কৃষ্ণচূড়া
ভাস্করব্রত পতি
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের তীব্র গরমে যখন সব ফুল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, তখন কৃষ্ণচূড়া তার লাল অবয়ব নিয়ে প্রেমলীলায় ব্যস্ত রাধাচূড়ার সাথে। রৌদ্রের তীব্রতর দাবদাহ উপেক্ষা করেই কৃষ্ণচূড়া তার সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে হাজির। প্রকৃতি যেন বলছে 'এতদিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে'।
সেই বসে থাকার সার্বিক সার্থকতায় লাল আবীর মাখা প্রেমের চিরন্তন আবেশ নিয়ে হাজির কৃষ্ণচূড়া। আমাদের বিশ্বকবির কন্ঠে তাই উচ্ছ্বাস-
'গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার উত্তরী
কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী।
তরুণ হাসির আড়ালে কোন আগুন ঢাকা রয়
এ কী গো বিস্ময়!
অস্ত্র তোমার গোপন রাখ কোন তূণে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে!
এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে
পথের পাশে কৃষ্ণচূড়া
ধুলোবালি, দূষণ, চিৎকারে ভরা জনএলাকা ছাড়িয়ে কৃষ্ণচূড়ার তলায় এলে, মেলেনা রুক্ষতা। মেলেনা হিংসা। মেলেনা অবিশ্বাস। এখানে এলে হয় মনের পরিস্ফুটন। স্মৃতিমেদুর হয় প্রাণ। বিগলিত হয় অন্তরাত্মা। উদ্বেলিত হয় হৃদয়ের বাষ্পচাপ। কথামুখে সঞ্চারিত হয় মুখরতা। আরও কাছে টানতে ইচ্ছে করে মনের মানুষকে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা সেই প্রেয়সীকে।
পিয়াসী হিয়ায় নিষ্কাম প্রেম ধীরে ধীরে ঢলে পড়তে চায় 'হংসমিথুন'এ। আর হাতে হাত রেখে বসে থাকতে থাকতে অনুভূত হয় হেমন্ত সন্ধ্যার যুগলবন্দীতে গাওয়া এক চিরন্তন গান --
'আজ, কৃষ্ণচূড়ার আবীর নিয়ে আকাশ খেলে হোলি
কেউ জানে না সে কোন কথা
মন কে আমি বলি।
মনের কথা মন যদি কয় মনে মনে
সেই, কথার মায়া জড়ায় কেন নয়ন কোণে
আহা, কিছু শুনি কিছু ভাবি নতুন পথে চলি।
এই সুর বলাকা মেলে পাখা আপন অনুরাগে
কেন সে মানেনা সুদূর তাকে ডাক দিয়েছে আগে
কত যে ডাক ডেকেই চলে পায়না সাড়া
দেখা পেয়েও কত দেখা দিশাহারা
তবু নদীর চোখে সাগর আঁকে
কৃষ্ণচূড়া ফুলের বাহারী রূপ
সত্যিই কেউ জানেনা যে, পরিবর্তন ঘটেছে প্রকৃতির অন্তরেও। পুরানো আবিলতা হঠিয়ে প্রকৃতি সেজেছে সবুজের চাদরে। পাতা ঝরার আর্তনাদ ভুলে এখন কচি পাতার দুলুনি দেহপট জুড়ে। তারই মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণচূড়ার রূপমাধুর্য। অনবদ্য সেই রূপ। যা দেখে প্রেমিক প্রেমিকার মনের কলকাকলি জাগরিত হতে সময় নেয়না। সত্যিই এটা যেন প্রেমের অঙ্কুরোদগমের অন্যতম দ্যোতক। এ সময় কৃষ্ণচূড়া যেন হয়ে উঠেছে প্রেমের পরিপূর্ণতার একমাত্র সাক্ষী। তাইতো আবদুল্লা আল সবুজের গলায় সেই না পাওয়ার সুর - 'কৃষ্ণচূড়া গাছে আজও লিখা আছে, আমার নামের পাশে নামটি তোমার / কৃষ্ণচূড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে, তুমি শুধু নেই আমার'। মনের চরম বেদনার আশ্রয় যেন এই কৃষ্ণচূড়া!
কৃষ্ণচূড়া মনে করিয়ে দেয় অসংখ্য স্মৃতি। হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট, আর মনে মন। এগুলো কি ভোলা যায়? এই লক ডাউনের চরম দুর্দিনে তীব্র দাবদাহ উপেক্ষা করেও থেমে নেই কৃষ্ণচূড়া। প্রান্তিক রেলস্টেশন হোক বা কোনো পার্ক। কিংবা নদীর কূলে কোনো নির্জন নয়নজুলির পাড়। রূপের পশরা সাজিয়ে ঠিক হাজির সর্বত্র। প্রেমিক কবির কবিতায় তাই ছলকে ওঠে - 'এই শহরের রাজপথগুলো যেন মরুভূমি / পিতলের থালার উপর দাঁড়িয়ে দেখি চকচকে আলো.. / রেসের ঘোড়ার মতো ছুটে চলে কোমল মরীচিকা.. / কাজলমাখা চোখগুলো ঘামে জুবুথুবু / একুয়ারিয়ামের পাশে রাখা ফুলদানির নেতিয়ে পড়া গোলাপ / এই শহরে কৃষ্ণচূড়া মাত্রই প্রেমের অসুখ'!
প্রেমের আগুনে জ্বলতে থাকা ফুলগুলো দেখে কবির কলমে তাই উঠে এসেছে সেই ভাবনা - 'কৃষ্ণচূড়ার রঙ লেগেছে / মনের গভীর কোনে / তাইতো ভাবি তোমায় এত / পড়ছে কেন মনে?' (সৌম্যকান্তি চক্রবর্তী )। কৃষ্ণচূড়া মানেই তাই মনের কথা ফিসফিসিয়ে বলা। কৃষ্ণচূড়া মানেই তাই প্রাণের ব্যাথা তিরতিরিয়ে ভোলা। মনের গভীরে আজও তো সুর তোলে 'আনন্দআশ্রম' ছবিতে উত্তমকুমারের লিপে কিশোর কুমারের গাওয়া সেই অমলিন তথা চিরসবুজ গান - 'এই সেই কৃষ্ণচূড়া, যার তলে দাঁড়িয়ে, হাতে হাত, চোখে চোখ, কথা যেতো হারিয়ে।'
একসময় এই কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী নিয়ে কত প্রেম উদ্ভাসিত হোতো অনাবিল নির্জনতায়। কোকিল, মৌটুসী ডাকা দুপুরে এই গাছের তলায় সাক্ষী থাকতো প্রেম। আজ নির্লিপ্ত পার্ক, নদীর পাড় থেকে স্টেশন চত্বর। খাঁ খাঁ। শুধু মাঝে মাঝে মালগাড়ির তীব্র ছুটে চলা। আর ডাহুক ডাকা দুপুরের নিস্তেজ অবসর যাপন। কেবল একা একা দাঁড়িয়ে বিরহ যন্ত্রনায় ছটপট করতে থাকা কৃষ্ণচূড়ার জীবন যৌবনের কালাতিপাত।
'সবাই যখন ঝরে গেছে, ঝরে যাচ্ছে / তখন তোমার ফোটার সময় হলো? / কৃষ্ণচূড়া, -- হে কৃষ্ণের প্রিয় লাল ফুল / শ্রীরাধার কাছে কী চাও তুমি বলো। / হঠাৎ ফুটেছো তুমি আমার বাগানে / আমি তোমার প্রেমের খেলায় / পুড়তে রাজী দহনবেলায় / আমাদের প্রেম কবে শেষ হবে বলো? / পতিদাহ, শাস্ত্রসম্মত নহে জানি, /আমারই না হয় সতীদাহ হলো' -- এভাবেই কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর কবিতায় (কৃষ্ণচূড়ার প্রতি রাধার উক্তি) প্রেমের নির্যাসটুকুর রসাস্বাদন করিয়েছেন আমাদের। কৃষ্ণচূড়ার দুয়ারে এলে হিল্লোল ওঠে প্রাণে। গোপন অভিসার ছলকে ছলকে ওঠে আত্মার অন্তরে। প্রেম ও কামের চূড়ান্ত মিশেল মিশে যায় কৃষ্ণচূড়ার রঙে। হারিয়ে যেতে সময় নেয়না একটুও। সুর ওঠে মিলনের।
একই সুর তুলেছেন কবি নীল। তাঁর লেখনীতে ধরা পড়েছে একটা গভীর আকুতি - 'কৃষ্ণচূড়া, বহুযুগ ধরে হয়তো তোমার অস্তিত্ব / সজীবতার আলাপনে / রূপ ছিল অটুট ...... / তুমি সেই কৃষ্ণচূড়া / যার আলাপন প্রকৃতির প্রতিটি / সূক্ষ্ম সরণির সাথে বহুযুগ ধরে'।
একজন পুরুষের কাছে কৃষ্ণচূড়া ধরা দেয় রূপবতী নারীর তোলা হিন্দোল রূপে। আর একজন নারীর কাছে তা হয়ে ওঠে অব্যক্ত আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন। কৃষ্ণচূড়ায় মন সঁপেছি আটকাতে কি পারবে? আসলে এর বর্ণ গন্ধ যেন মাদকতার পরিপূর্ণ ভাণ্ডার। কাজী নজরুল ইসলামের কথায় - 'কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জরী কর্নে / আমি ভূবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে'।
কে এই কৃষ্ণচূড়া? এটি একটি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Delonix regia। এতে প্রচুর পত্রপল্লব রয়েছে। এটি Fabaceae পরিবারভুক্ত। 'গুলমোহর' নামেও পরিচিত। সংস্কৃতে একে বলে সিদ্ধেশ্বর, গুজরাটীতে সন্ধেশ্বরী, কন্নড়ে বলে কোমরী, মালাবার উপকূলে তিসিত্তিমন্দারু, শিলংয়ে মেনোরামল এবং কোচিনে বলে হোসাফন্দ। ইংরেজিতে পরিচিত peacock flower নামে। এর আদি বাসস্থান মাদাগাস্কার দ্বীপ। তবে আমাদের দেশে এর আগমন মরিসাস দ্বীপ থেকে। অস্ট্রেলিয়ায় কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটে ঠিক এই সময় তথা ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে। তবে ভারতে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ফোটে কৃষ্ণচূড়া। জুন মাসে কেবল ফুটতে দেখা যায় দক্ষিণ ফ্লোরিডাতে। মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যে ফোটে ইউনাইটেড আরব এমিরেটসে। আর মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটে ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে।
তবে আজ কৃষ্ণচূড়া কোনো বৃক্ষ নয়। আজ আর কোনো ফুল নয়। এ যেন প্রেমের বৈতরণী। প্রেমরসের প্রতিচ্ছবি। প্রেয়স প্রেয়সীর ভালোবাসার দ্যোতনা।
'আজ দখিনবাতাসে
নাম না জানা কোন্ বনফুল
ফুটল বনের ঘাসে।
ঋতুরাজ
ও মোর পথের সাথি, পথে পথে
গোপনে যায় আসে।
বনপথ
কৃষ্ণচূড়া চূড়ায় সাজে
বকুল তোমার মালার মাঝে,
শিরীষ তোমার ভরবে সাজি –
ফুটেছে সেই আশে।
ঋতুরাজ
এ মোর পথের বাঁশির সুরে সুরে
লুকিয়ে কাঁদে হাসে।
বনপথ
ওরে দেখ বা নাই দেখ, ওরে
যাও বা না যাও ভুলে।
ওরে নাইবা দিলে দোলা, ওরে
নাইবা নিলে তুলে।
সভায় তোমার ও কেহ নয়,
ওর সাথে নেই ঘরের প্রণয়,
যাওয়া আসার আভাস নিয়ে
রয়েছে এক পাশে।
ঋতুরাজ
ওগো ওর সাথে মোর প্রাণের কথা
যখন আটকে যায় সদ্যযৌবনা প্রেমিক প্রেমিকার মিলন, বলতে গিয়েও বলা হয়নি যে প্রেম, সেটাও যখন কাঁটাতারের বেড়ায় আবদ্ধ, তখন মনে ঝড় তোলে এই 'কৃষ্ণচূড়া'। যখন পরকিয়া প্রেমও নিবু নিবু উনুনে ছাইচাপা হয়ে আছে। সাংসারিক জটিলতায় খাবি খাওয়া প্রেমটাও কেমন যেন নিষ্প্রভ তখন, তখন কৃষ্ণচূড়া কানে কানে এসে শোনায় জীবনের গান। আজ হয়তো প্রেম না পাওয়ার বেদনায় বড়ই অমলিন কৃষ্ণচূড়া। তবে এই ইট কাঠ পাথরের চিরন্তন লীলাভূমিতে প্রেম বারবার আছড়ে পড়বেই। শারীরিক চাহিদা নিয়ে কৃষ্ণচূড়া আজ হয়তো বড়োই একা। কিন্তু একদিন এই নিঝুম দুপুরে ঠিক কৃষ্ণচূড়ার কাছে কেউ এসে বলবেই 'প্রেম ভিক্ষা দাও'।
🍂
0 Comments