অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
গত শতাব্দীতেও যোগাযোগের মাধ্যম চিঠি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান। দূরে থাকা প্রিয়জনের সাথে সংযোগ স্থাপন ও রক্ষায় চিঠি ছিল অপরিহার্য আবার নিকটজনের কাছে গোপন কথা বলার একটা উপায়। চিঠি বহন করত প্রাণের কথা, মনের ব্যাথা, আনন্দগাথা। চিঠি তাই কখনো হয়ে উঠেছে কাব্য, সাহিত্য অথবা ছবি। কর্মব্যস্ততায় দূরে অবস্থানকালে পিতারা সন্তানদের অভাব যেমন বোধ করত তেমনই সন্তানেরা পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হত। সেসময় চিঠি হয়ে উঠত যোগাযোগের বাহন। এরকমই কিছু চিঠি লিখেছিলেন কারারুদ্ধ জওহরলাল নেহরু তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে।
ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে জওহরলাল অচিরেই ভারতীয় রাজনীতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধির অনুগামী কর্মী থেকে নেতৃত্ব দেবার দায়িত্ব পালন করেন। গান্ধিজীর ডাকা আইন অমান্য, অসহযোগ ও সত্যাগ্রহে যোগ, এবং ১৯২৯ সালে ডিসেম্বরে কংগ্রেস সভাপতি হয়ে পূর্ণ স্বরাজের ডাক দিয়ে ভারতের মাটিতে সে-সময়ের জাতীয় পতাকা তুলে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের মুক্তির দাবী জানানোর অপরাধে এলাহাবাদের নৈনি জেলে তিনি কারারুদ্ধ হন। স্ত্রী ও কন্যার প্রতি কর্তব্য যথাযথ পালন করতে পারছেন না বলে জওহরলাল ব্যথিত। কিশোরী কন্যা ইন্দিরাকে কাছে থেকে শিক্ষা দিতে পারছেন না বলে দুঃখ হচ্ছে। জেলের কুঠুরিতে বসে ইন্দিরার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। কথা বলতে চান জওহর। কিন্তু কিভাবে কথা বলবেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল চিঠি লেখার কথা। জেলে বসে সুযোগ ও সময়ের সদ্ব্যবহার করে ইন্দিরাকে লিখলেন যে উপদেশ বা জ্ঞান দেওয়া তিনি পছন্দ করেন না তাই নিজের মেয়ের ওপর সেই বোঝা না বাড়িয়ে তিনি মেয়েকে এই পৃথিবীর সাথে, তার প্রাণীদের সাথে পরিচয় করাবেন। এভাবেই দুজনের ভাবের আদান-প্রদান সার্থক হবে। কথা না বলতে পারার অভাব কিছুটা দূর হবে। এই মনোভাব নিয়ে তিনি শুরু করেন প্রথম চিঠি Book of Nature বা প্রকৃতির বই দিয়ে। তাঁর লেখা তিরিশখানা চিঠির সংকলন Letters From A Father To His Daughter। প্রকাশের সাথে সাথেই বইটা জনপ্রিয় হয় এবং ভারতের বহু ভাষায় অনুবাদ হয়।
ছোট থেকেই ইন্দিরা তার বাবার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত। মা কমলা নেহেরু থাকতেন এলাহাবাদে আনন্দ ভবনে। মা প্রায়শই অসুস্থ হয়ে বিছানায় থাকতেন। তাই ইন্দিরার শৈশব ছিল নিঃসঙ্গ ও অখুশি। এইসময় বাবার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ ছিল নামমাত্র, যোগাযোগ যা ছিল তা ওই চিঠির মাধ্যমেই।
পৃথিবীর ইতিহাস আমরা কী করে জানলাম সেই প্রসঙ্গে জওহরলাল কন্যা ইন্দিরাকে লিখছেন, ‘আমাদের কাছে এমন কিছু আছে যা প্রায় একটা বইয়ের মত। আমাদের কাছে আছে পাথর ও পাহাড়, সমুদ্র ও নক্ষত্র, নদী ও মরু এবং পুরনো প্রাণীর জীবাশ্ম। এগুলোই পৃথিবীর ইতিহাসের বইয়ের মত। পৃথিবীকে সত্যিকারের জানতে হলে অন্য লোকের বই পড়ে নয়, প্রকৃতির বই পড়তে হবে।’ খুব সহজ ভাষায় বোঝাচ্ছেন ইন্দিরাকে কিভাবে পুরনো ইতিহাস লিখতে শিখল মানুষ। এরপরেই লিখছেন, ‘নগর বাড়ার সাথে তৈরি হল অনেক দেশ। পাশাপাশি দেশে বাস করা লোকেরা নিজেদের মনে করল তারা অন্য দেশের লোকেদের থেকে বেশি জানে আর সেটা মেনে বোকার মত পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দিত। তখনও ভাবে নি আর এখনও মনে করে না যে যুদ্ধ করে লোক হত্যা করার মত নির্বুদ্ধির কাজ আর নেই। এতে কারোরই ভাল হয় না।’ কিশোরী কন্যার মনকে মানবহিতার্থে এভাবে তৈরি করে তোলার নিদর্শন বিরল।
ভারতবর্ষ সম্বন্ধে প্রাথমিক আলাপ করাতে গিয়ে রামায়ণ ও মহাভারতের কথা উল্লেখ করে বলছেন, ‘আমরা চেষ্টা করলে আমাদের দেশকে আবার স্বাধীন করতে পারি যাতে গরীব লোকেদের অনেক উন্নতি হয়।’ এভাবেই মেয়েকে দেশের স্বাধীনতা চিন্তা শেখাচ্ছেন জেলে বসে চিঠি লিখে। এরপর একটার পর একটা চিঠিতে লিখে যাচ্ছেন মূল্যবান সব বিষয় – পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস, প্রথম প্রাণের আগমন, প্রাণি জগতে বিবর্তন হয়ে মানুষের উদ্ভব। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝাচ্ছেন নিরক্ষরেখার আশপাশে সূর্যের তাপ অতি প্রখর হওয়ায় সেসব জায়গার অধিবাসীদের চামড়া পুড়ে কালো হয়ে যায়। হাজার হাজার বছর প্রজন্ম ধরে থাকতে থাকতে তাঁদের সন্তান্সন্ততিরা আপনা থেকেই সেই কালো রঙ নিয়ে জন্মায়। আর উচ্চ অক্ষরেখা এবং পাহাড়ী অঞ্চল সবসময় ঠাণ্ডা থাকায় লোকেদের চামড়া সাদা। ‘আবহাওয়াই মানুষের বর্ণবৈষম্যের মূল কারণ’ বলে সারা পৃথিবীজুড়ে বর্ণবৈষম্য নিয়ে ভুল ধারনার অবসান ঘটালেন মেয়ের জীবনের শুরুতেই।
🍂
অন্য এক চিঠিতে তিনি বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠার গল্প বলছেন। প্রথমে বড় বড় নদীর তীরে লোকে বসবাস শুরু করে সহজে জল পাবে বলে কারণ চাষের জন্যে জল লাগে, মাছ ধরা হয় নদীতে ইত্যাদি। সেইমত ভারতে সিন্ধু ও গঙ্গার ধারে, মেসোপটেমিয়ায় টাইগ্রিস ও ইওফ্রেটস নদীর তীরে, নীল নদের উপত্যকায় ইজিপ্ট এবং চিনেও সভ্যতা শুরু হয়। ভারতে প্রাচীনতম মানুষ ছিল উন্নত সংস্কৃতির দ্রাবিড়। পরে উত্তর-পশ্চিম থেকে আর্যরা আর পূর্ব থেকে মঙ্গোলরা আসে। আরব ও হিব্রুরা তৃতীয় উপজাতি বলে ধরা হয়। এভাবে তিনি এগিয়ে যান বিভিন্ন ভাষা সৃষ্টি ও পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাসে। ভারী চমৎকার এইসব গল্প যা নিশ্চই ইন্দিরা উপভোগ করতো, ভাবতো, ও এভাবেই বাবাকে কাছে পেত।
সভ্যতা কাকে বলে বোঝাতে দশ নম্বর চিঠিতে লিখছেন, সব থেকে ভাল হোল নিঃস্বার্থ ও পরের হিতের জন্যে কাজ করা এবং সবাই মিলে কাজ করা। এ কোনো আদেশ বা উপদেশ নয়, যেভাবে তিনি গল্পের ছলে এই উপসংহারে এলেন তা সত্যিই অতুলনীয়। এরপর একটা চিঠিতে তিনি লিখছেন ভয়ের থেকেই ধর্মের উদ্ভব এবং ভয়ের জন্যে যা কিছু করা হয় তা খারাপ। ধর্মকে মানুষ এমনভাবে ব্যবহার করেছে যে ধর্মের নামে মানুষ একে অপরকে ঘৃণা করে, এমনকি হত্যা করে। এর থেকে চলে যাচ্ছেন শ্রম বন্টন সূত্রে। পরে এক চিঠিতে বলছেন যে শ্রম বন্টন থেকে তৈরি হোল প্রতিটা শ্রম বিভাগে একজন লিডার এবং সে হোত অভিজ্ঞ পুরুষ। এই পুরুষকে লিডার করার ধারণাটা সে পেয়েছে তারও আগে পাশাপাশি দেশের যুদ্ধে পুরুষদের ভূমিকা থেকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ গঠণের সূত্রপাত এখান থেকেই। ইন্দিরা ঘরে বসেই শিক্ষিত হচ্ছেন, অভিজ্ঞ হচ্ছেন। পৃথিবীর প্রকৃত রূপ উন্মোচিত হচ্ছে আস্তে আস্তে। পরিচিত হচ্ছেন মানুষ ও তার আসল চেহারার সাথে। ভবিষ্যতের ইন্দিরার মানসিক গঠনের কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে ওই দশ বছর বয়সেই। তিনি লিখছেন, পরবর্তিকালে এই নেতারাই রাজা হয়ে শাসক হোল- ‘“The state, it is I’ or ‘I am the state’”। আজও এই ধ্বনি শোনা যায়, এমনকি গণতান্ত্রিক দেশেও! যারা প্রকৃতিকে বুঝতে না পেরে তার বিভিন্ন রূপের সাথে একটা অলৌকিক ঈশ্বরের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তারাই সেই ঈশ্বরকে মূর্ত আকারে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে কারণ শিশুদের মতই তারা পার্থিব মূর্তি ছাড়া পুজো করতে পারত না। একদিকে শাসকের আইন আর অন্যদিকে পুরোহিতের নিয়ম। একসময় পুরোহিতেরা সেই ভয় দেখিয়ে শাসকদের ওপরও কর্তৃত্ব করত। শাসক আর পুরোহিত একই লোক হয়ে ক্ষমতা ভোগ করেছে যেমন ইজিপ্টে ফ্যারাহোরা। তাঁদের এত ক্ষমতা হয়েছিল যে মৃত্যুর পর তাদেরও পুজো করা হোত।
আরও অনেক কথা আছে বাকি চিঠিগুলোতে। কিন্তু এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে শুরু থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত পৃথিবীকে পরিচয় করিয়ে দেবার মত এর থেকে ভাল উপায় আর নেই। এই প্রাথমিক পাঠই ইন্দিরার চরিত্র ও মানসিক গঠনে কাজ করেছিল তা তাঁর পরবর্তী জীবন সাক্ষী।
কন্যা সন্তানের প্রতি যথাযথ সময় দিতে না পারার বেদনা কর্মসূত্রে দূরে থাকা পিতাকে কুড়ে কুড়ে খায়। সে উপশমের একটা উপায় খোঁজে একজন রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মী পিতা। আপন কর্মক্ষেত্র তাঁকে সংসার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, সন্তান নিজে পিতার থেকে যতটা সময় কাছে পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আবার একজন সুশিক্ষিত পিতা চেষ্টা করেন তাঁর সন্তান যেন স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এরকম না মনে করে। তাই আমরা দেখতে পাই জওহরলাল নিজ পদ্ধতিতে সেই স্নেহ দিয়ে লালিত করছেন আপন সন্তান। এই পদ্ধতি নির্ভর করছে শিক্ষা, জ্ঞান, পরিবার, সমাজ, বহির্মুখীতা ও সর্বোপরি পরিবেশের ওপর। তাই সন্তানকে পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments