জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /উনপঞ্চাশতম পর্ব/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় 
উনপঞ্চাশতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী 


সেবার পুজোর পরে হলো এক অঘটন। দুর্গা পূজার পরে লক্ষ্মীপুজোও নমো নমো করে কেটে গেছে। অহনা শুনেছে, এবাড়িতে নাকি লক্ষ্মীপুজো খুব ঘটাপটা করে পালন করা হতো আগে। পুকুর ঘাটে বাসন মাজতে মাজতে বড়োজায়ের সঙ্গে এসব গল্প হয় আজকাল, কাজেকর্মে একসঙ্গে থাকতে থাকতে আজকাল আর তাঁকে পর মনে হয়না, এবাড়ির মানুষগুলিও ধীরে ধীরে পরমাত্মীয় হয়ে উঠছেন।
এই তো সেদিন দুপুরবেলা ভাতের পাতে চালতা মাখা খেতে খেতে দুই জায়ে এমনই আলোচনা চলছিল,
-’দিদিভাই,এবছর লক্ষ্মীপুজো করলে কেমন হয়? তুমি 
যে বলতে এবাড়িতে খুব ভালো করে আগে নাকি…’
মুখের কথা কেড়েই বড়ো জায়ের উত্তর ছিল,
-’করলে তো হয়। আমারও খুব ইচ্ছে করে.…’
-’তুমি তোমার ঠাকুরপোকে বলো না গো! তুমি বললে সে না বলবেনা,তা আমি জানি, বাকিটা আমরা সামলে নেব!’
ঠাকুরপোর কথা উঠতেই বৌদিদির মুখে উজ্জ্বল আভা;ভালোবাসার, বন্ধুত্বের।মনে পড়ে অহনার,বিয়ের রাতেই তাকে বলেছিল তার বর, ‘বৌদি আমাদের খুব ভালো,সংসারের জন্য নিবেদিত প্রাণ। কখনও ওকে অসম্মান কোরনা’
মনে রেখেছিল অহনা, যদিও সংসার শুরুর সময় বোঝাপড়ার কিছু সমস্যা ছিল, থাকেই সব সংসারে; কিন্তু এটাও সত্যি, দুপক্ষেরই ইচ্ছে ছিল আপন হওয়ার,তাই হয়েছে। এবং ফলে যৌথ পরিবার আরও সমৃদ্ধ হয়েছে।
আর এখন তো বাবু হওয়ার পরে, তার গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়েছে,পরিনতি এবং একাত্মতাও।এদের ভালোমন্দের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে থাকতে বুঝেছেন, শহরের উচ্ছল যাপনের বাইরেও এক উদার একাত্ম যাপনবৈভব আছে,যা গ্রামের নিজস্ব।এই সারল্য অনুভব করার জন্য সময় চাই, ধৈর্য্য চাই। অভ্যস্ত হলেই এ অনুভব আত্মস্থ হয়,হঠাৎ করে বহিরাগত কেউ তা টের পায় না।

এখানে থিতু হওয়ার পরে,সে অনুভব এখন তার হয়েছে। এখন এখানে থাকতে তার মন্দ লাগেনা, বরং গ্রামজীবনের রীতি নীতি উৎসব ব্রতপালনের গভীরে নিহিত কারণগুলি খুঁজতে চায় মন। সেই মন নিয়েই প্রস্তাব, দিদিভাইয়ের সমর্থন,বরের কাছে আবদার, অবশেষে বাড়িতে আবার মহাসমারোহে লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন।
সকাল থেকেই ব্যস্ততা, পুজোর জায়গা ঝাড়া-মোছা, আল্পনা দেওয়া,কাগজের ফুল কাটতে শিখিয়ে ছোটদের সাজাবার দায়িত্ব দেওয়া, প্রতিবেশী অগ্রজাদের পরামর্শে ভোগ রান্নার বিভিন্ন উপচারে নিজেকে নিয়োজিত করা, নিজের ইচ্ছেয় উপবাস,পুজো শেষে ভোগ বিতরণ, নিজেদের খাওয়া-দাওয়া এবং সবকিছু গুছিয়ে তোলা… দিদিভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে একটি ব্যতিক্রমী দিন কাটিয়ে অনেক রাতে যখন বিছানায় গিয়েছিল অহনা,বর-ছেলে ঘুমে কাদা। অত্যধিক পরিশ্রমে শরীর জুড়ে ব্যথা,মন খুশিতে ভরপুর,চোখে নেমে আসছে ঘুম। হঠাৎ জানলায় চোখ রাখতেই অবাক দৃষ্টি,ওমা!কে বসে আছে ওখানে! টানা টানা ভ্রু,গোলগোল প্রাণবন্ত চোখ,অবিকল একটা শিশুর মুখ! তাকিয়ে আছে তারই দিকে!কে ওখানে!
চোখ রগড়ে একটু ভালো করে তাকাতেই মোহভঙ্গ হলো,একটা লক্ষ্মীপ্যাঁচা বসে আছে তো!
বাইরে ফিনকি ফোটা চাঁদের আলো,উঠোনময় পূজার আল্পনা,জানলায় বসে থাকা লক্ষ্মীপ্যাঁচা…কী এক অপার্থিব কল্যাণ-আনন্দ যেন ছড়িয়ে গেল হৃদয়ময়…

পরের সকালে যখন চা খাওয়ার সময় সবাইকে সে গল্প করা হয়, শাশুড়ি মা শুনে বলেছিলেন,
-’ওমা! তুমি জানো না!পুজোর রাতে কোজাগরী ডাকে প্যাঁচাই তো আসে।আর বাইর লক্ষ্মীপুজোয় আসে ‘সার’

ছোট্ট থেকেই শহরে মানুষ,দেশের বাড়ি থাকলেও যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ;বাবা-মার বিয়ের আগেই অহনার ঠাকুরদা-ঠাকুরমা পৃথিবী ছেড়েছেন।মায়ের বাবার বাড়ি সুদূর বিহারে।অগত্যা এই সব দেশীয় সংস্কৃতি তার এতোদিন অজানাই থেকে গেছে।

🍂

প্রবল উৎসাহে জানতে চাইলে,
বাইর লক্ষ্মীপুজো!সেটা কখন হয়! আমাদের বাড়িতেও হবে গো দিদিভাই?’
অন্যসময় হলে হয়তো এমন উচ্ছলতার জন্য ধমক খেত, কিন্তু গতকালের পুজোয় তার সক্রিয় যোগদান,সাজানো,ভোগ-রান্নায় সবাই এতোটাই তৃপ্ত ছিল যে খুশি হয়েই দেওর-ভাসুর-বড়োজা শুনিয়েছিলেন বাইর লক্ষ্মীপুজোর কথা।পৌষ মাসের শেষদিনের বিকেলে উঠোনে গোবর লেপে আল্পনা এঁকে নতুন ধান ঢেলে ধামা-কুলো-আয়না-দেবীমুর্তি সাজিয়ে পুজো,মরসুমী ফল-পাকুড়ের সঙ্গে নতুন চাল বেটে মকর ভোগদান,সন্ধ্যেয় ‘সার’ অর্থাৎ শেয়াল ডাকলে ঠাকুর তোলা,পিঠে বানানো ইত্যাদি ইত্যাদি গল্প।শুনতে শুনতে কৃষিজীবী সমাজের ফসল বরণ ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনেই যে এই সব উৎসবের আয়োজন,তা বেশ বুঝতে পারছিল অহনার শিক্ষিত মন।তবে,ধর্মীয় রীতি কানুন ও অনুশাসনে এই সব সামাজিক উপযোগিতার যে দায়বদ্ধতা আছে,তা অস্বীকার করার কোন উপায় তো নেই।
ভাবতে ভাবতে পিসিমার ঘরে চা পৌঁছতে গেল নতুন বৌ।
ইদানিং তিনি খানিক ভালো আছেন,চেতনাও ফিরেছে।বিছানাতে উঠে বসেন,কথাতেও জড়ানো ভাব কমেছে।
ও ঢুকতেই ঘরে যেন কিসের শব্দ, হিসহিস…হিসহিস…
-’কিসের শব্দ হচ্ছে পিসিমা?আজ কেমন আছেন?’
দরজার দিকে পেছন ঘুরে শুয়েছিলেন বৃদ্ধা;মুখ ফিরিয়ে ওকে দেখেই চোখ দুটি বিস্ফারিত। স্পষ্ট গলায় আর্তনাদ,’বেরিয়ে যা! বেরিয়ে যা!’
ভয় পেয়ে খানিক পিছিয়ে যেতেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল বারান্দায়।হাতের চায়ের কাপ ভেঙে চৌচির। ইতিমধ্যে পেছনে এসে পৌঁছেছে বাড়ির অন্যরা, টলোমলো পায়ে অহনার সন্তানও।
সবাই অবাক হয়ে দেখলেন, অনেকদিন পরে,পিসিমা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, চিৎকার করে সাবধান করছেন,’সরে যা সরে যা,সাপ…’
ওরা মেয়েরা সরে গেলেও ছেলেরা ঘরে ঢুকেই দেখে, সত্যিই এক দুধেগোখরো কুন্ডলী পাকিয়ে চৌকাঠের পাশে,অসতর্কে ঢুকলে অবশ্যই কামড়াতো।
ভাগ্যিস পিসিমা দেখতে পেয়েছিলেন!ভাইপোরা পিসিমাকে জড়িয়ে সরিয়ে সাপটাকে একটা চটের বস্তায় পুরে ধানজমিতে ছেড়ে দিয়েছিল।সবাই বলতে লাগলো,সাক্ষাৎ দেবীই রক্ষা করেছেন তাদের, ভাগ্যিস আবার লক্ষ্মীপুজো শুরু হলো…
কিন্তু অহনার মনে হয়েছিল, সত্যিই যদি কল্যাণকর কিছু হয়ে থাকে,তবে তা পিসিমার সুস্থ হয়ে ওঠা…ডাক্তার বলেছিলেন,প্রিয় পরিজনকে রক্ষা করার তাগিদে হঠাৎ পাওয়া ‘শক’তাঁর অসাড় স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত করে চেতনা ফিরিয়ে দিয়েছিল। এরকমই নাকি কখনও কখনও হয়।
খুব খুশি হয়েছিল সবাই, যদিও এ সৌভাগ্য খুব বেশিদিন ভোগ করতে পারেনি চক্রবর্তী পরিবার।
(ক্রমশঃ)

Post a Comment

0 Comments