জ্বলদর্চি

নিশীথ রাতের অতিথি /পুলক কান্তি কর

চিত্র- চন্দ্রিমা ঘোষ 

নিশীথ রাতের অতিথি

পুলক কান্তি কর

আজ বেশ দেরি করেই বাড়ি গেল রীতা। সন্ধে বেলার রান্নাটা ওই করে। সকালের জন্য লোক রাখেননি আনিমা দেবী। তিনি নিজেই একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠেন। ঘর মোছা বাসন মাজার জন্য যদিও লোক আছে, তবু রান্নাটা নিজেই করে নেন। একার রান্না আর কতটুকু। তবু রাতের বেলায় কিছুতেই রান্না ঘরের দিকে পা নড়তেই চায় না। বিশেষ করে তপু’র বাবা মারা যাওয়ার পর বহু দিন তো রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়তেন। পরে সবাই বলাবলি করতে, বিশেষ করে তপু’র পীড়াপীড়িতেই বাধ্য হয়ে লোক রেখেছেন। রীতা অন্যান্য দিন আটটা সাড়ে আটটার মধ্যেই কাজ গুছিয়ে ফেলে। তবে আজ নাকি ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল। এখন ন’টা বাজে। অনিমা দেবী হুড়োহুড়ি করতে শুরু করলেন। নিজের কত কাজ রয়েছে, ওষুধ খাওয়া আছে, দু-একটা জরুরী ফোন করতে হবে আজকেই – যা বাইরের লোকের সামনে করা যায় না। বেশ দ্রুত ভাবেই সব সেরে রাতের খাওয়া শেষ করলেন তিনি। মুখ ধুয়ে খাটে বসে চুল আঁচড়াতে গিয়ে চোখ পড়ল টেবিলের উপর রাখা তপু’র ফটোর দিকে। রাত প্রায় এগারোটা বাজে- এবার ওর আসার সময় হল। ওর দিক থেকে চোখ সরাতে না সরাতেই ডাক এল- ‘মা আসব?’ 
-হ্যাঁ বাবা, আয় আয়।
- দরজা জানালা সব ঠিকঠাক করে লাগিয়েছ? না কি চেক করে আসব?
-না রে বাবা। সব সন্ধে থেকেই লাগিয়ে রেখেছি। আমাকে কি তোর অসাবধান মনে হয়?
- না আসলে সারাদিন একা থাকো তো। জানোই তো আজকাল কলকাতায় কতরকম চুরি ডাকাতি বদমাইশির ঘটনা ঘটে।
-তা ঠিক, তবে তোর মা কি যে সে মানুষ? আমার কাছে চোর আসতে ভয় পায়। বলেই একচোট হাসলেন আনিমা। সেই হাসির রেশ ধরে তপুও মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। আসলে অনিমা দেবী বেশ কয়েক বছর কলকাতা পুলিশে চাকরি করতেন। পুলিশে চাকরীর জন্য নয়, তিনি বরাবরই একটু ডাকাবুকো স্বভাবের। একবার বাসে এক পকেটমারকে ধরে কী মারটাই না মেরেছিলেন। পাড়ার দজ্জাল বউ হোক কিংবা দজ্জাল শাশুড়ি - তাঁর ভয়ে কাঁপত। উপযাচক হয়েই সালিশী করতেন, কেউ ভয়ে একথা বলতে সাহসই পেতনা যে আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে বাপু তুমি কেন?
- আজ রীতাদি দেরি করে কেন এল মা? ওর শরীর টরীর খারাপ নাকি?
- হ্যাঁ। কদিন ধরেই বলছে - ওর তলপেটে কেমন একটা ব্যথা। ডাক্তার দেখায়নি এতদিন। আমিই জোর করে তোর সতীশ জেঠুর কাছে পাঠালাম।
- তুমি ফোন করে দিয়েছিলে তো?
- হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ। ফোন করে দিয়েছিলাম। টাকাও দিয়েছিলাম যদি টেস্ট ফেস্‌ট করতে হয়। তবে জেঠু ফীস্‌ নেয় নি।
- ইউ.এস. জি. ইত্যাদি করতে দিয়েছে না কি?
- হ্যাঁ। ওসব করিয়ে দিন দুই তিন বাদে আবার যেতে বলেছে।
- দ্যাখো ওর শরীর খারাপ হলে তোমার ভারি মুশকিল হবে। বাপি চলো যাওয়ার পর যা হাল করেছিল নিজের! 
- সে যা বলেছিস্‌। দ্যাখ কেমন দুম করে চলে গেল লোকটা। রাতে দিব্যি সুস্থ মানুষ খেয়ে দেয়ে শুলো, সকালে নেই। 
- হ্যাঁ, বয়েসও তো এমন কিছু হয়েছিল না বাপির। যখন মারা গেল একজ্যাক্টলি কত ছিল মা? সাতান্ন না?
- ওই ছাপান্ন হয়ে সাতমাস আটদিন।
- তোমাদের দাম্পত্য কতদিনের মা?
- সাতাশ বছর। তোর বাপির তিরিশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল।
- আর তুমি?
- আমি তখন ছাব্বিশ।
- তুমি আজ শিশু নিকেতনে যাও নি?
- হ্যাঁ গেছিলাম তো। মনে মনে একটু চমকে গেলেন তিনি। তপু কি কিছু শুনতে চাইছে? চুপ করে রইলেন তিনি কিছুক্ষণ। প্রতি রবিবার তিনি শিশু নিকেতনে যান নিয়ম করে। তাও হয়ে গেল প্রায় আট বছর। ওটা একটা মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের প্রতিষ্ঠান। যাওয়াটা শুরু হয়েছিল ঝিনুকের হাত ধরে। এখন তো রবিবার বাদ দিয়ে মাঝে মাঝে অন্যদিনও যান তিনি।
- ঝিনুকের সাথে দেখা হয় নি তোমার?
- না রে। আজ আসে নি ও।
- কেন? শরীর টরীর খারাপ? ফোন করনি? বেশ উদগ্রীব শোনাল তপু’র গলা। 
- না রে ফোন করা হয়নি।
- গত সপ্তাহেও তো আসেনি বললে। ও কি ভালো নেই মা?
- তা কেন? নিশ্চই কোনও আসুবিধা হয়েছে।
- একবার ফোন কর না মা!
- সে কী রে! এখন সাড়ে এগারোটা বাজে। এতরাতে চমকে যাবে না!

🍂

- কি জানি মা, ওর জন্য মনটা কেমন করছে।
একটু চুপ করে রইলেন অনিমা। সত্যি, কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল। তপুর এগারো বারো ক্লাশের বন্ধু ছিল ঝিনুক। আসল নাম অঙ্গনা। তপুই ওর নাম দিয়েছিল ঝিনুক। বন্ধু থেকে প্রেম - যা হয় আর কি। তপু মাকে কোনও কিছু লুকোতো না। তপু জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ঢুকলো যাদবপুরে, আর ঝিনুক ইংলিশে অনার্স নিয়ে যোগমায়া দেবী কলেজে। ঝিনুক সপ্তাহে অন্তত দু’দিন এ বাড়ি আসতো। অনিমা দেবীর সাথেও অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছিল তার। চিন্তায় হঠাৎ ছেদ পড়ল তপুর কথায় - ঝিনুক সুখী তো, মা?
      কি উত্তর দেবেন অনিমা? আমরা নিজেরা সুখী কিনা তাই কি বুঝতে পারি? খুব অল্প সত্ত্বের মানুষ হলে তাও আন্দাজ করা যায়; ঝিনুক তো শক্ত মনের মেয়ে। ওর মনের কি তল পাওয়া যায়! আর তাছাড়া বেশ ক’বছর ধরে ওর সাথে আর তেমন গভীর কথা হয় না। এই কেবল শারীরিক খোঁজ খবর আর দু-একটা দীর্ঘশ্বাসের গভীরতা মাপা ছাড়া আর কিছু কথা মনে পড়ে না। ফোন করলে নীরবতাই বেশি থাকে। কে কিভাবে ফোন রাখবে, মনে মনে বাহানা খোঁজা জারি থাকে সবসময়ই। অথচ এই মেয়েটি ফোন করলে আগে ছাড়তেই চাইত না। কতরকমের গল্প, হাঙ্গি বাঙ্গি কথা, ক্লাসের বন্ধুরা কী বলল, তপু অভিমান  করলে কী করে – ইত্যাদি ইত্যাদি। ফুলের মতো কোমল মেয়েটা… বুকের মধ্যে আবার নতুন করে একটা মোচড় অনুভব করলেন অনিমা। 
       মা কে নিরুত্তর দেখে চুপ করে রইল তপু। তাহলে কি ঝিনুক সত্যি অসুখী? তার ঝিনুক আজ অন্য কারও - ভাবতে কষ্ট হয় ঠিক, তবে মনে মনে সে সত্যিই চায় ও সুখী হোক। তার সাথে বিয়ে হতে পারল না বলে মেয়েটার তো জীবন নষ্ট হতে পারে না! তখন তপু থার্ড ইয়ারে পড়ে। ঝিনুকের অনার্স কমপ্লিট হয়ে গেছে। কথাচ্ছলে তপুই বলেছিল- আচ্ছা তুই যে সারাদিন আমার সাথে টো টো করে বেড়াস, এইবার আমি যদি তোকে বিয়ে না করি? 
