জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন /পর্ব ২৪/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া


 ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব ২৪

 || ওপেন টু বায়োস্কোপ||
                 
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
       
নতুন সব বইখাতায় মলাট দেওয়া হয়ে গেছে। দাদাদের কাছ থেকে পুরনো সেভিয়েত ইউনিয়ন পত্রিকার পাতা খুলে খুলে সব মলাট দিয়ে নামের পাশে পঞ্চম শ্রেণী লিখেছে সে খুব যত্ন করে।তা যত্ন করলেই বা কী; হাতের লেখার মোটেও ছিরিছাঁদ নেই তার।এই হাতের লেখা আর অন্যমনস্ক বলে দুমদাম অংক ভুল করার জন্য প্রায়ই মা'র হাতে স্কেলপেটা খেলেও হেলদোল নেই তার।ক্লাস ফাইভ মানেই মায়ের ইস্কুলে সে ভর্তি হয়েছে এবার।  নতুন ইস্কুলে চারটেয় ছুটি হয় তবে সবে রেজাল্ট, ভর্তি,নতুন বই এইসব মিলে ইস্কুলে এ সপ্তায় পাঁচ পিরিয়ডে ছুটি হয়ে যাচ্ছে। 
          তারাও রেডি হয়ে থাকে। ঘণ্টা বাজলেই বাক্স হাতে দৌড় দেয় কারণ শীতের বেলায় বড্ডো তাড়াহুড়ো করে সন্ধে নামে। ঝিনিইইই,বাড়ি আয় শিগগির!কী রেএএ আসলিইইই বলে অমনিই বাড়িতে ফেরার হাঁকডাক শুরু হয়ে যায়। খেলার সময় কমে যায় বলে মুখ গোঁজ করে বাড়ি ফেরে সবাই।
        সেদিনকে ঝিনিরা খেলছিল ওপেন টু বায়োস্কোপ।ঝিনি আর বেবি তোরণের মতো করে 
দু হাত উঁচু করে ধরে আছে আর হাতের তলা দিয়ে রেল গাড়ির মতো একে অন্যের ঘাড়ে হাত দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে মণি টেনি খোকন বাচ্চুরা। ছড়া কাটছে সবাই ওপেন টু বায়োস্কোপ/নাইন টেন টেস্কোপ/চুল টানা বিবিয়ানা/সাহেব বিবির বৈঠকখানা/কাল বলেছে যেতে/পান সুপুরি খেতে/পানের মধ্যে মৌরি বাটা/ইস্কাবনের ছবি আঁটা/তার নাম রেণুবালা/গলায় দেব মুক্তোর মালা ... ছড়া শেষে যে হাতের মধ্যে আটকে পড়বে সে আউট। এইভাবেই দুই দলের খেলুড়ি সমান ভাগ করে নিয়ে তারা দুই পা জোড় করে সামনে মেলে বসেছে।পায়ের ওপর এক দুই করে চার হাত দিয়ে দিয়ে উঁচু করে ধরেছে আর দু'দলের খেলুড়িরা লাফ দিয়ে তা পার হচ্ছে।
        টেনি তাদের দুজনের চার হাতের ব্যারিকেডও হাইজাম্পে পেরিয়ে গিয়ে পা ক্রিস ক্রস করে ছড়া কাটল এন্টি বেন্টি টুয়েন্টি টা/পরজাপতি উড়ে যা...। বেবি চেঁচালো আউট আউট।ওর পা আমার পায় লেগিছ!কেইল করবি নে বেবি,মোটোও আমার পা লাগিনি। তাইলেও থুক্কুড়ি না দিয়ে তুই থামলি কেন?তাতিও আউট তুই। বেবি জোরে হেসে উঠল।ফের একটা মারপিট গোছের ঝামেলা বেঁধে যাচ্ছিলোই কিন্তু পেতলের ঘন্টার আওয়াজ আর মেঠাইইইই ...ধামা কুলো পাখা চাইইইই ...শুনেই ওরা থেমে গেল।এই বুড়ো আসে এত কচ্চিৎ যে ঝিনিরা ওৎ পেতে থাকে তার অপেক্ষায়।
         বুড়োর কাঁধের  বাঁকে দুটো বাঁশের ডালায় গোল করে সাজানো ক্যাটকেটে গোলাপি রঙের চিনির ধামা ,কুলো, পাখা এইসব।যে যার বাড়িতে দৌড় দিল পয়সা চাইতে।ঘটি প্যান্টের পকেট হাতড়ে পাঁচ পয়সা পেল ঝিনি। কিন্তু চিনির একখানা ছোট্ট হাতপাখার দাম অন্তত পঁচিশ পয়সা।কাজেই ঝিনিকেও দৌড় লাগাতে হলো বাড়িতে। মা ইস্কুল থেকে ফেরেনি।বড় দিদিমনির নাকি অফিসের অনেক কাজ সারতে হয়। ধুলোমাখা পায়েই সে বড়ঘরে ঢুকলো। 
            ভাগ্যিস বকুলদি রান্না ঘরে আটা মাখছে আর দাদারা ও খেলার মাঠে।তা নইলে এই ধুলো পায়ের জন্যই ঝক্কি পোয়াতে হত।বড়ঘরের খাটে বিছানার তোষক রোজকার মতো শীতল পাটির ওপরে  গোটানো।পাটির তলায় সে জেঠামনির দেওয়া দেওয়া পাঁচটা দশ পয়সা লুকিয়ে রেখেছিল। এখন খুঁজে পেতে তার থেকে দুটো দশ পয়সা বার করে নিলো। পয়সাকড়ি বড্ডই খরচা হয়ে যাচ্ছে। যদিও আরও তিনটে দশ পয়সা থাকলো হাতে। তাছাড়া পিসিমার দেওয়া চারটে পঞ্চাশ পয়সা আর হেমের দুটাকাও আছে তার তবে সেগুলো মাটির লক্ষ্মীর ঘটে রাখা আছে। চুলের কাঁটা দিয়ে অনেক খোঁচাখুঁচি করে তবে তাদের বার করতে হয়।
          রাস্তায় দৌড়ে গিয়ে দেখে তরুদিদের বাড়ি অবধি চলে গেছে লোকটা।চলেই যেত নেহাত ভোদিদি, ঝর্ণাদিরা ওর থেকে খাবার কিনছে তাই। একটুক্ষণ বেশি দাঁড়াবে না এমন গুমোর লোকটার।কেবল দু'চারটে হাঁক দিয়েই হাতের ছোট্ট ঘন্টাটা বাজাতে বাজাতে চলে যাবে অনেক দূর।
     কালভার্টের ওপর ওর ডালা নামিয়ে দরদস্তুর করছে ভোদিদিরা।কী ডাকাত গো!এই সেদিকে ছিল চার আনা আর এবার বলতিছ তিরিশ পয়সা?বুলাদি হাত পা নেড়ে ঝগড়া করছিল। অবিশ্যি কিনল ওইই সবচাইতে বেশি। উত্তেজনায় আর এতটা দৌড়ে এসে তার বুক ধ্বক ধ্বক করছিল। ওদের কেনাকাটার পর কী নেবা তুমি জিজ্ঞেস করল বুড়ো যখন সে আঙুল দিয়ে হাতপাখাটা দেখালো।
     বাচ্চু বেবি দুটো পাখি কিনেছে।মণি টেনি দুই বোন তিরিশ পয়সার একখানা কুলো কিনে সমান ভাগ করছে।সবে ঝিনি পাখার ডাঁটিটা  ভেঙে মুখে পুরতে যাবে চোখে পড়ল খোকনের  হাত ফাঁকা, মুখও শুকনো। নিশ্চয়ই মাসি ওকে পয়সা দেয়নি।  
      তুই কিনিসনি তো কী আমরাও চ' সমান ভাগ করি এটা।মোটোও আমার ভাল্লাগে না ওই খাবার।খোকন মুখ ঘুরিয়ে নিল।মা বলিছ ওতে খারাপ রং দোওয়া থাকে,খেতি নেই। একদিন খেলি কিছু হয় না।নে দিনি তুই।তুই তালি পাখাডা নে, আমার ডাঁটিখান দে। খোকনের চোখ চকচক করে উঠলো। ধুস ডাঁটিতে কী হয়। ওদের মতো আধাআধি ভাগ করি চ'। শীতের গোড়ায় দ্রুত নেমে আসা সন্ধের ঠোঁট জিভ দাঁত গোলাপি রঙ করে  হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরল সবাই।
      পুজোর ছুটিও শেষে বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসেছিল তারা। তারপরই তো ইস্কুল, পরীক্ষা সব হুড়ুম দুড়ুম করে ঘাড়ে লাফ দিল আর সেসব পার করে  নতুন ইউনিফর্ম, বুক লিস্ট আর নতুন ইস্কুলে বাড়ির চাইতে অনেক বেশি গম্ভীর মায়ের মুখ সামলে সুমলে চলতে হচ্ছে তাকে।
       ঝিনিইইই,হাত পা ধুয়ে সোয়েটার পরে পড়তে বসো। রান্নাঘর থেকে মা'র গলা ভেসে এলো।শীতের কালে এই ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধেয় চারধারটা কেমন ছোট হয়ে আসে। পুকুরে হাতপা ধুতে গিয়ে দেখে অল্প অল্প করে কুয়াশা জমছে জলের ওপর আর টেলিগ্রাফের খুঁটি পেরিয়ে পশ্চিম আকাশে বাদুড় উড়ে যাচ্ছে ঝাঁক বেঁধে। ওরা কতদূর যায় কে জানে। হয়ত ইচ্ছামতী নদী পেরিয়ে ইটিণ্ডের ঘাট পেরিয়ে,কাঁটাতার পেরিয়ে অনেক দিন ধরে উড়ে উড়ে মামাবাড়ির সেই পেয়ারা বাগানে গইয়া খেতে যায়।বাদুড় বাদুড় সয়া/মোরে একখান গয়া ঝিনি তপনদার বলা ছড়াটা বিড়বিড় করে।
       ওপারে তার বাপপিতেমোর দেশ হলেও এই যে তিন দিক দিয়ে ঘেরা ইচ্ছামতীর কোলে কোলে তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই জায়গাটা সব'চে ভালো মনে হয়।'আম আঁটির ভেঁপু' পড়তে গিয়ে সে বাবার কাছে শুনেছে বড়মাসিদের বাড়ি যে বনগাঁয় সেখানেই বিভূতিভূষণের বাড়ি।এই  ইচ্ছামতী নদী নিয়েও তাঁর লেখা আছে। কিন্তু বিভূতি রচনাবলী ধরেই দেখো না।ফের তুই বড়দের বই পড়ছিস বলে ছোড়দা কেড়ে নিয়ে বই আলমারির উঁচু তাকে তুলে দেবে। আসলে আম আঁটির ভেঁপু পড়তে গিয়েই সে জানতে পারে বাকি গল্পটা আছে পথের পাঁচালীতে  এবং সেখানেই বিপত্তি। পড়তে পড়তে ইন্দির ঠাকরুনের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল আর সর্বজয়ার ওপর রাগ। কিন্তু দূর্গার মৃত্যুতে সে এত কাঁদছিল আর সারা বাড়ি ঘুরপাক খাচ্ছিল কষ্টে যে তাদের বাবা বলে আর খানিকটা বড় হয়ে তবে যেন সে এসব পড়ে আর তা থেকেই ছোড়দার সর্দারি।

🍂

    তবু ইচ্ছামতীর নাম করলেই তিতপল্লা ফুলের নিরালা দুপুর হাতে জোয়ারভাটির যে নদী সামনে দাঁড়ায় তার ভরা জলে কালবোশেখী ছায়া ফেলে, তীরের ধুধুল প্রান্তরের বনজোছনায় বিভূতিভূষণ হেঁটে যান একলা।
             শৈশবের গাঁগেরামে যতবার সে যেতে চায় ততবার পুরনো এক ঘিঞ্জি শহর তার অলিগলি বুকে করে সামনে এসে দাঁড়ায়।তার রাস্তা খুঁজে খুঁজে আজন্ম শান্তি পাওয়া যায় না। কেবল চেনা নদীর জলে বেগুনি পানাফুলের মতো জমাট বেঁধে থাকে কত বচ্ছর আগেকার কথাটথা ভুলে যাওয়া সব গান। কুয়াশারর সন্ধেয় সেসব ছায়া পাখি ছোট পুকুরের পশ্চিম পারে উড়ে যাওয়া বাদুড়দের মতো কোন শূন্যপথে যে উড়ে যায়।
        এই যেমন পুজোর আগে আগে জামা কেনার পর তাদের বাবার সঙ্গে  যাচ্ছিল তারা বাটার দোকান। ব্যালেরিনা বা বেল্ট দেওয়া সাদামাটা কোনো  জুতো যা মোজার সঙ্গে বা এমনিই পরা যেতে পারে ফি বছর জুতোর তাই রকমফের কিছু নেই তা নিয়ে মাথাব্যথাও নেই অবিশ্যি শুধু মাপখানা দিয়েই ওৎ পেতে আছে কখন জুতোজোড়া বাক্সে ঢুকে বাঁধাছাদা হয়ে যাবে আর দোকানি হেসে কোথা থেকে যেন ফস করে বার করবে একখানা কাগজের রঙচঙে মুখোশ সাথে একটা বেলুন।
        সেবার টাউন হলের কাছেই একখানা বাক্স মতো জিনিস নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক মানুষ আট আনা করে দিলেই তার বাক্সের ফুটোয় চোখ রাখতে দেবে। তাদের বাবা  পয়সা দিলে তারা তিন ভাইবোনই ফুটোয় চোখ রাখল।লোকটা হাতল ঘুরিয়ে  ভিক্টোরিয়া, তাজমহল, টিকলি পরা সুন্দর মেয়েদের মুখ এইসবের ছবি ছড়া কেটে দেখাতে লাগল.. তারপরেতে দেখা গেল/তারাবতী এসে গেল/কপালে তার তারা ছিল...  
               ঝিনুক মা,ছড়া কেটে ওই যে তোমরা ওপেন টু বায়োস্কোপ খেলো এই হলো সেই বায়োস্কোপ। এতোল বেতোল তাদের ছড়ার কোনো মানে আছে নাকি?বাক্সের ভেতর চলন্ত ছবি দেখে এমনিতেই তার ধাঁধা লেগে গেছিল বাবার কথা শুনে ঝিনি আরও অবাক।বায়োস্কোপ নামের এমন চমৎকার জিনিসটা অবশ্য একটু পরেই ফুরিয়ে গেল ; বাক্স নিয়ে হাঁকতে হাঁকতে সে বসিরহাটের পুরোনো বাজারের গলি দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল যেমন করে একটা পাঁচ বা দশ পয়সা পেয়ে মুশকিইইইল আ-সাআআন তার ভুষো তোলা লম্ফোর তাপ ছুঁয়ে,চামরখানা মুখে বুলিয়ে দিয়ে হাঁক দিতে দিতে মিলিয়ে যায় সন্ধের অন্ধকারে আর বুকের কাছটায় হুহু করে তার দূরের হাঁক শুনে শুনে ; বায়োস্কোপওলার জন্যও ঝিনির তেমনিই ফাঁকা লাগছিল। দাদারাও কেমন চুপচাপ।
     সেই মনকেমন ভাঙিয়ে দিতেই বোধহয় তাদের বাবা বলে আরে চলো চলো বাড়ি ফেরার আগে মিষ্টি খেতে হবে না? ছোড়দা লাফিয়ে উঠে বলে! উহু!মিষ্টি না সিঙ্গারা। আচ্ছা তুমি না হয় সিঙ্গারাই।ডি লা গ্রাণ্ডি! বলে আরো একটা লাফ দিয়ে দাদামণির পা মাড়িয়ে সরি মিসটেক মিসটেক বলে ছোড়দা হাসল। খুব যে টেনিদা কপচাচ্ছিস সরি বললি নেহাত নাইলে এক ঘুষিতে এক্ষুণি তোর নাক নাসিকে পাঠিয়ে দিতাম।দাদামনিও সিঙ্গারা মিষ্টির নামেই বোধহয় চনমনিয়ে উঠল।
     ঢাকাই মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে সবাই তারা রসগোল্লা আর ভেজিটেবল চপ নামে চমৎকার এক খাবার খেয়ে জুতোর বাক্স বগলে বাড়িমুখো হলো।
        রাতে ঘুম আসবার আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে   সে ভাবে কোথায় থাকে মুশকিল আসান? কোথায় যাচ্ছিল ওই বায়োস্কোপওলা?
মনে মনে সে ভাবল আর একদিন হঠাৎ করে বেশ দেখা হলো তার সঙ্গে আর তিনটে পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে সে কেবল ছবিই দেখল জাদুবাক্স থেকে। 
       মার সঙ্গে আবার সে বসিরহাট গেল অবিশ্যি জষ্ঠি মাসের গোড়ায়।ততদিনে পঞ্চম শ্রেণীর নিয়ম কানুন অভ্যেস হয়ে গেছে তার কিন্তু বাক্স ঘাড়ে সেই ম্যাজিশিয়ানের সাথে এ জন্মে তার আর দেখা হলো না।
         জাদুবাক্সখানা ঘাড়ে করে সেই যে সেদিন রওনা দিল লোকটা পুরোনো বাজারের কাঁসাপেতলের দোকানগুলো পেরিয়ে বাতাসাপট্টির  পাশ দিয়ে ছোট এক মফস্বলের সরু সব গলিগালা পেরিয়ে সে তো খালি খালি দূরের দিকেই  যাচ্ছে আর তাপ্পি মারা তার কাপড়খানা থেকে আলনায় রাখা পুরনো জামাকাপড়ের গন্ধের সাথে  আতপ চাল আর ছাতিমের বাস মেশানো আজও ঘুমের গন্ধ  উঠছে অবিকল সেদিনকার মতোই।

Post a Comment

0 Comments