অফুরান
শুভশ্রী রায়
সুমিতবাবু গ্রামে পিসির বাড়ি যাচ্ছেন। চাকরির সূত্রে দীর্ঘ দিন দিল্লিতে থাকেন তিনি। বিয়ে করেননি। বাবা মায়ের মৃত্যুর প্রায় সাত বছর পর এবার দেশে এসেছেন। এবার পুজোর আগে সর্ধমান শহরে বাড়ি এসেছেন। অনেক দিন যেসব আত্মীয়র সঙ্গে দেখা হয়নি তাদের সঙ্গে দেখাটাও সেরে ফেলতে চাইছেন। পিসির বাড়ি বিজয় নদীর তীরে একটা গ্রামে। কাছাকাছি গঞ্জ জানপুর অবধি বাস যায়। সেখান থেকে রিক্সা, অটো বা টোটো ধরবেন। তারপর পৌঁছবেন পিসিদের গ্রামে। পিসির একটিই মেয়ে। সে বিয়ের সূত্রে অনেক দূরে থাকে। এবার পুজোয় বাড়ি আসেনি। পিসি বা পিসেমশায় বয়সের কারণে জানপুর অবধি এসে তাকে নিয়ে যেতে পারবেন না।
পরিকল্পনা শুনে ভাই আর ভাদ্র বৌ বারণ করেছিল। ভাদ্র বৌ মিতা বলেছিল, "দাদা বেরোচ্ছেনই বিকেল পাঁচটার পরে। জানপুর কম দূর নয়। তার ওপর বাস কিন্তু তাড়াতাড়ি যায় না। কোনো কারণে পৌঁছতে দেরি হয়ে গেলে আপনারই অসুবিধা। তাছাড়া জানপুর থেকে পিসিদের গ্রাম বেশ খানিকটা দূর। রাস্তাটার অনেক বদনাম। আগে যখনতখন চুরি ছিনতাই হ'ত। ভূতপ্রেতও নাকি আছে। আজ না হয় নাই গেলেন। কাল সকাল সাতটা নাগাত বেরোলে দুপুর দুপুর পৌঁছে যাবেন। পিসিদের ফোন করে বলে দিন না!"
🍂
সুমিতবাবু সে সব কথায় কান দেননি। সঙ্গে অনেক টাকাপয়সা নিয়ে যাচ্ছেন না যে ভয় করবে। ঘড়ি পরেন না। মোবাইলটাও খুব দামী নয়। ছিনতাই পার্টি চাইলে দিয়ে দেবেন।
"তোমরা চিন্তা কোরো না" বলে বেরিয়ে এসেছিলেন। এই সময় বাংলার প্রকৃতি মাধুর্যে ভরে ওঠে। সেটা উপভোগ করার এত ইচ্ছা হচ্ছিল যে বেরিয়ে পড়লেন। বাসে জানলার ধারে জায়গা পাওয়ায় আসতে মন্দ লাগছিল না। তবে নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছুটা পরে ছেড়ে বাসটা ঢিকঢিক করে এগোচ্ছিল। জানপুর পৌঁছতেই দশটা বেজে গেল।
নেমে পড়ে তিনি বুঝতে পারছেন যে অসুবিধায় পড়েছেন। জানপুর বাসস্ট্যান্ডে তেমন লোকজন নেই। আসলে গঞ্জ তো, শহর নয়। বাসস্ট্যান্ডের গায়ে লাগা একমাত্র চায়ের দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে। এখান থেকে দুটো রাস্তা দু' দিকে চলে গেছে। অনেক দিন পরে এসেছেন বলে দিশা ঠিকঠাক মনে নেই। কোন রাস্তাটা ধরে এগোবেন বুঝতে না পেরে পিসিদের ফোন করবেন কিনা ভাবছিলেন।
এমন সময় একটা লোক তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল। লোকটার মুখটা ঢাকা দেওয়া দেখে তাঁর একটু অস্বস্তি লাগছিল। উটকো লোকটাই আগ বাড়িয়ে কথা বলল, "মশাই কি এ অঞ্চলে নতুন?" সুমিতবাবু হ্যাঁ বলায় লোকটা জানতে চাইল তিনি কোনো অসুবিধায় পড়েছেন কিনা। সুমিতবাবু দেখলেন ইতস্তত করে লাভ নেই। সহজভাবে বলে দেওয়াই ভালো। লোকটার কথা বলার ধরণটা মোলায়েম। দেখে চোরছ্যাঁচড় বলেও মনে হচ্ছে না। নিজের সমস্যার কথাটা বললেন। পিসির গ্রামের নামটা বলে জানালেন, "ওখানে যাব। কোন রাস্তাটা ধরে যাব বুঝতে পারছি না। তাছাড়া এখানেই বেশ অন্ধকার! তার ওপর নির্জন। ও দিকের রাস্তায় না জানি কতটুকু আলো থাকবে!"
শুনেটুনে লোকটা আদেশ দেওয়ার ভঙ্গীতে চিৎকার করে উঠল- "অফুরান, অফুরান!" অমনি অন্ধকার ফুঁড়ে এক রিক্সাওয়ালা হাজির। এত তাড়াতাড়ি কোথা থেকে এল কে জানে! যাক গে, এসেছে এটাই বড় কথা। অফুরানকে উদ্দেশ্য করে লোকটা বলে উঠল- "এই ভদ্রলোককে পৌঁছে দে।" হুকুমের স্বরে এ কথা বলে গ্রামের নামটা উল্লেখ করে সে আরো কতকগুলো নির্দেশ দিল। "ভাড়া নিবি না, স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালাবি আর হ্যাঁ, কোনো কারসাজি করবি না। তেমন কিছু কানে এলে রাতের ডিউটি থেকে তোর নাম কেটে দেব কিন্তু।" অফুরান শুনেটুনে বিনীতভাবে বলল- "কি যে বলেন কর্তা! আপনি বারণ করে দেওয়ার পরেও বাড়াবাড়ি করলে তো এ তল্লাট ছাড়তে হবে।" তারপর সুমিতবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল- "আসুন বাবু।"
লোকটা তাকে ভারি যত্ন করে পৌঁছে দিচ্ছে। বকবক করছে না। খালি সুমিতবাবু'র মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে, রিক্শাটা যেন মাটির খানিকটা ওপর দিয়ে যাচ্ছে। দু'চার বার এমন হওয়ার পর অফুরান বোধহয় তাঁর মনের কথা বুঝতে পারল। অমনি রিক্সা ফের ঠিকঠাক মাটির ওপর। সঙ্গে সঙ্গে অফুরানের আফশোসের গলা-"এ বাবা, কর্তামশাই বারণ করে দিয়েছেন তবু অভ্যাসে একটু কারসাজি করে ফেলেছি।" তার কথা শুনে কারা যেন হেসেও উঠল। হয়তো সুমিতবাবুরই মনের ভুল। এখানে লোকজন কোথায়? আশেপাশে বিদ্যুতের আলো না থাকলেও গা ছমছম করার মতো ঘন অন্ধকার নেই। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর ছায়াও পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে না। তাঁর একটুও ভয় লাগছে না।
প্রায় আধ ঘন্টা পর গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপের কাছাকাছি এসে রিক্সাটা থামল। শিউলির গন্ধে ভরা জায়গাটায় মোটামুটি আলো আছে। এবার সব চেনা যাচ্ছে। এখান থেকে পিসির বাড়ি দূর নয়। একটা লোকও এগিয়ে আসছে। বোধহয় পিসির বাড়ি থেকে কাউকে পাঠিয়েছে। রিক্সা গ্রামে ঢুকবার আগেই পিসিকে ফোন করে দিয়েছিলেন।
অফুরানকে পাওয়া না গেলে আরো কত রাত হয়ে যেত কে জানে! উপকারী রিক্সাচালকটিকে অনেকবার ধন্যবাদ দিলেন তিনি। "বিরাট উপকার করলে ভাই, তুমি না থাকলে সত্যিই অসুবিধায় পড়ে যেতাম।"
বিদায় নেওয়ার সময় সুমিতবাবু সকৃতজ্ঞ ভঙ্গীতে পার্স থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে এগিয়ে দিতেই অফুরান জিভ কাটল- "টাকায় আমাদের কি কাজ! আপনাকে ভালোয় ভালোয় পৌঁছে দিতে পেরেছি, এই অনেক।" এ কথা বলার পর তাঁকে একটা প্রণাম ঠুকে রিক্সা সহ অফুরান শরতের নির্মল অন্ধকার-আলো, ছাতিম-শিউলির গন্ধ এবং আনন্দিত পুজো পুজো ভাবের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
4 Comments
সাহিত্য রসে পরিপূর্ণ, ঝরঝরে গদ্য ভাষায় লেখা অতি মনোরম একটি গল্প পড়লাম।
ReplyDeleteএই লেখকের আরো অনেক গল্প নিয়মিত পড়তে চাই।।
#শিবনাথ_বন্দ্যোপাধ্যায়
শুভশ্রীর গল্প উপস্থাপনা অভিনব। অল্প পরিসরে যা বলার বলে দিয়েছেন। পাঠকের মনে অনেক কল্পনা উসকে দিয়েছেন। শুভশ্রী ছোট গল্পের সার্থক কারিগর। 'শেষ হয়ে হইল না শেষ'।
ReplyDeleteভুতের গল্পও যে এমন সুন্দর হতে পারে, না পড়লে অজানা থাকতো। খুবই ভালো লাগলো।
ReplyDeleteখুব ভাল লাগল। আরো গল্প চাই।
ReplyDelete