- না করবি  না করবি !  আমি কি তোর মুখাপেক্ষি?
- না মানে বিয়েতে তো দুজনকেই দুজনের মুখাপেক্ষি হতে হয়, আমি ঠিক পুরুষ নারী হিসাবে বলছি না।
- বিয়ে না করে কি করবি তুই? লিভ টুগেদার? তাতেও তো তোর সাথে থাকব আমি। সমস্যা কী?
- না, তোর বদলে যদি অন্য কেউ থাকে?
- সে মুরোদ নেই তোর। আর আমি ছাড়া তোর এত মুড কে সহ্য করবে রে? করে দ্যাখ না, দুদিনের বেশী কেউ টিকবে না।
- আরে সিরিয়াসলি বল না, যদি সত্যি এমন হয়? 
- এমনটা কোনও ভাবেই হবে না। 
- ধর যদি মরে যাই!
- কী অলুক্ষণে কথা! আমি বেঁচে থাকতে যমের এত হিম্মত! তুই ওরকম ভাবিসই না। 
-‘ প্লিজ ঝিনুক বল না! তুই কি অন্য কাউকে বিয়ে করবি?’ চুপ করে রইল ঝিনুক। সত্যি এসব কথা তো সে ভাবতেই পারে না। চুপ করে থাকার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ভগবান ওকে দিয়েছেন। সব কথার পিঠে কথা না বললেই যে অনেক জটিলতা এড়ানো যায়, এই সংযম তার থেকে বেশী আর কারও আছে বলে মনে হয় না তপু’র। সে বুঝে গেল- এ কথার উত্তর ঝিনুক দেবে না। তাই স্বগোতোক্তির মতোই বলল, ‘তুই অন্য কারও হবি - আমি তো সইতেই পারবো না রে।‘  একটু চুপ থেকে বলল, কী রে আমাকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে, না? 
      চুপ করে রইল ঝিনুক এ কথার উত্তরেও।
- কী রে কিছু বলবি না? আছা শুধু মাথা নেড়ে বল, আমাকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে?
      ঝিনুক না সূচক মাথা দোলাল এবার।
- কেন মনে হচ্ছে না? আমি যা বলছি সেটা তো অন্যায়!
      আবার নিস্তব্ধতা রইল কিছুক্ষণ। 
- দূর! তোর সাথে কথা বলাই বৃথা। তপু বেশ রাগত গলায় বলল।
- আমার কিছু হলে বুঝি তুই বিয়ে করবি? 
- হ্যাঁ। আমি করব, কিন্তু তুই করবি না। 
- কেন? এক রাজার দুই আইন কেন? 
- এমনি। তোর বড় হৃদয়। আমার অতটা বড় নয়। তোর গোপনীয়তার ভাগ অন্য কেউ নেবে, আমি মরে গেলেও সইতে পারবো না রে ঝিনু। পাগলের মতো তপু ঝিনুকের হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে কচলাতে লাগলো কিছুক্ষণ। একটু পরে মুঠো আলগা করতেই ঝিনুক হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল - হ্যাঁ রে তপু, তোর বাপি কি আমায় পছন্দ করেন? এত গম্ভীর থাকেন, বুঝতেই পারি না আমি তোর বাড়ি যাই - এটা তাঁর পছন্দ কি না!
- বাপি এরকমই। তবে খুবই নরম স্বভাবের। আর তাছাড়া আমাদের বাড়ীতে মা’র কথাই শেষ কথা। বাপি এক কথায় পত্নী দ্বারা আবৃত।
- মহেন্দ্র বুঝি?
- মহেন্দ্র মানে?
- এটা আমাদের বাঙাল কথা। মহেন্দ্র মানে স্ত্রৈণ।
- না, না বাবা স্ত্রৈণ নয় একেবারেই। তবে মা যা বলেন, তার প্রকাশ্যে অন্যথা হতে দেখিনা তো কখনও।
- ওটা তো স্ত্রৈণই হলো!
- না, একটা সূক্ষ্ম তফাৎ আছে। স্ত্রৈণরা টু সাম এক্সটেন্‌ট বউকে ভয় পেয়ে বা বউএর অশান্তির ভয়ে সবকথা মেনে নেয়। বাপিরটা তেমন নয়। জাগতিক কিছুতে মাথা ঘামানোর জন্য মা আছে, মা ভাবছে - এই ভেবেই বাপি স্বস্তি পায়। নিজের জগৎ নিয়ে থাকে।
- এমন মানুষের সাথে তোর মা’র বিয়ে হলো কী করে?  শুনেছি তো তোর মা পুলিশে চাকরি করতেন, বাবা কলেজে পড়ান। 
- ঐ যাকে বলে প্রেম!  কোন এক কমন ফ্রেন্ডের বিয়েতে চার চোখের মিলন হলো, বাপির মত নিরীহ বাক্যহীন লোকও প্রগলভ হল - এ সবই প্রজাপতি’র নির্বন্ধ। নইলে দুজনে দুই মেরুর লোক। 
- না, না। তোর মা ও কিন্তু বেশ ভাল।
- দুই মেরুর বলতে কি আমি খারাপ বলছি? মা হল বেশী কথা বলা বাস্তববাদী লোক, আর বাপি হল নিরীহ, গোবেচারা কবি টাইপ। 
- তোর বাবা কবিতা লিখতেন শুনেছি, এখন লেখেন?
- না। আমি কলম ধরতেই বাপিরটা বন্ধ।
- ওমা, তা কেন? বাপ ছেলে দুজনে লিখতে পারে না বুঝি? তুই জোর করতে পারতিস তো!
- তুই বলিস্‌। পুত্র বান্ধবীর কথা ফেলতে নাও পারে।
- কেন?
- পুরুষ কি না! পুরুষ কবিরা নারীজাতির প্রতি বিশেষ দুর্বলই হ’ন। 
চিন্তায় ছেদ পড়ল কর্কশ কোনও এক পাখির ডাকে। তপু দেখল মা এক দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। খানিকটা অস্বস্তি কাটানোর জন্যই মা কে জিজ্ঞাসা করল- ‘তোমার যাদবপুরের ফ্ল্যাটটার কী গতি করলে?’ 
- ওটায় যে ভাড়াটিয়া ছিল তারা ছেড়ে দেবে আগামী মাসে। তারপর ভাবছি নতুন ভাড়াটিয়ার জন্য পেপারে বিজ্ঞাপন দেব।
- কেন মা আর এসব ঝামেলায় জড়াবে? বেচে দাও। টাকাটা ব্যাঙ্কে ফিক্সড করে দাও।
- টাকাই বা কী হবে আর? তোর বাপির পেনশন থেকে যা পাই, তা আমার হয়েও বেশী হয়ে যায়। ওই শিশুনিকেতনে মাস গেলে বাকীটা দিয়ে দিই।
- আচ্ছা মা, উইল টুইল করে রেখেছ তো ঠিকমতো? সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালেন অনিমা।
- আচ্ছা মা, কিছু যদি মনে না করো, যাদবপুরের ফ্ল্যাটটা ঝিনুককে লিখে দিতে পারো না? 
- তা তো পারি। কিন্তু আমি দিলে সে নেবেই বা কেন? তার আত্মসম্মান বোধ তোর তো অজানা নয়।
- এতে সম্মানে লাগার কী আছে মা? বিয়েটা আমাদের হয় নি, সেটা একটা দুর্ঘটনা। মনের, আত্মার টান কি তোমার তার প্রতি নেই? তুমি কি এখনও ওই হোমে ওর টানেই যাও না?
- তা ঠিক, তবে নানান প্রশ্ন উঠবে। ওর শ্বশুর বাড়ীতে প্রশ্ন উঠতে পারে- এ বাড়ী ওকে আমি দিলাম কেন? কী দরকার অশান্তি বাড়িয়ে! 
- তবু, ধর ও যদি কখন সমস্যায় পড়ে, ওর স্বামীর সাথে যদি না বনে, তখন তো একটা মাথার ছাদ পাবে ও। আমি বলি কি, এই দুটো বাড়ীই ওর নামে লিখে দাও।
      অনিমা শুনেছেন ঝিনুকের শ্বশুর বাড়ীতে সত্যিই নাকি কিছু সমস্যা আছে। ওর স্বামী চাটার্‌ড অ্যাকাউন্‌ট্যান্‌ট। সারা মাস এদিক ওদিক ট্যুরে যায়। বিয়ের দু-বছর পর একটা বাচ্চা হয়েছিল, ফুলটার্ম, কিন্তু ডেলিভারির সাতদিনের মধ্যেই মারা যায়। তারপর থেকে আর কোনও ইস্যু আসে নি। ওর বর ওকে সময়ও দেয় না ঠিকমতো। যদিও ঝিনুক এই নিয়ে একটা কথাও তাঁকে বলে নি। ওই হোমের মালকিনের কাছে তিনি শুনেছেন এসব কথা। তপু এসব জানে কিনা কে জানে। জিজ্ঞাসা ওঁকে করে মাঝে মাঝেই, তবে তিনি এত ডিটেল্‌সে কিছু বলেন নি তাকে। তাঁর নিজেরও মনে হয়েছে - যা কিছু ফিক্সড, এল.আই.সি গুলো আছে - সব উইল করে ওর নামেই করে দেন। আজ পুত্রবধূ হলে ওরই তো অধিকার হ’ত। কিন্তু মনে মনে ভাবেন ও তো খুব জেদী মেয়ে। যদি অস্বীকার করে। বা যদি এই নিয়ে নতুন কোনও অশান্তি হয় ওর সংসারে। আর যাই হোক অনিমা কোনো নিমিত্তের ভাগী হতে চান না। তবে এই নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে হবে এবার। দরকার পড়লে ঝিনুকের সাথেই কথা বলবেন এই নিয়ে। তাঁরও তো বয়স বাড়ছে। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘ভোর হতে চলল, চা খাবি বাবা?’  
- আনো। তবে যাবার আগে তোমার মবাইলে ওই গানটা আছে না - ওই যে ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই’ - ওটা লাগিয়ে দাও না! 
    সত্যি কী অপূর্ব এর কথাগুলো। অণিমা চা বানাতে বানাতে ভাবেন- ‘না চাহিতে মোরে যা করেছ দান- আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ/ দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহাদানেরই যোগ্য করে/ অতি ইচ্ছার সংকট হতে বাঁচায়ে মোরে।‘ হঠাৎ গুণগুণ করতে করতে মনে হল, আচ্ছা তপু এ গান শুনতে চাইছে কেন? এতো আমারই গান। না কি তপুর ও! ‘এ যে তব দয়া জানি জানি হায়/ নিতে চাও বলে ফিরাও আমায়/ পূর্ণ করিয়া লহ এ জীবন তব মিলনেরই যোগ্য করে’ - দুচোখ জলে ভরে গেল অণিমার। সত্যি, এ তো তপুরই গান। এভাবে তো ভাবেন নি তিনি কখনও। নিজেকে সামলে বসার ঘরে এলেন তিনি।
- নে চা টা খেয়ে নে।
- গানটা শুনলে মা? এটা বিক্রম সিং খাঙ্গুরা না? 
- হ্যাঁ।
- দ্যাখো, ঈশ্বর তাঁর মিলনের যোগ্য বলেই এই অল্প বয়সেই ছেলেটিকে টেনে নিলেন নিজের কাছে। কী যে ইচ্ছা তার! 
   কিছু না বলে দুফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল অণিমার চশমার তলা দিয়ে। তপুর চোখ এড়ালো না তা। বলল, মা ঝিনুক আমার কথা বলে কখনও?
- না। 
- একদম বলে না? আকারে ইঙ্গিতে শুনতেও চায় না আমার কথা? 
- না রে বাবা! এই নিয়ে ভাবছিস কেন আজ। ও যে এই পর্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পেরেছে, তা কি ভালো নয়? 
- সেইটাই তো জানতে চাইছি মা। সত্যি সত্যি কি নিজেকে সরাতে পেরেছে, নাকি সরাবার ভান করছে শুধু? 
- আমারও মাঝে মাঝে তাই মনে হয় বাবা। ও শুধু তোকে ভুলে যাবার ভান করে। আমার সামনে এই নিয়ে কথা না বলাও বোধকরি সেই ভানের অঙ্গ; যাতে আমি কষ্ট না পাই। ও খুব চাপা স্বভাবের তো!
- আচ্ছা মা, যেদিন আমার অ্যাক্‌সিডেন্টটা হয়, সেদিন ও এসেছিল?
- হ্যাঁ, তোর বন্ধুরা আমাদেরকে ফোন করেই ওকে খবর দিয়েছিল বোধহয়। আমরা যখন হাসপাতালে পৌঁছাই তখনও ও ওখানে এসে পৌঁছোয়নি। তোকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যেতে যেতে ঝড়ের বেগে এসে পড়ল ও। তোর ওই রক্তাক্ত চেহারা দেখে সেই যে জ্ঞান হারালো চারদিন আর চোখ খোলেনি। আমার আর তোর বাপির সে কী অবস্থা! তোকে দেখব না ওকে। ওর বাবা মাও ছিলেন, তবে আমরাও তো আর তাকে ফেলতে পারি না। তোকে আই সি সি ইউতে দিয়ে ওকে দিলাম সেমি আই সি ইউতে। ওঃ কী সময় গেছে সে সময়। এর পরেই তো তোর বাপির শরীরটা বোধহয় ভেতরে ভেতরে বিগড়ে গেল। খুব মনমরা হয়ে ছিল লোকটা। তোকে আর ঝিনুককে যে এতটা গভীর ভালোবাসতো, বাইরে থেকে বোঝা যায় নি কখন ও। 
- ঝিনুক হাসপাতাল থেকে কবে ছাড়া পেল? 
- ছাড় না বাবা এসব কথা!  
- যতবারই আমি জিজ্ঞাসা করি, তুমি এড়িয়ে যাও। 
- কী দরকার আর এসব কথায়? কোনও পক্ষেরই কি লাভ আছে কিছু? বেকার শান্তি নষ্ট। তোরও, তারও।
- না মা, আমি শুনতে চাই, তুমি বল। 
- তুই একবার গিয়ে ওর সাথে দেখা করতে তো পারিস। যাস না কেন? 
- না মা। তা হয় না। ওর ভালো লাগবে না। 
- গিয়েই দ্যাখ না। তাহলেই তো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।  
- এই যে বললে, কোনও পক্ষেরই কি লাভ আছে কিছু এতে? মিছিমিছি ওর শান্তি ভেঙে লাভ কি? 
- তাহলে তুই বা শুনতে চাচ্ছিস কেন?
- কৌতূহল মা। আজ সাত আট বছর তুমি ওর কথা আময় গোপন করে আসছ। আমি তো এখন সব কিছুর ঊর্ধে। আমার কষ্ট হবে না। তুমি বলো।
- কী বলব, বল্‌।
- ও কবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল? আমি কি তখন হাসপাতালেই?
- তুই তখন হাসপাতালেই। কোমায়। ভেন্টিলেশনে ছিলি পনেরো দিন। ওকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছিল দিন সাতেক পর। ওর বাবা মা কোনও রিস্ক নেন নি। ওকে নিয়ে সোজা ওর কোনও আত্মীয়ের বাড়ী রাঁচিতে  চলে গিয়েছিলেন। আমরাও তাতে সায় দিয়েছি।
- তবে আমার আলটিমেট খবরটা ও পেল কী করে? 
- জানিনা। যেদিন তোর বডি বাড়ীতে এল, তোর বাপি ওর বাবাকে ফোন করেছিলেন, তারা কীভাবে ওকে জানিয়েছিলেন আমি জানিনা।
- একবার ঝিনুককে জিজ্ঞাসা করবে মা?
- না, বাবা। অতবড় বুকের জোর আমার নেই। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অণিমার বুক থেকে। একমনে উদাস দৃষ্টিহীন ভাবে চেয়ে রইলেন টেবিলে রাখা তপু’র ফোটর দিকে। একটু পরে বললেন, ‘পাঁচটা বাজতে চলল, ভোরের আলো ফুটে যাবে এবার। আজ চলে যা বাবা।‘ চারদিক কর্কশ ভাবে সমস্বরে ডেকে উঠল কিছু কাক। খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়ালো তপু। তারপর আস্তে আস্তে গিয়ে মিশে গেল দেয়ালে টাঙানো তার বড় ছবিটার ফ্রেমে।

Post a Comment

0 Comments