জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ৩৯ /স্বপন কুমার দে

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ৩৯


স্বপন কুমার দে

সুদেষ্ণার সিদ্ধান্তে যে মণিদীপার প্রচ্ছন্ন মদত ছিল সেটা অমরেশবাবু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, কিন্তু এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি লক্ষ্য করেছেন, মণিদীপা আগের মত সবকিছু খোলাখুলি প্রকাশ করছেন না, অমরেশের কাছ থেকে লুকিয়ে ছাপিয়ে রাখছেন। অনেক সময় চুপ করে থাকেন; কী চিন্তা করেন তাও খোলসা করেন না। অমরেশ অনেকবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারেননি। জিজ্ঞেস করলে কখনও বলেছেন, ' শরীর খারাপ ', আবার কখনও বলেছেন, " এবার সমুর একটা বিয়ে দিতে হবে।" কখনও স্বামীর কাছে অভিযোগ করেছেন," তুমি তো নিশ্চিন্তে বসে আছো, ছেলের ব্যাপারে কিছুই ভাবছো না, চেষ্টাও করছো না।"
বিব্রত হন অমরেশবাবু," কী মুশকিল! আমি কী করবো? সমু বড় হয়েছে। ওর নিজের একটা মতামত আছে। ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে। তাছাড়া ও কি এ ব্যাপারে তোমাকে কিছু বলেছে?"
" ওকে কেন বলতে হবে? বাবা মায়ের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে এটা। আর ওর ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের কথা না ভাবাই ভালো। একবার যা হলো....।"
" ওভাবে বলছো কেন? যেটা হয়েছিল সেটা অতীত। একবার যেটা হয়েছে, বারে বারে সেরকমই যে ঘটবে সেটাও কথা নয়। তবে হ্যাঁ, এ ব্যাপারে ও যদি আমাদের বলে, আমরা সম্পূর্ণভাবে সে দায়িত্ব পালন করবো।"
" তুমি তার জন্য অপেক্ষা করতে পারো কিন্তু আমি পারবো না।" খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল মণিদীপাকে। অমরেশ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে বাধা দিয়ে আরও ঝাঁঝালো কণ্ঠে মণিদীপা," বলি, তোমার বয়স বাড়ছে না কমছে? তুমি তোমার বিয়ের জন্য তোমার বাবা মাকে বলেছিলে? বুদ্ধি শুদ্ধি সব লোপ পাচ্ছে নাকি?"

অমরেশ নিজের অবিবেচনায় লজ্জিত হলেন। সত্যিই তো বাবা মায়ের স্বাভাবিক দায়িত্ব, ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়া। তাহলে, এখানে ছেলে নিজে থেকে বলবে কেন? তবুও কেন জানে না, তাঁর মনে হচ্ছে, আরও একটু দেরি করা উচিত, সমুকে আরও একটু সময় দেওয়া উচিত। অথচ, ঐ একই বিষয়ে মণিদীপার মনে হল, আর সময় নষ্ট করা উচিত নয়। সিদ্ধান্ত কিছু হল না। অমরেশ অমীমাংসিত পরাজয়ে গিন্নির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।

🍂

অমরেশবাবুর মনে হল, মণিদীপার কথাগুলো অযৌক্তিক নয়। বাবা হিসেবে তাঁর আরও দায়িত্ব সচেতন হওয়া দরকার। সমু একবার বিশ্বাস করে ঠকেছিল, তাই সে নিজে নিজে হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। নিজের ওপর আস্থা আগের মত নেই। হয়তো বাবা মায়ের সাহায্য চায়, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না। তিনি ঠিক করলেন, সমুর সঙ্গে কথা বলতে হবে। জানতে হবে, সে কী চায়? অমরেশবাবু আরও ভাবলেন, তাঁর বয়স হচ্ছে। কাজেই ছোট ছেলের বিয়ের ব্যাপারে খুব বেশি দেরি করা উচিত হবে না। শনিবার বাড়ি এলেই সমুকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

মণিদীপা এখন দিনের বেলার বেশিরভাগটা হয় রান্নার তদারকি করেন নাহয় ঠাকুরঘরে কাটিয়ে দেন। অমরেশবাবুও লক্ষ্য করেছেন গিন্নির মেজাজ তিনি ঠিক মত বুঝতে পারছেন না। আজ শনিবার, গতকাল রাতের ট্রেনে সমু বাড়ি এসেছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে সে এসে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কাল কোনও কথা হয়নি। আজ সকাল সকাল তার মা ঘুম ভাঙিয়ে চা ব্রেকফ্রাস্ট খাইয়েছেন। এখন দুপুরে সমু কী কী খেতে পছন্দ করে তার লিস্ট করে সমুর হাতে ব্যাগ ফর্দ তুলে দিলেন।

বাজার থেকে আসার পর সমুর ডাক পড়ল বাবার ঘরে। সমু ভাবল, বাবার কিছু কাজ করার জন্য ডাকছে নিশ্চয়ই। ঘরে ঢুকতেই বাবা বললেন," বোস্ এখানে।" বাধ্য ছাত্রের মত বাবার পাশটায় বসে পড়ল সমু। অমরেশবাবু কিছুটা সিরিয়াস হয়েই শুরু করলেন, " এবার তো আমাদের ভাবতে হচ্ছে সমু। আমার, তোর মায়ের বয়স বাড়ছে। রোগ জ্বালা এসব তো লেগেই রয়েছে। তাই মাঝেমাঝে চিন্তা হয়, আর কতদিন শরীরটাকে টানতে পারবো। আমরা অনেক আগেই তোর বিয়েটা দিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু মাঝখানে কয়েকটা বছর শুধু শুধু নষ্ট হয়ে গেল। যাক সে কথা, আমরা আর দেরি করতে রাজি নই। তবে তোর যদি কিছু অন্যরকম চিন্তা ভাবনা থাকে তাহলে তুই বলতে পারিস।"
সমুর পরে পরেই তার মা এবার ঘরে ঢুকেছিলেন। তিনি বাধা দিয়ে বললেন," না, আমি আর দেরি করতে চাই না। এ বিষয়ে কোনও কথা হবে না। ঘটক মশায়কে খবর দিচ্ছি। পরের সপ্তাহ থেকেই আমরা মেয়ে দেখতে যাবো।"
সম্পূরক মায়ের দিকে চেয়ে করুণ আর্তি জানাল, " মা, আমাকে আর কিছুটা সময় দাও। অন্তত কয়েকটা মাস।"
" না, আর একদিনও নয়। এই করে করেই আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে। আর হতে দিতে পারিনা।"
অসহায় সমু বাবার দিকে চাইল। বাবাও তাকে ভরসা দিলেন না। সমু একরকম জোর করেই বলল," আর কিছুদিন পর তোমাদের বলবো।" প্রতিক্রিয়ায় বাবার সম্মতি বা অসম্মতি কিছু বোঝা গেল না, মা রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
                      

আবার মল্লিকার সাথে সম্পূরকের সাক্ষাৎ হল। সেই একই বার,একই সময়। সম্পূরক বন্ধুর বাড়ি যাবে বলে একই রাস্তা ধরল-- জোড়াদিঘি বস্তির গলি। কেন জানিনা, সম্পূরক ঐ রাস্তাটাকেই বেছে নিল। হতে পারে শর্ট কাট, তাই। তবে এদিন আর গাড়িতে তেল শেষ হয়নি। যেতে যেতে মল্লিকাকে দেখতে পেয়েই গাড়ি থেমে গেল। স্টার্ট বন্ধ করে নেমে এল সম্পূরক। মল্লিকা আগের দিনের মতই কতকগুলো বাচ্চাকে পড়াচ্ছিল। বাইকটাকে একপাশে রেখে ধীর পায়ে মল্লিকার দিকে এগিয়ে গেল।
" ম্যাডাম, ভালো আছেন?"
একগাল হেসে মল্লিকা জবাব দিল," হ্যাঁ, আজও কি পেট্রোল শেষ?"
সম্পূরক হাসির অর্থ বুঝল। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে জোরের সঙ্গে বলল," না, আজ আর পেট্রোল ফুরোয়নি। আজ আপনাকে দেখেই আমার বাইকটা দাঁড়িয়ে গেল।"
" বাঃ! বাইকটাকে তাহলে বাহবা দিতে হয়, আমাদের পাড়াটাকে বেশ চিনে ফেলেছে। আপনাকে সোজা রাস্তা থেকে সরু গলিতে নিয়ে এসেছে, আবার নিজে থেকেই এখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে!"
মল্লিকা সপ্রতিভ। কথাগুলো বলে সম্পূরকের প্রতিক্রিয়াও উপভোগ করছিল। বেচারা সম্পূরক একটু একটু করে ধরা পড়ে যাচ্ছিল। প্রথমটায় সাহস দেখালেও এখন মনে হল, এভাবে এখানে আসা উচিত হয়নি। মল্লিকা বোধহয় ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখছে না। তাই হয়তো সেকথাই তার মুখ থেকে বেরোল," কেন, আপনি রাগ করলেন নাকি?"
" ওমা সে কী কথা! আমার এতবড় উপকারী বন্ধুকে যদি ভুল বুঝি তাহলে লোকে আমাকে অকৃতজ্ঞ বলবে যে। আপনি ভালো আছেন? কবে এলেন? ক'দিন থাকবেন? আমাকে ভুল বুঝবেন না। একটু রসিকতা করছিলাম। আজ যে আমি সম্মানের সঙ্গে এখানে দাঁড়িয়ে আছি সে শুধু আপনার জন্যই। সেদিন যদি আপনি নিজের জীবন তুচ্ছ করে আমাকে বাঁচাতে গুন্ডাদের মাঝে ঝাঁপিয়ে না পড়তেন, আজ কোথায় থাকতাম আমি? কোথায় থাকত আমার আত্মসম্মান? আপনাদের মত মানুষদের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না।"
" সে রাতের কথা ভুলে যান ম্যাডাম। ওটা একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা। তার জন্য আপনি প্রতি কথায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন এটা ঠিক নয়। এতে আমার অস্বস্তি হয়।"
" ঠিক আছে, আর বলবো না। আপনি কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন? এই চেয়ারটায় বসুন, নাহলে পরে আবার দু'কথা শুনিয়ে দেবেন , অতিথিকে বসতে বলিনি বলে।"
" না না, ওটা আপনার জন্যই ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারবো।"
ছেলেমেয়েরা কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়েছিল। ভাবছিল, "এ সেই লোকটা, কয়েকদিন আগে যার বাইকের তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল।" কথা হচ্ছিল, তাই মল্লিকা তাদের পড়তে বলে সম্পূরকের সঙ্গে কথায় যোগ দিল।
" সম্পূরকবাবু, আপনাকে আগের মতই বেশ চনমনে লাগছে। কী ব্যাপার বলুন তো?" বলেই মুচকি হাসল। সেই হাসিতে যতখানি না সৌন্দর্য তার চেয়েও বেশি কৌতুকপূর্ণ লাবণ্য মল্লিকার চোখে মুখে ফুটে উঠল। সম্পূরক বোবা হয়ে গেল। সম্পূরকের বোকা বোকা চাহনি আর গুছিয়ে কথা বলার অক্ষমতা দেখে মল্লিকা আবার হাসল।
সম্পূরক একবার মল্লিকার দিকে, একবার বাচ্চাদের দেখল, তারপর কী মনে করে বলে বসল," আজ আমি আসি ম্যাডাম। "
" আরে, আরে লজ্জা পাচ্ছেন কেন? দাঁড়ান। কাল এসেছেন বুঝি? আবার কাল চলে যাবেন। তাই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চলেছেন। মাঝখানে আমি কতকটা সময় নষ্ট করে দিলাম।"
" কেন আপনি আমার বন্ধু হতে পারেন না?" মল্লিকা জবাব দিল না, বরং প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথা বলল।
" আপনি কী যেন একটা বলতে চাইছিলেন।"
" আপনি মন্টিকে পড়াবেন না কেন?"
" এটা আপনার নিজের কথা, না অন্য কারও? মন্টির মা বাবা কী বলেন?"
" মন্টি আমার ভাইঝি। তার ভালোমন্দের বিষয়ে আমি কিছু ভাবতে পারি না?"
" অবশ্যই ভাবতে পারেন, তবে তার মা বাবার সিদ্ধান্তই শেষ কথা হওয়া উচিত। আজ আবেগের বশে যদি কিছু করতে চান, ভবিষ্যতে তার মাসুল আপনাকেই দিতে হবে।"
" সে সব কথা ছাড়ুন। আপনি যাবেন না কেন?"
" বলেছি তো, আমার নিজের পড়ার চাপ আছে।"
" ওটা সত্যি নয়।"
" সত্যিটা যাই হোক, আপনি জোর করবেন না। তাতে আপনারই ক্ষতি।"
" আমার ক্ষতি?"
" যা বলছি শুনুন। আপনি অনেক কিছুই বোঝেন না। সরল, সাদা সিধা মানুষ আপনি। একবার ঠকেছেন, আর ঠকবেন না।"
মল্লিকার হেঁয়ালিপূর্ণ কথাতে সম্পূরক অবাক হয়ে যায়। কিছু বলতে পারে না। সেখান থেকে উঠে আসার উপক্রম করতেই মল্লিকা বলে," শুনুন"।
পিছন ফিরে চায় সম্পূরক," কী? বলুন।"
" আজ যে আমার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল, সে কথা বাড়িতে বলবেন না।"
" কেন?"
" আপনি আমাকে 'বন্ধু' বলে ডেকেছেন, তাই বন্ধুকে সতর্ক করে দিলাম।" বলেই আবারও হেসে উঠল মল্লিকা।
সম্পূরক এগিয়ে গেল বাইকের দিকে। ওদিক থেকে কথা ভেসে এল," সাবধানে যাবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন।"

নিজের ওপর নিজের রাগ হল সম্পূরকের। আজকের এই বোকামির জন্য নিজেকে মারতে ইচ্ছা করল। কী দরকার ছিল মল্লিকার সঙ্গে দেখা করবার। মনের ইচ্ছাগুলোকে উড়তে দিতে চেয়েছিল সে, কিন্তু উল্টে ডানা ভেঙে আছড়ে পড়ার আশঙ্কা করেনি। ভেবে দেখেনি আর একজনের মনের ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা। সে মল্লিকার প্রিয়ভাজন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সম্পূরকের সমস্ত কিছু একতরফা সিদ্ধান্ত মল্লিকা মেনে নেবে। আবার মল্লিকার এই কথাটাও সে মেনে নিতে পারল না, যে কাকু হিসেবে সে মন্টির পড়াশোনার ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করতে পারবে না। রাগ হল মল্লিকার ওপর। ভাবল, মল্লিকা অহংকারি। বৌদি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভেবে চিন্তেই নিয়েছে। সেও আর মল্লিকার সাথে কোনও অযাচিত আলাপ করবে না। আবার পরক্ষণেই ভাবল, মল্লিকা বলেছে বন্ধু হিসেবে সে সম্পূরককে সাবধান করতে চেয়েছে। তাহলে কি মল্লিকা সত্যিই তার শুভাকাঙ্খী? আজকের এই প্রত্যাখ্যান তার ভালোর জন্যই? আর ভাবতে পারল না সম্পূরক। হতাশা আর মনখারাপ নিয়ে চলল সামনের দিকে।

মল্লিকা ছেলেমেয়েদের ছুটি দিয়ে কতক্ষণ চুপ করে থাকল। কোনও কিছুতে মন বসাতে পারল না। দু'একটা দীর্ঘশ্বাস তার বুকের ভেতরটাকে কাঁপিয়ে দিল।

একটু পরেই মল্লিকাকে দেখা গেল পড়ার টেবিলে। নেক্সট মান্থে অনেকগুলো পেপার সাবমিট করতে হবে। আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে, আরও বেশি মনোযোগ দরকার। এ সময় মনকে ডাইভার্ট করা চলবে না। গতকালই স্যার খোঁজ নিচ্ছিলেন, কাজ কতটা এগিয়েছে। রাত জাগতে হবে। সকালে একবার নিমাইকাকুর বাড়ি যেতে হবে। তার শরীরটা কয়েকদিন ধরে খারাপ। দরকার হলে একবার নাহয় হসপিটালের আউটডোরে দেখিয়ে নেওয়া হবে। এরপর আর অন্য কথা না ভেবে একমনে স্টাডি করতে লাগল।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments