জ্বলদর্চি

গোবুচন্দ্র /পুলক কান্তি কর


চিত্র- শুভম দাস 

গোবুচন্দ্র

পুলক কান্তি কর


গোবুচন্দ্রকে পাশে বসিয়ে হালকা ফুলফুল ছিটের জামাটা ওর গায়ে পরিয়ে দেখলেন সৌমাল্য। যা শীত পড়েছে ! ঈশ্বরের জীব, ওদের শীত নিবারণের  ব্যবস্থাটাও ঈশ্বরই করেন; তবুও সৌমাল্যের মন স্বভাবতই করুণা প্রবণ। এই শীতে নিজেরা কুঁকড়ে মুকড়ে বসেন –সামনে গোবুচন্দ্র কুন্ডলী পাকিয়ে  শুয়ে থাকে, বড় খারাপ লাগে। পাড়ার টেলাররা সব বাবু লোক, কুকুরের পোষাক বানাতে  সম্মানে লাগে। একে ওকে তেল লাগিয়ে অবশেষে অনুরাধার দ্বারস্থ হলেন তিনি। অনুরাধা তাঁর সেলাই মেশিনে বেশ ভালোই তৈরী করে দিয়েছেন জামাটা। খুশী খুশী মুখ করে সৌমাল্য ঘরের ভেতরের দিকে তাকিয়ে হাঁক পাড়লেন, ‘অনু!’

দু-চারবার ডাকার পর অনুরাধা বাইরে এসে বললেন, ‘কী হল?’

-এইদ্যাখো, তোমার বানানো শার্টটা গোবুচন্দ্রকে ভালো ফিট করেছে। তুমি এর একটা ব্যবসা খুলতে পারো। বাজারে নিশ্চই এর চাহিদা আছে!

-আমি বসে বসে এই করি আর কি? এই একটা বানিয়ে দিয়েছি আর ঝঞ্ঝাট করো না।

-আমি তো ভাবছিলাম ওর জন্য একটা ব্লেজার বানিয়ে দেব।

-ভাবতে বসলে তোমার আর লাগাম থাকে না।  ব্লেজারই বানাবে যখন, পায়ে একটা প্যান্টও পরিও!

-পরাবো তো!

-হ্যাঁ, পরিয়ে দুপায়ে ওকে হাঁটাবে, নইলে ব্লেজারের শোভা খুলবে কেন! অনুরাধার গলায় কপট রাগ। আসলে এইসব পোষ্য তিনি দু-চক্ষে দেখতে পারেন না। কিন্তু বিয়ের পর থেকে এ বাড়ী কুকুর বেড়াল ছাড়া একদিনও উনি দেখেননি; ফলে আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেছে।

সৌমাল্য বললেন, ‘আহা চটছো কেন! ব্লেজারটা না হয় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি, সোয়েটার তো বানানোই যায়!’

-কুকুর বেড়ালের সোয়েটার বানানো আমি জানিনা গো!

-এর মধ্যে আর আছে কি?

-তাহলে তুমিই বানিয়ে নাও না।

-আমি তো বানাতে জানিনা। মানুষেরটা যদি আমি বানাতে পারতাম, তবে ওদের মতো করে এরটাও বানিয়ে দিতাম। বেসিকটাই তো জানি না।

-জানো না, অথচ এ জ্ঞান তোমার আছে যে ব্যাপারটার মধ্যে কঠিন আছে কী!

        সৌমাল্য একটু প্রলেপ দিতে বললেন, আরে আমার কথার স্পিরিটটা বুঝতে পারোনি অনু! আমার বক্তব্য হচ্ছে – তোমার জন্য এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয় এটা। তুমি যা ইনোভেটিভ, বুদ্ধি করে ঠিক একটা উপায় করে ফেলবে!

-বার খাইয়ো না আমায়! তোমার ফন্দি আমি বুঝিনা ভেবেছো! এই করে মাথায় হাত বুলিয়ে সোয়েটারটা বানিয়ে নেবে!

-আরে, অবলা জীব! তুমি বানিয়ে দিলে তোমারই পূণ্য হবে! আমার হবে কি?

-আমার এত পূণ্যের দরকার নেই! বলেই ভেতরের দিকে যাবার উদ্যোগ করলেন অনুরাধা।

-আরে অনু, যাচ্ছো কোথায়? আমি সিরিয়াসলি বলছি, ওর জন্য একটা সোয়েটার বানিয়ে দাও প্লীজ!

অনুরাধা এতটা কাকুতি মিনতি প্রত্যাশা করেননি। বললেন, ‘কী ব্যাপার বলতো?  এর আগেও তো শীতকাল এসেছে, গেছে। তোমার এমন আবদার তো আগে কখনও শুনিনি!’

-দ্যাখো এবছর শীত বেড়েছে। আমরাই কেমন কুঁকড়ে আছি দেখতে পাচ্ছো না? তাছাড়া গোবুচন্দ্রের বয়স এখন এগারো হল। ওরও তো বয়স হয়েছে। এই শীত ও নিতে পারছে না। আগের বছরগুলোতে ওকে এভাবে ঘরের মধ্যে জড়িয়ে মাড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছো? ও সব সময় ফূর্তি নিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতো।

-এত আর মায়া বাড়িও না।

-আর মায়ার জায়গা কোথায় অনু? এই তো শেষ প্রজন্ম।

-শেষ প্রজন্ম বলছো কেন?

-আমাদের জন্য তো শেষ! এ কোথায় এর ফলক রেখে গেছে আমাদের পক্ষে তো চেনা মুশকিল। এতদিন পর্যন্ত এর মা, ঠাকুমারাই আমাদের বাড়ীতে থাকতো। এই শেষ পুরুষ প্রতিনিধি।

গোবুচন্দ্রের প্রায় ছ’পুরুষ সৌমাল্যের বাড়ীতে। সৌমাল্যের বাবা নলিনী মজুমদার বাংলাদেশের ফরিদপুরের লোক। মস্ত বড় বাড়ী, প্রচুর জমিজমা, পুকুর বাগান নিয়ে সম্পন্ন লোক। যখন মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাংলাদেশ উত্তাল, নলিনী ধীরে ধীরে ওদেশের পাততাড়ি গুটানোর পরিকল্পনা করতে লাগলেন। গোবুচন্দ্রের প্র-প্র-মাতামহী একপাল ছেলেপুলে নিয়ে তখন ওঁদেরই আশ্রিত ছিল। একদিন এক অশান্ত রাতে যখন দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ফরিদপুর ছাড়লেন, তখন পোষ্যদের নেওয়ার মতো ইচ্ছা বা উপায় ছিল না। আগে থেকেই যোগাযোগ করে উনি ত্রিপুরায় জায়গা জমি কিনে রেখেছিলেন। অনেক বাধা ঝামেলা সামলে ওঁরা ত্রিপুরায় এসে থিতু হলেন। দিন সাত আট পরে দেখা গেল গোবুচন্দ্রের বৃদ্ধ মাতামহী তার এক পুত্র-সন্তানকে সাথে নিয়ে ত্রিপুরায় উপস্থিত। সৌমাল্য তখন ছোট, দশ-এগারো বছরের। কিন্তু বিষ্ময় এখনও কাটেনি, ওরা বাংলাদেশ থেকে কিভাবে এপারে এল? নিছক গন্ধ শুঁকে? নাকি ফলো করে? যদি ফলো করে এসে থাকে তবে মাঝে সাত-আটদিন কোথায় ছিল? ত্রিপুরায় এসে পথ হারিয়ে ফেলেছিল? তারপর থেকে ওরা বংশ পরম্পরায় এই বাড়ীতেই ঠাঁই নিয়েছে। গোবুচন্দ্র ওদের শেষ প্রতিনিধি।

নতুন পোষাক পেয়ে গোবুচন্দ্র অনেকক্ষণ কিঁউ কিঁউ করতে থাকলো একেবারে সদ্যোজাত বাচ্চাদের মতো। মানে ব্যাপারটা ওর পছন্দ হয়েছে সেটা পরিষ্কার। অনু ভেতর থেকে সেকেন্ড রাউন্ড চা নিয়ে এসে বললেন, ‘এখনও আহ্লাদিপনা চলছে? ওকে সরে বসতে বলো। আমি এখানে বসবো।’ গবুও বোঝে, মালকিন এলে ওর ঘরে থাকা বারণ। ও আস্তে আস্তে মুখ দিয়ে দরজা খুলে বেরোতে গিয়েও একবার পেছন ফিরে চাইল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ঠান্ডায় ওর আর বাইরে গিয়ে  বসার ইচ্ছে নেই। মালকিন যদি কোনও ভাবে মত বদলান। সৌমাল্য বললেন, ‘বাইরে ঠান্ডা, দূরে গিয়ে একটু বসুক না অনু!’

-বাইরে রোদ। একটু রোদে বসলেও তো গা গরম হয়। তুমি না বায়োলজি পড়াতে? একটু হাড়গোড়ও তো শক্ত হয় ওতে! খালি সারাদিন বুড়োকর্ত্তা সেজে বসে থাকা!

বোঝা গেলনা বাক্যগুলো গোবুচন্দ্রের উদ্দেশ্যে বর্ষিত হল, নাকি সৌমাল্যের জন্য। সৌমাল্য দেখলেন গোবুচন্দ্র আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে চলে গেল। সৌমাল্যদের বাড়ীটা সোনারপুরে। নলিনী বেঁচে থাকতেই সৌমাল্য কলকাতায় চলে এসেছিলেন চাকরীর সুবাদে। ক্যানিং এর দিকে একটা স্কুলে চাকরী পেয়েছিলেন। সোনারপুরে বাড়ী কেনার কারণ কিছুটা কলকাতার কাছে থাকা। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ী ও হরিনাভির কাছাকাছি। সবদিক দিয়ে সোনারপুরই পছন্দ হয়ে গেল তাঁদের। বাজার থেকে একটু ভেতরে বাড়ীটা। সামনে অনেকখানি জায়গা। বড় বড় পুরনো দিনের গাছ, বাগান আছে উঠোনে। বাড়ীর পেছন দিকে একটা মাঝারি পুকুর। পদ্ম-শালুক মোটামুটি সারাবছরই ফুটে থেকে সেখানে। গোবুচন্দ্রের মা যখন বেঁচেছিল, অনেক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে উঠোন জুড়ে সংসার চলতো তার। পাড়ার কুকুরদের সাহস ছিল না ওর মৌরুসিপাট্টায় কেউ দখলদারি করে। ঋতুর প্রয়োজন ও কিভাবে মেটাতো তা সৌমাল্য এবং অনুরাধার অনুমানের বাইরে। নিশ্চই ও রাধার চেয়েও বড় অভিসার পটিয়সী ছিল। তখন বাড়ীতে তিন চারটে বেড়ালও ছিল। সৌমাল্যের রোজ কাজ ছিল বাজার থেকে ওদের জন্য আলাদা করে চুনোমাছ কেনা। যেটা সবচেয়ে আদরের বেড়াল ছিল, ওর নাম ছিল নেফারতিতি। ও বাসি মাছ খেতো না। কাঁচা মাছ ছুঁয়েও দেখতো না। ওর জন্য আলাদা করে মাছ হালকা আঁচে ভেজে দিতে হত। অনু মাঝে মাঝেই মুখ ব্যাজার করে বলতেন, ‘বেশী বেশী আদিখ্যেতা!’ নেফারতিতি মাঝে একবার বেশ কিছুদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। ও যে কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল – কেউ জানে না। সে সময় আক্ষরিক অর্থে সৌমাল্য ছ’সাতদিন কোনও খাবার মুখে তোলেন নি। রাগে গজগজ করতে করতে অনুরাধারও একই অবস্থা। সৌমাল্য স্কুল কামাই করে দিনরাত রাস্তায়, ঝোপে, জঙ্গলে যেখানে পেরেছেন খোঁজার চেষ্টা করেছেন। একদিন সে হঠাৎ করে ফিরেও এলো। নিরুত্তাপ, যেন কিছুই হয়নি। সৌমাল্যকে ব্যাপারটা ভীষণ প্রভাবিত করেছিল। উনি রাগ করে একমাস ওর সাথে কথা বলেন নি। যদি ও হারিয়ে যেত, ওর অভিব্যক্তি নিশ্চই এমন হ’ত না! নেফারতিতির মেজাজও রাজকীয় ছিল। ও সহজে ভাঙবার পাত্র নয়। তবে কিনা সময় বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস। মানুষ বড় বড় শোক ভুলে যায়, ভাঙা মনও জুড়ে যায়। কিন্তু যেদিন ও মারা গেল – সেদিন বাড়ীতে একেবারে শ্মশানের স্তব্ধতা নেমে এল। সৌমাল্য ওকে নিয়ে মাটি খুঁড়ে কবর দিয়ে এসেছিলেন। পুরুত ডেকে শ্রাদ্ধ-শান্তি করিয়েছিলেন। বাড়ীতে নিরামিষ হয়েছিল এগারোদিন। নেফারতিতির একটা ছেলে ছিল – ডোকরা। ওটাই এই বাড়ীর শেষ বিড়াল। সাদা রঙের ধবধবে চেহারায় শুধু মাথার উপরটা একটুখানি কালো – বড় সুন্দর দেখতে ছিল ও। নরম, তুলতুলে। সৌমাল্য সচরাচর যেটা করেন না –ডোকরার বেলায় তেমন একটি অপরাধ করেছিলেন। হাসপাতালে গিয়ে ওর নির্বীজকরণের অপারেশন করিয়ে এনেছিলেন। হুলো বেড়াল ওঁর পছন্দ ছিল না। এরা ঠিক ঘরে থাকার জন্য নয়। কিন্তু আজও তাঁর এই নিয়ে একটা খারাপ লাগা কাজ করে। নিজের ইচ্ছার জন্য একটি প্রাণীর প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতা লোপ না করলেই হত! এজন্য গোবুচন্দ্রের ক্ষেত্রে তিনি এমন কিছু করেন নি। ডোকরার যখন ছ’বছর বয়েস, হঠাৎ একদিন ও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সৌমাল্য ভাবলেন –এটা বোধহয় ও জিন সূত্রে মায়ের থেকে পেয়েছে। এবার খোঁজাখুঁজি কিছুই হল না। দিন পাঁচেক বাদে পাড়ার একজন খবর দিল – ও নাকি বাসে চাপা পড়ে মারা গেছে। তারপর থেকে বিড়ালের পাঠ চুকে গেছে এ বাড়ীতে। মাঝে মাঝে কোনও মা-বিড়াল বাচ্চা নিয়ে এখানে বসত করার চেষ্টা করেনি তা নয়, তবে কিনা অনুরাধার তীব্র আপত্তিতে আর গোবুচন্দ্রের চৌকিদারিতে তা আর সম্ভব হয়নি। অনুরাধা সমানে বলেন - ‘এবার এসব মায়া ত্যাগ করো বাপু, বয়স হচ্ছে - এসব শোক আর নেওয়া যাচ্ছে না। এখন যেগুলো আছে আছে, আর নতুন করে মায়া বাড়িও না। ’এখন সব কমতে কমতে শুধুমাত্র গোবুচন্দ্রতে এসে ঠেকেছে। গোবুচন্দ্র কিন্তু তার মর্জির মালিক। সকাল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটায় ও ঘুম থেকে উঠে যায়, সৌমাল্যের সাথে সাথেই। সৌমাল্য পাশেই একটা পার্কে খানিকক্ষণ জগিং করে হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার ভেতরে যান – গোবুচন্দ্রের যেদিন মুড হয় সঙ্গে যায়। অবশ্য পার্ক পর্যন্ত ও রোজই যায়, পরের হাঁটাটুকু ওর জন্য অপশনাল। ও যখন একদম ছোট ছিল, তখন থেকেই ওর এই অভ্যাস। সারাদিন ও সৌমাল্যের সাথে লেগে থাকতো বলে অনুরাধাই মজা করে বলতেন – হবুচন্দ্র রাজার গোবুচন্দ্র মন্ত্রী। সেইথেকে  ওর নাম গোবুচন্দ্র। ও একেবারেই দেশী নেড়িকুকুর। কিন্তু মেজাজ-চলন-বলন এবং স্বাস্থ্য সবকিছুতেই অ্যালসিসিয়ানকে হার মানায়। ও যখন রাস্তা দিয়ে চলে, সত্যি সত্যি অন্যান্য কুকুর সসম্ভ্রমে ওর সামনে পিঠ দিয়ে গড়াগড়ি খেয়ে বশ্যতা জানায়। ওর মা লালিরও তেজ ছিল খুব। তবে লালি খুব সুন্দরীও ছিল। এতগুলো বাচ্চাকাচ্চা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে খুব মেনটেইনড রাখতো। সৌমাল্যের এই সোনারপুরের বাড়ীতে লালি যখন এল, তখন ওর সদ্য সদ্য জন্ম হয়েছে। লালির মা লহরী ত্রিপুরায় নলিনীবাবুর কাছে থাকতো। নলিনীবাবুর মারা যাওয়ার খবর পেয়ে সৌমাল্য যখন ত্রিপুরায় পৌঁছোলেন, তখন গভীর রাত। সৌমাল্যের মা বহুদিন আগেই গত হয়েছিলেন। সৌমাল্যকে দেখেই লহরী দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওঁর গায়ের উপর। তখন উনি দেখেছিলেন লহরী প্রায় ছ’সাতদিন কিছু মুখে দেয়নি। ওর চোখ থেকে শুধু টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়তো। শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে যাবার পর সৌমাল্য পড়লেন মহা সমস্যায়। ওঁর ভাই দীপ্তেন আবার কুকুর-বেড়াল একেবারেই পছন্দ করে না। লহরী বুঝতে পারছিল সৌমাল্যের কলকাতায় চলে আসার দিন এসে গেছে। সে তখন এমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল যে সৌমাল্য ওকে কলকাতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। ওর তখন তিনটে বাচ্চা, আর তার মধ্যে দুটো পুরুষ। সৌমাল্য এয়ারপোর্টে গিয়ে খোঁজখবর নিলেন কিভাবে এদের সঙ্গে করে আনা যায়। ওঁরা জানালেন খাঁচায় পুরে আনা যেতে পারে। কিন্তু খাঁচায় লহরীকে পোরা অসাধ্য হয়ে উঠলো। সৌমাল্য যতই বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে ওদের উনি কলকাতায় নিয়ে আসবেন কিন্তু ওরা কোনওভাবেই বুঝতে চাইলো না। অবশেষে একটা কার ভাড়া করে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন ওদের। প্রায় তিন দিন লেগেছিল আসতে। লহরী কলকাতায় এসে খুব বেশীদিন বাঁচেনি। বছর দুই-তিন পরে ও যখন মারা যায়, তখন লালি উদ্ভিন্ন যৌবনা। ভারতচন্দ্র কবেই বলে গেছেন যৌবনে কুক্কুরী ধন্যা। লালির সে গর্ব ছিল বটে। তবে ওরা কেউ গোবুচন্দ্রের মতো মুডি ছিল না। গোবুচন্দ্র পার্ক থেকে জগিং সেরে এসে বারান্দায় বসে খানিকক্ষণ জিরোয়। সৌমাল্য ফিরলে ওঁর সাথে চা-বিস্কুট খায়। তারপর আবার ঘন্টাদুয়েক ওর দেখা মেলে না। বারোটা থেকে বিকেল চারটে বাড়ীতে। দুপুরে আহারাদি সেরে দিবানিদ্রা দেয়। চারটের পর পাড়া বেড়ানো।  সেসময় সে রাস্তাঘাটে সৌমাল্য বা অনুরাধাকে দেখলেও বিশেষ পাত্তা দেয়না। আড়চোখে একবার দেখে না দেখার ভান করে অন্য ফুটে চলে যায়। কখনও ডাকলে আলাদা ব্যাপার! সন্ধে সাড়ে ছটায় আবার চা -বিস্কুট। কোনওদিন বিশেষ কারণে অনুরাধা বা সৌমাল্য যদি বিকেলে বেরোন তবে –বাড়ীটার সামনের মোড়ে একটা চায়ের দোকানে বলা থাকে, গোবুচন্দ্র সেখানে গিয়ে বৈকালিক নেশাটি সেরে আসে বিষ্কুট সহযোগে। সন্ধ্যের পর থেকে গোবু বিশিষ্ট ভদ্রলোক। বাড়ীর সামনের বারান্দায় ওর জন্য একটা চট বিছানো থাকে –সেখানেই সে শোয়। শীতের সময় একটা কম্বলও ওর জন্য বরাদ্দ থাকে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার –গোবুচন্দ্র বিছানা নিজে করে নেয়। সন্ধে সাতটা থেকে রাত এগারোটায় শোওয়ার আগে পর্যন্ত টিভির ঘরে ও সবার সঙ্গেই থাকে। টিভি দেখে গল্প আড্ডায় কান রাখে। শুধু অনুরাধা এলে ওকে একটু দূরে দূরে থাকতে হয়।

(৩)

অনুরাধা সন্ধের চা নিয়ে গোবুচন্দ্রের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলেন ও সারা চত্বরে কোথাও নেই। সাধারণত এমনটা হয় না। গজগজ করতে করতে ফিরে এসে বসলেন সোফায়। সৌমাল্য বললেন, ‘কী ব্যাপার, গজগজ করছো কেন?’

-এই শীতে দ্যাখো না, গোবু ফেরে নি। আবার আমায় একবার চা করে দিতে হবে।

-ভালোই তো। এই অনারে আর একবার চা খাওয়া হয়ে যাবে।

-আজ্ঞে না। চা এই একবার। করলে ওর জন্যই করে দেবো।

-কেন? ওর বুঝি গরম করে দিলে চলে না?

-না। ফ্রেশ বানিয়ে দিতে হবে।

-গরম করে দিলে চায়ের স্বাদ সত্যি সত্যি চলে যায়। ওদের তো এসব সেন্স মানুষের চেয়ে বেশী!

-তা ঠিক।

-অনু, আমাকে দ্বিতীয়বার চা না দেওয়ার কারণ কী?

-কতদিন থেকে বলছি সুগারটা চেক করো। বয়স পঁয়ষট্টি হয়ে গেল। এবার তো নিয়ম করে ব্লাডটা চেক করা উচিৎ। মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ।

-সুস্থ মানুষ অকারণ ডাক্তারের কাছে যাবো কেন? আমার কি কোনও সমস্যা হচ্ছে?

-তাই বলে একটা রুটিন চেক-আপ করাবে না?

-ডাক্তার যেই শুনবে রুটিন চেক-আপ, গাদা গুচ্ছের টেষ্ট করাবে।

-করালে তো ভালো।

-আরে বোঝ না, সব কমিশনের খেলা!

-কমিশন খেলে খাবে! তোমার পরীক্ষাটা তো হবে!

-না গো অনু! শুনি নাকি মাঝে মাঝে বিভিন্ন কোম্পানির থেকে যে হেল্থ চেক-আপের প্যাকেজ আসে – ওগুলো তে নাকি মিছিমিছি রিপোর্ট দেয়। সত্যি সত্যি পরীক্ষা করে না।

-ওসব দুষ্টু লোকেদের গসিপ। একপ্রকার মতলববাজি। কাউকে না কাউকে তো তোমায় বিশ্বাস করতে হবে। এসব বাহানায় আর ফেলে রেখো না। এবার টেষ্ট ফেষ্টগুলো করাও। বুঝতে চাওনা, হঠাৎ করে কিছু একটা হয়ে গেলে?

-সে তো যে কারোর যে কোনও সময় হয়ে যেতে পারে অনু। রিপোর্ট করানো থাকলেও হতে পারে।

-তাই বলে সাবধান হবে না? তোমায় এসব কথা বললে তো রাগ করো, তুমি বলোতো, তোমার বা আমার কারোর যদি আগে ডাক আসে –অন্যজন কী নিয়ে থাকবে?

-এই বৃদ্ধ বয়সে আর এই নিয়ে গঞ্জনা কেন অনু?

-বাচ্চা-কাচ্চার প্রয়োজন তো এই বয়সেই!

-ভাবো তো –যাদের ছেলেমেয়েরা থেকেও দ্যাখেনা – আমরা তো অন্তত তাদের থেকে ভালো আছি।

-এ তো আঙুরফল টকের গল্প! যখন বয়স ছিল, তখন কতবার বললাম – চল ডাক্তার দেখাই, শুনলে না। কুকুর বেড়াল নিয়ে মেতে রইলে।

-এ কথা বলো না অনু। ডাক্তার কি আমি দেখাই নি? ডাক্তার যা যা টেষ্ট লিখেছে সবই তো করিয়েছি।

-ডাক্তার তো বলেছিলেন আই.ভি.এফ করতে। তুমি রাজী হলে না।

-তখনকার দিনে এর সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা ছিল অনু? আর তার জন্য যে টাকা লাগতো –তা কি আমি বিয়ার করতে পারতাম? তখন তিনলাখ টাকা চেয়েছিল। আমাদের ষ্কুল টীচারের কত মাইনে ছিল তখন অনু?

অনুরাধা চুপ করে রইলেন। কথাটা যে সৌমাল্য মিথ্যে বলছেন তা নয়, তবু অনুরাধার কোথাও যেন মনে হয়, সৌমাল্যের কিছুটা হলেও বিষয়টার মধ্যে উদাসীনতা ছিল। হয়তো এইসব পোষ্যদের নিয়ে ওঁর পিতৃত্ব তৃপ্তি পেত। মাঝে মাঝে সৌমাল্য বলতেন – দ্যাখো কুকুর কখনও বেইমানি করে না। মানুষের বাচ্চা হলে নিশ্চিত করতো। দ্যাখো না, অমুকের ছেলে বাপ-মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলো। ওই অমুকের ছেলেটাকে এত খেটেখুটে মানুষ করলো, এখন বিদেশে সেটেলড। এদেশে আসেই না। দেখবে আমাদের গোবু কখনও এমন করবে না। যখন সৌমাল্য চাকরী করতেন, পাঁচ বছরে একবার অন্তত ভোটের ডিউটিতে যেতে হত। তখন দুদিনের জন্য বাড়ীর বাইরে থাকতে হত। এতবড় বাড়ীতে একা অনুরাধা। প্রথম প্রথম বেশ ভয় করতো। চোর-ডাকাতের ভয় তো ছিলই – এছাড়াও মেয়েদের কত রকমের ভয়। কিন্তু অনুরাধা অনুভব করতেন, গবু তখন এক সেকেন্ডের জন্যও বাড়ী ছেড়ে কোথাও যেত না। পাড়া বেড়াতেও নয়, জগিং করতেও নয়! প্রথম দিকে বাপের বাড়ীর কাউকে এসে থাকতে বলতেন, শেষের দিকে আর তার প্রয়োজন হত না। এসব পুষ্যির জন্য সাধারনত সৌমাল্যরা বড় একটা কোথাও বেড়াতে যেতেন না। যখন গোবুচন্দ্র একা হয়ে গেল – তখন দু-একবার বেড়াতে গেছেন ওঁরা। গোবুকে খাবারের জায়গা দেখানো থাকতো। ও ওই ক’দিন শুকনো খাবার টাবার খেয়ে চালিয়ে নিতো। চা –এর বন্দোবস্ত তো করা থাকতোই। হঠাৎ করে একটা দরজা আঁচড়ানোর শব্দে সৌমাল্য উঠে গিয়ে দেখলেন –বাইরে গোবুচন্দ্র। একটা অস্বাভাবিক শব্দ করে গোঁগাচ্ছে ও। ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা গেল – পেছনের একটা পা কেমন ঝুলে আছে – ও পা টা গুটিয়ে কষ্ট করে চলছ। নির্ঘাত মোটর সাইকেল চাপা দিয়েছে, - নইলে কেউ মেরেছে। গোবুর যা দাপট –কেউ ওকে মেরে পালাবে – এমনটা মনে হল না। রাগে দুঃখে সৌমাল্যের ভেতরটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। অনেক কষ্টে উনি বললেন, ‘অনু এদিকে একবার এসো তো!’

-কেন, কী হল আবার?

-দ্যাখোনা, গোবুর বোধহয় একটা পা ভেঙে গেছে। তুমি একটু এসে টর্চটা ধরো। কোনও ইনজুরি আছে নাকি দেখি।

-তুমি দেখে কী করবে? দ্যাখো, কোনও ভেটেনারী ডাক্তার এখন পাও কিনা!

-এতরাতে কি বেলগাছিয়ার ভেটেনারি কলেজে নিয়ে যাওয়া যাবে?

-তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ভেটেনারিতে আবার ইমার্জেন্সি কবে খোলা থাকে?

-পশুপাখীদের কি ইমার্জেন্সি হয় না অনু? রাতেভিতে ওদের কিছু হলে মানুষ যাবে কোথায়? বেলগাছিয়ার কলেজটায় ইমার্জেন্সি আছে জানি, কিন্তু এতরাতে অতদূর নিয়ে যাবো কিভাবে –সেটাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি।

🍂

-তুমি আগে যে ডাক্তারকে কল দিতে, তিনি নরেন্দ্রপুরে থাকেন না? তাঁকে একবার ফোন করে দেখো না। যদি না আসতে চান তবে আমরাই গিয়ে দেখিয়ে আসবো।

ডাঃ বেরা বেশ ভালো একজন পশুরোগ বিশেষজ্ঞ। সৌমাল্য ওঁর পোষ্য সংক্রান্ত সমস্যায় সাধারণত তাঁর সাথেই যোগাযোগ করেন। ফোন করে জানা গেল – এখন উনি গড়িয়ায় থাকেন। ওখানেই চেম্বারে নিয়ে যেতে হবে। গাড়ী ভাড়া করে যখন তাঁরা গড়িয়ায় পৌঁছলেন, তখন রাত্রি প্রায় সাড়ে ন’টা। ডাঃ বেরা ওঁদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। দেখে টেখে জানালেন প্লাষ্টার করতে হবে। ফ্রাকচার ডিসলোকেশন হয়েছে। এখানকার মতো ওষুধ দিয়ে দিলেন। প্লাষ্টার করানোর জন্য আবার কাল আনতে হবে। গোবুচন্দ্রকে নিয়ে এদিকে ওদিকে নিয়ে যাওয়াটাই সমস্যা। ওর ওজন বেশ ভালো। তার উপর ব্যথায় পাছে লেগে যায় – এই আশঙ্কায় ওকে নাড়াতেই ভয় লাগছে ওঁদের। যাইহোক সারারাত প্রায় জেগেই কাটলো সৌমাল্যের। সকালে উঠে রেডি হয়ে আবার দুজনে মিলে গেলেন ডাঃ  বেরার কাছে। প্লাষ্টার করে ডাঃ বেরা বিধান দিলেন কমপ্লিট রেষ্ট এ রাখতে হবে। আজ পর্যন্ত কোনওদিন  গোবুচন্দ্রের গলায় শেকল পরান নি সৌমাল্য। আজ যখন শেকল লাগাতে গেলেন গোবুচন্দ্র প্রাণপণ বিরোধিতা করতে লাগল। ঘাড় মুখ নাড়িয়ে বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করতে লাগল। অবশেষে অনুরাধা এসে দিলেন সজোরে এক ধমক। গোবুচন্দ্র কী বুঝলো কে জানে, চুপচাপ শেকল পরে উদাসীন চোখে সামনে শিরীষগাছটার দিকে চেয়ে রইল। জীবনে কোনওদিন সুসু – পটির জন্য সে কারোর মুখাপেক্ষী হয়নি, এবার তাকে বেডপ্যানে করার জন্য অনেক প্রকার আকার ইঙ্গিতের সাহায্য নিলেন সৌমাল্য। অনভ্যস্ত মানুষই ঠিক মতো এর ব্যবহার পারে না – গোবুচন্দ্র তো চতুষ্পদ। তবে কিনা প্রকৃতির ডাক বড় বালাই। বেডপ্যানে করতে গিয়ে প্রথমদিকে অধিকাংশ সময়েই বাইরে হয়ে যেতে লাগলো। লজ্জায় বিড়ম্বনায় গোবুচন্দ্রের মুখ চোখ লাল। অথচ সৌমাল্য পরম যত্নে সেসব পরিষ্কার করতে থাকলেন। অনুরাধা বললেন, ‘বেশ ভালোই! জন্ম-বয়সের কর্ম!’

-মানে?

-ঈশ্বরের আসলে সবকিছুর কোটা মাপা থাকে। ছেলেপুলে হলে তো গু-মুত করতে হত। তোমার সেই বকেয়াটা ঈশ্বর এবার পূরণ করে দিলেন।

-হ্যাঁ অনু। গোবুচন্দ্র তো আমার ছেলেই।

-হ্যাঁ। আমরা মরলে বলে যেও, ওই বাতি দেবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অনুরাধা।

সৌমাল্য খুব নরম স্বরে বললেন, জীবনে কোনও খেদ রেখে যেওনা অনু। ধরো তোমার ছেলে – মেয়ে যদি দুষ্টু হত, তাদের হাতে মরার পরে বাতি নিতে ভালো লাগতো তোমার?

-কিছু একটা বললেই তুমি নেগেটিভ কথা বলো কেন? যেন দুষ্টু হওয়াটাই অনিবার্য্য?

-ব্যাপারটা তা নয় অনু। ওটা একটা সম্ভাবনা। ওটা এক প্রকার নিজেকে রিলিফ দেওয়া ভাবতে পারো। খারাপটা ভাবলে কষ্টের ফিলিংসটা কম হয়। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না।

-কিন্তু একটা কথা আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যিই আমাদের মধ্যে যে শেষে যাবে – তার দাহ-কাজ ইত্যাদি কে করবে?

-মরে যাবার পর কী হবে – এই নিয়ে আর চিন্তা কর কেন অনু? কেউ না কেউ করবে! কেউ না করলে পুলিশ করবে। এসব ভেবো না। দীপ্তেনের ছেলেপুলেরা করতে পারে!

-হ্যাঁ! বিদেশ থেকে মুখে আগুন দিতে আসছে!

-ছাড়ো এসব কথা। গোবুচন্দ্রের জন্য বিশেষ কিছু মেনু কর। এই সময় এক্সট্রা প্রোটিন,  ক্যালসিয়াম ইত্যাদি দিতে হয়। ডাঃ বেরা কিছু ওষুধপত্র দিয়েছেন, বাকী খাবার দাবার ব্যাপারটা ভালো করে জানা হয়নি, একবার ফোন করে দেখি বরং।

(৪)

সকাল থেকে শরীরটা ভালো লাগছেনা অনুরাধার। গতকাল রাতে ভালোমত ঘুম হয়নি। শরীরটা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে। চারপাশে কিসব অজানা জ্বর হচ্ছে – সেসব হল কিনা কে জানে? সাড়ে পাঁচটায় সৌমাল্য মর্ণিংওয়াকে বেরিয়ে গেলে অন্যান্য দিন অনুরাধা উঠে পড়েন। আজ আর উঠতে ইচ্ছে করছে না তাঁর। সৌমাল্য হেঁটে এলেই উঠে চা বসানো যাবে। আজ পর্দাটা একটু ফাঁক থেকে গেছে। সেখান থেকে সূর্য্যের আলোর একটা টুকরো এসে ওঁর চোখে লাগছে – উঠে গিয়ে বন্ধ করে দেন - সে ইচ্ছেটুকুও আর নেই। হঠাৎ করে গোবুচন্দ্রের চিৎকার চেঁচামেচিতে তাঁকে উঠতেই হল। রোজ যাবার সময় বাইরের কোলপসিবল গেটটা সৌমাল্য তালা লাগিয়ে এক সেট চাবি নিয়ে যান। আজও তাই হয়েছে। অনুরাধা বাড়ীর আর এক সেট চাবি দিয়ে দরজাটা খুলতেই গোবুচন্দ্র যেন একেবারে অনুরাধার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এমনিতে শরীরটা ভালো নেই বলে উনি ধমক দিয়ে গোবুচন্দ্রকে জোর করে যখন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন, সে তখন দ্বিগুন উদ্যমে ঘেউ ঘেউ করে কিছু বলতে চাইল। শেষে ওঁর নাইটির কোণটা ধরে টানতে লাগলো। প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও শেষে বুঝলেন গোবুচন্দ্র ওঁকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। একটা জুতো আর ওভারকোটটা চড়িয়ে তিনি গোবুচন্দ্রের পিছু নিলেন। গোবুচন্দ্র আক্ষরিক অর্থেই দৌড়াচ্ছে। পার্কটা পেরিয়ে একটা গলি মতো রাস্তার মধ্যে এসে পিছন ফিরে দেখলো অনুরাধা এখনও বেশ খানিকটা পেছনে। আবার দৌড়ে পিছনে গেল সে। অনুরাধা এসে দেখলেন রাস্তার উপর সৌমাল্য মুখ থুবড়ে পড়ে। অজ্ঞান হয়ে আছেন। তখনও সকালের কর্মোদ্যোগ শুরু হয় নি মানুষের।  অনুরাধার চিৎকার চেঁচামেচিতে লোকজন জড়ো হল; কিন্তু এতে কিছুটা সময়ও গেল।  অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে নার্সিংহোমে ভর্ত্তি করতে করতে বেলা ন’টা। অনেক চেষ্টা চরিত্র হল, সৌমাল্যের জ্ঞান আর ফিরলো না। ডাক্তার এসে যখন মৃত্যু সংবাদ ঘোষনা করলেন – অনুরাধার মাথায় ছাদ ভেঙে পড়ল! এত বড় বাড়ীতে উনি একা – এটাই বড় পীড়ার কারণ হয়ে উঠল। সর্বোপরি সুস্থ মানুষ, কোনও মানসিক প্রস্তুতিও ছিল না। মৃতদেহ যখন বাড়ী এল, গোবুচন্দ্র দৌড়ে এসে দেখলো শুধু। ঝাঁপিয়েও পড়লনা, চিৎকার করেও ডাকলো না। শুধু দূরে এক কোণে গিয়ে বসে রইল। ওর চোখ থেকে শুধু টপ টপ করে জল পড়তে লাগলো।

অনুরাধা পাড়ার কিছু লোকের সাথে যখন শ্মশানঘাটে পৌঁছলেন তখন রাত বারোটা। গোবুচন্দ্রকেও সাথে করে এসেছেন তিনি। পুরোহিত যখন শাস্ত্রসম্মত কৃত্য করে মুখাগ্নি করার জন্য পাটকাঠিগুলো মুঠো করে অনুরাধার হাতে দিলেন, অনুরাধা ওটা গোবুচন্দ্রের মুখে ধরিয়ে ওর সাথে সাথে মৃতদেহকে পরিক্রমা করতে শুরু করলেন। পুরোহিত হাঁ হাঁ করে উঠলেন। অনুরাধা বললেন, ‘এর নাম গোবুচন্দ্র। ও ওনার ছেলে। আপনি সেই মতো কাজ করুন।’ এখন শ্মশানের সব পুরোহিতই সরকারী। সুতরাং দু-চার মিনিট এটা ওটা বুঝিয়েও যখন অনুরাধার মত বদলালো না – কিছু অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে উনিও বিশেষ বাগড়া দিলেন না।

এখন বাড়ীতে দুটি প্রাণী। গোবুচন্দ্র আজকাল আর পাড়া বেড়াতে যায় না। রাতে অনুরাধা যখন বাথরুমে যান, ও গিয়ে দরজার সামনেটায় বসে থাকে। উনি বাজারে গেলে ও সাথে সাথে যায়। খাওয়া দাওয়ার কোনও বাছবিচার নেই। সৌমাল্য মারা যাবার পর অনুরাধা আর নিজের জন্য মাছ – মাংস করেন না। প্রথম প্রথম গোবুচন্দ্রের জন্য আলাদা করে কিনে রেঁধে দিতেন। গোবুচন্দ্র কোনওভাবে বুঝতে পেরে ইদানীং ওসব ছুঁয়েও দেখে না। ও এখন বিশুদ্ধ নিরামিষাশী। অনুরাধা পছন্দ করতেন না বলে গোবুচন্দ্র বেশীরভাগ সময়ে ঘরের বাইরেই বসে। রাতে শুধু ঘরের ভেতর ঢোকে। ইদানীং অবশ্য অনুরাধারই একা থাকতে ভালো লাগে না। কারণে  অকারণে উনি গোবুচন্দ্রকে ঘরের ভেতরে ডাকেন, ঘরের ভেতরেই খেতে দেন। 

বিকেলের চা বানিয়ে আজ অনেকক্ষণ ধরে গোবুকে নাম ধরে ডেকে চলেছেন। কী ব্যাপার? একডাকেই তো সাড়া দেয় রোজ! কিছু হয়ে যায় নি তো আবার! বুকটা হঠাৎ করে শূণ্য হয়ে গেল। উনি তড়িঘড়ি করে দরজার বাইরে এসে দেখলেন –গোবুচন্দ্র চুপ করে বসে। ওঁকে দেখে চোখটা সরিয়ে নিল। অনুরাধা বুঝলেন, গোবুচন্দ্র তার চোখের জল দেখাতে কুন্ঠাবোধ করছে। অনুরাধা হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসলেন। নাইটির কোণা দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। ওরও তো বয়স হচ্ছে। সাধারণত এরা তেরো-চোদ্দ বছর বাঁচে। কোনও বিপদ আপদ না হলে আর দু-তিন বছর বাঁচবে। ভাবতেই আতঙ্কে গা-টা শিউরে উঠলো তাঁর। ইস্। যদি ওর কোনও উত্তরসূরী থাকতো!

Post a Comment

0 Comments