কমলিকা ভট্টাচার্য
আজ জাতীয় শিক্ষা দিবস। পেশায় শিক্ষিকা হলেও আজকের এই লেখার উদ্দেশ্য জ্ঞান বিতরণ করা নয়। বরং আজ আমি একান্তই ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই, যা আমার শিক্ষা নিয়ে ভাবনাকে অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সাহায্য করেছে।
২০১৮ সাল থেকে আমি চেন্নাই শহরে আছি। ভাষাগত সমস্যার কারণে কখনোই বাড়িতে কোনো সহায়ক হাত পাইনি। তাই ঘরের যাবতীয় কাজ, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সব একলাই সামলাতে হয়েছে। সঙ্গে আছেন ৯৪ বছরের বাবা,আমার শ্বশুরমশাই। তাঁর খাবার, ওষুধ, সময় মতো যত্ন নেওয়া—এসব একলা করতে করতে কখনো কখনো আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম।
কিন্তু ভাগ্যের কৃপায়, প্রায় এক মাস আগে সুদূর পশ্চিমবঙ্গের এক গ্রামের মেয়ে আমার সাহায্যকারী হিসেবে আমার কাছে এল। তার আগমন আমার জীবনে নতুন কিছু ভাবনার জন্ম দিল।
আপনারা হয়তো ভাবছেন, এর সাথে শিক্ষা দিবসের কী যোগ? সত্যি বলতে কোনো সরাসরি যোগ নেই, তবে আমি মনে করি আজকের এই দিনে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করাটা প্রাসঙ্গিক।
যেদিন মেয়েটি এলো, সেদিন ওর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, ও কোনোদিন স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায়নি। ওর পরিবারের বাকি বোনেরাও কেউ স্কুলে যায়নি, শুধু ওর দাদা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। বিশ্বাস করুন, ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে ২৫/২৬ বছর বয়সের একটি মেয়ে, যে ন্যূনতম শিক্ষাও পায়নি, এই বাস্তবতা আমাকে হতবাক করে দিল।
আমার পরিচিত গণ্ডির বাইরে এক অজানা পৃথিবী আমাকে ঘিরে ধরল—এই পৃথিবীতে কীভাবে শিক্ষার আলো থেকে এত মানুষ বঞ্চিত থাকে? আমার মনে একসঙ্গে দুঃখ, রাগ, হতাশা, অনুশোচনা, আর অসহায়তার বোধ কাজ করতে লাগল।
🍂
আমি ওকে বললাম, "আমার বাড়িতে তোর প্রথম কাজ হল পড়াশোনা করা। এখানে থাকতে হলে তোকে পড়তে হবে।" ও আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।
এটা ছিল আমার অভিজ্ঞতার একটি দিক। এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি। এই এক মাসে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমি বুঝেছি, যতই ও আক্ষরিক শিক্ষায় পিছিয়ে থাকুক, সাংসারিক শিক্ষায় সে অনেকের থেকে অনেক এগিয়ে। ওকে কোনো কাজ একবার বললেই হয়, বারবার বলার প্রয়োজন পড়ে না। ও খুব সহজেই কাজ শিখে নেয়, এবং বাংলা-ইংরেজি দুই ভাষায় ফোনের নম্বর পড়তে পারে।
একদিন আমার ফোনে ফোন এল। আমি ব্যস্ত থাকায় অভ্যাসবশত ওকে বললাম, "দেখত, কে ফোন করছে?" ও আমাকে বলল, "দাদা," অর্থাৎ আমার স্বামী। আমি অবাক হলাম, কারণ ফোনে কোনো ছবি আসেনি, শুধু নামটা দেখা যাচ্ছিল। আগেও দু-একবার ফোন ধরে দিয়েছিল, এবং সেই দেখে ও শিখে নিয়েছে।
আরেকটা মজার বিষয় লক্ষ্য করেছি। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দীর্ঘদিন থাকার কারণে আমাদের কথায় ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ অনেক বেশি। ইদানীং ওর কথাতেও ইংরেজি শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গেছে।
এবার আমার এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি কিছু উপলব্ধি করেছি। প্রথমত, যদি আমরা শিক্ষার সুযোগ সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারতাম, তাহলে ওর মতো মেয়েরা অনেক আগেই জীবনে এগিয়ে যেতে পারত। বুদ্ধির কোনো অভাব নেই, শুধু সুযোগের অভাব।
দ্বিতীয়ত, পরিবেশ থেকে পাওয়া শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। পুঁথিগত বিদ্যার অভাব থাকলেও যে সমাজে মানুষ বাস করে, সেখান থেকেই সে অনেক কিছু শিখে নেয়। আর এই শিক্ষাই তাকে নিজের পরিবেশে বাঁচতে শেখায়। প্রকৃত অর্থে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যও এটাই—মানুষকে তার জীবনে এবং সমাজে মানিয়ে চলতে শেখানো।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments