জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২১৪জার্মাণি (ইউরোপ)দুটি গরীব ভাই বোন /চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
দূর দেশের লোকগল্প— ২১৪
জার্মাণি (ইউরোপ)
দুটি গরীব ভাই বোন
চিন্ময় দাশ 


দুটি ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। হান্স আর তার বোন মার্গারেট। বাবা মা নাই তাদের। এমনকি, মাথা গুঁজবার একটা কুঁড়েও নাই। যা আছে, সেটা হোল অভাব। আর কী আছে, বল তো? সেটা হোল দুজনের দুটো পেট। কিন্তু সেই পেট দুটো ভরবে কী দিয়ে, তেমন কিচ্ছুটি নাই বেচারাদের।
এদিকে হান্স সবে এগারো। বোনটি তার আরও ছোট। গতরে খেটে পেট চালাবে, গায়ে তেমন শক্তি হয়নি তখনও। তাই ভিক্ষা করে বেড়ায় দুটিতে। তাতেই বেঁচে আছে কোনও রকমে।
সূজ্জি ডুবতে বসলে, কোন একটা বাড়ির দরজায় গিয়ে টোকা দেয় দুজনে। রাতটুকু কাটাবার মতো আশ্রয় চায়। পেয়েও যায়। আহারে, দুধের বাছা দুটো। আয়রে, ভেতরে আয়। 
মুখ ফেরায় না কেউ কোন দিন। বরং বিছানা দেয়, রাতের খাবারও। তেমন ভালো মানুষও আছে কেউ কেউ। গরম জামাকাপড়ও জড়িয়ে দেয় বাচ্চা দুটোর গায়ে। 
এ ভাবেই দিন কাটে ভাই বোনের। 
একদিন সূর্য ডুবতে বসেছে। আশেপাশে একটা বাড়িও চোখে পড়ছে না। শেষমেষ একটেরে একটা বাড়ি চোখে পড়ল। এগিয়ে গিয়ে টোকা দিয়েছে দরজায়। একটা থুত্থুরে বুড়ি বেরিয়ে এল—কী চাই, বাছারা? 
--রাতের মত একটু ঠাঁই দেবে, বুড়িমা? 
হান্সের কথা শেষ হতে পেল না। বুড়ি বলল—দেব না কেন? এসো, এসো। ভেতর ঢুকে পড়ো।
ছেলেমেয়ে দুটো খুশি মনে ভেতরে ডুকে পড়ল। বুড়ি বলল—তবে,এক্টা কথা বলি, বাছারা। রাতের মতো লুকিয়ে রাখছি তোমাদের। তবে, আমার বুড়ো ফিরে আসবে একটু বাদে। তার চোখে পড়ে যাও যদি, তখন কিন্তু বাঁচার উপায় বাই।
ছেলেমেয়ে দুটো ভয় পেয়ে গেল—কেন, বুড়িমা? বাঁচব না কেন?
বুড়ি বলল—কেন আবার? ছোট বাচ্চাদের মাংসের রোস্ট খাওয়া ভারি পছন্দ আমার বুড়োর। এজন্যই তো, যে বাচ্চারা এখানে আসে, কেটে কুচিকুচি করে আগুনে সেঁকতে বসে যায়। ভাগ্যিস আজ এখনও ফেরেনি। তাই রেহাই পেয়ে গেছ। 
বাচ্চা দুটো তো কাঁপতে লেগেছে ঠকঠক করে। কিন্তু এখন আর বেরিয়ে পালাবারও উপায় নাই। অন্ধকার নেমে গেছে বাইরে। 
বুড়ি অভয় দিয়ে বলল—ভয় পেয়ো না। আমি লুকিয়ে রাখব তোমাদের। তবে, ঠোঁট এঁটে থাকবে। টুঁ শব্দটিও কোর না যেন। 
দুজনকে একটা ব্যারেলের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল বুড়ি। পাথরের মতো পড়ে রইল বাচ্চা দুটো। ভয়ে ভাবনায় ঘুম আসছ না চোখে। ঘন্টাখানেক বাদে একটা গর্জন শোনা গেল। সেই সাথে পা ফেলবার দুম দুম শব্দ।
বুড়ো ফিরেছে। ছেলেমেয়ে দুটো বুঝতে পারল, আসলে কিন্তু সে একটা রাক্ষস। কেন না, বুড়ো তখন ধ্মকাচ্ছে বুড়িকে—খাবো কী আমি? কেন কচি বাচ্চার মাংস রোস্ট করে রাখিসনি? 
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল দুটিতে। সকাল হলে, দৈত্যটা বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। সেই শব্দে ঘুম ভেঙেছে তাদের। বাচ্চা দুটোকে জলখাবার খেতে দিয়ে, বুড়ি বলল—্বুড়ো কাছাকাছিই থাকবে। বাইরে বেরোবে না যেন। আমিও একটু বেরুব। আর শোন, খেতে দিলাম। তার বদলে একটু উপকার করে রেখো আমার।
হান্স বলল—বলো, কী উপকার। 
দুটো ঝাড়ু নাও দুজনে। ওপরে যাও। বারোটা ঘর আছে ওখানে। এগা্রোটা ঘর পরিষ্কার করে রাখবে। শেষের ঘরটায় শেকল তোলা আছে। ওটায় ভুল  করেও ঢুকবে না যেন। আমি ফিরে আসবার আগে, কাজ শেষ করে রাখবে কিন্তু। 

🍂

বুড়ি বেরিয়ে যেতেই, কাজে লেগে গেল ভাই বোন। চটপট সেরেও ফেলল। এগা্রোটা ঘর একেবারে সাফসুতরো। এবার চোখ গেল শেষের ঘরটার দিকে। 
কী আছে এই ঘরে? কেন বারণ করে গেল বুড়িমা? হাজারো কৌতুহল দুজনের মনে? 
মার্গারেট আর থাকতে পারল না। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে। পাল্লার ফাঁক দিয়ে দেখতে গিয়ে, চোখ কপালে উঠে গেল মেয়েটার। বলল—হান্স, তাড়াতাড়ি এসো। দেখো, ভেতরে কী?
ভেতরের ছবি দেখে, হান্সেরও কথা সরছে না মুখে। ভেতরে সোনায় তৈরি ঝকঝকে একটা গাড়ি। তাতে চড়ে বসে আছে একটা হরিণ। সেটাও সোনার। 
এল লহমাও দেরি করল না হান্স। দৌড়ে জানালায় গিয়ে, উঁকি দিয়ে বাইরেটা দেখে নিল। অনেক দূর পর্যন্ত বুড়ি বা বুড়োর ছায়াটাও দেখা যাচ্ছে না কোত্থাও। 
হান্স বলল—চলো, নিয়ে পালাই। 
আর বিলম্ব নয়। হরিণ শুদ্ধ গাড়ি নিয়ে, চটপট করে নীচে নেমে এল দুজনে। গাড়িতে চেপে পালাতে লাগল। যত তাড়াতাড়ি যত দূরে সরে পড়া যায়। 
কিন্তু রাক্ষসের হাত এড়ানো কি আর এত সহজ? খানিক দূর এগিয়েছে ভাই বোন। দেখা গেল বুড়ি আর রাক্ষস এই পথেই এদিকে এগিয়ে আসছে। যদিও বেশ কিছুটা দূরে। এখনই তাদের চোখে পড়ে যাওয়ার কথা নয়। 
হান্স কিন্তু ভয়ে আঁৎকে উঠেছে—এখন কী হবে, বোন? ওদের চোখে পড়ে গেলে আর বাঁচতে হবে না।
মার্গারেটও দেখতে পেয়েছে বুড়ো বুড়িকে। সে বলল—একদম চুপ করে থাকো। ঠাকুমার শেখানো সেই ছড়াটা মনে আছে আমার। দেখো না, কী করে বুদ্ধু বানাই দুজনকে। 
মেয়েটা বিড়বিড় করে উঠল—গোলাপ ডালে তীক্ষ্ণ কাঁটা। ভুল করেও ছুঁয়ো না।। ভাবো, ভাবো, দু’বার ভাবো। হাতটি কিন্তু দিয়ো না।। 
ছড়া শেষ হয়েছে। অমনি একেবারে ভোজবাজির মতো কাণ্ড! গাড়ি, হরিণ, দুটো ভাই-বোন সব কোথায় উধাও। ফুলে ভরা একটা গোলাপ গাছ রাস্তার ধারে। হরিণটা হয়েছে গাছ, গাড়িটা পাতা। কাঁটায় ভরা কাণ্ড হয়ে গেছে হান্স। আর তার বোন মার্গারেট, সে ফুটে উঠেছে সুগন্ধী রঙীন ফুল হয়ে।
বুড়ো বুড়ি এসে পৌঁছেছে খানিক বাদে। ফুল দেখে বুড়ির মনে আনন্দ। ছিঁড়ে তুলতে গেছে, ধারাল কাঁটায় হাতে রক্তপাত। ধুত্তেরি বলে, রাগে গজগজ করতে করতে দুজনে চলে গেল সেখান থেকে। 
অমনি সাত তাড়াতাড়ি নিজের চেহারায় ফিরে এসেছে চারজনে। আবার গাড়ি ছুটতে লাগল তাদের। খানিক দূর গিয়েছে, সামনে একটা পাঁউরুটি ভরা ওভেন। ভেতর থেকে একটা গলা ভেসে এলো—রুটি আমার আছে আরও। যতো ইচ্ছে নিতে পারো।
কয়েকটা রুটি তুলে নিয়ে, গাড়ি আবার ছুটতে লাগল। খানিক দূর গিয়েছে। রাস্তার গায়েই একটা নাসপাতি গাছ। পাকা ফলের ভারে গাছ ভেঙে পড়বার জোগাড়। ওপর থেকে একটা গলা ভেসে এলো—গাছটি ধরে ঝাঁকাও। ইচ্ছে মতন কুড়াও।
এমন মওকা ছাড়া যায়? ঝাঁকুনি দিতেই ধুপধুপ করে ফল পড়তে লাগল। ঝুড়িখানিক ফল কুড়িয়ে গাড়ি ছুটল আবার।
এবার সামনে পড়ল এক আঙুর মাচা। মাচা ভর্তি রসে টইটুম্বুর থোকা থোকা আঙুর। মাচা বলল— থোকা থোকা আঙুর কতো। নাও তো্মাদের ইচ্ছে মতো।।
আঙুরও নেওয়া হোল অনেক। গাড়ি এখন প্রায় ভর্তি হয়ে এসেছে। তারা চলতে লাগল আবার।
এদিকে হয়েছে কী, বুড়ো বুড়ি ঘরে ফিরে এসেছে। তাদের তো চোখ কপালে উঠে গেছে। ছেলেমেয়ে দুটো উধাও। তারচেয়ে বড় সর্বনাশ হোল, গাড়ি আর হরিণ লোপাট হয়ে গেছে।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে রাক্ষসটার। সেই কতো বছর আগের কথা। গাড়ির মালিকের মুণ্ডু কেটে, এটা চুরি করে এনেছিল ঘরে। গাড়ি আর সহিস যে শুধু দামী জিনিষ, তা কিন্তু নয়। অনেক ক্ষমতা আছে সহিসটার। চাইলেই মূহুর্তে নানা রকম জিনিষ এনে হাজির করতে পারে সে। এত বছর ধরে, তার কেরামতিতেই খেয়ে পরে বেঁচে আছে দুজনে। গাড়ি হারিয়ে গেলে, না খেয়ে মারা পড়তে হবে তাদের।
রাগে গর্জন করে উঠল রাক্ষসটা। তারপর দৌড় লাগিয়েছে। যে করেই হোক পাকড়াও করতে হবে ছেলেমেয়ে দুটোকে। তারপর? জ্যান্ত ঝলসে খাবো আজ তোদের।
লম্বা লম্বা পা ফেলে দৌড়চ্ছে তারা। লাগলও না বেশি সময়। এক সময় দূরে গাড়িটা চোখে পড়ে গেল। সব ভাবনা উড়ে গেল মন থেকে। হা-হা করে হেসে উঠল রাক্ষস। অনেক দিন কচি বাচ্চার ঝলসানো মাংস খাওয়া হয়নি। আজ খাবো তারিয়ে তারিয়ে। মনে তখন ফূর্তি ধরে না তার। 
ছেলেমেয়ে দুটোর গাড়ি এসে হাজির হয়েছে একটা নদীর পাড়ে। রাস্তাটা এখানেই শেষ। সামনে গভীর নদী। না আছে নৌকা আর মাঝি, না আছে কোনও সাঁকো। ওপারে যাবে, কোন উপায়ই নাই। থাকবার মধ্যে এক ঝাঁক রাজহাঁস খেলা করে বেড়াচ্ছে নদীতে। 
এদিকে বুড়ি আর রাখসটা এসে পড়ল বলে। কান্না পেয়ে গেছে হান্সের। হাঁসগু্লোকে বলল—দোহাই তোমাদের। যেভাবে পারো বাঁচাও আমাদের। রাক্ষসটা এসে পড়ছে। চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে দুজনকে। 
সহিস করেছে কী, একটা একটা করে পাঁউরুটি ছুঁড়ে দিচ্ছে জলে। তাতে পাড়ের দিকে চলে আসছে হাঁসগু্লো।
মার্গারেট চেঁচিয়ে বলল—বন্ধু তোমরা, জুড়ে দাঁড়াও। পার করে দাও, সাঁকো বানাও।। 
কথা শেষ হতে পেলো না। রইলো পড়ে মিষ্টি সুবাসের পাঁউরুটি। হাঁসগুলো ঝটপট সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল, গায়ে গা লাগিয়ে। নদীর এপার থেকে ওপার—ধবধবে সাদা রঙের সে এক আশ্চর্য সাঁকো গড়ে উঠল। ঝলমল করে ফুটে উঠেছে নদীর নীল জলে।
নদীর দুই পাড় দেখল সেই নতুন ছবি। কোনদিন দেখেনি এমন জিনিষ। নীল আকাশ দেখল। উড়ে যাওয়া মেঘেরা থমকে পড়ল দেখে। দেখল বাতাসে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া পাখিরা। দুই তীরের গাছপালা, লতাপাতা। সবাই দেখল, সাঁকোটার ওপর দিয়ে ওপারে পৌঁছে গেলে গরীব ভাই বোন দুটো। একটা গাড়ি, একজন সহিস, আর একটা হরিণও পেরিয়ে গেল তাদের সাথে। 
ছেলেমেয়ে দুটো সবে ওপারে গিয়ে নেমেছে। রাক্ষস আর তার বুড়ি এসে হাজির। রাক্ষস গর্জন করে উঠল-- পার করে দে, দুজন যাবো। ওই দুটোকে চিবিয়ে খাবো।
রাক্ষসের সাথে হাঁসেদের তো কোন বিবাদ নাই। আগের দুজন গিয়েছে। বুড়ো বুড়ি দুজনও যাবে। আপত্তির কি আছে? তারা বলল—যাবেই যদি জলদি করো। বুড়োবুড়ি সাঁকোয় চড়ো।। 
বুড়োর তো তর সইছে না। তাড়াতাড়ি বুড়িকে নিয়ে সাঁকোয় চড়ে পড়েছে। কিন্তু হাঁসেদের মনে কী ছিল, রাক্ষস তো সেটা জানে না। লাফিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে দুটিতে। দেখতে দেখতে ঠিক নদীর মাঝামাঝি পৌঁছেছে। জল সেখানে সবচেয়ে বেশি গভীর। রাজহাঁসেদের গলা যেমন কর্কশ, তেমনি চড়া। হঠাৎই তাদের সর্দার ডেকে উঠল—ট্যাঁ-ট্যাঁ।  বাকি হাঁসগুলোও ডেকে উঠল গলা চড়িয়ে। 
সেই বিকট শব্দে আকাশ চমকালো। আকাশের মেঘেরা চমকালো। বাতাস চমকালো। চমকালো উড়ে যাওয়া পাখির দল। নদীর জল, বনের গাছপালা সবাই চমকে উঠল। চমকে গিয়ে দেখল, ঝটপট জল কেটে যে যার মতো দূরে সরে যাচ্ছে হাঁসের দল। ধধবে সারা রঙের সাঁকোটা উধাও হয়ে গেছে। চিহ্নটিও নাই আর। আর, হাবুডুবু খেতে খেতে, গভীর জলে তলিয়ে যাছে ভয়ানক রাক্ষস আর তার বুড়ি বউটা। 
পাড়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখল ভাই বোন মিলে। বুক ভরে শ্বাস নিল দুজনে। সহিস করল কী, যত পাঁউরুটি ছিল গাড়িতে, সব ঢেলে দিয়ে এলো হাঁসেদের সর্দারকে। 
বেশি দূর এগোয়নি দলটা। পাশের গাঁয়েই থিতু হয়ে গিয়েছিল। সহিসের যাদুর গুণে, কোন অভাব ছিল না তাদের। খাবার-দাবার সব জুটে যেত। বরং অভাবী মানুষ দেখলেই, সাহায্য করত অকাতরে। সুখে শান্তিতে দিন কেটে যেত তাদের। 
সহিস কোনদিন একটা কাজ করতে ভুলে যেত না। সকাল হলেই, এক ঝুড়ি পাঁউরুটি মাথায় নিয়ে, নদীর পাড়ে চলে যেত। পাঁউরুটি দিয়ে আসত হাঁসেদের। 
ঝুড়ি মাথায় নিয়ে সহিস নদীর দিকে যাচ্ছে না—এটা কেউ কোনদিন দেখেনি সেই গাঁয়ে।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments