জ্বলদর্চি

বার্লিনের ডায়েরি ৪৯ পর্ব। চিত্রা ভট্টাচার্য্য (রোমের পথেপরবর্তী অংশ কলোসিয়াম )

প্রাচীন রোম।

বার্লিনের ডায়েরি  ৪৯ পর্ব।    চিত্রা ভট্টাচার্য্য  
(রোমের পথেপরবর্তী অংশ 
কলোসিয়াম )

রাত গভীরে নাগরিক আকাশের গায়ে দেবীপক্ষের তৃতীয়ার কাস্তের ফলার মত একফালি চাঁদ শ্রীময়ীর জানলা দিয়ে রবাহুতের মত তেরছা ভাবে লেখার টেবিলে এসে পড়েছে। দূরে কোথাও শারদীয়া দুর্গোৎসবের শুভ সূচনায় দেবীবরণে মন্দিরে মন্দিরে ঢাকের গায়ে কাঠি পরার সাথে কাঁসরের আওয়াজ   আনন্দ বার্তা বয়ে নিয়ে আসছে। শ্রীময়ীর নিদ্রাহারা চোখ ও মন ও দুই ই রয়েছে হারিয়ে যাওয়া রোমান ইতিহাসের পাতায়। প্রাচীন ইতিহাসের পাতাগুলো নীরব আকর্ষণে ওকে কোন অতীতে টেনে নিয়ে চলেছে। টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলোয় বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে পড়ছে,শতাব্দীর পর শতাব্দীর গহনে চাপা পড়ে থাকা কলোসিয়ামের স্তূপাকৃত ইটের পাঁজরের প্রকোষ্টে , বিশাল তোরণ দ্বারে বা সাদা ধবধবে মার্বেলপাথরের স্তরেস্তরে লুকোনো অজানা রহস্যের দিকে। 

ওর ভ্রমণ উপন্যাস ''বার্লিনের ডায়েরি '' তে রোম নগরের পথ পরিক্রমায় কলোসিয়ামের কাহিনী লিখতে বসে ভাবছে সেই পিয়াজ্জার প্রাঙ্গনে ইতালীর বিখ্যাত ছাদহীন রঙ্গমঞ্চ। প্রায় ৭০ থেকে ৭২ খ্রীষ্টাব্দে এই কলোসিয়ামের ভিত্তি স্থাপনার থেকেই বহু অত্যাচারিত মানুষের পরিশ্রম দেহের রক্ত বিন্দু ,চোখের জলের বেদনার অশ্রূ দিয়ে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য্যের অন্যতম এই নিদর্শন টি । ঐতিহাসিকদের মতে সেই সময় ফ্লাভিয়েন বংশের সম্রাট ভেসপাজিয়ান কলোসিয়ামের নির্মাণ কার্য্যের সূচনা করেন এবং তাঁর পৃষ্টপোষকতায় তিনতলা পর্যন্ত অডিটোরিয়াম টি  নির্মিত হয়েছিল।  তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র টাইটাস ৮০ খ্রীষ্টাব্দে চতুর্থ তলটি নির্মাণ সম্পূর্ণ করেছিলেন। এরপর ৮১ খৃষ্টাব্দের থেকে  ৯৬ খৃষ্টাব্দের মধ্যে সম্রাট ডোমিটিয়ান এর পুনরায় সংস্কার করেছিলেন । এই তিনজন সম্রাটই ফ্লাভিয়ান বংশের ছিলেন বলে কলোসিয়ামটিকে "ফ্লেভিয়ান এমফিথিয়েটার " ও বলা হয়। রোমান সম্রাট নিরোর গোল্ডেন হাউজের পাশেই দশ বছর ধরে এই রঙ্গমঞ্চটি গড়ে উঠেছিল এবং আদিপর্বে এটি একটি মুক্ত ক্রীড়াঙ্গন ছিল। 
রোমের বিখ্যাত কলোসিয়াম।

  কলেজের সিলেবাসে রোমের ইতিহাস পড়তে গিয়ে এই সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য  কলোসিয়ামের রোমাঞ্চকর কাহিনীর সাথে  শ্রীময়ীর নিবিড় পরিচয় ঘটেছিল সেই কোন অতীতে। রোমান হলিডে বা গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমায় ওদের রক্তাক্ত ছবি  , কত হিংস্র নির্মম খুন যখমের দৃশ্য, কত পাশবিক অত্যাচারে বীভৎস উল্লাসের মর্মান্তিক দৃশ্য চোখের ওপর ভেসে ওঠে ।   

  বিশ্বের অন্যতম বিশাল ডিম্বাকৃতির এই মুক্ত রঙ্গমঞ্চটি  রোম সাম্রাজ্যের স্বর্ণ যুগের কুৎসিত জঘণ্যতম রক্তপিপাসু প্রাণসংহারী দ্বৈত যুদ্ধের কলঙ্কময় ইতিহাসের নীরব স্বাক্ষী। যার ভিত্তি স্থাপনার থেকেই বহু অত্যাচারিত মানুষের পরিশ্রম দেহের রক্ত বিন্দু ,চোখের জলে ভেসে,বেদনার অশ্রূ দিয়ে গড়ে উঠেছিল  এই বিখ্যাত স্থাপত্য টি। যার প্রতিটি ইটের পাঁজরের স্তূপে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ,প্রকোষ্টের গায়ে মিশে আছে সহস্র মানুষের রক্তেস্নাত নিথর শরীর ,  লড়াইয়ে পরাজিত  বিধস্থ প্রাণীর ক্ষত বিক্ষত দেহের শেষ পরিণতি,তাজা লোহিত স্রোত । অন্তিম কালের আর্তনাদ ,  শেষ মুহূর্ত অব্দি বাঁচার তাড়নায় হাহাকার। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনেও জীবনের শেষ লগ্নে প্রাণ ভিক্ষার করুণ আবেদন ,কত তিতিক্ষা কত অশ্র্রু জলের প্লাবন।কত অশরীরী আত্মার দীর্ঘশ্বাস।  সব ব্যথা বেদনার হাহাকার বুকে বয়ে আজও নিশ্চল নির্বিকারে ইতালীর রোম নগরের কেন্দ্র বিন্দুতে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই কলোসিয়াম। শোনাযায় এর উদ্বোধনের উৎসবে সেকালে  ৯০০০ জংলী জানোয়ার কে এনে হত্যা করে এক পৈশাচিক হত্যা লীলার আনন্দে এর শুভারম্ভ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল। 
ধ্বংস প্রাপ্ত কলোসিয়াম।

পড়ার টেবিলে রাইটিং প্যাডের ওপর ঝুঁকে পড়ে কলম চালায় শ্রী। মনে পড়ে সেদিন এজেলিয়ার রেস্তোরাঁয় ফ্যামিলি সাইজের ঢাউস এক পিজ্জা দিয়ে ডিনার সারার পরে সারাদিনের ক্লান্ত শরীর বিছানায় প্রবেশ মাত্র অকাতরে ঢলে পড়েছিল গভীর ঘুমে। সকালে বেশ বেলায় দেরীতে ওর ঘুম ভেঙেছিল। তিতিরের সেদিন প্রচুর ব্যস্ততা ঠিক সকাল ন' টায় পেপার প্রেজেন্টেশন ছিল। কনফারেন্সে রওনা হয়ে যাবার আগে ঋষভ কে বলেছিল কাজ শেষ হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসবো তোমরা রেডি থাকবে।

🍂
 ঠিক সাড়ে বারোটায় তিতির এলো কোর্ডিলিয়া এবং আলেক্সেইয়ের সঙ্গে। গোলাপি ফর্সা, ব্রাউন চুল তীক্ষ্ণ নাসা নীল চোখের রাশিয়ান আলেক্সেই এক মুখ সারল্যে ভরা হাসি নিয়ে হাত জোড় করে ভারতীয় ভঙ্গিতে শ্রী ও ঋষভ কে নমস্কার জানাতে অদ্রিজা রীতিমত অবাক ! বলে এ আবার শিখলে কোথা থেকে? আলেক্সেই হেসে বলে আরে তুমি ভুলে গেলে? আমি যে তোমাকে দেখে প্রথম দিন ই বলেছিলাম  " আমার মম ইন্ডিয়ান ,ড্যাড রাশিয়ান। "  ভারতীয় রীতি সংস্কৃতি রুচি বোধের সাথে অল্প স্বল্প পরিচয় আছে।
                                           কলোসিয়াম সম্পর্কে ওর দারুণ কৌতূহল ,সিনেমায় ও  ছবিতে দেখেছে এবারে স্বচক্ষে বন্ধুদের সাথে দেখবে । আলাপ পরিচয় সারা হলে ওরা বাসে ঠিক ১৫মিনিটে পিয়াজ্জা ডেল কলোসিয়ো তে পৌঁছছিল।

 ষ্টেডিয়ামের গেটের সামনে টিকিট কেটে অন্দরে প্রবেশের লাইনে তখনো দর্শনার্থীদের যথেষ্ট  ভীড়। শ্রী কলসিয়ামের সিংহদুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে।  বাস্তবিকই সব কল্পনাতীত লাগছিল। নিজেকে ও প্রশ্ন করেছিল এ কী বাস্তব ! এ স্বপ্ন  নয় তো ?  এক অজানা শিহরণ --অদ্ভুত অনুভূতি ওর মন কে বারবার নাড়া দিয়েছিল।  ভাবছিল এ পৃথিবী টা যেন এক স্বপ্নের দেশ।

কোর্ডিলিয়া অদ্রিজার হাতে মৃদু স্পর্শ করে খুব নিভৃতে বলে তোমাদের মা মেয়ে কে দেখে আমার এই মুহূর্তে হারিয়ে যাওয়া মমের কথা মনে পড়ছে। এক ভুলে থাকা অদ্ভুত অনুভূতির সাড়া জেগেছে মনে।     
                                    
ঐ যে  রাস্তার উল্টো দিকে জিওলজিক্যাল সার্ভের বড়ো অফিস বিল্ডিংটি দেখছো , মম ঐ সার্ভে অফিসের পুরাতত্ত্ব বিভাগের এমপ্লয়ী ছিল। একসময় আমার ছোটবেলা এখানেই কোনো এককামরার এপার্টমেন্টে কেটেছিল। আট বছর বয়সে হোস্টেলে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মমের কাছে এই কলোসিয়ামের গল্প প্রতিরাতে শুনে ঘুমিয়েছি। আসলে বাবা কে দেখিনি , কে ছিলেন জানিনা। কিন্তু মা মেয়ের একাকী সংগ্রামী জীবন বেশ এগিয়ে চলেছিল। লেখা পড়া শিখে ঘুরে যখন দাঁড়ালাম তিন বছর আগে মা সুইসাইড করলেন।  এই সুন্দর পৃথিবী থেকে কেন বিদায় নিলেন আজো সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি । ভাগ্যের এমন পরিহাস ,যে হাজবেন্ড কে বিশ্বাস করে পথ চলবো ভেবেছিলাম সে ও প্রতিদিন অবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। মিথ্যা বঞ্চনার শিকার হয়ে চলেছি। প্রমান খুঁজছি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার । কোর্ডিলিয়ার এমন আবেগ ঘন স্মৃতিরোমন্থনে অদ্রিজা নির্বাক। বিদেশীনী মেয়েটির জলে ভেজা নীলচোখ যেন বৃষ্টি স্নাত অপরাজিতা। শ্রীর প্রথমে ওকে দেখে মনে হয়েছিল এই জেদী একগুঁয়ে মেয়েটা মায়াদয়া হীন মেজাজী।  কিন্তু কত যে বিশাল ক্ষত বুকে বয়ে ওর দিন চলছে তা ওর সাথে না মিশলে বোঝা সহজ নয়।       
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম আশ্চর্য্য-- কলোসিয়ামের অন্দর স্থল।

টিকিটস পাওয়া গেলে ভিতরে ঢুকে আলেক্সেই বলে রোমান স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব এবং রোম শহরের একটি বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক এই কলোসিয়ামের  সম্পর্কে গ্লাডিয়েটরের গল্প ছাড়া ওর কিছু জানা নেই।তবে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে একে ২০০৭ সালে নথি ভুক্ত করেছে জানি । কলসিয়ামের নিপুন শিল্প শৈলী স্থাপত্য ওদের বিস্ময়ে মুগ্ধ করেছিল। অদ্রিজা ঋষভের হাত ধরে বলে , এখানে এসে এক অদ্ভুত মানসিকতায় শিহরিত হলাম । ঋষভ ও বিস্ময়ে অভিভূত। হাতের গাইড বুক আর ম্যাপ ভরসা করে অন্দর মহলে ওরা প্রবেশ করে  ভাবছিল গাইড নেবে।   কোর্ডিলিয়া বলে চিন্তা নেই আজ গাইডের ভূমিকায় আমি আছি। মমের কাছ থেকে শোনা গল্প ছবির মত আমার ব্রেনে আঁকা হয়ে আছে।              

হলদে ফর্সা মাঝারি গড়নের,বয়েস কাট চুলের মেয়েটি গটগট করে সামনে এগিয়ে গিয়ে ডান হাতের তর্জনী প্রসারিত করে বলে,এই যে অসম্ভব সুন্দর তোরণ দ্বার গুলো দেখছো ,এরই নির্মাণ কৌশলের মাধ্যমে একসঙ্গে দর্শকের এতো ভীড় সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছিল। এখানে মোটামুটি ৬৫ হাজার দর্শক একসাথে বসতে পারতেন। কী  অসাধারণ নির্মাণ শৈলী এবং বুদ্ধিমত্তা সে যুগে ছিল। ৬৫ হাজার লোক একই সাথে খুব তাড়াতাড়ি সভা শেষে বেরিয়ে ও আসতে পারতেন। আসনের নীচে নির্মিত হয়েছিল ভোমিটোরিয়াম পথ। ঐ পথ ধরে দর্শক গণ তাদের নির্দিষ্ট আসনে পৌঁছতো। এই ভোমিটোরিয়ান পথ টি হোলো লোকজন চলাচলের জন্য আসন সারির নীচে বা পিছনের দিকে থাকে। ঐ যে তোরণ গুলো দেখছো এখানে প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য ৮০ টি তোরণ দ্বার ছিল। সাধারণ দর্শকের জন্য ৭৬টি  ও  তিন টি দ্বার ছিল গন্যমান্য ব্যক্তি দের জন্য। শুধু উত্তর দিকের একটি বিশেষ ভাবে নির্মিত প্রধান তোরণ দ্বার দেখিয়ে বলেছিল এই দ্বারটি দিয়ে শুধু রোমান সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী এবং রাজ পরিবারের ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজন অমাত্যবৃন্দ কলোসিয়ামে তাঁদের নির্দিষ্ট বিলাসী সভা কক্ষ্যে যাতায়াত করতেন। 

শ্রী বলে রোমানসম্ৰাট তথা শাসকের এক প্রহরের প্রমোদ লীলায় কত নীরিহ প্রাণের বলিদানের স্বাক্ষর বহন করছে এই মঞ্চ যেখানে গ্ল্যাডিয়েটরদের বধ্য ভূমিতে বাধ্য করা হতো ক্ষুধার্থ  হিংস্র পশুদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য। যে কলঙ্কিত রঙ্গমঞ্চ নির্মিত হয়েছিল শুধু মাত্র সম্রাটের মনোরঞ্জনের জন্য। মধ্যাহ্নের রৌদ্রজ্জ্বল আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা সৌধটির শীর্ষ বিন্দুর দিকে তাকিয়ে ওর মনে প্রশ্ন জাগে এর উচ্চতা কত হতে পারে ? প্রস্থ ই বা কত ? এর সীমানা পরিধি ? কলোসিয়ামের যা দেখছে সব কিছুতেই চরম বিস্ময়ে ওরা বাকরুদ্ধ হয়ে আসছিল । আলেক্সেই ও ঋষভ একমনে ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসাব করে সমাধানে আসে এই ডিম্বাকার চারতলা উঁচু বিশাল স্থাপত্য টির উচ্চতা দৈর্ঘে প্রায় ১৮৯ মিটার এবং ১৫৬ মিটার চওড়া। মূলএলাকা ছয় একর।  বহিরাংশের দেওয়ালের উচ্চতা ৪৮ মিটার। ডিম্বাকার কেন্দ্রীয় এরিনাটি ৮৭ মিটার লম্বা এবং প্রস্থে ৫৫মিটার চওড়া। ভেতরে পুরো জায়গাটি একটি ৫মিটার উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা আছে। 

  এবারে কোর্ডিলিয়া বলে ঐযে ঘেরা এরিনাটি দেখছো ঐ খানেই লড়াই হতো হিংস্র জানোয়ারের সাথে গ্লাডিয়েটরের বা দুই গ্লাডিয়েটরের মধ্যে। এতক্ষন কলোসিয়ামের দৈর্ঘ্য প্রস্থ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে ম্যাথমেটিক্যাল ক্যাল্কুলেশনের গম্ভীর  আলোচনায়  শ্রী  অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামায় নি , শুধু এদের বক্তব্য একটু সুযোগ পেলেই মনোযোগী ছাত্রীর মত ডায়েরিতে নোট করছিল। কিন্তু পাশেই এক ইটালীয়ান ট্যুরিষ্ট  ভদ্রলোক পেশায় প্রত্নতাত্ত্বিক রিকার্ডকার্ডোর সাথে আলেক্সেই  ও কোর্ডিলিয়ার বেশ আলাপ জমে উঠেছে।  তিনি বললেন ষ্টেডিয়ামের মধ্যবর্তী যে ঘেরা অংশটি দেখছো সেখানে এম্পিথিয়েটারের প্রধান আকর্ষণ গ্ল্যাডিয়েটর দের লড়াই যুদ্ধ চলত। দুজন গ্ল্যাডিয়েটরের মধ্যে যেমন লড়াই চলতো তেমনি কখোনো গ্লাডিয়েটরদের লড়াই করতে ছেড়ে দেওয়া হতো হিংস্র ক্ষুধার্থ উপবাসী বন্য পশু দের সামনে। এবং এই লড়াইয়ের জন্য হাজারের ওপর ভয়ঙ্কর হিংস্র প্রাণী গন্ডার সিংহ হাতি বাঘ ভাল্লুক নেকড়ে এমন কি কুমির ও উত্তর আফ্রিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমদানি করা হতো। এই বন্য পশুগুলোকে ক্ষুধার্থ  অবস্থায় রাখা হতো  গ্যালারির নীচের প্রকোষ্ঠর খাঁচার মধ্যে। এইভাবে একসাথে ১০০টি অভুক্ত পশু প্রদর্শন করা হতো। এবং লড়াইয়ের সময় তাদের ছেড়ে দেওয়া হত। এবং অধিকাংশ গ্লাডিয়েটোর কিছু ক্ষণের মধ্যেই ছিন্নভিন্ন হয়ে প্রাণ হারাতো হিংস্র পশু খাদ্য হয়ে। এবং সম্রাট মাততেন উল্লাস আনন্দ সুখে। তিতির চমকে উঠে বলে কি বীভৎস ! সাংঘাতিক সব পরিকল্পনা। 

শ্রীময়ীর কৌতূহলী মনে কলোসিয়ামের প্রতিটি তলা ও বিশাল অডিটোরিয়ামের সব কোণগুলো নিয়ে অজস্র জিজ্ঞাসা।  আলেক্সেই ও রিকার্ড ইতালীয়ান ভাষায় আলোচনা শুরু করেছিল। ঋষভ বলে চল আমরাও ওদের সাথে এগিয়ে যাই। শ্রী ও ফুরফুরে মেজাজে এগিয়ে চলেছে ওর চিন্তা নেই ওদের  ইতালীয়ান ইংলিশ বুঝে নিয়ে তিতির ঠিক দোভাষীর কাজ করে ওকে সব বাংলায় বলে দেবে।                                     গ্লাডিয়েটর

রিকার্ড বলেছিল ৭০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে ইহুদি বিদ্রোহের পর সে যুগে জেরুজালেম থেকে এক লক্ষ ইহুদি বন্দিদের দাসপ্রথা অনুসারে বন্দী করে নিয়ে আসা হয় এবং তাদের অনলস পরিশ্রমে  অমানুষিক দৈহিক শ্রমে পিঠে বা কাঁধে করে রোম থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে টিভেলি চুনাপাথরের খনি থেকে ট্র্যাভেনটাইম চূনা পাথর সংগ্রহ ও বহন করে নিয়ে এসে  ইট চুন সুড়কি ইত্যাদির ব্যবহারে ধীরেধীরে এই বিশাল স্থাপত্য টি গড়ে তুলেছিল ।  এই কলসিয়ামের তিনটি তলের প্রতিটিতে ৮০ টি করে মোট ২৪০ টি আর্চ বা তোরণ আছে। সেই সময়ে নীচের তলের যে তোরণ গুলো ঢুকতেই দেখা গিয়েছিল ,সে দ্বার গুলো প্রবেশ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। উপরের তলার তোরণগুলোর অন্দরে ও বাইরে প্রতিটি দেওয়ালে এক সময় গ্রীক পৌরাণিক দেবদেবীর ও  বীর যোদ্ধাদের  ব্রোঞ্জের বড় মূর্তি দিয়ে সাজানো ছিল।এছাড়া রঙ্গ মঞ্চের গায়ের দেওয়াল জুড়ে বহু মূল্যবান ধাতুর তৈরী ভাস্কর্যে সমৃদ্ধ করাছিল যার হদিস এখন আর দেওয়ালের গায়ে নেই।                 

কলোসিয়ামের  বিশাল লম্বা কাহিনী । শ্রীময়ীর ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে এলে অবাধ্য চোখের পাতা বুজে আসে।  অলস সোহাগী রাত ক্রমশঃ এগিয়ে চলেছে ভোরের দিকে। পুবের আকাশে প্রত্যুষার আবির্ভাবে রাতের আঁধার ক্ষীণতর হয়ে আসছে। ওর জানলার পাখির বাসায় ওপরে দোয়েল দম্পতির প্রণয়ালাপ চলছে।  কিচির মিচির শব্দে পাখা ঝাপ্টে বাসা ছেড়ে আকাশে পাড়ি দেবার আগে শ্ৰীময়ী কে জানায় এবার অন্তত দুচোখের পাতা এক করো। শ্রী আপন মনেই বলে এবার ঘুমোতে যাবো। কিন্তু কলোসিয়ামের বিশাল কাহানি শেষ হলো না।  
শ্রী ভাবে বাকী টা আজ তোলা থাক আগামী কালের জন্য।

Post a Comment

0 Comments