আটচল্লিশতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
সেদিন আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা। বিয়ের প্রায় তিন বছর পেরিয়ে অহনা এখন মোটামুটি সংসারী। একটি ছটপটে দুষ্টু ছেলে,তিনজন বৃদ্ধা শাশুড়ি সহ বিশাল একান্নবর্তী পরিবার নিয়ে সদাব্যস্ত বড়ো জায়ের কাজেকর্মে সামান্য হলেও সঙ্গত করার যোগ্যতা তার এখন হয়েছে। শহরের উচ্ছল ব্যস্ত জীবন থেকে বহুদূরের শান্ত নিস্তরঙ্গ গ্রামজীবনে সে এখন খানিকটা হলেও জীবনানন্দ খুঁজে পেয়েছে। আশৈশব পরিচিত যাপনের বাইরে হলেও এখানে কি সুন্দর সূর্য ওঠে,পুকুর জলে পানকৌড়ির ডুব…বর্ষা শেষে ধানজমির ধারে ধ্যানমগ্ন বক।এসব তাকে মুগ্ধ করে।
বাড়ির গরুগুলির জাবনা তৈরীর কৌশল শিখতে শিখতেই ইদানিং সে শিখে ফেলেছে চালতা কাটার ধরন,আম-কাসুন্দির স্বাদ এখন তার হাতেও খেলে ভালো। বাৎসরিক সুপুরী-নারকেল গাছের পরিচর্যা,ফলগুলি ছাদে শুকিয়ে সংরক্ষণ,প্রয়োজনে বিক্রয়ের বিলি ব্যবস্থা,শীতের দিনে নতুন বিউলীর ডাল বেটে বড়ি দেওয়া…আস্তে আস্তে নিজের অগোচরেই সে পিসি শাশুড়ির অনুগামিনী হয়ে উঠছে।তারই মধ্যে দেশ এগিয়ে চলছে সময়ের হাত ধরে,রাজ্যে সরকারের পরিবর্তন না হলেও কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। নতুন নতুন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ঢেউ লেগে রাস্তা ঘাট উন্নয়নে জোয়ার; শোনা যাচ্ছে, বাড়ির সামনের তেমোহানী বাঁকে নদীর ওপরে কঙ্ক্রীট সেতুর ব্যবস্থা হয়েছে জেলা পরিষদের প্রস্তাবে। যদি হয়,তাহলে নিশ্চয়ই যোগাযোগে অনেক উন্নতি হবে। নিজের বাবার বাড়ি যাওয়া, এই এলাকার মানুষ জনেরও যাতায়াত সহজ হবে,বাবুর বাবাও আরও ঘনঘন বাড়ি আসতে পারবে।
অলস মেঘমেদুর দুপুরে ছেলেকে ঘুম পাড়াতে বসে এসব কথা ভাবতে ভাবতেই গালে টোল পড়লো প্রোষিতভর্তিকা অহনার, এবাড়ির রীতি অনুযায়ী বরের সঙ্গে একান্ত সংসার তার তখনও করা হয়ে ওঠেনি।
হঠাৎ নীচে কলরব,কি হলো তা দেখার আগ্রহে নীচে নেমে দেখে, একটু দূরের পুকুরপাড়ে অনেক মানুষের জটলা, ছোটাছুটি, তারমধ্যে তাদের পাড়ার মানুষই বেশি।
তখন দুপুরবেলা, কাজকর্ম সেরে সবাই ঘুমোচ্ছে।কাউকে কিচ্ছুটি না বলে পা টিপে টিপে ঘটনাস্থলে গিয়ে যা শুনলো অহনা,ভয়ে তার মুখচোখ শুকিয়ে গেল,পা টলোমলো,চোখে অন্ধকার।তার ঘরেও তো…
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ি ফিরে সোজা দোতলায়…নাঃ!ঐ তো ঘুমোচ্ছে,তার বাবুর তো অন্তত কোন ক্ষতি হয়নি; ঘুমন্ত সন্তানটিকে বুকে তুলে অঝোর ধারায় চোখে অশ্রুর প্লাবন।
সেই প্রথমবার অহনা বুঝেছিল,নারীজীবনের অসহায়তা এবং তার সারাৎসার সন্তানের ঐকান্তিক মঙ্গল কামনাতেই নিহিত,তাকে ঘিরেই তার জগৎ;তা সে মা শিক্ষিত-অশিক্ষিত,ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ,যাই হোক না কেন!
🍂
ফিরে দেখলে সেদিনকার ঘটনায়, পূর্ব মেদিনীপুরের অধিকাংশ গ্রামেই তো পায়ে পায়ে পুকুর; পথের ধারে, বাড়ির ধারে। গাঁয়ের একপাশে বুড়ি মায়ের থানের পাশেই তাদের যে পড়শীর বাড়ি, তাদেরও ছিল তেমনই এক পুকুর। দুপুরবেলা সব কাজ সেরে বাড়ির বৌটি খেতে বসেছিল, বাকিরা হয়তো ছিল বিশ্রামে। সবার চোখ এড়িয়ে ছোট্ট বাচ্চাটি কখন যে একা একাই বেরিয়ে পড়ে বাইরে,কেউ খেয়াল করেনি। খানিক পরে, তার মা তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে দিশাহারা,পুকুরে জাল ফেলার ব্যবস্থা হচ্ছে…যদি;
এ পর্যন্ত শুনেই অহনা দৌড়ে বাড়ি চলে এসেছিল দারুন ভয়ে।
ঐ যে পিসিমা বলেন না, ‘মায়ের মন সবসময়েই সন্তানের অনিষ্ট আশঙ্কা করে’!
অবশ্য তার খানিক পরেই এলোমেলো চিন্তার ধ্যান ভাঙলো দিদিভাইয়ের ডাকে,
-’মেজ,মেজ! তুমি কি ঘরে!
ভয়ে গলা দিয়ে স্বর চড়েনি।একে তো ওদের বলাও যাবেনা, সবাইকে লুকিয়ে সে একা গিয়েছিল বাড়ির বাইরে ছেলেকে ফেলে, তখনও বাড়ির নতুন বৌদের একা পাড়ায় বেরোনো নিষিদ্ধ ছিল।তায় আবার এমন অঘটনের সময়ে!
যদিও দিদিভাই কিছু বুঝতে পারেনি।ভেবেছিল,ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে গেছে গলার স্বর,তাই ঘরে ঢুকে অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে লাগলো,একটু আগেই ওর নিজের চোখে দেখা ঘটনাটির।
সে নিজে তখনও দেখেনি,শুনেছে। এবার দেখতে যাচ্ছে,জানতে এসেছে অহনাও সঙ্গে যাবে কিনা!
ততক্ষণে হৈচৈ ছাপিয়ে কানে আসছে কান্নার রোল।যাবে কি যাবেনা ভেবেও দ্বিধান্বিত দুই বধূ শেষপর্যন্ত গিয়েছিল; এবং সারাজীবন ধরে মনে হয়,ভাগ্যিস গিয়েছিল।
তো গিয়ে দেখে,বাবুর বয়সীই একটি বাচ্চা,জালে জড়িয়ে তোলা হয়েছে সবে,শরীর ফুলে ঢোল। সবাই ভীড় করে দেখছে, আছড়ে পড়ে কাঁদছে তার মা…ঐ
মুহুর্তে কী যে মনে হলো,স্কুলবেলায় শেখানো চীম্ময়ীদির ট্রিকস;বাবুকে দিদিভাইয়ের কোলে দিয়ে,আঁচল কোমরে জড়িয়ে সবাইকে সরিয়ে অহনা দ্রুত পৌঁছে গেল বাচ্চাটির কাছে,ওকে চিৎ করে শুইয়ে পেটের ওপরে হাল্কা করে বসে বিশেষ কৌশলে দুই আঙুলে বুকে ও পেটের মাঝে চাপ দিতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো কাদাজল,দমকে দমকে। এভাবে এপাশ-ওপাশ…বেশ খানিকক্ষণ পরে ঘড়ঘড়…ঘড়ঘড়! ঠোঁটের নড়াচড়া।প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে!
অতঃপর পাড়াশুদ্ধ মানুষের উল্লাস,তাকে মুহুর্মুহু আশীর্বাদ,ছেলে কোলে নিয়ে তার মায়ের সটান অহনার পায়ে পড়ে যাওয়া…।
এটা যে সময়ের কথা, তখনও মানুষ, বিশেষত গ্রামের মানুষ যূথবদ্ধ ভাবেই বাঁচতে জানতো,একে-অন্যের আনন্দ-খুশী-দুঃখ-বেদনার শরিক হয়েই।হয়তো অভাব ছিল।অশিক্ষা, কুসংস্কারও…তবু সারাজীবন মনে থাকবে, সেই সব গ্রামজীবনের অসহায়তা ছাপিয়েও নিমগ্ন সমানুভব!
ভাগ্যিস সেদিন অহনা ছিল, শহরের স্কুলে শেখা প্রাথমিক প্রতিবিধানের পাঠ ছিল,তা নাহলে যে কি সর্বনাশ হয়ে যেত!মায়ের কোলের সম্পদ,নিজে মা হয়ে বোঝে তো!
পরে পরে আরও দিন গড়িয়েছে, নিজের ছেলের সঙ্গে সঙ্গে তার পড়সী ছেলেপুলেরাও সব বড়ো হয়েছে, বড়ো হয়েছে সেই বাচ্চাটিও।তবু যখনই ঐ পুকুরপাড় দিয়ে যাতায়াত চলে,মনে পড়ে যায় সেদিনের সেই ঘটনা, কেঁপে ওঠে মন, সতর্কতায়, জীবনের প্রতি কল্যাণ আকাঙ্ক্ষায়।
0 Comments