জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন/ পর্ব -২৭/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব -২৭
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া 

 || সে আমাকে গোধূলি চেনায়...|| 

     
তিন তিনটে প্রাইজ রাখবি কোথায় শুনি? পিঠে কিল খেয়ে পেছন ফিরে ঝিনি দেখল কাকলি হাসছে।তোর মাথায়। মুখভর্তি শাঁকালুর দোকান বন্ধ কর।দেখছিস না বস্তার মতো ব্যাগ এনেছি।আর তুইও তো সেকেন্ড হলি ডিবেটে।
      শোন না কলি, তোর দাদাটা না কেমন যেন ইয়ে।কে পুলুদা? না না ওই ধ্রুব।আরে পুলু ওর ডাকনাম।কেন রে?পুলুদা তো তোর খুবই প্রশংসা করে। বাজে বকিস না। আজই তো চিনল আমায়। না না পঁচিশে বৈশাখ পাঠাগারের ফাংশানে তুই ঝুলন বলছিলি না? পুলুদা বাড়ি গিয়ে বলল  স্রোতস্বিনীর খুব ইমপ্রেসিভ গলা আর কবিতাটা বোঝেও। আমি ভুলে গেলাম তোকে বলতে। অতবড় মানুষটাকে নাম ধরে ধ্রুব ধ্রুব কচ্ছিস যে?
     দাদা বলতে পাচ্ছিস নে?অরু মিতুদাদের চেয়েও কত বড় জানিস?ঘাড় বাঁকিয়ে কলি গলা চড়ায়।
      এঃ ! স্রোতস্বিনী! নাম যদি জানে আমার তাইলে আজ যে খালি খালি খুকি বলছিল? আবার ঢঙ করে বলছে খুকি তোমার নাম ঝিনি নাকি ঝিনুক কোন ধরণের ন্যাকামি এসব?ঝিনিও ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
        তাই বল! স্রোতস্বিনী দেবীকে খুকি বলায় চটিতং? খিকখিক হেসে কলি মাথা নাড়তে থাকে ঘাড়ে স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো।তা তোমায় কেউ বললে বললে তুমি কী করতে খুকি? ঝিনি মুখ ভেঙালো।ঝিনিইই কলিইই ফিরতে হবে দূরে তুষারদার হাঁক শুনে কথা মুলতুবি রেখে দলের দিকে দৌড় লাগায় দুজন।
         এই নে তোর জন্য পাঠালো।কিছুদিন পর টিফিন পিরিয়ডে ঝিনির কোলের ওপর কলি ঝপাং করে একটা পত্রিকা বার করে দিল।কে দিল?ন্যাকা।পুলুদা আবার কে? পত্রিকার নাম জানলা। অচেনা গোধূলি নামে পদ্য লিখেছে ধ্রুব রায়।ঝিনি পড়তে গিয়েই চমকাল। বাড়ির সামনে কৃষ্ণচূড়া /তার দুধারে গাছেদের নাম/নার্সারি থেকে আনার পথেই হারিয়ে গিয়েছে/ উড়ে আসে ধুলো ফুল/অবুঝ চোখের কিনারায়/দিনে দূরে ঠেলে কিশোরী আঙুল/দিনান্তে আমাকে গোধূলি চেনায়...
         শোন শোন কলি, প্রাথমিক উত্তেজনায় বেঞ্চি থেকে ঝিনি সটান উঠে দাঁড়ালো। হয়েছে টা কী?ওর'ম থে কাট কাট উঠে পড়লি যে?ভারী একখানা বোঝার মতো ধপ করে সে বসে পড়ে আবার। কলির মাথাটা বেড় দিয়ে নিজের মুখের কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বলে, কলি,এটা আমায় নিয়ে লেখা। তোকে নিয়ে লিখেছে মানে?তোর কি মাথা খারাপ? নাকি পুলুদা পাগল? হতে পারে সে তোর গলার প্রশংসা করে তাই বলে একেবারে পদ্য লিখে দেবে তোর জন্য?ভাবলি কী করে এটা? নিজের জেঠতুতো দাদাকে নিয়ে সে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
         ঝিনি খুব আস্তে বলল বিশ্বাস কর কলি,এই যে  বাড়ির সামনে গাছের নাম হারিয়ে যাওয়া,এই চোখে কুটো উড়ে পড়া সব সেদিন হয়েছিল।কলি এটা কি পাপ? ভড়কে যাওয়ার মতো হঠাৎই সে খামচে ধরে কলির হাত।
 কোনটা?ঝিনির হাতটা ছাড়াতে ছাড়াতে কিছু একটা ভাবছিল যেন কলি। এই যে আমার চোখ ছুঁয়েছিল,আমায় নিয়ে কবিতা লিখল?পাপ হয়ে গেল  না রে?
