জ্বলদর্চি

হান কাং- এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী মহিলা সাহিত্যিক /সজল কুমার মাইতি

হান কাং- এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী মহিলা সাহিত্যিক

 সজল কুমার মাইতি


হান কাং এর জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমের জোয়াল্লা প্রদেশের গোয়াংজু শহরে ১৯৭০ সালের ২৭শে নভেম্বর। তিনি ৫৩ বছর বয়সে এই বিশ্বখ্যাত সম্মান নোবেল পুরষ্কার লাভ করলেন ২০২৪ সালের সাহিত্যের নোবেলজয়ী হিসেবে। তিনি আঠের জন মহিলাদের মধ্যে একজন যাঁরা আজ অব্দি এই অনন্য নোবেলজয়ীর সম্মান লাভ করেছেন। এবং তিনি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম মহিলা সাহিত্যিক যিনি এই অনন্য দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হলেন। তাঁর লেখা " হিউম্যান অ্যাক্টস" অনন্য। নোবেল কমিটির সেক্রেটারি কথায় " কাব্যিক গদ্যের মাধ্যমে মানব জীবনের ভঙ্গুরতা, ব্যথা বেদনার ঘাত প্রতিঘাত তার লেখায় পরিস্ফুট"। নোবেল কমিটির সেক্রেটারি যখন কাং কে এই আনন্দ সংবাদ ফোনের মাধ্যমে জানান তখন কাং ছেলের সঙ্গে সবেমাত্র রাতের শেষ খাবার খেয়ে উঠেছেন। 

হান কাং এর বাবা হান সিউয়ান ওন ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক। কাং এর ছোটবেলাতে তারা রাজধানী সিওলের সুয়ুরি তে চলে আসেন। তার বাবার সাহিত্য চর্চার জন্য তাদের পরিবারকে অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। তা নিয়ে ছোট্ট কাং এর কোনো অভিযোগ ছিল না। বরং চারপাশে সাহিত্য চর্চা ও বই এর পরিবেশে ছোট্ট কাং খুশিই ছিল।

কাং কোরীয় সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে সিওলের ইউয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তার কাব্য চর্চা শুরু হয় পাঁচটি কবিতাগুচ্ছের সংকলনের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে। এই কবিতাগুলি ত্রৈমাত্রিক সাহিত্য পত্রিকা " লিটারেচার এন্ড সোসাইটি " এর শীতকালীন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই কবিতাগুলির মধ্যে একটি হল 'উইন্টার ইন সিওল'। তার পরের বছর কাং এর লেখা ছোট গল্প " দ্য স্কারলেট অ্যাঙ্কর" 'সিওল সিনমান স্প্রিং লিটারেরি কনটেস্ট' এ জয়ী হয়। তার লেখা গল্পগুচ্ছ " এ লাভ অফ ইওসু" ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় ও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়। তার লেখায় জাপানি ঔপনিবেশিক শাসনে কোরীয়দের অত্যাচার, যন্ত্রণার কথা প্রকাশ পেয়েছে। তার লেখায় শরীর ও আত্মার মধ্যে সম্পর্ক, জীবিত ও মৃতের মধ্যে সম্পর্ক ও কাব্যধর্মী ও পরীক্ষামূলক স্টাইলের মধ্যে সম্পর্কের এক সুন্দর চিত্র চিত্রিত হয়েছে। এ যেন সমসাময়িক গদ্যসাহিত্যের এক উদ্ভাবনকারী প্রয়াস। 

২০০৭ সালে হান  " এ সঙ টু সিঙ কামলি" নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এর সঙ্গে একটি মিউজিক অ্যালবাম ও প্রকাশিত হয় যেখানে হানের গাওয়া গান ও আছে। হান বিখ্যাত কোরীয় আধুনিক কবি য়ুই স্যাঙের কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই প্রভাব ও জাপানি ঔপনিবেশিক অত্যাচার তার বিখ্যাত উপন্যাস " দ্য ভেজিটেরিয়ান" এ ছত্রে ছত্রে বর্ণিত হয়েছে। এই উপন্যাসের দ্বিতীয় খন্ড " মঙ্গোলিয়ান মার্ক" য়ুই স্যাঙ লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। " দ্য ভেজিটেরিয়ান" উপন্যাস পরে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ডেবোরাহ স্মিথ এর ইংরেজি অনুবাদক। ২০১৬ সালে এই উপন্যাস আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ জেতে। হানের এই উপন্যাস ২০১৬ সালের নিউইয়র্ক টাইমসের বুক রিভিউতে সর্বশ্রেষ্ঠ দশটির মধ্যে একটি বই ছিল। তার অন্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে " দ্য হোয়াইট বুক" তার জীবনস্মৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও " হিউম্যান অ্যাক্টস" তাকে নোবেলজয়ীর সম্মান এনে দেয়। এটি ইটালিতে অনূদিত হয়। " উই ডু নট পার্ট" নামে তার আরও একটি উপন্যাস ২০২১ সালে প্রকাশ পায়। এটি ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। এটি একজন লেখকের কাহিনী অবলম্বনে লেখা। ২০২৩ সালে তার আর ও একটি উপন্যাস "গ্রীক লেশনস" প্রকাশ পায়। পরে এটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়। 

হানের স্বামী হং ইয়ং হি একজন সাহিত্য সমালোচক। তিনি ক্যুং হি সাইবার ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক। হানের একজন পুত্রসন্তান আছে। মা ছেলে মিলে তারা সিওলে একটি বই দোকান চালান। হান মজা করে বলেন তিনি মাইগ্রেন আক্রান্ত এবং এর প্রভাব তাকে অনেক বেশি বিনয়ী করে তুলেছে।

হান তার সাহিত্যকৃতির জন্য অনেক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯৯ এ তিনি তার "বেবি বুদ্ধা" উপন্যাসের জন্য পঁচিশতম কোরীয়ান লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এবং ২০০০ সালে তিনি কোরীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক প্রদত্ত  ইয়ং আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড এর জন্য নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে দ্য ভেজিটেরিয়ান এর দ্বিতীয় খন্ড মঙ্গোলিয়ান মার্ক এর জন্য য়ি স্যাঙ লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।  ২০১০ সালে তার লেখা "দ্য উইন্ড ইজ ব্লোয়িং" এর জন্য ডংরি লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড পান। দ্য ভেজিটেরিয়ান উপন্যাস তাকে ২০১৬ তে বিশ্বখ্যাতি এনে দেয় আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ জেতার মাধ্যমে। ২০২৩ এ তিনি রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচার এ আন্তর্জাতিক লেখিকা হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০২৪ এ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের 'একুশ শতকের একশোটি সর্বোত্তম বই' এর হানের লেখা দ্য ভেজিটেরিয়ান অন্তর্ভুক্ত হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করে। অবশেষে ২০২৪ এ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরষ্কার নোবেল জয় তার জীবনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পরিচয় এনে দিয়েছে।

হানের সাহিত্যকৃতির প্রমাণ সাহিত্য সংস্কৃতির বিভিন্নক্ষেত্রে বিস্তারিত। কবিতা দিয়ে শুরু, তারপর ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সংগীত বহু ক্ষেত্রেই তা ব্যাপ্ত। তার লেখার চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। তার লেখা "বেবি ফুদ্ধা" ও "দ্য ভেজিটেরিয়ান" চলচ্চিত্রে রূপ লাভ করেছে। হান কাং হলেন প্রথম কোরীয় যিনি নোবেল জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করলেন, আর তিনি হলেন প্রথম এশীয় মহিলা সাহিত্যিক যিনি নোবেল জয়ীর এই অনন্য ও দুর্লভ সম্মানের অধিকারী।

...............

লেখক : অধ্যাপক

🍂

Post a Comment

0 Comments