জ্বলদর্চি

চেয়েছিনু যবে মুখে/পুলক কান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস


চেয়েছিনু যবে মুখে

পুলক কান্তি কর


কোলবালিশটাকে জড়িয়ে দ’ এর মতো মেয়েটাকে শুয়ে থাকতে দেখে মায়া হল মমতার। সারাদিন আজ অনেক কাজ। সাড়ে আটটা বেজে গেছে। চায়ের পর্বটা চুকে গেলে ভালো হত। থাক শুয়ে আর একটু। নাইটিটা হাঁটু অবদি উঠে গেছে। অনেক দিন পর মিমির ফর্সা দুটো সুন্দর পা দেখে নিজেরই ভালো লাগলো তাঁর। নাইটিটাকে টেনে দিতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল ঘাড়ের কাছে একটা কালশিটে দাগ। মুচকি হাসলেন তিনি। জামাই নীলেশকে তো শান্তশিষ্ট মানুষ বলেই মনে হয়। থু,থু। কারোর নজর যেন না লাগে। ‘হে মা লক্ষ্মী, মিমির ঘর যেন সুখের হয় মা!’  

- ‘এই যে দিদান, তুমি এখানে বছে বছে কি করছ?’ মমতা দেখলেন পাশের বাড়ীর বিট্টু কখন এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছর বয়স তার। সারাদিন মোটামুটি এ বাড়ীতেই কাটায় সে।

-এই তো বিট্টু সোনা। তোমার মিমিদিদি এসেছে তো! 

-মিমিদিদি? কই?

-ওই যে শুয়ে আছে! 

হঠাৎ করে মিমির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চুল ধরে টানতে লাগল বিট্টু। ‘এমা এতা কে?’

-কেন রে তুই আমায় চিনতে পারছিস না? মিমি বলল।

-তুমি বুলি হয়ে গেলে কী কলে? মাথায় লাল লাল কী লাগিয়েছ দিদানের মতো? হাতে এত চুলি কেন?

-‘তুই জানিস না, দিদির বিয়ে হয়ে গেছে?’ মমতা বললেন।

-ছে তো মা’ল ও বিয়ে হয়েছে! মা তো পলে না এসব। এতো শুধু দিদান লা পলে! 

-ঠিক বলেছিস সোনা! দিদিটা বুড়ি হয়ে গেছে কদিনে! মিমি তুই কি আর একটু শুবি? না কি চা দেব এখন?

-তুমি অন্য কাজে যাওনা মা। আমি চা করে নেবো।

-এখন রান্নাঘরে ঢুকলে মণ্টুর মা বিরক্ত হয় রে! আমি বরং ঠাকুরঘরের ইনাডাকশান থেকে করে আনছি। 

-তুমি অস্থির হ’য়ো না মা। ঠাকুরঘর তো আমিও চিনি নাকি? তা বিট্টুবাবু দূরে সরে বসলে কেন? দিদিকে আর পছন্দ হচ্ছে না বুঝি?

- তুমি ছেই মিমিদিদি না। তুমি ওল ভূত!

- আমি ভূত? দাঁড়া তোকে হাউমাউ করে খাব এখন’ - বলেই ধরতে গেল বিট্টুকে।

-তুমি আমাল কিচ্চু কলতে পালবে না ভুতুদিদি। জানো না ‘ভূত আমাল পুত পেত্নি থামাল ঝি। লাম লখ্‌খন বুকে আছে ভয়তি আমাল কি?’

-কে শেখালো ছড়াটা?

-দাদু!

-দাদু মানে? তোর দাদু না আমার বাবা?

-লাঙা দাদু।

-ও।বাবা! তোর সাথে এখন বাবার বন্ধুত্ব হয়েছে? 

ঘাড় নাড়ল বিট্টু।

-কী রে এখনও বিছানা ছাড়িস নি? চা হয়ে গেল যে! মমতা তাড়া দিলেন।

-সত্যি মা! তোমার পায়ে না একেবারে চরকি লাগানো! এই তো ছিলে এখানে। এর মধ্যে চাও হয়ে গেল?

-চা ভেজাতে দিয়েছি। হ্যাঁ রে তোর শ্বশুরবাড়ীতে কী চা খায়?

-সি.টি.সি.।

-তুই তো পাতা চা ছাড়া একেবারে খেতে পারতিস না? আশেপাশের দোকান থেকে কিনেও নিতে পারতিস তো! দাঁড়া আড়াইশো করে প্যাকেট করে তোকে কে.জি. খানেক দিয়ে দেবো। অনেকদিন চলে যাবে।

-দিও না মা। ওই সি.টি.সি.তে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি।

-কেন মা? একটুখানি চা নিজের জন্য বানিয়ে নিতে তোর আর কতখানি সময় যাবে? 

-তা নয় মা। আসলে দু-চারদিনের জন্য করা যায়। আজীবন যেটা নিয়ে থাকতে হবে তার সাথে যত তাড়াতাড়ি অভ্যস্ত হওয়া যায় ততই ভালো!

-তোর তো সকালে ওই এককাপ সুগন্ধী চা না খেলে মাথা ধরে থাকতো রে! এই ছ’মাসে তুই অনেকখানি বড় হয়ে গেছিস মিমি!

-তুমিই তো চাইতে মা! আগে বলতে না, তোর যা কুঁড়ে স্বভাব শ্বশুরবাড়ী এবেলা নিয়ে গিয়ে ওবেলা ফেরৎ দিয়ে যাবে? 

মমতা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

-তোমার আবার খারাপ লাগলো নাকি মা? আরে আমি অন্য কিছু ভেবে বলিনি। সব মা মেয়েদের এমনটাই বলে, আমি জানি মা।

-আমি তো তোর জন্য পাতা চা’ই ভিজতে দিয়েছি। মন্টুর মা’র জন্য সি.টি.সি আনা আছে। ও ওটাই ভালোবাসে। তুই চাইলে ওটাও করে দিতে পারি।

-এতটাও অভ্যস্ত হয়ে যাইনি মা যে পুরোনো  ভালোলাগা একেবারে ভুলে যাবো।

-না, মানে অভ্যাসের অনুশীলনও তো জরুরী। 

মিমি বুঝলো মমতার অভিমান হয়েছে মনে মনে। আসলে মমতা ভীষণই সূক্ষ্ম। মেয়েদের বেশী সূক্ষ্ম হলে বড়ো জ্বালা। অভিমান হয়, আবার সেই অভিমান নিজেকেই ভুলে যেতে হয়! এই ব্যস্ত সংসারে দেয়াল উঠোন থালা বাসনই শুধু সেই অভিমানের মূল্য দেয়। কোনও মানুষ দেয় না। মিমি গিয়ে আলতো করে মমতাকে জড়িয়ে ধরল। মমতা ওর কপালে হাল্কা একটা  চুমু এঁকে বললেন – ‘যা যা ব্রাশ করে নে। চা তেতো হয়ে যাবে এর পরে। দাদান, তুমি কী খাবে? দুদু দেব একটু চকলেট দিয়ে?’

-না। আমি তা খাব!

-চা খাবে? চা তো বড়রা খায় সোনা!

-আমিও বল হয়ে গেছি। আমায় তা-বিতকুৎ দাও।

মিমি চুপিচুপি বলল, দাঁড়াও মা আমার কাছে চোকো পাউডার আছে। তুমি দুধ দাও এককাপ। আমি ওটা মিশিয়ে দেব - দেখবে চায়ের মতোই দেখতে লাগবে।

-তুই কি টেবিলে বসে চা খাবি, নাকি এখানে নিয়ে আসবো?

-টেবিলেই চল। বাবা কোথায়?

-ও বাজারে গ্যাছে। রাতের জন্য গিফ্ট টিফ্টও তো কেনা হয়নি। সেসব ও কিনে ফিরবে।

-বাবাকে একা ছেড়ে দিলে? ঠিকঠাক দেখে কিনতে পারবে তো?

-যা কেনে কিনবে! আজকাল আমি আর ওসব দিকে নজর দিই না মিমি।

  চা খেতে খেতে মিমি বলল, ‘এটা কি ওই আটশো টাকার পাতাটাই, নাকি বেশী দামের?’ 

-না,না। ওই এক দামই আছে এখনও। বিট্টু কোথায় গেল রে?

-ও পালিয়েছে মা।

-যাঃ। দুধটা নিয়ে এলাম যে রে! কখন আবার আসবে, ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!

-খুব ভালো হয়েছে মা চা টা।

-ভালো হয়েছে? নে জলখাবারটা করে নে। আর এক কাপ করে দেব না হয়!

-এখন আর জলখাবার খাবো না মা। চান টান করে তাড়াতাড়ি বরং দুপুরের খাবার খেতে হবে। ঝুমা’রা আড়াইটে-তিনটের মধ্যে ওদের বাড়ী পৌঁছোতে বলেছে। বাড়ীতেই পার্লার থেকে মেয়েরা আসবে। মেহেন্দি টেহেন্দি বাড়ীতে করে ফাইন্যাল মেক-আপ পার্লারে করবে। 

-তোর ওই পার্লারের মেয়েটাই করবে তো! 

-হ্যাঁ। সুজাতার নাম্বারই ওদের দিয়েছি। ও খুব ভালো সাজায়।

-হ্যাঁ রে। সত্যিই সুন্দর। তোর বিয়ের সিডিটা যখন দেখি তখন তোর মুখটা দেখে বুকটা জুড়িয়ে যায়!

-‘মেক-আপ সুন্দরী, বলো!’ মিমি হাসতে লাগলো। 

মমতাও হাসলেন। ‘জানিস তো যারা সত্যিকারের ভালো মেক-আপ জানে তারা মুখের ডিসেন্সিটা নষ্ট হতে দেয় না। তোর আদল তো অনেকটা গায়ত্রী দেবীর মতো। বিয়ের সাজ বলে যদি মোটা মেকাপ দিয়ে জাবড়ে দিত, কেমন হত?


🍂

মিমি এর জবাবে শুধু মিষ্টি করে হাসলো।

-হ্যাঁ রে মিমি, তুই সকালে ক’টায় উঠিস?

-ছ’টা মা। 

-এত সকালে কেন?

-শ্বশুরমশাই হেঁটে ফেরেন ছ’টা দশ পনেরো। চা করে দিই।

-কেন তোর শাশুড়ী আর রান্নাঘরে ঢোকে না?

-ঢুকবে না কেন? দুপুরের রান্নায় একটা-দুটো পদ করে।

-নিজের বরের চা টা তো সকালে করে দিতে পারে?

-তুমি উত্তেজিত হচ্ছ কেন মা? এতদিন হয়তো দিত, এবার ঘরে বৌমা এসেছে। একটু তারও তো সকালে হাত পা ছড়িয়ে শুতে ইচ্ছে করে! আর তাছাড়া তোমার জামাইও বেরোয় সাড়ে আটটায়। ছ’টায় না উঠলে ওর খাবারই বা করে দিতাম কখন?

-যদি চাকরী করা বউমা হতো? তুই যদি এখন চাকরী করতে যাস?

-সে গুড়ে তো তোমরা বালি দিয়ে দিয়েছ মা! ওরা বিয়ের আগে তো ‘চাকরী করা যাবে না’- এ কথাটা বহুবার বহুভাবে তোমাদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে।

মমতা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। হঠাৎ যেন খুব জরুরী কথা বলছেন, এমন মুখ করে বললেন – নীলেশ আজ কখন আসবে রে?

-সন্ধ্যের সময় তো আসবে বলেছে।

-এখানে আসবে নাকি সরাসরি ঝুমার রিসেপশন এ চলে যাবে?

-ঠিক জানি না। ফোন করে নেবে নিশ্চই।

একটু ঢোক গিলে মমতা আবার বললেন, ওখানে তো পলাশও থাকবে!

-তো? ওর বোনের বিয়েতে ও থাকবে না, কোথায় যাবে?

-না-মানে, নীলেশ জানে?

-আমার অতীত টতীত নিয়ে ওর এত মাথাব্যাথা নেই। নিজেরটা মিটে গেলে হ’ল।

কথাটা খট করে কানে বাজলো মমতার। উনি বললেন, ‘তুই সুখে আছিস তো মা?’

-আমি যদি বলি ‘তুমি সুখে আছো?’ কী উত্তর দেবে?

মমতা চুপ করে রইলেন।

-জানো তো মা, সুখে থাকা ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। মানুষ তার চাহিদার নিরিখে কোথায় আছে এটাই তার সুখের মাপকাঠি। আমি চাহিদার লেভেলটা যতটা সম্ভব শূন্যে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তাতে সবকিছুতেই সুখ নজরে আসবে।

-এমন করে বলছিস কেন মা? আমরা তো তোর ভালো চেয়েই...

-আমিই বা কখন বললাম তোমরা আমার খারাপ চেয়েছ? সুখের কথা তুললে তাই বললাম।

-ওরা কি তোকে কষ্ট দেয়?

-কষ্ট মনে করলেই কষ্ট মা। মারধোর করে না। পণ নিয়ে খোঁটা দেয় না। ঝগড়াঝাঁটিও সচরাচর করে না। ওদের এদিক থেকে ভালোই বলতে হবে।

-তবু তোর কথায় যেন মনে হচ্ছে - তুই আপোষ করছিস্‌।

-কে আপোষ করে না মা? তুমি করছ না? বাবা তো শান্ত মানুষ। নেশা ভাঙ করে না। তোমাকে মারধরও করে না, বরং তোমার কেয়ার করে। বাড়ীর কাজের লোক না এলে বাসনপত্র মেজে দেয়। ঘরে ঝাড়ু দেয়। তবে তোমার সমস্যাটা কোথায়? আসলে সে তোমার মনের লেভেলে মেলে না। তুমি কি তা বলে খুশি খুশি  এতগুলো বছর বাবাকে মেনে নাওনি? নাকি সংসারকে অবহেলা করেছ?

-তুই গান-নাচটা একেবারে কেন ছেড়ে দিলি মিমি? নিজের জন্য এইটুকু না রাখলে বাঁচবি কী করে?

-সময় কোথায় মা?

-এরমধ্যে অ্যাডজাস্ট করতে হবে মিমি। এরপর দেখবি বাচ্চাকাচ্চা হলে সময়ের আরও টান পড়বে। বিকেল টিকেলে অন্তত আধঘন্টা রেওয়াজ কর।

-ও হবে না মা।

-কেন হবে না? বিয়ের সময় তো ওরা গান-নাচ নিয়ে কোনও আপত্তি করে নি।

-তা করেনি। তবে আমার আর ওসব ভালো লাগে না। এই দ্যাখো বিট্টু এসেছে আবার। ‘ কী রে দিদান চা দিয়েছে। তুই কোথায় চলে গেছিলি?’

-তা কোতায়? আমাকে দুদ দিয়েছে।

-কে বললো তোকে?

-আমি বল হয়ে গেছি। তুমি কি ভাবো, আমি বুজতে পালি না?

মমতা বললেন – ‘খেয়ে তো দ্যাখ চা কিনা?’ 

-আচ্চা দাও। আমাকে ম্যাগি কলে দাও, খাব।

-বাড়ীতে খাসনি?

-মা কে বল্লাম ম্যাগি দাও, মা দুদ কলনফেকছ্‌ ধলিয়ে দিল। আমি না খেয়ে পালিয়ে এছেছি।

-ভালো করেছ। তুমি এখানে বসো। দিদান ম্যাগি করে দিচ্ছে।

-মিমিদিদি ভাই কই?

-ভাই কোত্থেকে আসবে?

-তোমাল বিয়ে হয়ে গেছে না? বিয়ে হলে তো ভাই হয়!

-বাব্বা। তোমার তো অনেক জ্ঞান হয়ে গেছে।

-বল্লাম না, আমি বল হয়ে গেছি। এখন আমি অনেক কিচু জানি।

                                (২)

-কি রে মিমি, চেয়েও দেখিস না যে!

-ওঃ পলাশদা। তুমি দেখা দিতে না চাইলে দেখবো কী করে? সেই তিনটে থেকে তোমাদের বাড়ীতে ছিলাম।

-আসলে ফুলের কাজের লোক, ক্যাটারিং এর লোক – সব তো এখানে, এই হলটায়। আমি তাই এখান থেকে নড়তেই পারছি না।

-তোমাকে এত রোগা দেখাচ্ছে কেন পলাশদা? শরীর ঠিক নেই নাকি?

-না রে। শরীর ঠিকই আছে। আসলে ঝুমার বিয়েটা নিয়ে টানা অনেকদিন বেশ খাটুনি যাচ্ছে তো! ঘুমটাও কম হচ্ছে কদিন, ওজন্যই মনে হচ্ছে তোর।

-সে হতে পারে। তবে মনে হচ্ছে বিষয়টা আরও গভীর। বিয়ে টিয়ে মিটলে ভালো মত ডাক্তার টাক্তার দেখিও পলাশদা।

-ও ঠিক আছে। তুই চিন্তা করিস না।

-সব বিষয়ে এত ক্যাজুয়াল হওয়া ভালো না পলাশদা।

-সে আমার চেয়ে কে আর ভালো বুঝবে বল? ঠিক আছে আমি ডাক্তার দেখিয়ে নেব। ঝুমাকেও বলে দেব ওনার উপদেশ। তোর সাথে তো ঝুমার রেগুলার কথা হয় শুনি! 

-হ্যাঁ। তোমার এদিকের সব কাজকর্ম মোটামুটি সারা হয়ে গেছে তো?

-হয়েছে মোটামুটি। একটা ব্যাচ খাওয়াও হয়ে গেছে। বরযাত্রীরা বাড়ী থেকে রওয়ানা দিয়েছে ঘন্টাখানেক হল। ওরাও এসে পড়বে এবার। শোন মিমি, তুই কিন্তু ওদের রিসেপশানের সময় থাকিস। গোলাপের তোড়া বানিয়ে রেখেছি। তুই দিস। ঝুমার গ্ল্যামার বেড়ে যাবে তাতে!

-আমার হাতে অন্য লোকে গোলাপ নিলে এখন বুঝি তোমার সহ্য হয়ে যাবে?

-স্বয়ং তোকেই যখন অন্য লোক নিল, তখন আর গোলাপ!

-দিলে বলেই না নিল!

-চাইবার সাহস ছিল না তখন মিমি!

-সাহস ছিল না বলো না; বল, গুরুত্ব ছিল না।

-এমনভাবে বলছিস কেন মিমি?

-ছাড়ো ওসব কথা! দাঁড়াও মা আসছে এদিকে। তুমি অন্য কাজে যাও।

-এখানেই থাকবি তো? আমি আসছি একটু পরে।

-আচ্ছা, এসো।

-শোন না মিমি, নীলেশ ফোন করেছে নাকি?

-না।

মিমি দেখল ওর মা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। 

-এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দ্যাখনা একটু বাইরের গেটে দাঁড়িয়ে। আসার তো সময় হয়ে গেছে নিশ্চই।

-তুমি অকারণ চিন্তা করো না মা, ও ফোন করে নেবে।

-তুই চল না ভেতরে। ওখানে ঝুমার কাছে বসবি!

-তোমার এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই মা! তুমি তোমার কাজে যাও! আমি বড় হয়েছি। সবদিক আমার খেয়াল আছে। তুমি চিন্তা ক’রো না।

-এদের বাড়ীর লোকরাই বা কি ভাববে মিমি?