        কী জানি? এবার কলিও গম্ভীর। মাথা নেড়ে বলল,তুই কিন্তু পুলুদার সামনে আর যাবি নে খবরদার! তাইলে বলো সত্যিই পাপ হবে।পত্রিকাটা না হয়  তুই রেখেই দে।ঝিনি এত সন্তর্পনে ম্যাগাজিনটা হাতে নেয় যেন দারুণ নিষিদ্ধ কিছু সে বইয়ের ব্যাগে রাখছে।

🍂

          ফের ট্রান্সলেশনে ভুল। এসেটা তো শুরু করেছিলে ভালোই তোমার ইমাজিনেশান আছে কিন্তু মা জননী তুমি হলে বানানে দিগগজ! দিন তিনেক ধরে লিখেছো তো ওই দেড় পাতা খানেক এসে আর ছোট একখান লেটার তা দুটো মিলে গুণে দেকো  পাঁচ পাঁচটা বানান ভুল? নাম্বার তো ওখানেই কাটা যাবে।আর হাতের লেখার যে ছিরি।দশ বচ্ছর চাগরি না কল্লে  কেউ মাধ্যমিকের এগজামিনার হয় না।আর দশ বচ্ছর মাষ্টারি  ঘষটালে তার ধৈর্য্য এমন হয় যে পরীক্ষের খাতায় ভালো যতই নেকো এই র'ম জড়ানো মড়ানো নেকা দেকে তার ধর্যি থাকবে নাকো খুঁটিয়ে পড়ার! পরিস্কার করে ধরে ধরে লিখবে।
       চেষ্টা যতই করো এই অন্যমনস্কতা থেকে বেরুতে না পারলে কিস্যুই  হবে না তোমার।রাগমাগ করে খাতাবই ঠেলে সেদিনের মতো উঠে পড়লেন শিববাবু স্যার। স্যার যাওয়ার পরও সব হোম টাস্ক শেষ করে সে খেতে গেল। বিকেল থেকে কেন যে ভয় ভয় করছে।
        খাচ্ছিস না কেন?তখন থেকে ভাত নাড়ছিস।সন্ধেবেলাও খেলি না কিছু।জ্বর টর এলো নাকি?মা কপালে হাত দিতে এলেই ধুৎ! এমনি  ভাল লাগছে না বলে উঠে পড়ে।ঝিনিিইই ব্রাশ করার আগে দুধ খেয়ে যাও অন্তত।মা'র কথা কানে যায় না বারান্দার গ্রিল ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
         রাতে মা ঘুমোলে সে বালিশের তলা থেকে পত্রিকাটা বার করে বারবার পড়ে 'অচেনা গোধূলি।' 
      নিঃশ্বাসে মেধার গন্ধ/এলা রঙ সিন্ধু রূপসী সেই ত্বক... পড়ে তার দম আটকে আসে।নিজেই নিজের বুকের শব্দ শুনতে পায়। বারবার সে বলে পাপ নিও না সরস্বতী ঠাকুর।আমার মন ভাল করে দাও। তবু পড়ায় মন বসে না। ভাল করে খেতে পারে না। ঘুমের মধ্যেও ছটফট লাগে তার।
        আচ্ছা ব্রততীদি, ঘরবাড়ি ভাসায় বলে চীনের লোকেরা হোয়াংহোকে চীনের বিষাদ বলে  তাকেই আবার  স্বর্গের নদীও বলে। বলে তারাদের ছায়াপথ থেকে নাকি নেমে এসেছে সে! যে যেভাবে দ্যাখে, না দিদি? তানাবাতা আর চিনহুর গল্পটাও কী যে অদ্ভুত! আর সব দেশের রূপকথাতেই দেখি চাঁদ,তারাদের দেশে মেয়েরা কিছু বুনছে নয়তো সেলাই করছে কেন বলো দেখি?
         আবার আকাশ ঢুকল মাথায়?ব্রততীদি হাসল। কি জানিসতো, পুরনো কাল থেকে যখনই মানুষের খিদে মিটে গেছে অমনি সে  বাতাসের দোলাকে,নদীর ঢেউকে সুরে বাঁধতে গেছে,আঁকতে চেয়েছে পাথরে।  শিকার ঝলসে খাওয়ার পর হয়তো আগুন ঘিরে বসে থাকতে থাকতে কারো চোখ পড়লো তারাদের দিকে। ওরা দেখছে ওরা আমাদের দেখছে বলে উঠলো কেউ।ব্যাস! দূর আকাশের মিটমিটে তারাদের দেখে অচেনা সেই রহস্যর গা ছমছম সেতো অন্যদেরও জানাতে চাইবে তাই না? অন্যের ঘুম আর স্বপ্নে মানুষই তাই বুনে দিতে চেয়েছে সেইসব ছবি। 
      এখন চট করে খাতাটা খোল দিকি,নীলবিদ্রোহ নিয়ে লিখতে দিয়েছিলাম না?  নীলবানরে সোনার বাংলা করল এবার ছারখার/অসময়ে হরিশ মোল,লঙের হল কারাগার..এটা দিয়ে শুরু করলি না কেন?জানিস নিশ্চই এই লঙ হলেন জেমস লঙ।
        কলির দাদা খুব আসছে তাদের বাড়িতে।ছোড়দামনির সাথে জমেছে খুব। দৃষ্টি পত্রিকা নিয়ে ছোড়দাদের নানা পরামর্শ দিয়ে, দলের ছোটদের আবৃত্তি শিখিয়ে,স্টাডি সার্কেলে যোগ দিয়ে ধ্রুব রায় মুকুল সাংস্কৃতিক সংস্থায় কদিনেই জমিয়ে নিয়েছে। অথচ ধ্রুব রায় দাদাদের চাইতেও বেশ বড়।কলির চেতাবনি মনে করে ঝিনি অবশ্য দূর থেকেই সরে পড়ে।
        ইয়ার্কি হচ্ছে এটা? ঘরে ঢুকেই হাতের বইগুলো খাটের ওপর ফেলে হেঁকে উঠল ছোড়দামনি। খামোখা বাসভাড়া দুম করে বাড়িয়ে দিলেই হলো? ছড়িয়ে ফেলা বইক'খানা থেকে ইস্পাতটা উঠিয়ে ছোট পার্থদা  ভুরু কুঁচকে বলল কত?বসিরহাট থেকে তেঁতুলিয়ার ভাড়া ষাট থেকে এক লাফে আশি পয়সা।ছাত্রভাড়াও দশ পয়সা থেকে পঁচিশ হয়ে গেল। শুনেই ক্লাবের দাদারা খাড়া হয়ে বসল।দানি, ছোড়দা, সজলদা,ছোট পার্থদারা রাতারাতি একখানা ছাত্র ইউনিয়ন বানিয়ে আন্দোলনে নেমেও পড়ল। চোদ্দটা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ইস্কুল নিয়ে  স্বরূপনগর বসিরহাট স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বা 
এস বি এস এ তৈরি করে ফেললো ওরা।
        কলি,ঝিনি,বুলি,কণারা ইস্কুল কামাই করে বা টিফিনের পর পেট কামড়াচ্ছে এসব ডাঁহা সত্যি বলে বলে দাদাদের সঙ্গে হেঁটে সাইকেলে করে গিয়ে সেসব ইস্কুলের সামনে ভিড় জমাতেও থাকল। ভাড়া বাড়ার বিরুদ্ধে তাদের জমায়েতে খালি খালি দাদাদের  বক্তব্য শুনেই ছাড় নেই, যেসব ইস্কুলের ভেতরে ঢোকার পারমিশন পাওয়া যেত সেখানে  দলবল বেঁধে দাদারা দাঁড়াতো বাইরে আর  ছোড়দা,পার্থদা এরকম দুএকখানা চাঁই ঝিনি আর কণাকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকে বক্তব্য রাখতে বলত ঝিনিকেই। আগের রাতেই শিখিয়ে পড়িয়ে দিত ছোড়দা। একটু বড়সড় দেখানোর জন্য রোগা পটকা ঝিনিকে শাড়ি পরে যেতে বলতো দাদারা তাছাড়া অচেনা ইস্কুলে বড় দাদা দিদিদের সামনে ক্লাস লেকচারিংএ  ঠ্যার ঠ্যার করে ঠ্যাং কাঁপাটাও ঢেকে রাখে মায়ের শাড়ি।
       এসব হচ্ছেটা কী বড়দি?ঝিনি দেখি লেখাপড়া বাদ দিয়ে বয়েজ ইস্কুলের সামনে কৌটো বাজিয়ে ভিক্ষে করছে?মানে? শোবার ঘরের টেবিলে খাতাপত্রের পাহাড়ের ওপার থেকে ভারী ফ্রেমের চশমা দেওয়া মা'র চোখ গোল্লা হয়ে গেল বিস্ময়ে।    
       প্রণিধান করুন বড়দি, অংকের পরেশবাবু স্যার বোধহয় মা'র মাথা থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখে ভয় খেয়ে সাধু ভাষা ধরলেন।অর্থ হলো ইয়ে আর কী অষ্টম শ্রেণীতেই যদি রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে।কী হয়েছে পরেশবাবু?মাকেও এবার খানিকটে দিশেহারা লাগে।মানে ইয়ে হয়েছে,পরেশবাবু স্যার খানিক মরিয়া হয়েই বলে ফেললেন ইস্কুলের ছেলেপিলেরা সব বাসভাড়া বাড়ানোর জন্য যে আন্দোলন করছে ঝিনিকে প্রায়ই দেখছি তিদের সঙ্গে চেঁচাচ্ছে। সে ঠিক আছে থেমেও যাবে দু'চার দিনে ভেবে চুপ করেই ছিলাম কিদের ওদের আন্দোলনের মাইক ভাড়া, লিফলেট এইসবের জন্য কাল থেকে দেখি কৌটো বাজিয়ে পয়সা তুলছে ! বড়দুটোই মাথা খাচ্ছে বুঝতে পারছি। কিন্তু ওরা নয় মেডিকেলে ঢুকে গেছে কিন্তু এ যে কেলাস এইট!এখন থেকে রাশ না টানলে কী হবে এ মেয়ের? পর্দার আড়াল থেকে পষ্ট দেখল ঝিনি উত্তেজনায় পরেশবাবু স্যারের গোঁফ নড়ছে বলে সাতে পাঁচে না থাকা নিরীহ স্যারকে অবিকল হিংস্র একটা ট্যাঙ্ক পোকার মতো দেখাচ্ছে। 
    কাজেই স্যার পড়িয়ে যাওয়ার পর স্কেলে আর শানায়নি।পাখার বাট দিয়ে আচ্ছা মতো দিয়েছে মা।ঝিনি জানতই আজ পিঠে তার মুষ্টি যোগ অবধারিত। এ সপ্তায় তাদের বাবা আসতে পারেনি।দাদারাও সন্ধের ট্রেনে কলকাতার হস্টেলে ফিরে গেছে।থাকলেও অবিশ্যি বাঁচাতে পারত না  তাকে।ঝিনিইই খেতে আয়।মার খেয়েই পেট ভরে গেছে  বলে শুয়ে পড়ল সে আর অনেক রাতে সে জানলা নামের চটি একখানা পত্রিকা খুলে বসল।
          বহুবার পড়া পদ্যটায় হাত রেখে চোখ কড়কড় করে উঠল তার। নিজের চোখে ফুঁ দিচ্ছে যেন সে, রুমালে করে মুখের গরম ভাঁপ দিচ্ছে। কী এক আবছা জগত যেন খুলে ধরছে জানলা। সবকিছু বেড়ে যাচ্ছে।প্রসারিত হচ্ছে। নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে ভয় করছে তার। একটা জোনাকি ঢুকে এল ঘরে একটা।মশারির বাইরে এদিক সেদিক উড়তে লাগলো দেখে হালকা হয়ে এল তার বুক। টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে সবুজাভ অন্ধকারে  আঙুল বোলালো সেই লেখার ওপর যেন সেদিনের মতোই ... উড়ে এল ধুলো ফুল/অবুঝ চোখের কিনারায়/দিনে দূরে ঠেলে কিশোরী আঙুল/দিনান্তে আমাকে গোধূলি চেনায়...
        লেখার ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments