জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৮০/ বিজন সাহা


আধুনিক দুবনার একাংশ

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৮০ 

বিজন সাহা 

দুবনা – আধুনিক কাল 


আমি দুবনা আসি ১৯৯৪ সালে। তখন সমস্ত রাশিয়ায় বাজার অর্থনীতি চালু হয়ে গেছে। রাজত্ব করছে বন্য পুঁজিবাদ। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাস্তা ঘাট সবসময়ই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল। বাজার অর্থনীতির পাল্লায় পড়ে সব রাস্তা ঘাট ভরে গেছে স্তূপীকৃত মালামাল আর ময়লায়। মস্কো পরিণত হয়েছে বিশাল এক নোংরা বস্তিতে। ঠিক এই সময় দুবনায় এসে মনে হল আবার যেন সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে এলাম। সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, দোকানপাট সোভিয়েত ইউনিয়নের দোকানপাটের মত ফাঁকা। 

বর্তমান দুবনা প্রথমে তভের অঞ্চলের অংশ ছিল আর যখন সোভিয়েত সরকার দুবনা প্রতিষ্ঠা করে মানে ১৯৫৬-১৯৫৮ সালে এটা ছিল কালিনিন (বর্তমানে পুনরায় তভের) প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। পরে তা মস্কো প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পারমানবিক বোমা তৈরির প্র্যাক্টিক্যাল কাজ  শুরু করার একটি গোপন নির্দেশ জারি করা হয় সোভিয়েত সরকারের পক্ষ থেকে। ধরে নিতে পারি এটা ঘটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট গ্যারি ট্রুম্যান স্তালিনকে পারমাণবিক বোমা সম্পর্কে অবহিত করার পরপরই। এটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম পারমাণবিক প্রোজেক্ট। ১৯৪৬ সালের ১৩ আগস্ট সোভিয়েত সরকার একটি শক্তিশালী সাইক্লোট্রন তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আর সেটা তৈরির স্থান হিসেবে ইভানকভস্কি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বেছে নেয়া হয়। ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে ইভানকভা শহরের ভোলগার দক্ষিণ তীরে সিনখোসাইক্লোট্রন তৈরির প্রস্তুতি কাজ শুরু হয়। এটাই দুবনার প্রথম কোলাইডার। এখানেই কাজ করেছেন ইয়াকভ পেত্রোভিচ তেরলেৎস্কি। এই নির্মাণ যজ্ঞকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে ওঠে জনপদ যা বর্তমানে ইনস্টিটিউট এলাকা নামে পরিচিত। এখানেই অবস্থিত জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ। উল্লেখা করা যেতে পারে যে আমাদের ইনস্টিটিউট মেন্দিলিভের সরণীর মিসিং এলিমেন্টগুলো আবিষ্কারের জন্য প্রসিদ্ধ। ১৯৪৭ সালের শুরুতে নভ-ইভানকভায় পদার্থবিদদের একটি গোপন মিলিটারি-গবেষণা কেন্দ্র গড়া হয় যার লক্ষ্য ছিল সিনখোসাইক্লোট্রন তৈরি করা। গোপনীয়তার কারণে এই জনপদ আলাদা ভাবে গড়ে উঠতে থাকে, তবে পরে ১৯৬০ সালে একটি অভিন্ন শহরে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে মার্চে বলশায়া ভোলগায় হাইড্রোটেকনিক্যাল ল্যাবরেটরি তৈরির কাজ শুরু হয় যা পরবর্তীতে সোভিয়েত একাডেমীর নিউক্লিয়ার প্রবলেম ইনস্টিটিউট হিসেবে পরিচিত হবে। ১৯৪৯ সালের ২ মে সোভিয়েত সরকার এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার নির্দেশ জারি করে। কথিত আছে দুবনায় এই ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠে লাভরেন্তি বেরিয়ার উদ্যোগে। তাঁকে স্তালিনের ডান হাত হিসেবে বিবেচনা করা হত। ধারণা করা হয় যে স্তালিনের কুখ্যাত গুলাগের পেছনে বেরিয়ার হাত ছিল। তবে সোভিয়েত পারমাণবিক বোমা তৈরিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক ভাবে যাই হোক তাঁর ছিল অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা।  

🍂

তিনি চেয়েছিলেন এধরণের একটি ইনস্টিটিউট এমন জায়গায় গড়া হোক যা মস্কোর খুব কাছেও হবে না আবার মস্কো থেকে খুব দূরেও হবে না। ফলে এখানে কর্মরত বিজ্ঞানীরা যখন তখন মস্কো চলে যাবে না বা মস্কোয় বসবাস করে সেখানে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে কাজ করতে পারবে না। আবার এতটা দূরেও হবে না যাতে কেন্দ্র থেকে যখন তখন তাদের ওখানে যাওয়া যায়, কাজের হিসেব নেয়া যায়। ১৯৫৪ সালের ১৭ মার্চ সমাজতান্ত্রিক রুশ ফেডারেশনের সুপ্রিম সোভিয়েতের আদেশক্রমে ইভানকভার দক্ষিণাংশ ডিক্ল্যাসিফাইড করা হয় আর এই শ্রমিক পল্লীর নাম দেয়া হয় দুবনা। ১৯৫৬ সালের ২৬ মার্চ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার ফলশ্রুতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক সংস্থা - জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ। এখনও পর্যন্ত তার আন্তর্জাতিক স্ট্যাটাস বজায় আছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সেই আদেশে দুবনার নাম ভুল করে দুবনো লেখা হয়েছিল। আমার মনে আছে ২০০৬ সালের মার্চের শুরুতে স্থানীয় কালচারাল সেন্টারে একটি ফটো এক্সিবিশন চলছিল। আমি এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওরা জিজ্ঞেস করে আমি এরকম এক্সিবিশন করতে আগ্রহী কি না? তাহলে ২৬ মার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে করতে পারি। যেহেতু এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস তাই আমি রাজী হয়ে যাই। সে সময় আমি ফিল্ম ব্যবহার করতাম। পুরানো নেগেটিভ আর ছবি স্ক্যান করে নতুন করে প্রিন্ট করি। এটাই ছিল আমার প্রথম সলো এক্সিবিশন। এভাবেই দুবনায় আমার ফটোগ্রাফির নতুন জীবন শুরু হয়।

৯ মে বিজয় দিবসের র‍্যালী

১৯৫৬ সালের ২৪ জুলাই সমাজতান্ত্রিক রুশ ফেডারেশনের সুপ্রিম সোভিয়েত  নতুন নির্দেশ জারি করে। সেই আদেশে দুবনাকে শহরের স্ট্যাটাস দেয়া হয়। তাই ১৯৫৬ সালের ২৪ জুলাই দুবনার জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয়। বর্তমানে দুবনার জন্মদিন পালন করা হয় জুলাইয়ের তৃতীয় অথবা চতুর্থ শনিবার যেটা জুলাই মাসের ২৪ তারিখের আশেপাশে পড়ে। ১৯৫৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের সরকারি নির্দেশে দুবনার সাথে ইভানকভার বাম দিক, রাতমিনো, কাজলাকি, আলেক্সান্দ্রভকা, নভ-ইভানকভা এসব জনপদ সংযুক্ত করা হয় আর বর্ধিত দুবনাকে মস্কো প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৫৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর দুবনোর জনগণের পক্ষ থেকে শহরের নাম পরিবর্তন করার জন্য সমাজতান্ত্রিক রুশ ফেডারেশনের সুপ্রিম সোভিয়েতের কাছে আবেদন জানানো হয়, যার প্রেক্ষিতে ১৯৫৮ সালের ০৮ জানুয়ারি শহরের নাম বদলিয়ে দুবনা রাখা হয়। ১৯৬০ সালের ১৩ ডিসেম্বর দুবনা ও ইভানকভা একত্রিত করার সিদ্ধান্ত নেয় সুপ্রিম সোভিয়েত। এভাবেই জন্মগ্রহণ করে বর্তমান দুবনা। এরপর থেকেই শুরু হয় শহর গঠনের কাজ। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি চলে আসে তাদের পরিবার পরিজন। জন্ম নেয় নতুন দুবনাবাসী। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় টেঞ্জর নামে এক ফ্যাক্টরি, ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আজিমুত-এম২ যা পরবর্তীতে কসমিক কন্ট্রোল কেন্দ্র হিসেবে বিকাশ লাভ করে। এখান থেকেই বিভিন্ন স্পুটনিকের গতিবিধি লক্ষ্য করা হয়। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দুবনা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০১ সালে দুবনাকে নাউকাগ্রাদ বা বিজ্ঞান শহরের মর্যাদা দেয়া হয়। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক শহরের মত দুবনাও গড়ে উঠেছিল কয়েকটি ইনস্টিটিউটকে কেন্দ্র করে। এর একটি রাদুগা, যেখানে মিসাইল তৈরি হত। মনে পড়ে আমি যখন দুবনা আসি তখন রাদুগা প্রায় ধ্বংসের পথে। একদিন যারা রকেট তৈরি করত এসময় টিকে থাকার জন্য তারা বাচ্চাদের জন্য স্ট্রলার তৈরি করতে শুরু করে। এখন অবশ্য অবস্থা ঘুরে গেছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পরে এখানে এখন তৈরি হচ্ছে মিসাইল আর ড্রোন। অন্যটি আমাদের ইনস্টিটিউট – যাকে ঘিরে সমাজতান্ত্রিক ব্লকের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন যৌথ গবেষণা পরিচালনা করেন। বর্তমানে এখানে স্পেশাল ইকনমিক্যাল জোন, ন্যানো টেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার ইত্যাদি কাজ করতে শুরু করেছে। কাজ করছে বিভিন্ন ফারমাসিটিক্যাল কোম্পানি যাদের একটি বড় অংশ ভারতীয় পুঁজিতে চলে। আমি যখন মস্কো থেকে দুবনা আসি এটা ছিল একটি পিছিয়ে পড়া শহর। এখন দুবনা ক্রমবর্ধমান এক শহর।  আগে যেসব জায়গায় পিকনিক করতাম এখন সেখানে বহুতল বিল্ডিং। এমনকি আমরা যে বিল্ডিঙে বাস করি সেখান থেকেও আমি এক সময় বাচ্চাদের জন্য নল খাগড়া তুলতাম। ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত কাজ আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ২০০৫ থেকে দুবনার সামাজিক জীবনে জড়িয়ে পড়ি ফটোগ্রাফির মাধ্যমে। এখন সাধারণ মানুষ আমাকে ফটোগ্রাফার হিসেবেই বেশি চেনে, বিশেষ করে ২০১২ সালে বাংলাদেশের উপর একটি ফটো এক্সিবিশন করার পর থেকে। এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। দুবনার দক্ষিণ অংশ দ্বীপের মত। এর বাঁদিকে ভোলগা, পশ্চিমে সেস্ত্রা নামে এক  নদী যা দুবনা নদীতে গিয়ে মিলেছে, আর ডান দিকে দুবনা নদী, যা পড়ছে ভোলগায় রাতমিনোর ওখানে। এছাড়াও দুবনায় প্রায়ই চোখে পড়বে বিভিন্ন রকমের স্ট্যাচু – যেমন ইলিয়া ফ্রাঙ্ক আর ব্রুনো পন্তেকরভোর স্ট্যাচু – যেখানে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পন্তেকরভো। এই ইতালীয়ান পদার্থবিদ কমিউনিস্ট ছিলেন, পালিয়ে এখানে চলে আসেন। তিনিই দুবনায় সাইকেল চড়ার রীতি চালু করেন, যা এখনও বিদ্যমান।

দুবনা সেতু

 আছে বিশাল এক চেয়ার, আছে যুদ্ধ বিমানের স্ট্যাচু। আর রাস্তার নাম? সোভিয়েত আমলে যেকোনো শহরের রাস্তার নাম রাখা হত কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের নামে। কিন্তু দুবনার অধিকাংশ রাস্তার নাম বিজ্ঞানীদের নামানুসারে। প্রথমবার মানে ১৯৯৪ সালের মার্চে যখন দুবনা আসি তখন একটি দেয়ালে লেখা ছিল – «পরমাণু সৈনিক নয়, পরমাণু খেঁটে খাওয়া মানুষ।» ট্রেন থেকেই সেই লেখা দেখে অবাক হয়েছিলাম – ছোট্ট কিন্তু কী সুন্দর কথা। সেসব গল্প অন্য কোন সময়ে। এখন বিদায় নেবার পালা। ঘরের ছেলে ঘরে পৌঁছে গেছি, তাই আপাতত এখানেই শেষ করছি। তার আগে দিলীপ ও দেমিদকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। বিশেষ ধন্যবাদ জ্বলদর্চি পত্রিকার সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠীকে যার অনুপ্রেরণায় আমার ভোলগা ভ্রমণ শুধু লিখিত রূপই পায়নি, আপনাদের সামনে হাজির হয়েছে। ফলে নতুন করে পুরানো ভ্রমণই শুধু উপভোগ করিনি, অনেক পড়াশুনা করে অনেক কিছুই শিখেছি, জেনেছি অনেক অজানা তথ্য। এটা আশিতম পর্ব, মানে দীর্ঘ দেড় বছর ধরে লিখে গেছি এই ভোলগা ভ্রমণের গল্প। যারা সাথে ছিলেন, কমেন্ট করে, পড়ে উৎসাহ দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। ধন্যবাদ যারা পড়েননি কিন্তু পড়বেন বলে আমার ভাবনায় ছিলেন সেই সব কল্পিত পাঠকদের। সবার জন্য শুভকামনা।                

ছবিতে দুবনা ডে
http://bijansaha.ru/album.php?tag=249 
ফায়ার ওয়ার্ক 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=300


Post a Comment

0 Comments