জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন/ পর্ব ২৬/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া


ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব ২৬
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া 

  || যে নদী হোয়াংহো ছিল দুঃখ চীনের ||
 
              
ঘটনা কী তোমার?হোম ওয়ার্ক যা দিয়েছিলাম আদ্দেকের বেশি তো ভুলেই ভরা। আবার ওইটুক ট্রান্সলেশন নিয়ে তখন থেকে জলঘট হয়ে বসে আছো যে। তাড়া খেয়ে ঝিনি একবার শিববাবু স্যারের দিকে একবার সামনের দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঝুঁকে পড়ল খাতায়।
         যখন তোমার দাদা নিতে আসবে তখনই ছাড়ব বলেছি কাজেই অতবার করে ঘড়ি দেখে লাভ নেই। পড়ালেখায় মনোযোগ তো কোন কালে ভুলে খেয়েছো।আর মনটা আসবেই বা কোত্থেকে? মাথায় সর্বক্ষণ ওই ছাতা মাতার গান কবিতা ঘুরলে এই ট্রান্সস্লেশন কেন, হোল লাইফেই স্রেফ কিস্যু হবে না এই বলে রাখলাম!
        ক্লাস এইটে উঠেছে ঝিনি। ফাইভ থেকে সে ব্রততীদির কাছেই পড়ে। কিন্তু পড়াশুনোয় এখন থেকে জোর না দিলে মাধ্যমিকের ফাঁড়া কাটবে না বলে মা ব্রততীদি ছাড়াও সপ্তাহে তিনদিন শিববাবুবাবু স্যারের কাছে ইংরেজি আর তিনদিন পরেশবাবু স্যারের কাছে অংক টিউশানি ধরিয়ে দিয়েছে।
       মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ায় সে।হতচ্ছাড়া ছোড়দাটাও  আসছে না। তাদের ব্লকের যুব উৎসব এবার বাড়ি থেকে বেশ অনেক দূরে হওয়ায় ছোড়দা আর তার বন্ধুরা  মুকুল ক্লাবের বড় ছোট মাঝারি সব প্রতিযোগীদের নিয়ে রওনা দিয়েছে। টিউশনির দিন পড়ে যাওয়ায়  চেষ্টা করেও ছোড়দা কিছুতেই মা আর শিববাবু স্যারের হাত থেকে ঝিনিকে উদ্ধার করতে পারেনি।
         অগত্যা বলে গেছে নটা থেকে তো ছোটদের বসে আঁকো,ছড়া, আবৃত্তি  এসব শুরু। ওদের পৌঁছে আমি সাইকেল নিয়ে ফের আসছি। তোর ডিবেট আর আবৃত্তি তো দুটোর পর।পড়া হয়ে গেলেই রেডি হবি। 
       আ্যতোটুকু প্যারাগ্রাফে পাঁচ পাঁচটা বানান ভুল?যাও যাও রেডি হও গে। আজ আর পড়তে হবে না। আমি বরং মঙ্গলবারই আসবখন। তবে টাস্ক ঠিক করে না রাখলে আর এর'ম বানান ভুল করলে কপালে সেদিন দুঃখ আছে বলে রাখছি। 
      ওইসব ছাইভস্ম কবিতার ভুত মাথায় চাপলে নিজের রেজাল্ট খারাপ হওয়া ছাড়া কিস্যু হবে না। আর রেজাল্টের ইদিক সিদিক হলে কোন ফাংশনের কে তোমায় বাঁচায় সেদিন দেখব আমি। দস্তুর মতো শাসিয়ে টাসিয়ে উঠে পড়লেন স্যার। 
       ঝিনিও চট করে চান খাওয়া সেরে পুজোয় পাওয়া মভরঙা টপ আর গাঢ় নীল লং স্কার্ট পরে রেডি। প্রতিযোগিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের  'সালেম আলির মা' কবিতাটা ঠিক ঠাক করে বলতে হবে।আগে তাদের বাবাই তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিত কিন্তু ইদানিং তাদের বাবার করা আবৃত্তি ঝিনির তেমন পছন্দ লাগছে না।একটু চড়া এবং নাটকীয় লাগছে।
 বাবার খারাপ লাগে বা কষ্ট পায় পাছে বলে ঝিনি এখনও,ও বাপি একটু দেখিয়ে দাও না  বলে তাদের বাবার কাছে কবিতা নিয়ে বসে বটে, বলার সময় নিজের মতো করেই কম্পিটিশনে সে বলতে চেষ্টা করে। পড়াশোনায় ফাঁকির মতলব বলে মা পেছনে টিকটিক করলেও তাদের কছোড়দা আর সে প্রায়ই নানা জায়গা থেকে প্রাইজ টাইজ আনছে দেখে তাদের বাবাও খুশি হয় খুব।
        পাগল বাবর আলীর চোখের মতো আকাশ... লাইনটাকে কিভাবে শুরু করবে ঝালিয়ে নিতে নিতে ডিবেটের পয়েন্ট লেখা খাতাটা  খুঁজছিল সে আর তখনই বাবার পছন্দ করে লাগানো শৌখিন কলিং বেলের পাখি ডেকে উঠল দরজায়।
        বাব্বা এতক্ষণে এলি ? আমি সেই কখন থেকে বসে... দরজা খুলেই ঝামরে ওঠে ঝিনি তারপর গ্ৰিলের ওধারে ছোড়দার জায়গায় অচেনা কে একটা সাইকেল নিয়ে  দাঁড়িয়ে দেখে থতমত খেয়ে চুপ করে যায়।
       ইয়ে, আমি হলাম ধ্রুব। কল্লোল আমায় পাঠালো তোমাকে নিয়ে যেতে। কাকলির এই দাদাকে দূর থেকে দেখেছে ঝিনি। খুব নাকি ব্রিলিয়ান্ট।কলি  বলে নাকি ডাব্লু বি সি এস পরীক্ষায় বসবে। দারুণ আবৃত্তি করে। নিজের একটা আবৃত্তির স্কুলও আছে। এখানকার সব লিটল ম্যাগাজিনে তার লেখা বেরোয়। জেঠতুতো দাদাকে নিয়ে কলির তাই গর্ব খুব।
      কিন্তু এ তো তাদের মুকুল ক্লাবের কেউ নয়।ছোড়দার সাথেই বা এত ভাব তার কবে হলো যে ছোড়দার বদলে একেবারে বাড়ি বয়ে তাকে নিতে চলে এল।
        ঝিনির ইতস্তত ভাব বুঝে  কলির দাদা বলল, আসলে কল্লোলের নিজের গানই আগে শুরু হয়ে গেছে। তুষার তরুণরা কুইজ গ্রুপটাকে দেখছে আর আরও ছোটদের শফিক, তুহিনরা সামলাচ্ছে।তবলায় মৃদুলকে তো থাকতেই হচ্ছে। কাজেই তোমাকে নিয়ে যাওয়ার কাউকেই  ওরা ঠিক খুঁজে পাচ্ছিলো না।তো সব শুনে আমিই চলে এলাম। তুমি রেডি তো খুকি? ডাক শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
     এ আবার কোন গেরো ভাবতে ভাবতে ভেতর থেকে মাকে ডেকে আনল সে। থাক থাক প্রণাম কেন আবার?তুমি হেড মাস্টার মশাইয়ের ছেলে ধ্রুব না? রিটায়ার করার পর দেখা হয়নি আর।ভালো আছেন উনি ? মিতুর গান শুরু হয়ে গেছে  বলে তোমায় পাঠিয়েছে? বেশ, তুমি বলেই ছাড়ছি।    
        ঝিনি তো একাই সাইকেলে যেতে চাইছিল। কিন্তু এতটা দূর ওকে একলা ছেড়ে দিই কিভাবে বলো দেখি। ঝিনি তোর,হয়ে গেলেই দাদাদের সঙ্গে ফিরে আসবি কিন্তু।দেরি না হয় যেন।
      বয়েজ ইস্কুলে হিটসের দিন তোমার  আবৃত্তি শুনছিলাম। পাগল বাবরালির চোখের মতো আকাশ... প্রথম লাইনটার পর বেশ কিছুক্ষণ পজ দিয়ে শুরু করবে আর "বাবরালির চোখের মতো এলেমেলো এ আকাশের নীচে কোথায়/বেঁধেছ ঘর তুমি/ কোথায়/সালেমনের মা? "এখানটা থেকেই গলাটা চড়বে আর ...মিছিলের গলায় গলা মিলিয়ে/পিঁচুটি-পড়া চোখের দুকোণ জলে ভিজিয়ে/তোমাকে ডাকছে শোনো,সালেমনের মা ... এইখানে মা আআআআ বলে একটা লম্বা টান দিলে আর্তিটা ঠিকঠাক পৌঁছবে বুঝলে?
      সাইকেলে যেতে যেতে কলির দাদা বলছিল।যাত্রা নাকি?এই লম্বা টান টোন দিয়ে আবৃত্তিটাকে নষ্ট করার যোগাড়যন্তরে  তার মন মোটেও সায় দিল না।এ কি সারা রাস্তা এরকম জ্ঞান দিতে দিতে যাবে ? বেজায় বিরক্ত লাগছে তার এবার।
      আচ্ছা খুকি তোমার ডাকনাম ঝিনুক না ঝিনি? তোমার দাদা কল্লোল তো বললে ঝিনুক আর মাসিমা বলছেন ঝিনি?দুটোই।অ! ঝিনুক থেকেই ছেঁটে ছুটে ঝিনি তাই না? উত্তর দিল না সে আর।
        নাঃ!দিনটাই খারাপ আজ।একে তো মা কিছুতেই একা একা সাইকেল চালিয়ে তাকে বাদুড়িয়া আসতে দিল না।সকালে আবার স্যারের মনোযোগ নিয়ে লম্বা বক্তব্য এবং একচোট বকুনি তাকে শুনতে হয়েছে,তার ওপর কোত্থেকে উদয় হয়েছে কাকলির বিখ্যাত কবি দাদা আখাম্বা এই ধ্রুব রায়।    

🍂

       এখন কম্পিটিশনটাতেও না  ভুলভাল কিছু হয়ে যায়! আচ্ছা খুকি তোমাদের বাড়ির রাস্তার সামনে কৃষ্ণচূড়ার পাশে ওই দুটো বড় গাছের নাম কী বলো তো?জানি না। বাবা নার্সারি থেকে আনতে আনতেই নাম ভুলে গেছে। সত্যি? বলে খুব জোরে হেসে ওঠে কলির দাদা।এ তে হাসার কী আছে?
        এই ছেলে তো দেখি সমস্যা করবে। অল্প সমস্যা না। ভয়ানক সমস্যা।একে তো সাইকেলের রডে বসে যেতে তার ব্যথা লাগছে। কেন যে তার নিজের সাইকেলে মা কিছুতেই  ছাড়ল না।সে বসতে চাইল পেছনের ক্যারিয়ারে কিন্তু ইট খোয়ার উঁচু নিচু রাস্তায় বড্ড লাফাচ্ছে বলে সামনেই বসতে হলো,তার ওপর কলির কবিমার্কা ব্রিলিয়ান্ট দাদার আলটপকা প্রশ্নে ঝিনির বেদম রাগ হতে থাকে। তবে রাগটা মা,ছোড়দা, সাইকেল না খাপছাড়া ছেলেটা কার ওপর ঠিক কতখানি ঠিক করতে পারে না।
           ডিবেটের বিষয় কী তোমার? খুব কমন, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ। পক্ষে বলছ?হ্যাঁ।শুরু কী দিয়ে করছো?
      "যে নদী হোয়াংহো ছিল দুঃখ চীনের/আজ তা উপছে দেয় সুখ/জলের ধারায় ভাসে ফসলের বুক/আর নাচে জলবিদ্যুৎ "! বাহ্। কোথায় পেলে এ কবিতা। এটা গান। গণসঙ্গীত।ও কিন্তু তোমার আবৃত্তিটা ঠিক মতো..শেখো কার কাছে?নিজে নিজে।ঝিনির ভদ্রতার বাঁধ বিপদসীমার  কাছাকাছি পৌছে গেছে। যেকোনো সময়েই ভেঙে পড়তে পারে।
      আর ঠিক তক্ষুনি কী একটা উড়ে এসে তার বাঁ চোখের মধ্যে ঢুকে পড়ল।উঃ করে চোখ চেপে ধরল সে। হলো কী? সাইকেল থামিয়ে কলির দাদা সামনে দাঁড়ালো। দেখি দেখি অত চোখ ডলছো কেন?খোলো চোখটা খোলো।আর এই রুমালটা দিয়ে...পকেট থেকে ছেলেটা রুমাল বের করতেই ঝিনি  হাত নেড়ে বলে আমার আছে। আচ্ছা বেশ তোমার রুমালই দাও।ব্যাগ হাতড়ে ঝিনি বের করে দেয় রুমাল। চোখ থেকে জল পড়ছে আর খচখচ করছে খুব।চোখটা একটু দেখি আহা নোড়ো না অত বলে বাঁ হাতে মুখটা ধরে রুমালের কোণা দিয়ে আস্তে করে বার করে দেয় ছোট্ট একটা উড়ো কুটো। তারপর জলের বোতল বার করে বলে, চোখটা বেশ ভালো করে ধুয়ে ফ্যালো দেখি ।
         চোখ এইবার ঠিক আছে না খুকি?প্রায় এসেও গেছি আমরা।এই বাজারটা পেরুলেই বড়জোর  মিনিট পাঁচ সাত । সত্যিই চোখ ধুয়ে, রুমালে মুছে আর ভাঁপ দিয়ে খানিক স্বস্তি পেল। তবে খুকি খুকি করে কেন যে এত উত্যক্ত করছে এই হতচ্ছাড়া কলির দাদাটা। বেজায় রাগ আর হালকা চোখ খরখর চেপেই আবার সাইকেলে বসে সে।
        বাজারের দোকানপাট পেরিয়ে রাস্তাটা বাঁক নিতেই বাদুড়িয়া স্কুলের মস্ত মাঠকোঠা দালানটা খানিক দূরে থেকে চোখে পড়ল। গুনগুন ভোমরার মতো গুঞ্জন আর মাইকের আবছা ঘোষণাও কানে এল।
       আরও খানিক পর ছোড়দাদের দেখতে পেয়ে গেল ঝিনি। তুহিনদা তরুণদা কাছে পিঠে নেই। তবে শফিকদা আর মনসুরভাই একটু দূরে সিগারেট টানছে।যথারীতি হাত পা নেড়ে ছোড়দা ছোটদের কী সব বোঝাচ্ছে দেখতে পেয়েই ঝিনি কটকটে গলায় শুনুন, আমার নাম স্রোতস্বিনী।খবরদার,আমায় খুকি বলবেন না! বলে সাইকেল থেকে লাফিয়ে নেমে নিজেদের দলে ভিড়ে গেল।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments