জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭৬/ বিজন সাহা

সোভিয়েত সেনার প্রতি উৎসর্গীকৃত স্মৃতি স্তম্ভ

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭৬ 

বিজন সাহা 

সোভিয়েত সেনার প্রতি উৎসর্গীকৃত স্মৃতি স্তম্ভ 


সোভিয়েত সেনার প্রতি উৎসর্গীকৃত রঝেভের স্মৃতি স্তম্ভ – এটা ১৯৪২ – ১৯৪৩ সালে রঝেভ ও তার আশেপাশে হিটলারের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেসব সোভিয়েত সেনা জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্থাপিত। রঝেভ – ভিয়াজেমস্কি অপারেশন নামে খ্যাত ভয়াবহ সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে ২০২০ সালের ৩০ জুন এই মেমোরিয়াল কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করা হয়। মেমোরিয়ালের কেন্দ্রীয় চরিত্র ২৫ মিটার উঁচু সোভিয়েত সেনার বিশাল স্তম্ভ। ১০ মিটার উঁচু অষ্ট কোণী কৃত্রিম টিলার উপরে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ সৈনিক। তার পরনে যোদ্ধাদের খেলার পোশাক আর তাকে পুরোপুরি আবৃত করে পেছনে উড়ছে রেইন কোট যা প্রয়োজনে তাবু হিসেবে ব্যবহার করা যায়। নীচের দিকে সেই কোট পরিণত হয়েছে ৩৫ টি বলাকায়। এই পাখীগুলি সৈনিককে সমর্থনকারী ধাতুর কাঠামো ঢেকে রেখেছে যার ফলে মনে হয় তরুণ সেনানী যেন দাঁড়িয়ে নেই, যেন সে উড়ছে, বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। সৈনিকের হাত দুটো ঝুলছে। ডান হাতে তার আগ্নেয়াস্ত্র। বাঁ দিকে ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে। মেমোরিয়ালের সামনে ভিড় করা দর্শকদের পাশ কাটিয়ে চলে গেছে তার দৃষ্টি দিগন্তের ওপারে। সৈনিকের মুখ শান্ত, সে চিন্তামগ্ন, সে নির্বিকার। 


পাখীর দলে হারিয়ে যাওয়া এই সৈনিকের ধারণায় আছে রাসুল গামজাতভের বিখ্যাত কবিতা বলাকা     

কখনও কখনও আমার মনে হয় যে এই সৈন্যেরা
রক্তাক্ত মাঠ থেকে আসেনি
তারা কখনোই এই মাটিতে মিশে যায়নি
তারা পরিণত হয়েছে সাদা বলাকায়।।

রঝেভের মেমোরিয়াল

তবে এই অনুপ্রেরণার প্রথম উৎস ছিল আলেক্সান্দর তভারদভস্কির “রঝেভের উপকণ্ঠে আমি নিহত হয়েছিলাম” নামক কবিতা। অনুপ্রেরণার অন্য আরেকটি উৎস ছিল গ্রিগরি চুখরাই-এর সিনেমা “দ্য ব্যালাড অফ এ সোলজার” যেখানে পা হারিয়ে এক সেনা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরছে ক্রাচে ভর করে। তার রেইন কোট এমন ভাবে বাতাসে উড়ছে যেন সে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। শিল্প ইতিহাসবিদদের মতে রঝেভের মনুমেন্টের প্রোটোটিপ বার্লিনের “ওয়ারিয়র-লিবেরাটর”, ভোলগাগ্রাদের মামায়েভ কুরগান ও বুলগেরিয়ার প্লভডিভের “আলিওশা” – এই তিন স্মৃতিস্তম্ভ। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার মনুমেন্টাল ট্র্যাডিশনের অনুসরণ এই স্মৃতিস্তম্ভকে এক বীরত্বপূর্ণ মোটিফ দেয়। অন্য দিকে হাওয়ায় হারিয়ে যাওয়া এই ভাসমান মূর্তি এক পোস্ট-মডার্ণ বক্তব্য। এটা সেনার দুঃখ, যুদ্ধের ট্র্যাজেডিকে সামনে নিয়ে আসে। এর ফলে এই মনুমেন্ট একই সাথে যুদ্ধের ট্র্যাজেডি ও হিরোইজমকে প্রকাশ করে। স্তম্ভের সামনের দিকটায় কালো মর্মর পাথরের কেন্দ্রে রয়েছে লরেল পুষ্পস্তবক আবৃত সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঁচ কোণা তারা যার নীচে সোনালী অক্ষরে লেখা আলেক্সান্দর তভারদভস্কির “রঝেভের উপকণ্ঠে আমি নিহত হয়েছিলাম” কবিতার কয়েকটি লাইন “আমরা মাতৃভূমির জন্য প্রাণ দিয়েছি – মাতৃভূমি শত্রু মুক্ত”, ঠিক তার নীচে রয়েছে ফুল রাখার জায়গা। 

কেন্দ্রীয় টিলার সামনে আরও একটি ছয় মিটার উঁচু টিলা যার ভেতর দিয়ে কাটা ৫৫ মিটার দীর্ঘ গলি চলে গেছে মেমোরিয়ালের দিকে। এটা দেখতে পাথর বা কোন কিছুর টুকরার মত। কৃত্রিম মরিচা দিয়ে ঢাকা এই গলির আঁকাবাঁকা দেওয়াল একে ট্রেঞ্চের রূপ দেয়। সেই দেওয়ালের গায়ে লেখা আছে যুদ্ধে নিহত ১৭ হাজারের বেশি মানুষের নাম। আছে কোন কোন সৈনিকের প্রতিকৃতি। এছাড়াও এই কমপ্লেক্সে সব সময়ই চলছে আলো আর মিউজিকের খেলা যা এক বিশেষ আবহের জন্ম দেয়। টিলার পূব দিকে রয়েছে জাদুঘর। এখানে রয়েছে ছবি, ফ্রন্টের চিঠি, আছে গল্প, আছে রঝেভ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের স্মৃতিকথা। এই জাদুঘরের বিশেষত্ব এর কাঁচের মেঝে যার ভেতর দিয়ে দেখা যায় অস্ত্র, গোলাবারুদ, গ্রেনেড ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম। 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন ইতিহাস নতুন করে লেখা হচ্ছে। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্ব ইতিহাস থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম মুছে দিতে চাইছে পশ্চিমা বিশ্ব। ফলে হিটলারের বিরুদ্ধে বিজয়ে অন্যতম শক্তি হলেও এবং যুদ্ধে ২৭ মিলিয়ন সোভিয়েত নাগরিক আত্মদান করলেও তাদের অবদানকে আজকাল পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয় আর যার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় নিও ফ্যাসিজম। ইউক্রেনের যুদ্ধের পেছনে এর গুরুত্ব কম নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ ও তরুণ সমাজের মধ্যে ঐতিহাসিক ও দেশপ্রেমিক চেতনা জাগিয়ে তোলার জন্য ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল ক্রেমলিনে একটি সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় রাশিয়ার যুদ্ধ ইতিহাস সমিতিকে বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভ ও মেমোরিয়াল প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০২০ সালে বিজয়ের ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে রঝেভে সোভিয়েত সেনার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক সেনাদের কাছ থেকে প্রস্তাব আসে। তার ভিত্তিতে মেমোরিয়াল নির্মাণের জন্য বাজেট করা হয় ৬৫ কোটি রুবল,  ২০ কোটি রুবল সরকারি কোষাগার থেকে বরাদ্দ করা হয়। ২০১৭ সালের ১ আগস্ট মেমোরিয়াল তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার নোটিশ দেয়া হয়। প্রাথমিক ভাবে রাশিয়া ও বেলারুশের বিভিন্ন গ্রুপের ১৩ টি প্রোজেক্ট বাছাই করা হয় যা ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে পাক্লন্নিয়ে গোরির মিউজিয়ামে প্রদর্শন করা হয়। এখান থেকে বিচারক মণ্ডলী তিনটি কাজ বেছে নেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন প্রজেক্টই গৃহীত হয় না।

🍂
 ফলে প্রতিযোগিতার সময়সীমা ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ২০১৮ সালের মে মাসের প্রথম দিকে ১৯ টি প্রোজেক্ট থেকে সেরা তিনটি প্রজেক্ট বেছে নেয়া হয়। শেষে “রঝেভের উপকণ্ঠে আমি নিহত হয়েছিলাম” এই মোটিফের উপর ভিত্তি করে রচিত বেলগোরাদের ভাস্কর আন্দ্রেই করবৎসভ ও ইলেকত্রোস্তালের স্থপতি কনস্তানতিন ফোমিনের প্রোজেক্ট গৃহীত হয় যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আন্দ্রেই কনচালভস্কি। তিনি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক নিকিতা মিখালকভের বড় ভাই ও সোভিয়েত ও রুশ জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা সেরগেই মিখালকভের পুত্র। ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি এই মেমোরিয়ালের ছবি সহ তিন রুবলের কয়েন ছাড়ে সেন্ট্রাল ব্যাংক। প্রথমে কথা ছিল ২০২০ সালের ৯ মে বিজয়ের ৭৫ বর্ষপূর্তিতে মেমোরিয়াল উদ্বোধন করা হবে। কিন্তু কোভিড ১৯ এর কারণে সেটা পিছিয়ে ২২ জুন করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২২ জুন ১৯৪১ সালে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। এখন সেটা শোক দিবস হিসেবে এদেশে পালিত হয়। কিন্তু পরে তারিখ পিছেয়ে ৩০ জুন ২০২০ করা হয়। মেমোরিয়ালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বেলারুশের প্রেসিডেন্ট গ্রেগরী লুকাশেঙ্কো। প্রথম দিকে সোভিয়েত সৈনিকের পোশাক নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলে। পরে সেটাকে বদলিয়ে বর্তমান পোশাক পরানো হয়। তবে এই মেমোরিয়ালের পক্ষেও যেমন অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন এর বিপক্ষেও অনেকেই বলেছেন। তবে এটা আইডিয়া নিয়ে নয়, স্থাপত্য নিয়ে।     

মিউজিয়ামের কাঁচের মেঝে

আমার মনে আছে ওই দিন গুলিয়া কুকুর কেনার জন্য ওই এলাকায় গেছিল আর বাসায় ফিরে সেখানে রাস্তা বন্ধ থাকায় অনেক ঘুরে যেতে হয়েছিল বলে জানিয়েছিল। পরে টিভিতে দেখেই ওখানে যাবার ইচ্ছে জাগে। আসলে এ দেশে প্রায় সব স্ট্যাচুই দেখার মত। প্রতিটি স্ট্যাচু যেন একেকটি গল্প। এখনও মনে পড়ে ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিনস্ক সম্মেলনে গিয়ে খাতিন যাবার কথা। খাতিন একটি ছোট গ্রাম যার প্রায় সব অধিবাসীকে হিটলারের বাহিনী হত্যা করে। এক বৃদ্ধ তাঁর মৃত নাতি বা নাতনিকে হাতে করে দাঁড়িয়ে আছেন খোলা মাঠে - খাতিনের সেই মূর্তি এখনও চোখের সামনে ভাসে। আমরা যখন এই মেমোরিয়ালে পৌঁছুই তখন বিকেল হয়ে গেছে। নীল আকাশে ভাসছে সাদা মেঘ। আর বলাকারা বীর সেনার আত্মাকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশের নীলে। প্রচুর লোক। একেবারেই অন্য রকম অনুভূতি। চারিদিক ঘুরে ঘুরে প্রচুর ছবি তুললাম।   এদেশের প্রায় প্রতিটি সমাধিতে যুদ্ধে নিহত সেনাদের নাম খোঁদাই করা থাকে। এখানেও ব্যতিক্রম নেই। তবে এসব নাম খোঁদাই করে বেশ কিছু সেনার প্রতিকৃতি সত্যিই দেখার মত – এক সময় ০ আর ১ দিয়ে যেমন কম্পিউটারের সাহায্যে কাগজে মোনালিসার ছবি আঁকা হত ঠিক তেমন। অনেকক্ষণ সোভিয়েত সেনার চার পাশে ঘুরে শেষে গেলাম স্থানীয় জাদুঘরে। মোটা কাঁচের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চোখে পড়ছে সমরাস্ত্র। সব মিলিয়ে অভিনব। বাজছে যুদ্ধের মিউজিক। এদেশে যুদ্ধের গান সত্যিই শোনার মত – যেমন কথা, তেমনি সুর, তাতে আছে দেশের প্রতি ভালোবাসা, আছে লড়াই করার ইচ্ছে আবার আছে প্রচণ্ড ভালোবাসার কথা। মিউজিকের শব্দের সাথে চলছে আলোর খেলা। এটা দেশ একটা জাতি তার অতীতকে কতটুকু মনে রাখে তার উপরই নির্ভর করে সে দেশের, সে জাতির ভবিষ্যৎ। আমি অনেক দূর পর্যন্ত দেখি কারণ আমি দৈত্যদের কাঁধে দাঁড়িয়ে আছি। অনেক আগে স্যার আইজ্যাক নিউটন একথা বলেছিলেন। একটি দেশ, একটি জাতি দাঁড়িয়ে থাকে তার, তাদের অতীতের বীরদের কাঁধে। যারা এটা স্বীকার করে শুধু তারাই নিউটনের মত বড় বিজ্ঞানী হতে পারে। দেশ বা সমাজ তার ব্যতিক্রম নয়।   

ভিডিওতে রঝেভ মনুমেন্ট  

https://youtu.be/JYmX3XREguc?feature=shared 

ছবিতে রঝেভের সেনানীর আত্মা  

http://bijansaha.ru/album.php?tag=273


Post a Comment

0 Comments