-কেউ কিছু ভাববে না। কেননা কেউ কিচ্ছু জানে না। এমনকি ঝুমাও না। তুমি যাও।

  মমতা চলে যেতে মিমির খুব রাগ হ’ল নিজের উপর। কোন কুক্ষণে মায়ের কাছে ধরা দিতে গেছিল সে! পলাশ নিজেই যখন তৈরী ছিলনা, অকারণ মাকে বলে কী লাভ হল তার? আর মাও অদ্ভুত। এখনও কেমন স্কুলের দিনগুলোর মতো তার উপর নজদারি করছে! সে কি তেমন কিছু করেছে কোনও দিন? হঠাৎ সম্বিত এল তার পলাশের ডাকে, ‘মা কোথায় গেলেন?’

-ভেতরে গেছে বোধ হয়।

-তুই আমাকে সরিয়ে দিলি কেন? মা কি আমাকে নিয়ে সন্দেহ করেন নাকি?

-মা কি আমার শাশুড়ী যে সন্দেহ করবে? নিজের মনে পাপ আছে বলে সরিয়ে দিলাম। সাক্ষী বাড়িয়ে কি লাভ?

-মাসিমা কি আমাকে নিয়ে আগে সন্দেহ করেছেন কখনও?

-সন্দেহ করার মতো আমাদের কি কোনও সম্পর্ক হয়েছিল পলাশদা? বিয়ে যখন স্থির হওয়ার মুখে, তখন মা’কে বলেছিলাম কাছাকাছির মধ্যে তোমার কথাও যদি ভাবে।

-কী বললেন মাসিমা?

-জিজ্ঞাসা করলো তুমি কী করো। যখন শুনলো চাকরী করো না, কোনও কিছুই আর বিবেচনার মধ্যে এল না। আমি তো বলতে পারিনা, তুমি জিনিয়াস্‌, তুমি স্কলার, যে কোনও চাকরীই তুমি পেতে পারো ইচ্ছে করলে! পি.এস.সি পরীক্ষা দিতে গিয়ে যে নিজের অ্যাডমিট কার্ড নিতে ভুলে যায়, তার হয়ে সুপারিশ করাও যে বিড়াম্বনা হয়ে দাঁড়ায় – সে কথা তো তুমি বোঝনি কোনওদিন পলাশদা।

-তোর বর আসবে তো?

-আসার তো কথা। দেখার জন্য মুখিয়ে আছো মনে হচ্ছে !

-না। আসলে দেখবো ভাগ্যবানরা কেমন হয় দেখতে।

-ঠিক আছে। আসুক। আলাপ করিয়ে দেব।

-তার দরকার নেই মিমি। দূর থেকেই দেখে নেব ঠিক!

-তোমার দরকার থাকলে যাও না ভেতরে! তোমার খোঁজ পড়ছে নিশ্চই!

-যাবো রে! একটুখানি থাকতে দে তোর সাথে। তোকে এত সেজেগুজে থাকতে তো কখনও দেখিনি আমি। এটা কি তোর বিয়ের বেনারসী? নাকি নতুন কিনলি?

-না না। বিয়েরই। কয়েকবার তো পরে নিই। এসব অনুষ্ঠান ছাড়া তো এত ভারি শাড়ী পরা হয়না! 

-খুব সুন্দর লাগছে রে মিমি আজ তোকে। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র দেখলে তোকে আজ কামনা করতেন!

-ওর কামনাকে কে মূল্য দেয় পলাশদা? এক নম্বরের লম্পট, ধাপ্পাবাজ !

-তা হোক। দেবতা তো! চাইলেই রূপটূপ বদলে অনেক ছলচাতুরী করতে পারে।

-সে ক্ষমতা তোমার থাকলে তুমি কি করতে?

-আমরা যে মানুষ রে মিমি। বিবেক থাকলে ওসব ছল-চাতুরী আসবে কোত্থেকে?

মিমি মনে মনে ভাবলো, তাও যদি করতে, তবু তো মনে হত কিছু একটা করছো! মুখে বললো, ‘তোমার কফি বা চায়ের স্টল কোথায়? চল একটু কফি খাই।‘ 

-তুই দাঁড়া না! আমি নিয়ে আসছি।

-না,না। চল। আমিও যাই।

-চিকেন পকোড়াও আছে। খেয়েছিস?

-না। ওসব এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।

-দাঁড়া তো দেখি একটা ফোন আসছে। বোধ হয় বরযাত্রীরা। ‘হ্যালো! কতদূর পৌঁছেছেন? আর মিনিট দশেক? আচ্ছা আসুন সাবধানে’।

-এসে গেছে নাকি পলাশদা?

-হ্যাঁ রে! মিনিট দশেকের মধ্যে ঢুকে যাবে। তুই কফিটা খেয়ে  গেটের কাছে চলে যা। আমি ওখানেই আসছি।


                                (৩)

-কীরে মিমি, হঠাৎ এলি?

-কেন মা আসতে নেই? 

-এভাবে কথা বলছিস কেন? এমন সপ্তাহের মাঝে তো আসিস না কখনও। নীলেশের অফিসের কী হবে?

-ওঃ এই চিন্তা! নীলেশ নেই। ও অফিসের ট্যুরে দিল্লি গেছে। দিন সাতেক পরে ফিরবে।

-নীলেশের বাবা-মা আপত্তি করলো না?

-দ্যাখো মা, আমি চলে এলে শাশুড়ীমাকে হেঁশেল ঠেলতে হবে। সুতরাং একটু ওজর আপত্তি থাকাটা তো অস্বাভাবিক নয়। আমি খুব একটা পাত্তা দিইনি।

-কেন রে? এর আগে নীলেশের ট্যুর হলে তুই তো ওখানেই থাকতিস!

-তুমি কী চাও মা? আমি না আসি?

-তা কেন মিমি? আমি চাই তোকে যেন অশান্তির মুখে দাঁড়াতে না হয়।

-তুমি আমার বিষয় আমাকে ফেস করতে দাও না! অকারণ চিন্তা করছ কেন? আসার মতো কারণ ছিল বলেই এসেছি। 

-কী কারণ রে? কোনও ঝামেলা টামেলা হয়নি তো?

-আবার? আমি কোনওদিন কোন ঝামেলা বা আমার সাংসারিক বিষয় নিয়ে তোমাদের কাছে নালিশ করেছি?

-তবে?

-শাশুড়ীর বিষয় নয়। আমি কাল পলাশদা’র সাথে দেখা করতে যাবো।

-কেন রে? ঝুমা তো নেই এখন। ওতো সেই অষ্টমঙ্গলার সময় এসেছিল! তারপর প্রায় তিনমাস হয়ে গেল, আসেনি। ওর বর এর চাকরীর জায়গায় গেছে গতমাসে।

-জানি।

-তবে?

-আমি কি তোমায় ঝুমা’র সাথে দেখা করতে যাবো বললাম? বললাম তো পলাশদা’র সাথে দেখা করতে যাবো।

-কেন রে?

-তুমি ঝুমার সব খবর রাখো, পলাশদা’র খবর রাখো না?

-না। কি হয়েছে পলাশের?

-ব্ল্যাড ক্যান্সার।

-সে কী রে? কবে?

-ঝুমার বিয়ের পরই। শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। সবসময় ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। পরীক্ষা টরীক্ষা করে দেখা গেছে ব্লাড ক্যান্সার।

-তোকে কে বলল?

-ঝুমাই বলল পরশুদিন।

-যা বাবা। এত সুন্দর হৃষ্ট পুষ্ট চেহারা। দেখলে বোঝাই যায় না। ভাগ্যিস তোর সাথে সম্বন্ধটা হয়নি।

মিমি কিছু না বলে একঝলক মমতার মুখের দিকে তাকালো।

-তুই দেখা করতে যাবি, ঝুমার বাবা-মা কিছু মনে করবে না?

-এই মনে করা নিয়েই তুমি গেলে মা। ওর ক্যান্সার হয়েছে। ঝুমা তো আমার বন্ধু। কতদিন ওর বাড়ী কারণে অকারণে গেছি কেউ দোষ ধরেনি। আজ বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও যদি ওর রোগ হয়েছে শুনে দেখা করতে যাই, তাতে কারো কিছু মনে হতে পারে কি?

-জানিনা বাবা! যা। তোর বাবাকে বলব?

-এতে লুকোবারই বা কি আছে মা? আমি কি কোনও কথা তোমাকে লুকিয়েছি, না লুকোতে বলেছি?

-না মানে পলাশের সাথে তোর ব্যাপারটা তোর বাবা তো জানে না।

-পলাশদা’র সাথে আদৌ কি আমার কোনও ব্যাপার ছিল মা? তোমরা নানান সম্বন্ধ দেখছিলে। আমার কোনওভাবে মনে হয়েছিল পলাশদাও মেরিটোরিয়াস এবং ভালো ছেলে। ওর কথাও ভাবতে পারো। তার আগে না তো পলাশদা আমাকে কোনও প্রস্তাব দিয়েছে, না তো আমি তাকে কিছু বলেছি।

-কোনও কিছু না থাকলে কেউ মা বাবার সামনে এমন কথা বলতে পারে মিমি? আমারও তো একদিন এরকম বয়স ছিল।

-আমার পছন্দ ছিল বলেই তো তোমাকে বলেছিলাম মা। পছন্দ থাকলেই তো বিষয়টা প্রেম বা ব্যাপার হয়ে যায় না! তোমাদের অপছন্দ থাকলে তো আমি এগোতে পারি না! তুমি বা তোমরা রাজী হলে ওটা নিশ্চই ব্যাপার হত।

-আজকাল তুই বড় ক্যাটস ক্যাটস কথা বলিস মিমি! 

-এরকম আগে বললেই ভালো হত মা! স্বগোতক্তির মত বলল মিমি!

-বুঝলাম না। কি বললি?

-ছাড়ো এসব। চল খেতে দেবে। আজ ভীষন টায়ার্ড লাগছে।

-কেন রে?

-ওই তো ওদের চার-পাঁচদিনের মতো রান্না করে ফ্রীজে রেখে এলাম। জলখাবারের কয়েকটা আইটেমও মোটামুটি রেডি করে দিয়েছি। জানো তো, আজ আমি ভাত খেয়েছি বিকেল পাঁচটায়।

-হজমের কিছু খেয়েছিস তো মিমি? তোর তো আবার অম্বলের ধাত! 

-খাইনি। আজকাল আর অম্বল হয় না। অভ্যেস হয়ে গেছে সব শ্বশুরবাড়ীর জলের গুণে।

-তোর কথা ঠিক বুঝতে পারছিনা রে মিমি! তুই কি আমাকে কথা শোনাচ্ছিস নাকি শ্বশুরবাড়ীর সুখ্যাতি করছিস?

-সুশীলা বউরা শ্বশুরবাড়ীর নিন্দা করে মা?

-বুঝি না বাবা। খেয়ে নে শিগ্‌গিরি। কাল কখন যাবি?

-ব্রেকফার্স্ট করে। দশটা নাগাদ।

-ও অফিস যাবে না? তুই ফোন করে দিয়েছিস?

-পলাশদা’র ফোন নম্বর আমার কাছে নেই মা। ঠিক আছে আমি আটটা-সাড়ে আটটায় বেরিয়ে যাবো। যদি অফিস যায় তবে ফিরে আসবো, নইলে দেরী করে আসবো। 

-তার চেয়ে ওর মা কে আমি ফোন করে জেনে নিই না ও থাকবে কিনা!

-না মা থাক। ফোন না করেই গিয়ে দেখি।

মমতা মুচকি হাসলেন। সারপ্রাইজ আর কী!

পরের দিন সকালে ঠিক আটটায় বেরিয়ে গেল মিমি। ঝুমার মা ওকে দেখে বললেন, ‘কী ব্যাপার রে মিমি? তুই হঠাৎ?’

-এই পলাশদা’র সাথে দেখা করতে এলাম।

-ও। তুই শুনেছিস সব?

-হ্যাঁ।

-কে বলল?

-ঝুমার কাছে। ডাক্তারের কাছে আগের সব রিপোর্ট বললো তো! তখনই বুঝলাম। 

-যা। ও উপরে আছে। 

-মিমি উপরে উঠে দেখল পলাশ তার ঘরে বসে এক মনে গান শুনছে। দেবব্রত বিশ্বাস। ওকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল পলাশ। ‘কী রে, তুই এখানে?’ 

-অবাক হলে?

-সত্যি সত্যি বাকরুদ্ধ গয়ে গেলাম যে রে! তাছাড়া সপ্তাহের মাঝখান বলে আরও অপ্রত্যাশিত।

-তুমিই বা অফিস কামাই করে ঘরে যে?

-তুই আসবি বলে! 

-যাঃ। তুমি যেন জানতে!

-মন বলছিল রে! এর মধ্যে তুই আসবি। তাই রিস্ক নিইনি। একটাও ছুটি নিইনি এবছরে। যতদিন বেঁচে আছি, নিয়ে নি।

-যতদিন বেঁচে আছি মানে?

-সব জেনেও না জানার ভান করছিস কেন মিমি? আমি জানি তুই ঝুমার থেকে আমার খবর নিবি।

-আমি না জানার ভান করছি না পলাশ দা। বলতে চাইছি, আজকাল কত ভালো ভালো ওষুধ  বেরিয়েছে। অনেকদিন বাঁচবে তুমি। আগে থেকে ‘বাঁচবো না’ ‘বাঁচবো না’ করলে ভালো হবে কী করে?

-ভালো হয়ে কী লাভ মিমি? 

-ছিঃ পলাশদা। তোমার মতো ছেলে এমন কথা বললে সমাজেরই ক্ষতি !

হঠাৎ মিমি পলাশের ডান হাতটা নিজের কোলে নিল। এমন উষ্ণতার আগে কখনও অভিজ্ঞতা হয়নি পলাশের। গভীর আবেগ নিয়ে মিমি বলল, ‘তুমি অ্যাটলিষ্ট আমার জন্য বাঁচো পলাশদা’।

  আজ কী হয়েছে মিমির! এত প্রগল্‌ভতা তো ওর ছিল না কখনও। বিয়ের আগে ও মাঝে মাঝে পলাশের কাছে টুকটাক পড়া বুঝতে আসতো বি.এস.সি বা এম.এস.সি পড়ার সময়। পলাশ আর ওর একই সাবজেক্ট ছিল। কেমিস্ট্রি।তখন পড়াতে গিয়ে পাছে আঙ্গুল ছুঁয়ে যায়, এজন্যই কত গুটি-সুটি মেরে বসত মিমি। তবে কি বিয়ে হলে মানুষের লজ্জা ভেঙে যায়? আগের মতো  আড়ষ্টতা পেয়ে বসে না তাদের? মিমিও এমন করে সরাসরি কথা বলতে পারে, সে স্বপ্নেও ভাবে নি কোনওদিন। কিছুটা আড়ষ্টতার সাথে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘মা এসে পড়তে পারে মিমি, সরে বোস’।

-এলে আসুক।

-ছিঃ মিমি। তোর নিন্দা হবে যে!

-নিন্দাকে ভয় করিনা আর!

-পাগলামি করিস না লক্ষীটি! আলতো করে মিমির মাথায় একবার হাত রাখল পলাশ।

মিমি ছলোছলো চোখে বলল, ‘তোমাকে ঝুমার বিয়ের দিনই দেখে সন্দেহ হয়েছিল পলাশ দা। তোমার শরীরটা ঠিক নেই। এতকরে বলে গেলাম ডাক্তার দেখাতে। সেই দেখাতে দেখাতে তিনমাস কাটিয়ে দিলে!’ 

-ওসব নিয়ে এত ভাবিস না। সবই ভবিতব্য।

-তাই বলে কি সবকিছু ভাগ্যের ঘাড়ে ফেলে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে?

-ছাড় এসব কথা। সত্যি সত্যি বল না, সপ্তাহের মাঝে চলে এলি কেন? 

-তোমায় দেখতে।

-তোর বরের অনুমতি নিয়েছিস?

-আর্জিই পেশ করিনি। অনুমতির প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?

-এমন করে এলি কেন মিমি? অশান্তি হবে।

-কী বলে আসতাম?

ঠিক কথা। কীই বা বলে আসতো মিমি? জীবনটা সত্যি বড় জটিল। পলাশ বলল, ‘ফিরবি কবে?’ 

-ঠিক করিনি। সপ্তাহখানেক থাকার ইচ্ছে।

-এক সপ্তাহ থাকবি? ভালো। বিয়ের পর বাপের বাড়ীতে তো এসে থাকিস না তেমন! 

-বাপের বাড়ীতে কে থাকবে?

-তবে?

-সারাদিন তোমার কাছে থাকবো। বাড়ীতে শুধু খেতে আর শুতে যাবো।

-না মিমি। এমনটা করিস না। আমার বাবা-মা ই বা কী ভাববে!

-বাড়ীতে আসবো না। পার্কে যাবো, সিনেমা যাবো, রেষ্টুরেন্টে খাবো।

-তা হয় না মিমি। তুই এখন অন্যের।

-সুশীলা মেয়েরা তো সারাজীবনই অন্যের পলাশদা! শিশুকালে বাবার অধীন, যৌবনে স্বামীর আর বার্দ্ধক্যে পুত্রের। এই সাতটা দিন আমাকে আমার হয়ে থাকতে দাও না পলাশদা! 

-ঠিক আছে। এখন তুই পালা।

-এই তো এলাম। আরো একঘন্টা আমি থাকতে পারি।

-দোহাই মিমি। তুই চলে যা।

-তাহলে বলো, বিকেলে দেশবন্ধুপার্কে আসবে? তিনটের সময়। আমি ওখানে থাকবো।

-আচ্ছা তুই পালা এবার।

মিমি উঠে এসে পলাশের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। ওর হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বলল,ঠিক আসবে তো? আমি কিন্তু অপেক্ষা করবো।

  মিমি এখন পলাশের একদম নাগালে। ওর চুল থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ এসে লাগছে পলাশের নাকে। চুলগুলো খোলা। হালকা হলুদের উপর সবুজের অ্যাপ্লিক করা শাড়ীতে সত্যি অপরূপ লাগছে আজ ওকে। ওর চোখের দিকে চাইতে হঠাৎ করে শিরশির করে উঠল ওর বুক। মিমি বলল, ‘কিছু বলবে পলাশদা’?

-না রে! 

হঠাৎ করে খুব সন্তর্পণে দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে এসে মিমি জাপটে ধরলো পলাশকে। বলল ‘আমি জানি তুমি এখন আমাকে চাইছো মনে মনে। পুরুষ মানুষ। জোর করতে পারো না?’

-ছাড় মিমি।

আরও জোরে জাপটে ধরল মিমি। ‘না, ছাড়বো না’। 

-তুই অন্যের মিমি। তুই কারও স্ত্রী।

-বললাম না, এখন আমি শুধু আমার।

-তুই তো এমন নয় মিমি! তোর স্বামীর বিশ্বাস নষ্ট করিস না তুই!

-ওটা রক্ষার দায় তো দু’পক্ষেরই পলাশ’দা। 

-মানে? 

-ওসব ছাড়ো পলাশ’দা। এমন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কী ভাবছো? খারাপ মেয়ে?

কী বলবে পলাশ? কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো মিমির তীব্র আলিঙ্গনে পিষ্ট হতে লাগলো। হঠাৎ মন গেল সি.ডি প্লেয়ারটার দিকে। দেবব্রত তখন একমনে গেয়ে চলেছেন ‘চেয়েছিনু যবে মুখে, তোল নাই আঁখি/ দূরেতে নীরব ব্যথা গিয়েছিল ঢাকি...  


Post a Comment

0 Comments