জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২১৫/জার্মাণি (ইউরোপ)গানের গুঁতোয় ভূতের ভয় /চিন্ময় দাশ

শিল্পী - অর্ণব মিত্র 

দূর দেশের লোকগল্প— ২১৫

জার্মাণি (ইউরোপ)

গানের গুঁতোয় ভূতের ভয়

চিন্ময় দাশ


এক ধোপার একটা গাধা ছিল। নদীতে কাপড় কাচতে নিয়ে যাওয়া। কাচা কাপড় গেরস্ত বাড়ির ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া। সবই করতে হোত গাধাকে। সারা জীবন হাসি মুখেই সব কাজ করেছে গাধা।

এখন বয়স হয়েছে। ঠিক মত আর পেরে ওঠেনা সব কাজ। মনিবও তাই তার উপর বিরক্ত। নিশ্চয় এবার তাড়িয়ে দেবে একদিন। গাধা বলে, একেবারেই কি বুদ্ধি নাই তার? গাধা ভাবল, তাড়িয়ে দেওয়ার আগে, নিজে থেকে চলে যাওয়াই ভালো।

কিন্তু চলে গেলেই তো আর সব মিটে গেল না। পেট চলবে কী করে। ক’দিন ভেবে, স্থির করল—ব্রেমেন শহরে চলে যাবে। গাইয়ে হিসাবে পেট চালাবে।

যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। তখন মাঝরাত। মালিক নাক ডাকিয়ে ঘুম দিচ্ছে। বাড়ি ছেড়ে, রাস্তায় নেমে পড়ল গাধা।

খানিক দূর গিয়েছে, এক কুকুরের সাথে দেখা। গাধা বলল—কী হয়েছে গো? মুখ ভার কেন এমন?

একজন দরদী পেয়ে, জল গড়াতে লাগল কুকুরের চোখ দিয়ে— আর বোল না, দাদা। সারাটা জীবন খেটে মরলাম মালিকের জন্য। এখন বুড়ো হয়েছি। আমাকে আর দরকার নাই তাদের। দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিল ঘর থেকে।

গাধা বলল—আর বোল না, ভাই। একই দুঃখে আমি আমিও দুঃখী। আমি নিজেই বেরিয়ে চলে এসেছি মালিকের ঘর ছেড়ে।

কুকুর বলল—বেরিয়ে তো এসেছ, দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু চললে কোথায়?

--পেটটা যে সাথেই আছে। ব্রেমেন শহরে যাচ্ছি। সেখানে নিশ্চয় অনেক সমঝদার লোকজন থাকবে। গান গেয়ে পেট চালাব। তা বলি কি, তোমারও তো ভারি গলার জোর। তুমিও যেতে পারো আমার সাথে। 

গলার জোরেই তো পেট চালাতে হয় কুকুরকে। এমন কথা শুনে সে ভারি খুশি। সে রাজি হয়ে গেল।

কিছু দূর গিয়েছে, এক বিড়ালের সাথে দেখা। একটা গাছের তলায় একলাটি বসে আছে মনমরা হয়ে। দুজনে গিয়ে বলল—কী হোল, বেড়াল মাসি? অমন মন মরা কেন গো?

বিড়াল বলল—আর বলো কেন? ভারি অগোছালো মানুষ আমার মালকিন। সারা ঘরময় জিনিষপত্র ছড়ানো। একটা কিছু যদি গুছিয়ে রাখতে জানে। ইঁদুরদের তাতে তো পোয়াবারো। বাড়িটা যেন ইঁদুরদের রাজ্য! 

কুকুর বলে ফেলল—তাতে তোমারি তো লাভ, মাসী। বার পোয়ার অপর চোদ্দপোয়া। মন খারাপ হোল কেন?

এক পাল ইঁদুরকে সামলানো চাট্টি কথা না কি? যত দিন বয়স ছিল, করেছিও। এখন বয়স হয়েছে। সারা দিন আর দৌড়ঝাঁপ করে উঠতে পারি না। তাতেই মহারানির মাথা গরম। তাড়িয়েই দিয়েছে ঘর থেকে।

অনেক কথা বলে, একটু দম নিল বেড়াল। তার পর বলল—তা বোনপোয়েরা, তোমরা দুজনে কোথায় চলেছ দল বেঁধে? 

কুকুর আর গাধা সব কথা খুলে বলল বেড়ালকে। একই অবস্থা তিনজনেরই। বেড়ালও তাদের সাথে চলল গাইয়ে হবে বলে। 


🍂

কিছু দূর গিয়েছে, এবার এক মোরগের সাথে দেখা হোল। বেশ তাগড়াই চেহারা। গায়ের রঙে ঝিলিক দিচ্ছে। মাথার ঝুঁটিখানা যেন রাজার মুকুট। টকটকে লাল কানের লতি দুটো গলা পর্যন্ত নেমে এসেছে যেন। আর, লেজ তো নয়, যেন উঁচানো চামর একটা।

কিন্তু এমন তাগড়াই চেহারার একটা জীব, সে কেন  একটা গাছের ডালে বসে আছে চুপটি করে? বেশ বোঝা যাচ্ছে, কিছু একটা সমস্যায় পড়েছে বেচারা। গাধা বলল—কী হয়েছে গো? কোন সমস্যায় পড়েছ, মনে হচ্ছে।

মোরগ তার বিপদের কথা খুলে বলল। একেবারে ছোট্টটি থেকে এক চাষির বাড়িতে আছে সে। ভারি আদর-যত্ন। খাওয়া-দাওয়া বেশ ভালোই। আদর করে গায়ে মাথায় হাতও বুলিয়ে দেয় ছেলেপুলেরা। চাষি আর তার বউ নিজের ছেলেপুলেদের মত ভালওবাসে তাকে। কিন্তু এখন তার জীবন মরণের সমস্যা। 

--কেন গো? সমস্যা হোল আবার কীসের?

মোরগ বলল-- আজ মালিকের জামাই আসবে বাড়িতে। সবাই বলাবলি করছিল, জামাইছেলে না কি আবদার করে বলেছে, ষাঁড়া মোরগটার ঝোল খাওয়ালে, তবেই সে আসবে। না হলে ফক্কা।

একটু ভয়ের গলাতেই আবার বলল—বুঝতেই পারছ, আমার কী বিপদ। ও বাড়িতে থাকলেই, জবাই করা হবে আমাকে। ডাকাডাকি করে সবার ঘুম ভাঙাই রোজ। আজ ভোর হওয়ার আগেই সরে পড়েছি।

সব কথায় নাক গলানো কুকুরের অয়াস। সে বলে উঠল—সরে পড়লেই কি আর বাঁচা যায় গো? শুধু কি মানুষ? শেয়াল কুকুররাও ওঁত পেতে বসে আছে তোমার জন্য। বাঁআর কোন উপায় নাই। 

মোরগ বলল—জানি গো, জানি। তাই তো গাছের ডালে উঠে বসে আছি। 

গাধা নিজেদের কথা সব শুনিয়ে মোরগকে বলল— আপত্তি না থাকলে, আমাদের সাথে আসতে পারো। এক সাথে থাকব চারজনে।

মোরগও ভিড়ে গেল তাদের সাথে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারজনে ঠিক করল, আজ আর শহরে পৌঁছানো যাবে না। বনের মধ্যে ঢুকে পড়ে রাতটা কাটিয়ে দেবে চার জনে।

বনের রাস্তায় যেতে যেতে দূরে একটা আলো দেখা গেল। বনের ভিতর আলো এলো কোথা থেকে? সেদিকেই চলল চারজন। অনেক দিনের একটা পোড়ো বাড়ি। চারজন লোক বসে আছে তার ভিতরে। সামনে খাবার দাবার সাজানো। কুকুরের তো জল ঝরতে শুরু করেছে জিভ দিয়ে।

একটা বুদ্ধি এসে গেল তার মাথায়। সদর দরজায় হবে না। পিছনের দিকে ঝোপঝাড়। সেখানে একটু উঁচুতে একটা জানালা পাওয়া গেল। নিজের ফন্দী সবাইকে বুঝিয়ে, গাধাকে বলল—জানালাটার গা ঘেঁষে দাঁড়াও তুমি। 

গাধার স্বভাব হুকুম তামিল করা। সে চুপচপ গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কুকুর গাধার পিঠে উঠে পড়ল। বেড়াল উঠল কুকুরের পিঠে। বেড়ালের পিঠে চড়ে, জানালার মুখে পৌঁছে গেছে মোরগ। ভেতরের লোকগুলো সাড়াশব্দটিও পায়নি। হঠাতই তীব্র স্বরে মোরগের ডাক। লোকগুলোর একেবারে কানের গোড়ায় যেন। 

ভয়াণক চলমে গেছে লোকগুলো। এত রাতে মোরগ? তাও আবার এই বনের ভিতর? কিছ্য বুঝে উঠবার আগেই, বিড়ালের মিউ-মিউ ডাক। ঘাবড়ে গেছে মানুষগুলো। 

রাত এখন। বনের ভিতর চারদিক নিঃশব্দ। এই শব্দ এলো কোথা থেকে? এমনটা তো কোন দিন হয় না। ঠিক তখনই একটা বিকট শব্দ—ঘেউ-ঘেউ, ঘেউ-ঘেউ। নিঝুম রাতের নীরবতা ভেঙে খান-খান। ঘরটা কেঁপে কেঁপে উঠল সেই গর্জনে। 

আর যায় কোথায়। ভাবনা চিন্তার সময় নাই। খাবার দাবার ফেলে, দে দৌড় লোকগুলো। কে যে তারা কোন দিকে দৌড়ল, তারও নাই ঠিক। লোকগুলোকে পালাতে দেখে, মহা আনন্দ এক্চার জনের। ঝুপ ঝুপ করে নেমে, ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল তারা। খাবারের স্তুপ চোখের সামনে। দেরি না করে মহাভোজে বসে পড়ল চারজন। খাওয়া দাওয়া সেরে, যে যেখানে পারল, বিশ্রাম নিতে চলে গেল। 

হয়েছে কী, লোকগুলো আসলে চারজন চোর। বনের আড়ালে এই বাড়িতে তাদের ডেরা। রাত নামলে, খাওয়া-দাওয়া সেরে, চুরি করতে বেরোয় তারা। সেদিনও খেতে বসেছে সবে। তখনই এই এই কাণ্ড। 

নিজস্ব নানা রকম ইংগিত আছে চোরেদের। কত রকমের রাতচরা পাখি থাকে বনে-বাদাড়ে। কত রকমের ডাক তাদের গলায়। এক এক পাখির ডাক ডেকে, এক এক রকমের ইশারা পাঠায় চোরেরা। সেদিনও তাই করল তারা। 

যে যেদিকে পারে, দৌড়ে পালিয়ে বেঁচেছিল। অনেক রাত হলে, আবারপাখি ডা ডেকে, এক জাগায় মিলিত হয়েছি চার জনে। একজন বলল—এমন বোকা কেন আমরা? কুকুরের ডাক শুনে দৌড় লাগালাম? 

একজন বলল—কেন, তার আগে যে মোরগ আর বেড়াল ডাকল। সেটা কী?।

তৃতীয় জন বলল— আচ্ছা, কুকুর আর বেড়ালের সাথে, মোরগ থাকতে পারে কখনও? 

দলের সর্দার বলল—সেটাই তো আসল ব্যাপার। নিশ্চয় এটা ভূতেদের কাণ্ড, বুঝলে। নানা রকম গলা করে, ভয় দেকালো আমাদের।

আলোচনার শেষে ঠিক হোল, অনুমানের উপর নির্ভর করে ফয়সালা করা বিবেচনার কাজ নয়। আর একবার পরখ করে দেখা দরকার। নিজেদের ডেরায় ফিরে চলল চারজনে। কাছাকাছি এসে গিয়েছে। সর্দার বলল—সবাই একসাথে ঢুকে কাজ নাই। একজন ঢোকাই ভালো।

সর্দার নিজে একেবারে ভীতুর ডিম। সে চালাকি করে একজনকে হুকুম করে বলল—ভিতরে গিয়ে দেখে আয়, অবস্থা কেমন।

সর্দারের হুকুম, কী আর করা যায়? এদিকে সর্দার নিজেই ভূতের কথা বলেছিল একটু আগে। বুক ঢিপ-ঢিপ করছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু করবার কিছু নাই। গুটুগুটি পায়ে ঘরে গিয়ে ঢুকল সে। কিন্তু ঘটঘুট্টি অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না চোখে। লোকটা ভাবল, রান্নাঘরে যাই, দেশলাইটা নিয়ে আসি।

খাওয়ার পর বিশ্রামের জন্য বেড়াল ঢুকেছিল রান্নাঘরে। বেশ আয়েশ করেই ঘুম লাগিয়েছিল। আচমকা কাএ যেন পায়ের শব্দ। ঘুম চটকে যেতে মেজাজ বিগড়ে গেছে বেড়ালের। দিয়েছে লোকটার পায়ে এক কামড়। আর যায় কোথায়? বাবাগো মাগো, মরে গেলাম গো—বলেই দৌড়ে পালাতে গেল বাড়ি ছেড়ে। 

গাধা শুয়ে ছিল উঠোনে, ধুপধাপ সব্দে তারও ঘুম গেছে ভেঙে। মেজাজ বিগড়ে গেছে তারও। লোকটা তার পাশ দিয়েই দৌড়ে পালাচ্ছিল। কষে এক লাথি লাগিয়েছে পেছনের পা দিয়ে। অমনি দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়েছে বেচারা চোরটা। 

তার পর? তার পর আর কী? চার চোরে বসে ফয়সালা করেছে, ঐ বারিতে আর নয়। এমনকি, ওই বনেরও ধার মাড়াবে না তারা এ জীবনে। ভূতের লাথি খাওয়া ভারি বেইজ্জতের ব্যাপার।

চারজন গাইয়ে মিলে মহানন্দে থাকে বাড়িটাতে। নিজেদের মধ্যে ভারি মিলমিশ চারজনের। 

 বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments