অফিস খোলার দিন। পর্ব ২
বাসুদেব গুপ্ত
ট্রেন শ্যাওড়াফুলিতে দাঁড়ায়। দশ মিনিট প্রায়। কি ক্রসিং আছে। একজন চাওলা জানলায় আসে। চাওলাদের এখন সম্ভ্রম করে লোকে। দেবোত্তমের ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে। রোজি আর ও ক্লাস পালিয়ে শিবপুর গার্ডেনে গিয়েছিল। ঝালমুড়ি আর চা। তখন তার কাছে স্যমন আর ক্যাভিয়ার কোথায় লাগে। সে অনেকদিন আগে। আগের সরকারের আমলে। রোজি অত উচ্চ বৃক্ষচূড়ে যায় নি।
-চা চলবে?
দেবোত্তম হঠাৎ বলে ওঠে।
না না স্যার আপনি খান।
কেন কুসুম বারণ করেছে রাস্তায় চা খেতে?
কি যে বলেন। দিন। দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে।
ভাঁড় নয়। কাগজের কাপে চা। আর শক্ত বিস্কুট। ওরিও ফ্যানটাসি এসব রোজি কেনে। কিন্তু এই চা ওলার বিস্কুট এনি ডে তাকে বিট মেরে দেবে। চায় ধীরে চুমুক দিয়ে খায় দুজনে। নৈলে চটপট শেষ হয়ে যাবে। তারপর কাপটা ছুঁড়তে যায় দেবোত্তম আর সজল হাঁ হাঁ করে ওঠে।
-আমায় দিন। আমি স্টেশন এলে ফেলে দেব। কার গায়ে লাগবে আবার।
অপ্রস্তুত হয়। একটু অভিমানেও লাগে দেবাত্তমের। আমাকে শেখাবে? গাঁয়ের মজুর তার আবার পরিয়াবরন নিয়ে চিন্তা! অবশ্য টেকনিকাল লোক। ওও টেকনিকাল আমিও টেকনিকাল। টেকনিকাল ভ্রাতৃত্ব বলে কিছু হয়? ইংরেজীতে fraternity. বাংলা বা হিন্দিতে বোধহয় অনুরূপ শব্দ নেই। অটো ইউনিয়ন কুরমি সম্প্রদায় ওবিসি মতুয়া এরকম হয়। বড় বড় রাজনৈতিক দল হয় তারা দেশ শাসন করে। কিন্তু একজন ফিটার বা ইলেকট্রিসিয়ান বা রাজমিস্ত্রী আর জাভা প্রোগ্রামার বা সিস এডমিন বা ডেটা সায়েন্টিস্ট, তাদের ভ্রাতৃত্ব! না ওরকম হয় না। আমার চোখে সজল একটি মজুর। রিক্সাওলা ঠিকে ঝি এইরকম।
চুপচাপ খানিকক্ষণ। ট্রেন আটকে আছে। কুর্মিদের আন্দোলন। হঠাৎ অবরোধ। ওদের নাকি তপশিলী উপজাতি ঘোষণা করতে হবে তাই। একে একে সবাই নীচে নামছে। প্লাটফর্মে গোল গোল মৌচাকের মত গুলতানির চাক তৈরী হয়েছে।
আজি শুভদিন পিতার ভবনে। হঠাৎ গান গেয়ে ওঠে সজল। মোটামুটি গলা। কিন্তু মসৃণ। দেবোত্তমের চোখ বড় হয়। রোজির পছন্দের গান আজকাল কোম্মা উয়ালা বা RRRএর গান। কি ভাষা কিচ্ছু বোঝে না কিন্তু মাঝে মাঝেই গেয়ে ওঠে। বাংলা গানটা গাইত বিধবা পিসীমা। কিন্তু পিতা সদয় হতে হতে বহু বছর লেগেছিল। এই গানটা সজল জানল কি করে? ও বরং কোমমা উয়ালা বা খেলবো হোলি রং দেব না এমনি গান গাইলে স্বাভাবিক লাগত।
কখন দেবোত্তমও গলা মিলিয়েছে গানে খেয়াল নেই। গানটা শেষ হলে দুজনেই চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে ।
আমার মা গাইত। কলকাতার মেয়ে। ছোটবেলায় গান শিখত। তারপর তো বাবার সংসারে খেটে খেটে সব গেছে। আপনি জানলেন কোথায়?
আমার পিসীমা। বিধবা আর প্যারালিসিস। সবসময় মরার কথা ভাবত।
-তা কেন হবে! আমার মা গাইতো যেদিন বাবা মাকে ট্রেনে করে বাপের বাড়ী নিয়ে যেত। শিবপুর বেতাইতলা। আসার সময় দুজনেই খুব রাগী মুখ করে ফিরত। আর শুরু হত ঝগড়া। যাঃ এসব কথা আপনাকে বলছি কেন। কিছু মনে নেবেন না স্যার।
-মজার কথা আমরা দুজনেরই আজ পিতার ভবনে যাত্রা। চাকরি যে দেয় সেওতো বাপ। তাই না?
-জানি না স্যার। আপনি বাঁচলে বাপের নাম।
আবার একসাথে দুজনে হেসে ওঠে। দেবোত্তমের আবার অস্বস্তি লাগে। যতই সহযাত্রী হোক ছোটলোক তো। কোন তুলনাই হয় না দুজনের সামাজিক গোত্রের। স্যার বলছে। ওর দিক থেকে ঠিকই আছে। স্যার বলতে বারণ করবো? নাঃ ঠিকই আছে। বেশি গায়ে পড়া ঠিক না। আর কে জানে যা বলছে সত্যি কিনা। এ ধরণের লোক ঠক জোচ্চোর হতেই পারে।
-আপনার বাড়ি কি স্যার পপার সিটিতে?
-আমার বাড়ি নয় শ্বশুরবাড়ী। আমার বাড়ি সাউথে, বাঙ্গালোরে। এখানে করোনার ঠিক আগে বেড়াতে এসে আটকে যাই। আমার শ্বশুরমশাই নাম করা লোক। ট্রাকের ব্যবসা। চাল এক্সপোরট।
-ওনার নাম কি মনতোষ যশ ?
একটু শকড হয় দেবোত্তম। ওর শ্বশুর যে এত বিখ্যাত তা তো জানা ছিল না।
-কি করে জানলেন?
-জানবো না? সবাই জানে। সিবিআইএর রেড হল প্রথম তো ওনার বাড়িতেই। তিন বছর হল। অবশ্য এরেস্ট হননি। ওনার দিল্লীর সংগে সাটঘাট ভালোই। ম্যানেজ করে নিয়েছেন। আপনি তো স্যার বড় ঘরের জামাই তাহলে।
দেবোত্তম ভীষণ বিব্রত বোধ করে। একবার মনে হয় বলি আপনার এত কথা বলার কি দরকার। কিন্তু অবাক হয়ে সে দেখে ডিফেন্সে খেলতে শুরু করেছে
-আমি তো এতসব জানি না। বাইরে থাকি। আটকে গেছি করোনার জন্য। আর বিত্তবান ব্যক্তিদের ওসব তদন্ত হয়েই থাকে। আমি কিন্তু ব্যবসাতে যুক্ত নই। কম্পিউটার কাজ করি। এমন কিছু নয়।
-সে তো নিশ্চয়ই। আপনাকে দেখে তো বেশ ভদ্র মানুষ বলেই মনে হয়। শিক্ষা দীক্ষা আছে। চুরি চামারি করে পয়সা করেন নি।
এই কথাটা তীব্র ভাবে লাগে। একটা জোরালো প্রতিবাদ করতেই হয়। কিন্তু সেইসময় একটা বিকট শব্দ হয় কামরার কাছেই। আর প্রচুর লোকের গলার আওয়াজ দৌড়ে দৌড়ে নিকটেই আসছে বলে মনে হয়।
-পেটো চার্জ করেছে এই আন্দোলনের কেউ। আরে আরে ঐ দেখুন পাশের প্লাটফরমের পুলিশ তাড়া করছে। লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। ওরা ঢিল ছুঁড়ছে। টিয়ার গ্যাস। টিয়ার গ্যাস। চলুন এদিক দিয়ে নেমে পালাই।
সজল উত্তেজিত হয়ে ধারাবিবরণী দিচ্ছিল। ওর হাত ধরে টান দেয়। বলে,
-চলুন। এই গাড়ীর ওপর হামলা হবে এর পরে। সামনেই ওভারব্রিজ। বেরিয়ে স্টেশন থেকে পালাই।
দেবোত্তম হতভম্ব হয়ে কিছুই বুঝতে পারে না। ল্যাপটপ শুদ্ধ বড় ব্যাগটা নিয়ে কোনমতে দৌড় দেয়।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখে একটা টোটো। ড্রাইভার আরাম করে বিড়ি খাচ্ছে আর ফোনে রীল দেখছে আর আপনমনেই ফিকফিক করে হাসছে। এত কান্ড হচ্ছে ভ্রূক্ষেপ আছে বলে মনে হলো না।
কোনমতে তাকে রাজি করিয়ে বালি অব্দি রফা হয়। লোকটা বুঝে গেছে কেস, ৫০০ টাকা চায়। সজল অসহায় হয়ে তাকাতে দেবোত্তম বলে কোন চিন্তা না করতে। ও দিয়ে দেবে পুরোটা।
🍂
বালি স্টেশনে চায়ের স্টলে বসে দুজনে চা খায়। বড় ভাঁড়ে চা। ততক্ষণ বিকেল। বেঙ্গালুরুর ট্রেন চলে গেছে। সজলের চাকরি জয়েনিং মাথায়। তখন হঠাৎ দুটো ফোন একসাথে বেজে ওঠে। দেবোত্তম অভ্যাস বসত ফোনটা নিয়ে দূরে গিয়ে কল রিসিভ করে।
-হাই ডিক। দেয়ার ইস নিউজ।
দেবোত্তম কুশারীকে এই নামেই ডাকে ম্যানেজার। পবন মেহতা। দেবোত্তমের কান খাড়া হয়ে যায়। আবার ফোন করার কি হলো।
-ইয়েস পবন। হাউ ইউ ডুইং? আমারও নিউজ আছে দেবার। আগে তুমি বলো।
-ইট উইল বি হার্ড এন্ড হার্শ। মেহতার এরকম phrase ব্যবহার করার অভ্যাস আছে। শক এন্ড অ। হায়ার এন্ডফায়ার। এফ এন্ড এফ। দেবোত্তম এতে অভ্যস্ত।
-ওকে ডিক আগে তুমি বল। কি নিউজ।
-আমার ট্রেন মিস হয়ে গেছে। রাস্তায় এজিটেশান চলছিল। নিশ্চয় নিউজে দেখেছ। ট্রাইবালরা আন্দোলন করছে। আমার ট্রেনের ওপর হামলা হাতে যাচ্ছিল। আমি পালিয়ে বেঁচেছি কোনমতে । বান্গালোরের ট্রেন মিস। আবার কবে রিজারভেশান পাবো জানি না। প্লেনের সব ফুল। পোস্ট করোনা রাশ।
এক নিঃশ্বাসে সবটা বলে থামে দেবোত্তম। সন্দেহ হয় পবন ঠিক বুঝলো কিনা। খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর পবনের একটা কাশির শব্দ হয়। পবন বলে,
-দ্যাট ইজ অলরাইট ডিক। তোমার না এলেও চলবে। তোমাকে কম্পানী ডিসমিস করেছে আজ থেকে।
-মানে? বুঝলাম না। আমি তো আসছিই তো জয়েন করতে। আর কদিন মাত্র দেরী।
তা নয়। তুমি বেআইনী ভাবে আর একটা চাকরী করছ, কম্পানীর কোড অফ কন্ডাক্ট সেটা এলাও করে না। তারপর তুমি কম্পানীর এলগরিদম অন্য কম্পানীকে দিয়েছ। এটা একেবারেই বেআইনী। কাজেই তোমার চাকরির আজকেই শেষ দিন। তুমি কোনরকম বেনিফিটও পাবে না। চিঠি পৌঁছে যাবে। গুড লাক। বাই।
ফোনটা কেটে যায়। কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে।
সজলের ফোনে স্বপনদার গলা। ইউনিয়নের মেম্বার।
-কি রে তুই জয়েন করলি না?
-ও দাদা কি বলবো, রাস্তায় বিরাট হুজ্জুতি। ট্রেনে পেটো চার্জ। কোনমতে পালিয়েছি। এই বালি পৌঁছেছি। আরও এক ঘন্টা তো লাগবে। ম্যানেজ করে দাও একটু।
সরি রে সজল। আমাদের ইউনিয়নের কোন মেম্বারকে ওরা নেবে না জানিয়ে দিয়েছে। বড় ইউনিয়ন দলবল নিয়েএসেছিল। আগে ওদের সবাইকে কাজ দিলে তবে অন্য কাউকে ওরা ঢোকাবে। গর্জন সিং এসে গুলিও চালিয়েছে। তবে আকাশে।
গর্জন সিং তো আমাদের দলে ছিল।
না। ও পার্টি পাল্টেছে। পুলিশ ওকেই প্রোটেকশন দিয়ে নিয়ে গেল। বাজোরিয়া সাহেব এসেছিলেন। কি সব মিটিং হল। বলেছে কাল কার্ড দেওয়া হবে। যারা পাবে তারা জয়েন করবে।
এটা কি হলো স্বপনদা। এখন আমি কোথায় যাবো। এবার তো ঝাঁপ দিতে হবে। বাড়ীতে মুখ দেখাবে কি করে?
এখন কি বলি বল। আমরা ভাবছি পার্টি পাল্টাবো। একটা মিটিং ডাকছি। তুই ও চলে আয়।
সে কি স্বপনদা। এক কথায় এতদিনের ইউনিয়ন পার্টি পাল্টাবো? কত লড়াই কত স্ট্রাইক মিছিল সব ভুলে যাবো। তা হয় না।
তবে মর।
ফোন কেটে যায়।
দেবোত্তম আর সজল আবার টুলে এসে বসে। হাতে আধ ঠান্ডা চা। দুটো ঝড়ে ডানা ভাঙা পাখি।
ডানা ভেঙে গেলে ঈগল আর চড়াই একই। ডানা ভাঙা পাখি।
অফিস খোলার দিন সন্ধে হয়ে আসে। দুজনের চোখের ওপর অস্তসূর্যের লাল আলো আস্তে আস্তে নিভে আসে। ওভারব্রিজ না প্লাটফর্ম। কোথা থেকে ঝাঁপ দেওয়া যায়? কালো আকাশটা বিশাল ডানা মেলে নীচে নামছে নামছে নামছে।
=শেষ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments