পর্ব-৩৭
স্বপন কুমার দে
কোথাও কি কিছু একটা ঘটল? যদি না ঘটে, তবে তো এরকম হওয়ার কথা নয়। হঠাৎ করে কিছু না জেনে মল্লিকাদের পাড়া দিয়ে যাওয়া, বাইকে তেল ফুরিয়ে যাওয়া, স্টার্ট বন্ধ এবং সেখানে মল্লিকাকে আবিষ্কার করা-- এর কোনোটাই পূর্ব পরিকল্পনা তো দূরের কথা, প্রাথমিক অনুমানের মধ্যেও ছিল না। অথচ হল সবটাই। সম্পূরকের মনে হল, হয়তো কেউ আড়াল থেকে চিত্রনাট্য তৈরি করেই রেখেছিল সম্পূরক সেখানে নির্দেশ মত অভিনয় করে গেছে। সম্পূরক ভাবল, বন্ধুর বাড়ি যেতে যেতে ভাবল, বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে আসতে আসতে ভাবল, অন্যের সঙ্গে কথা বলার মাঝে ভাবল, বাড়িতে শুয়ে বসে ভাবতে লাগল। মল্লিকাকে তার ভালো লেগেছে আগেই। মল্লিকার মেধা, বুদ্ধি, শেখানোর দক্ষতা, সাহস এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই দেখে তার প্রতি সূক্ষ্ম শ্রদ্ধাবোধ সম্পূরকের মধ্যে গড়ে উঠেছে। আগে ভালো লেগেছিল মন্টির প্রিয় শিক্ষিকা হিসেবে, একজন হার না মানা লড়াকু ছাত্রী হিসেবে। ভালো লেগেছে মল্লিকার কথা বলার ধরণ, মার্জিত রসবোধ এবং ভদ্রতার জন্য। ভালো লেগেছে তার বন্ধু সুলভ মনোভাবের জন্য। বন্ধু সে নয়। অন্তত এখনও পর্যন্ত সেই অন্তরঙ্গতা বা ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠেনি। তবুও সম্পূরকের মনে হল," বন্ধু বলে ডাকি "। কিন্তু কেন এমন হল? তাহলে কি 'ভালোলাগা' অন্য কিছুর জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছে?
কোথাও কি কিছু ঘটল? মল্লিকা পর পর ঘটে যাওয়া সিকোয়েন্স সাজাল। সম্পূরকের হঠাৎই এই বেপাড়ার সরু গলি দিয়ে যাওয়া, পেট্রোল ফুরিয়ে যাওয়া, মল্লিকার দেখা পাওয়া, তারই সাহায্যে পেট্রোল নিয়ে আসা, ততক্ষণ বসে গল্প করা এবং সম্পূরকের চোখ! চোখ দুটো যেন ভিন গ্রহের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে মল্লিকার দিকে চেয়েছিল। মুগ্ধ হয়ে শুনছিল মল্লিকার কথা। খুব সাধারণ কথাকেও সে অসাধারণ মুগ্ধতায় হৃদয়ঙ্গম করছিল। আর মল্লিকাও সম্পূরকবাবুকে সাহায্য করতে পেরে আনন্দে আপ্লূত হয়ে উঠেছিল। এটা কি শুধুই কৃতজ্ঞতাবোধ না আরও কিছু? মল্লিকার মনেও কি তাহলে দুর্বলতা তৈরি হয়েছে? কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। ভালোলাগার মাঝখানে কঠোর সংযমের বাঁধন তাকে সতর্ক করল। তার তো আবেগ থাকলে চলবে না। ভালোবাসা তার কাছে বিলাসিতার একটা অন্য রূপ। যাদের সবকিছু সাজানো রয়েছে, যাদের নিজেদের স্বাছন্দ্যের জন্য জন্য ভাবতে হয় না, তারা না হয় প্রেম করুক। কিন্তু মল্লিকার তো সেরকম হলে চলবে না। নিজেকে ব্রহ্মচর্যের কঠিন বাঁধনে সে বেঁধে রেখেছে যে একটু ঢিলে হলে চলবে না। তাছাড়া সে সম্পূরকদের বাড়িতে পড়াতে যায়, সে তার একটা গুড উইল আছে, সেখানে সে শুধুমাত্র মন্টির টিচার। একটি পদস্খলনেই তার সে স্ব অর্জিত রেপুটেশন্ তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে। মন্টির কাছে ছোট হয়ে যাবে। অমরেশবাবুর মধ্যে তার প্রতি যে স্নেহাশ্রিত শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে তা চিরতরে ধ্বংস হয়ে সে সকলের ঘৃণা কুড়াবে। সে নিজের সঙ্গে নিজে এমন বিশ্বাসঘাতকা করতে পারবে না।
🍂
বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাত সাড়ে ন'টা নাগাদ বাড়ি ফিরল সম্পূরক। মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। ঢুকে পড়ল মন্টির স্টাডিরুমে।
" কেমন পড়াশোনা হচ্ছে, মন্টি? সামনেই তো মাধ্যমিক, প্রিপারেশন্ কেমন? শুনলাম টেস্টে তুই সেকেন্ড হয়েছিস। ফার্স্ট হতে হবে। সায়েন্স সাবজেক্টগুলো ঠিক ঠাক হচ্ছে তো?"
" কাকুর আজ বড় সময় হল আমার খবর নেওয়ার! হ্যাঁ, আমার প্রিপারেশন্ ঠিক ঠাক চলছে। "
" অঙ্কে কত পেয়েছিস?"
" একশোয় একশো। বলো, আরও ভালো করতে হবে।"
" হবেই তো, যাতে তোর ফাইনালে এক নম্বরও না কমে যায়। ম্যাডাম ঠিক মত পড়াচ্ছেন?"
মন্টি কিছুটা অবাক হয়ে কাকুর দিকে চাইল। " অঙ্ক নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। যাঁর ভাবার কথা তিনি ভাবছেন।" সম্পূরক মন্টির কথার অর্থ বুঝল। মনে মনে আনন্দিত হল। প্রকাশ্যে অবশ্য মন্টির সামনে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল," আচ্ছা আচ্ছা দেখা যাবে ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্টে। ওঃ হ্যাঁ, তোকে বলতে ভুলে গেছি, আজ তোর মল্লিকা ম্যাডামের সাথে দেখা হয়েছিল। তিনি তোর পড়াশোনার খোঁজ খবর নিলেন।"
" কার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সমু?" বলতে বলতে মা ঘরে ঢুকলেন।
" মা, আজকে এক্কেবারে না জেনে মল্লিকা ম্যাডামের পাড়ায় ঢুকে পড়েছিলাম। তারপর সে এক কাণ্ড।" বলে এক এক করে সব ঘটনা বলে গেল। মা শুনছিলেন, মুখে তেমন কিছু বললেন না। শুধু বললেন," মেয়েটার অনেক গুণ আছে।" তারপরই সমুকে তাড়া দিলেন," অনেক দেরি হয়ে গেছে, এবার খাবি চল।"
মায়ের চিন্তা বাড়ল। আবার এক দুর্যোগের কালো মেঘ তিনি দেখতে পেলেন। আশঙ্কা হল ছেলের জন্য। মুখে কিছু বললেন না, ভেতরে ভেতরে সমস্তটা অনুভব করতে লাগলেন। সমুর মানসিক অবস্থা তিনি জানেন। একবার কঠিন আঘাত পেয়েছে সে, আবার যদি সেরকম ঘটে? মল্লিকা কী করবে, কী বলবে, তিনি জানেন না কিন্তু নিজের পরিবার, নিজের সমাজকে তিনি চেনেন। একজন বংশমর্যাদাহীন বস্তির মেয়েকে কি সবাই মেনে নেবে? হয়তো ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ বিচ্ছিন্ন হওয়াটাও অসম্ভব নয়।
খাবার টেবিলে প্রায় সকলেই খেতে বসেছে। পরিবেশন করছে বড় বৌমা সুদেষ্ণা।তার শাশুড়িমা সবকিছু লক্ষ্য রাখছেন,বিশেষত স্বামীর খাবারে যেন রেস্ট্রিকশন্ থাকে, এটাই তাঁর দেখার। সবাইকে খেতে দিয়ে শাশুড়ি-বৌমাও খেতে বসে পড়ল। খেতে খেতেই সুদেষ্ণা বলল," দেখুন না বাবা, মন্টি বায়না ধরেছে, আমরা যে ওর পরীক্ষার পর সিকিম বেড়াতে যাবো, তাতে যেন ওর মল্লিকা ম্যাডামকেও নিয়ে যাওয়া হয়। এ কীরকম বায়নাক্কা বুঝুন বাবা। আমরা যেখানে যাবো সেখানে সেখানে ওনাকেও নিয়ে যেতে হবে? উনি কি এই পরিবারের লোক?"
অমরেশবাবু হাসতে হাসতে বললেন," মন্টি হয়তো ভেবেছে ওর ম্যাডাম এই পরিবারেরই লোক। তোমার মেয়ের জন্য আমাদের যা যা করা উচিত, মল্লিকা ততটাই করছে কিনা। আসলে মন্টি এখনও বড় হয়নি। আমাদের মত বড় হলে বুঝত।"
" না বাবা, আপনি আর প্রশ্রয় দেবেন না। এখন থেকেই বুঝতে হবে। মল্লিকা ম্যাডাম এ বাড়ির শুধুমাত্র একজন টিচার, মন্টিকে পড়ান এবং সেজন্য মাসে মাসে বেতন পান। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। হতে পারে মন্টির ফেভারিট টিচার, তাই বলে তাকে ফ্যামিলি ট্যূরে সঙ্গী করতে হবে? এ আমি মেনে নিতে পারছি না।"
সম্পূরক কথাগুলো শুনছিল। এবার কিছু একটা বলার উপক্রম করতেই বাবা ঈশারায় তাকে থামতে বললেন। খাওয়া প্রায় শেষের মুখে তবু সম্পূর্ণ না খেয়েই মন্টি টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। চিৎকার করে উদ্দালককে ঠেলা দেয় সুদেষ্ণা," দেখছো, দেখছো তোমার মেয়ে কেমন অবাধ্য হয়ে উঠছে। তাড়াবো,তাড়াবো। আগে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা হয়ে যাক তারপর ঐ ম্যাডামকে দেখছি।"
উদ্দালক এতক্ষণ একমনে খাচ্ছিল, এইবার ব্যাপার ঘোরালো দেখে ফিল্ডে নেমে পড়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে," সুদেষ্ণা, তুমি একটু শান্ত হও। তুমি যা বলছো, তাই হবে। তবে আমি বলছিলাম, মন্টি যখন চাইছে...."
" না। বড় বৌমা যেটা চাইছে, সেটাই হবে।" বাড়ির সকলে দেখল গৃহকর্ত্রীর দৃঢ় ,গম্ভীর অথচ সংক্ষিপ্ত কথাই শেষ কথা। উদ্দালক বুঝতে পারল না মা কেন সুদেষ্ণাকে সাপোর্ট করল।
মণিদীপার কথা আরও স্পষ্ট হল," আমি বলছি, সবকিছুরই একটা সীমা মেনে চলা উচিত। মল্লিকা যত ভালো মেয়েই হোক, সে এ বাড়ির কেউ নয়। তাই বৌমা যেটা বলছে সেটা একদম ঠিক কথা।"
অমরেশবাবু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। সিলিং ফ্যানটা একইভাবে ঘুরে চলেছে।
0 Comments