার গুপ্তধন।মা মাসিরা অবশ্য ধরতে গেলেই হাঁ হাঁ করে পুঁটলি তুলে রাখে যেন সে ধরলেই সব বেগোছ আর নষ্ট হয়ে যাবে।
           ঝিনি বিরক্ত হয়ে ছইয়ের বাইরে এসে ঢেউ দেখে।লাওয়ের আগায় বইয়ো না মনু আচুক্কা
পইড়া গ্যালে খুইজ্যাও পাইব না। একটু পিছিয়ে 
ছইয়ের বাতা শক্ত করে ধরে বসল সে।অগাধ জলের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে শান্ত লাগে কেমন।কী এক নিঝুম  ঘোরে দেখে  স্রোতের টানে শাদা ফেণা ওঠে ঘূর্ণিতে তবু জলকে কেন যে এত চেনা লাগে কে জানে। জ্যাঠামণিদের বাড়িতে সেবার রোদের মধ্যে  সাইকেল চালিয়ে রেশন তুলে ফিরল ছোট খোকাদা। বারান্দা পা দিয়েই  জল চাইলে দৌড়ে এক গ্লাস জল আনল ঝিনি। জেঠিমার এক্ষুণি খাস না একটু জিরিয়ে নে বাপ। ঠাণ্ডা লেগে সর্দিগর্মি হয়ে যাবে যে না শুনেই ঢকঢক করে গ্লাসটা খালি করে জেঠিমাকে বললো ওসব ঠাণ্ডা মাণ্ডা লাগার আগেই তেষ্টায় আমার প্রাণ যাক আর কি আর ঝিনির মাথায় আলগা চাঁটি মেরে বললো তেতেপুড়ে এসেই তেষ্টা মেটার মতো শান্তি আর নেই বুঝলি?স্রেফ এই জন্য জলের আর এক নাম হলো গে জীবন।কী সুন্দর । কথাগুলো মনে ধরল তার।বার কয়েক ছড়ার মতো করে আউড়ে নিয়ে মনে করে রাখল তাদের। অনেক দিন পর আজ নৌকোয় যেতে যেতে জলের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছিল সে ছোট খোকাদার বলা কথা গুলো।
           এখানে নদী অনেক চওড়া‌।পারে দূরের গাঁ নীলচে হয়ে  কেমন গল্পের বইতে আবছা করে আঁকা ছবির মতো দেখাচ্ছে।
        মা মাসির হাসির শব্দ কানে এলে সে ছইয়ের ভেতরে ঢুকল আবার।বি ডি আর-রা সানাকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল কই যাইবা পিচ্চি?মামাবাড়ি ? মোগো বাড়ি যাইবা? মা বলেছিল বলো তোমরা সবাই আমাদের সঙ্গে চলো। সানা অবশ্য কিছুই বলেনি আ্যতবড় হাঁ করে বুথ সাহেবের বাচ্চার মতো কান্না জুড়েছিল।তার সেই বিকট ভ্যাঁ শুনে মা হাত বাড়িয়ে দিল আর তাড়াতাড়ি করে তারা সানাকে মা'র কোলে হ্যাণ্ড ওভার দিয়ে দিল।
       মা ফিসফিস করে হেমকে বলল ভাগ্যিস কান্না শুরু করল মেয়েটা এত ভয় করছিল আমার। কথা বলতে বলতে জামার ভেতর ওর গলায় না হাত দেয়।তখন বর্ডারের এপারে সোনা গয়না আনা  মানা।মা তবু বেলাদির জন্য একটা সোনার হার বানিয়েছে আর সানার গলায় নাকি সেটা পরানো ছিল। সানাকে কোলে ফিরে দিতে তাই দুজনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।
        বেলার বিয়ের সময় ওটা কাজে লাগবে বল,সে সময় তো আসা হবে না। তবু এটুকু ওর জন্য আনতে পেরেও শান্তি। মার কথায় হেম সায় দেয়। চাকরিটা যদি আর একটু আগে পেতাম। আমি তো কিছুই নিতে পারলাম না। হেমের গলায় আক্ষেপের সুর। দেওয়ার সময় কি পালিয়ে যাচ্ছে নাকি? যখন পারবি করবি তখন ।তাছাড়া আমার দেওয়া যা তোর দেওয়াও তাই। একই ব্যাপার। না ।একই নয়। সেই কোন ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি তুই শুধু দিয়েই যাস। আমরা কবে আর করবো এসব?      
         অঞ্জুটাকে নিয়েই চিন্তা ,মা হেমের কথা শুনে বলল;বি এ পাশের আগেই ওকে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। নিজের পায়ে না দাঁড়ালে মেয়েদের কথায় দাম দেয় না সংসার।তোদের জামাইবাবু অমন মানুষ না হলে আমিও কি পারতাম এসব বিয়ের পর? 
          মাগো তোমার খুব আনন্দ হচ্ছে তাই না? কেন বল দেখি?বা রে তুমি না নিজের বাড়ি যাচ্ছো? তাহলে বসিরহাটের বাড়িটা কি আমার নয় মা হেসে জিজ্ঞেস করে।ওটাও তোমার বাড়ি আর জ্যাঠামণিদের বাড়িটা তোমার শ্বশুরবাড়ি তবে এই মামুবাড়িটা এক্কেবারে নিজের না মা? মা একটু হাসে। তারপর হেমের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে ঠিকই তো বল সেজো ?শ্বশুরবাড়ি,বাপের বাড়ি, নিজের হাতে নতুন করে সংসার পাতা বাড়ি কোনটা আসলে একদম তার নিজের বাড়ি মেয়েরা কি সত্যিই জানে? 
         বাতাসে আদ্দেক কথা ভেসে গেল মার মুখ থেকে।কোথায় যাচ্ছে মা'র কথারা?হাওয়ায় ধাক্কা খেয়ে ফিরবে কোথাও তারা? পাকুড় গাছের ছায়ায় কোল পেতে বসে  কোনো ছোট বেলার নদী তীর
বিদেশ বিভুঁই থেকে পিছু ডাকবে কখনও এমন?  ফিরবো বললে ফেরা যায় না জেনেও অনেক কোনো দিনের পর ডুবোমুখ কলমি শাকের ফুল আর বেগুনি পানাফুল সরিয়ে সরিয়ে রোগা খুকির মতো ঘরে ফেরার সুর নাম ধরে ডাকবে তাকেও? পাড়া গেঁয়ে পথের ধারে এরম সুদূর কোনো স্বপ্ন বা মরীচিকার  মতো মিষ্টি  পিছুডাক শোনার জন্য কান পেতে থাকে সকলে?
        ও মাজি ভাই,নাও লইয়া যাও কইইই? বানরীপাড়া নরেরকাডি রায়গো বাড়ি।তোমরা কই যাও?ঝালোকাডির আডে যাইতাছি।হওদা আছেনি? ক্ষ্যাতে অইছে কিছু ফুডি বাংগী।
        লাও খাড়াও।কুডুম আছে।বাংগী কিনবো। তাদের বাবা ফুটি কিনলো নৌকা থেকে।পাকা ফুটির মিষ্টি গন্ধে ছইয়ের ভেতরটা ভরে গেল কিন্তু খেতে কেমন পানসে বালি বালি। সানার বেবী ফুড আর দুধ সাবু রান্নার জন্য কৌটোয় চিনি ছিল। সেই চিনি মাখিয়ে সবাই খেল। দুপুরে তাদের ভাতের খিদে পেলে ছোট ছোট বানরুটি আর শুকনো চমচম দিল মা।জলের বোতলও শেষ। শুধু সানার বোতলে আর ফ্লাস্কে যেটুকু। কিন্তু তার জল তো আর খেয়ে ফেলা যায় না।
🍂
      ছইয়ের মুখে দাদাদের সাথে বসেছিল তাদের বাবা। হঠাৎই বিড়বিড় করে বলল ...ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়ার নট আ্য ড্রপ টু ড্রিঙ্ক...। ওই অলুক্ষণে কবিতাটা এখন একদম বলবে না তুমি। হ্যাঁ জামাইবাবু এতগুলো বাচ্চা নিয়ে একে তো দিগদারি ধরে যাচ্ছে এখন একদম শুনব না এসব লাইন।দু পা টান করে ঘুমন্ত সানাকে সেই পায়ের ওপর শুইয়ে হেমও তেড়ে উঠল বাপিকে।কোলরিজের এত বিখ্যাত কবিতা যদি  তোদের অলুক্ষণে মনে হয় তবে বৃথাই লেখাপড়া শিখেছিস। আদতে মুখ্যুই রয়ে গেলি! বাপি হাসছিল।
     কী লাইন বলো বাপি বলো। তিন ভাইবোন ছেঁকে ধরল তৎক্ষণাৎ। আচ্ছা বলবো।অত লম্বা কবিতা মুখস্থ বলা সম্ভব না তবে আজ রাতে আমি দ্য রাইম অফ দ্য আ্যনসিয়েন্ট মেরিনার কবিতায় তোমাদের সেই বুড়ো নাবিকের গপ্পো শোনাবো।
     জলপথ সরু হয়ে এল।বড় নদী থেকে কখন যেন নৌকো ঢুকেছে ছিপছিপে এক নদীর ভেতর।  কথা বলতে ইচ্ছে করে না আর।রোদের তাপ মরে এসেছে তখন। জলমাখা বতাসের হাতও ক্লান্ত হয়ে এল। বিকেলের লালচে মরা আলোয় গাছগাছালি ঝিম ধরে আছে।
           খিদে তেষ্টা ক্লান্তিতে তারা যখন নেতিয়ে পড়েছে বেলা গড়িয়ে তাদের নৌকো এসে ঠেকল মামার বাড়ির ঘাটে। 
     বইতে দে অগো, জল খাইতে দে, ও আরতি! শীতল পাটিডা লাছা,তরাতরি মায়রে বোলা।কও দেহি, আইজই নয়া বাড়ি যাওন লাগল তার!
অ তপইন্যা,তর মায় কি কানের মাতা খাইছে না লতুন বউ হইয়া বইছেনি? বাইরায় না ক্যান? মামুর হাঁকডাকে সোনামামি বেরিয়ে আসে আর ঝালর দেয়া পাখায় বাতাস করতে করতে,ডাঙ্গর হইছেনি? ও বেলা,বীণার মাইয়াডা, সুন্দার হইছেনি? তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে মামি ।ঝিনির মনে পড়ে যায় মার মুখে শুনেছিল কি একটা অসুখে বহুদিন হল সোনামামি অন্ধ হয়ে গেছে।

Post a Comment

0 Comments