জ্বলদর্চি

গল্প।। গেরো।। সন্দীপ দত্ত

চিত্র- শুভম দাস

গল্প।। গেরো।। সন্দীপ দত্ত


মুড়ির সঙ্গে বাদাম মেশানো ছিল। ইচ্ছে করে হোক বা টেনশনে,বারকয়েক বাদামগুলোই বেছে বেছে খেলেন বলরাম। তারপর ঘুমহীন লাল চোখে একরাশ ভক্তি এনে অর্ধেন্দুভূষণের দিকে তাকিয়ে বললেন,"এখন কী করব দাদা? আপনি না বাঁচালে যে অধমের এই প্রাণটাই অকালে চলে যাবে। বউটাকে আমি বড্ড ভালবাসি দাদা। অসময়ে বিধবা হয়ে গেলে কে দেখবে ওকে? ছেলেদুটোও ছোট ছোট।"একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বলরাম টেবিলে ঢাকা দিয়ে রাখা জলের গ্লাসটা তুলে এমনভাবে জলটুকুখেলেন,দেখে মনে হল সাধের প্রাণবায়ু যেন বেরিয়ে যায় যায়।
         অর্ধেন্দুভূষণের চোখের সামনে তিন চারটে খবরের কাগজ। সবগুলোরই প্রথম পাতায় আগামিকালের জনসভার আঁটোসাঁটো নিরাপত্তাসহযোগে ম‍্যারাপ বাঁধার প্রস্তুতি। বড় বড় হরফে সেখানে ফলাও করে লেখা রাজনীতির যা কিছু অংশ,পরিবহণমন্ত্রীর উপস্থিত থাকবার যা কিছু খবর,এমনকি মঞ্চে ভাষণ দেওয়ার পর স্থানীয় যে নিম্নবিত্ত মানুষের বাড়িতে মধ‍্যাহ্নভোজনের ব‍্যবস্থা রাখা হয়েছে,সে সমস্ত খবরের বিশদ আলোচনা রয়েছে। কিন্তু পৃষ্ঠা এখন উল্টে ফেলেছেন অর্ধেন্দু। যে পাতায় ফিল্মিদুনিয়ার খবর থাকে,চায়ের সাথে মুখোরোচক চানাচুরের মতো লাস‍্যময়ী নায়িকাদের অর্ধনগ্ন শরীর থাকে,নাকের ডগায় চোখের চশমাটা ভাল করে সেঁটে ঘোরচোখে তিনি বলিউডের এক সুন্দরী নায়িকার উন্মুক্ত নাভির হীরককুচি গয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুধু নাভিটার গভীরতা দেখছিলেন।
          সেদিক থেকে চোখ না সরিয়েই অর্ধেন্দুভূষণ বললেন,"মন্ত্রী হয়েছেন,এত ভীতু কেন? নেতামন্ত্রীদের সাহসী হতে হয় বলরাম। নেতাগিরি মানেই দাদাগিরি। সবসময় মনে রাখবেন,মন্ত্রীদের মাথার উপর কেউ নেই। ইচ্ছেমতোন কথা বলুন। যা মনে হয়,তা-ই প্রতিশ্রুতি দিন। জনগণকে ভুলিয়ে রাখাই আমাদের কাজ। আমাদের কাছে জনগণ শিশু। শিশুদের যেভাবে গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়,নেতাদের সেই কৌশল অবলম্বণ করতে হবে। এসব তো আমি আগেও আপনাদের শিখিয়েছি। কথাগুলো কি বার বার বলতে হবে আমায়?"

🍂

"না দাদা,সে আপনি আমাদের আগেও বলেছেন এগুলো। আসলে পরিবহণমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দিতে গিয়ে আমি যদি রাজ‍্যের স্কুলগুলোতে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিই,সেটা কি ঠিক হবে? ভয়টা আমার ওখানটাতেই। জনগণ ক্ষেপে গিয়ে যদি......। শিক্ষামন্ত্রী তমালবাবুর যেটা কাজ......।"আমতা আমতা করে বললেন বলরাম।
"আরে ছাড়ুন তো ওসব! পৃথিবীটা কি আজ ওভাবে চলছে নাকি? ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে দারোয়ান ট্রিটমেন্ট করছে না? মোবাইল রিচার্জ করবার দোকানে আজকাল মেয়েদের অন্তর্বাস যেমন পাওয়া যায়,মাছের দোকানে গিয়ে দেখুন,খুচরো সমস‍্যা কাটাতে দু'টাকা পাঁচটাকার চকোলেট রাখছে। আসলে আপনি মশাই জগতের কোনও খোঁজই রাখেন না। ছাগলের মতো মুখ নাচিয়ে আর যা কিছুই করুন,পার্টি পলিটিকস্ করা যায় না বলরাম। আপনার মতোন লোককে মন্ত্রীসভায় রেখে আমার তো দেখছি সিঁদুরে মেঘের আশঙ্কা! মন্ত্রীত্ব পাওয়ার জন‍্য আপনি পঞ্চাশ লাখ দিলেন আর আমিও রাজি হয়ে গেলাম। রাজনীতিটা মন দিয়ে করুন। বাধ‍্য হতে শিখুন। আর তানাহলে ইস্তফা দিয়ে কেজি দরে ঢ‍্যাঁড়স বিক্রি করুন বাজারে। ভীতুর ডিম কোথাকার! তমালবাবু কোথায় গেছেন আপনি জানেন না? সব জেনেবুঝেও যে আপনি কেন এরকম বলেন.....! তমালবাবু দেশে আছে নাকি? মোনালিসা চক্রবর্তীর কাছ থেকে কুড়ি লাখ নিয়ে বিনা পরীক্ষাতে কলেজের অধ‍্যাপিকা করে দিল,টাকার সাথে ফাউ হিসেবে মেয়েটার তন্বী শরীরটা একটু ঘাঁটতে হবে না? তাই তো ও এখন আমেরিকার হোটেলে। মিডিয়া তো এসব জানে না। ওরা জানে,শিক্ষামন্ত্রী তমাল বিশ্বাস তাঁর হার্নিয়া অপারেশনের জন‍্য আমেরিকায় গেছেন। সে যাক,কথায় কথা বাড়বে। আগামিকাল আপনি পেটকুলচাঁদের ওই জনসভায় সরকারের প্রতিনিধি হয়ে পরিবহণমন্ত্রী হিসেবে যাচ্ছেন,মঞ্চে শাঁসালো বক্ত‍ব‍্য রাখছেন,রাজ‍্য সড়কের উন্নতির ওপর বেশ কিছু প্রকল্পের কথা তুলে ধরে মিথ‍্যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন শিক্ষক নিয়োগের আশ্বাস মিশেল দিয়ে আর ভাষণ সেরে ওখানকারই কোনও এক গরিবের বাড়িতে দুপুরে সংবাদমাধ‍্যমের সামনে খেতে বসে আন্তরিকতার খানিকটা অভিনয় করবেন,আমার শুধু এটুকুই বলার। আর মাত্র পনেরোদিন বাকী বিধানসভা। ভোট আদায়ের জন‍্য মন্ত্রীদের কত কী করতে হয়,আর এ তো সামান‍্য! মাথায় রাখুন,শুধু প্রতিশ্রুতি। প্রতিশ্রুতির বন‍্যা বইয়ে দিতে হবে। জনগণ ওই মন্ত্রেই জড়ভরত। বুঝেছেন?"



মুখ‍্যমন্ত্রী অর্ধেন্দুভূষণের ধমক আর শাসানিতে পরিবহণমন্ত্রী বলরাম সেদিন কী বুঝেছিলেন কে জানে,পরদিন বর্ধমানের পেটকুলচাঁদের বিধানসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে পরিবহণ,পূর্ত আর শিক্ষার খিচুড়ি ঘেঁটে সুদৃশ‍্য মঞ্চ আলো করে জনগণকে হাততালি দেওয়ার জন‍্য বসিয়ে রেখে ভাবলেন,কূটনীতিতে তিনি আস্তে আস্তে একেবারে তুখোড় হয়ে উঠেছেন। কিন্তু মঞ্চ থেকে নামার পর জনগণের চালাকির চক্রব‍্যূহে তাঁকে যে কী দুর্বিসহভাবে বন্দি হতে হবে,তা তিনি কোনওদিন কল্পনাও করেননি। 
          শোনা যায়,রাজ‍্যের পরিবহণমন্ত্রী বলরাম মান্না তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া সেই খারাপ দিনটা ভুলে থাকতে তারপর থেকে রোজ রাতে শোয়ার আগে ঘুমের ওষুধ খেতেন। আর রাজনীতি ছেড়ে বাকী জীবনটা কাটিয়েছিলেন কোনও বৌদ্ধ প‍্যাগোডায়।

Post a Comment

0 Comments