পর্ব- ৩৩
স্বপন কুমার দে
প্রতিদিনের রোজ নামচার মধ্যে গতানুগতিকতা থাকে, একঘেঁয়েমি থাকে তবুও তার মধ্যে গতি থাকে, প্রাপ্তি থাকে। গতিশীলতাই জীবনের ধর্ম। পৃথিবী ঘুরছে অনাদি কাল থেকে, ঘুরতে ঘুরতেই সে তার মধ্যেকার সমস্ত কিছুকে ধরে রেখেছে। যেদিন এই ঘোরা বন্ধ হয়ে যাবে সেদিন আর কোনও কিছুই থাকবে না। না থাকবে পৃথিবী,না থাকবে তার ভেতরের সবকিছু। পৃথিবীর প্রাণ, তার সত্তা, তার শৃঙ্খলা, সবকিছুই তার গতির উপর নির্ভরশীল। মানবজীবনও তাই। অনবরত চরকির মত ঘুরে যাওয়া এবং ঘুরতে ঘুরতে জীবনবৃত্তের এক একটা ধাপকে স্পর্শ করে যাওয়াই তার ধর্ম, তার বেঁচে থাকার লক্ষ্মণ।
মাঝখানে অনেকগুলো দিন ঘরে বসে থেকে সম্পূরকের মনের মধ্যে যে অবসাদ জমছিল তা তার কাজের গতি, স্পৃহা, উৎসাহে কিছুটা ক্ষয় এনে দিয়েছিল। অনেকদিন পর কাজে জয়েন করে একদিকে যেমন কাজে ফেরার একটা স্বস্তি এসেছিল, অন্যদিকে সমসাময়িক পরিস্থিতি, কাজের চাপ, ফাইলের অগ্রাধিকার প্রভৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকায় কিছুটা অসুবিধায় পড়তে হয়। এজন্য তাকে অনেকবারই নিজের টেবিল থেকে উঠে গিয়ে অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে। তাই তার কাজের গতি আগের চেয়ে কিছুটা ধীর।
সম্পূরকের শরীরটা এখনও ঠিক মত সারেনি, তাই তার মা সঙ্গে এসেছেন। কিছুদিন এখানে থাকবেন। আসার দিনে স্টেশনে হঠাৎই মল্লিকার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। মল্লিকা হাওড়ার যাওয়ার ট্রেন ধরবে আর সম্পূরকরা ধরবে পুরুলিয়ার ট্রেন। ওদের দেখে মল্লিকাই এগিয়ে গিয়েছিল," জেঠিমা, আপনি সঙ্গে যাচ্ছেন নাকি?"
" হ্যাঁ, সমু এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয় তাই ওর বাবাই আমাকে ওর সঙ্গে পাঠিয়ে দিল।"
" ভালো করেছেন জেঠিমা। সম্পূরকবাবু, আপনি খুব ভাগ্যবান। মাকে কাছে পাবার এমন সুযোগ আর ক'জন পায়?"
" আপনার বুঝি ঈর্ষা হচ্ছে?" কথাটা ইয়ার্কির ছলে বলা হলেও সম্পূরক ভাবল এইভাবে বলাটা ঠিক হয়নি। মা-হারা সন্তানের আসল জায়গায় হয়তো আঘাত করে ফেলেছে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে বলল," ম্যাডাম, আমরা সকলেই কিন্তু আপনার ভালো রেজাল্ট আশা করছি। ঠিকঠাকভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ভালো থাকবেন।"
" হ্যাঁ, আপনিও ভালো থাকবেন। শরীরের অনিয়ম করবেন না। জেঠিমা তো রইলেনই আমিও মাঝেমাঝে খবর নেব।"
" আচ্ছা, পুরুলিয়া গেলে আমাদের ওখানে যাবেন। মা থাকলে আপনার যত্নের কোনো ত্রুটি হবে না।"
" মায়ের আদরে ভাগ বসালে আপনার ভাগে কম পড়ে যাবে যে। তখন আমাকে দোষ দেবেন না যেন।"
বলতে বলতেই সম্পূরকদের ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকল। ওরা একটা কামরাতে উঠে জানলার ধারে বসল। ট্রেন ছেড়ে দিল। সম্পূরক প্লাটফর্মের দিকে চেয়েছিল। দেখল, একটা হাত তার দিকে টা টা করে হাত নাড়ছে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
কাজের ফাঁকে ফাঁকে কখনও টাটকা স্মৃতিগুলো সম্পূরকের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের জন্য সেও ডুবে যায়, কিছুটা ভালো ভালো আবেশ জাগে আবার কিছুটা হতাশা, ব্যর্থতায় মন খারাপ করে।বাসায় ফিরে দেখতে পায় মায়ের যত্ন আত্তিরের শেষ নেই। প্রয়োজনের সব কিছু জিনিস বাড়ির কাজের লোককে দিয়ে বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন, ছেলের পছন্দের জলখাবার বানিয়ে রেখেছেন। বাথরুমে ঠাণ্ডা জল, টাওয়েল, সাবান সব রেডি। এমনকি, এক সেট জামা, ট্রাউজার, চটি সব কিছু হাতের কাছে গোছানো রয়েছে।
চা- জলখাবার খেতে খেতে মা ছেলে চেয়ারে বসে গল্প করে।
" বুঝলে মা, মল্লিকা একটা কথা কিন্তু ঠিকই বলেছিল, আমি খুব ভাগ্যবান। মায়ের এত আদর যত্ন আর কেউ পায়নি। মল্লিকা খুব সুন্দর কথা বলতে পারে,তবে বাড়তি কিছু বলেনি।"
" কেউ বলবে, তারপর তোর মা ছেলদের যত্ন আত্তি করবে, তেমন তোদের মা নয়। আগেও যা করেছি, এখনও তাই করছি। কে বলল, আর কে বলল না, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।"
" এমন করে কেন বলছ মা? সে তো অন্যায় কিছু বলেনি।"
" না, অন্যায় কিছু বলেনি, আর প্রশংসা পাবার মতও কিছু বলেনি।"
" আচ্ছা ঠিক আছে মা, অন্য কারও কথা আর বলবো না। এখন শুধু মা ছেলের নিজেদের কথা হবে। তুমি সারাদিন কি শুধু কাজ করেই চলেছো? একটুও বিশ্রাম নাওনি কেন? ছেলের পরিচর্যা করতে গিয়ে নিজেই যদি অসুস্থ হয়ে যাও তখন আমি কিভাবে সামাল দেবো?"
" না রে সমু, আমি ভালো আছি। ভাবছি, তোর বাবার কথা। মানুষটাকে আমি খেয়াল না রাখলে কে রাখবে বল্ তো? বৌমা মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত। সে কি আর শ্বশুরের খেয়াল রাখতে পারবে? ওষুধপত্র ঠিক সময়ে না খেলে যে আবার বাড়াবাড়ি রকমের অসুখ বাঁধিয়ে বসবে।"
" বেশ তো মা, তুমি নাহয় আরও দু' একদিন এখানে থেকে বাড়ি চলে যাও।আমি এখন ভালো হয়ে গেছি।"
" এখানে তোকে কার কাছে রেখে দিয়ে যাবো? একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিতে পারলে আমারও শান্তি।"
"ভালো মেয়ে বললেই তো রাজ্যের যত ভালো চরে আসবে না মা। আর তাছাড়া আমার এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।"
মণিদীপা লক্ষ্য করেছে, ছেলে যখন তখন অন্যমনস্ক হয়ে যায। কখনও কখনও চুপচাপ হয়ে যায়, তখন বার বার ডাকলেও সাড়া পাওয়া যায় না। বললেও খুব কম কথায় উত্তর দিয়ে আবার চুপ হয়ে যায়। মা ভাবেন, রূপসার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে গেছে বলে তার মনখারাপ, তা কিন্তু নয়। তবে এ মনচাঞ্চল্য কিসের জন্য? কেন অকারণ বিষাদ তার মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে? কেনই বা হঠাৎ হঠাৎ চুপ হয়ে যায়? এগুলো তার মাকে ভাবায়। তাহলে কি মল্লিকা? কিন্তু না, এ কোনোদিনই হতে দেওয়া যায় না। মল্লিকা মেধাবী, শিক্ষিতা, সুন্দরী ভদ্র মেয়ে, -- এসব ঠিক আছে কিন্তু তার বংশ পরিচয়? সে একজন বাপ-মা হারা বস্তির মেয়ে, অনাথা। সম্পূরকদের বংশ গৌরব বা সামাজিক কৌলিন্যের সঙ্গে মল্লিকার খাপ খায় না। তাছাড়া সম্পূরকের জীবনে একটা সম্পর্ক তার সব কিছুকে তছনছ করে দিয়েছে আবারও যদি তাই হয়, তখন? না, তার চেয়ে ঢের ভালো বাবা-মা কোনো ভালো মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া।এতে পরিবারের একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায়।
0 Comments