জ্বলদর্চি

পাগল/পুলককান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস

পাগল

পুলককান্তি কর 

অনেকক্ষণ ধরেই এক দৃষ্টিতে পাগলাটার কান্ডকারখানা দেখছিল খোকন। কদিন ধরে গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহকে শান্ত করে বিকেলের বেশ খানিকটা আগেই নেমে এসেছে কালবৈশাখি। মাটির সোঁদা গন্ধ, এলোমেলো হওয়ায় বৃষ্টির ধারাদের নেচে বেড়ানো, হঠাৎ করে সন্ধের মতো অন্ধকার – সবকিছুই বড় মায়াময় করে রেখেছে কমলপুর নামের এই ছোট্ট গঞ্জটিকে। খোকনের খুব ইচ্ছে করছিল আজকের প্রথম বৃষ্টিতে একটু ভেজে, কিন্তু উপায় নেই। দোকানে এক্সট্রা কোনও জামাকাপড়ের সেট নেই। বাড়ী যেতে গেলে দু-তিন কিলোমিটার সাইকেল চড়ে যেতে হবে। এই ঝোড়ো হাওয়ায় ভিজে ভিজে গেলে আবার বাড়ীর লোক গালমন্দ করবে! পাগলটারই ভালো! কারও কথার পরোয়া করতে হয় না তাকে! দিব্যি একটু আগেই বৃষ্টি ভিজলো লাফিয়ে লাফিয়ে। খোকনের মনে হল, স্বয়ং ঈশ্বরই যেন বৃষ্টিধারায় ওকে স্নান করিয়ে দিলেন। কতদিনের ময়লা ধূলোর পলেস্তরা ছিল গায়ে, মাথায় এত বড় জটা – বৃষ্টির ধারা পড়তে যেন মনে হল লোকটা বোধহয় সম্ভ্রান্ত কোন বাড়ীর ছিল। বেশ ফর্সা রঙ। উজ্জ্বল কাটাকাটা চোখ মুখ! এই পাগলটার আমদানি এখানে খুব বেশী দিনের নয়। আশেপাশের দোকানদার বা তাদের কাছে আসা দূর দূরান্তের খরিদ্দারেরাও চেনেনা ওকে কেউ। এর রকম-সকমও অন্যান্য পাগলদের মতো নয়। ওকে এক মনে পাগলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নান্টু বলল, ‘কী দেখছো দাদা, এত মন দিয়ে?’

  • ওই পাগলটাকে দেখছি রে নান্টু!

  • ওতে আর এত কী দেখার আছে খোকন দা? পাগলদের কাজ করবার কি চেয়ে দেখার? ওরা কি আর কিছু ভেবে করে?

  • আমি তো ওটাই ভাবছি রে! সত্যি কি ওদের ভাবনা বলে কিছু নেই?

  • থাকলেও নিশ্চই সুস্থ মানুষদের মতো নয়!

  • ওটাই তো আমার সন্দেহের রে! এই যে বৃষ্টিটা হল, দ্যাখ কত আনন্দ নিয়ে সে ওতে ভিজলো। মানে আমাদের মতো গরমে ওরও কষ্ট হচ্ছিল! আমরা যেমন প্রথম বৃষ্টি ভেজার মজা পেতে চাই, সেও তেমন করেই চায়। শুধু আমরা নানান স্বারোপিত বিধিনিষেধ দিয়ে নিজেকে নিরস্ত করি, ও সেটা করে না। দ্যাখ না কি করছে এই মুহূর্তে! 

  • কী করছে? দেখতেই তো পাচ্ছিনা ওকে !

  • দেখবি কী করে! ও তো ওই মাদুরটাকে গোল করে দাঁড় করিয়ে ওর মধ্যে বসে ঘর ঘর খেলছে। দেখবি – একটু বাদে বাদে হালকা করে মাথাটা তুলে উঁকি দিয়ে দেখছে বাইরেরটা।

  • ছোটবেলায় আমরা এমনটা খেলতাম খোকন দা।

  • শুধু তুই কেন রে, গ্রামের সব ছেলেমেয়েরাই বোধহয় এই খেলাটি খেলে বর্ষার দিন হলে। আমাদের তো ইয়া বড় বড় মাদুর ছিল বাড়ীতে – নানান মাপের! আমরা এই গুলোকে গোল করে তার উপর ছাতা দিয়ে এরকম ঘর ঘর খেলতাম। আমাদের বাড়ীতে আবার অনেক বেড়াল ছিল। সেই বেড়ালগুলোকে জোর করে নিয়ে ঢোকাতাম ওর ভেতর। ওরা ভয় পেয়ে লাফ মেরে বেরোবার চেষ্টা করত। অত উঁচু মাদুর থেকে সব সময় পারতো না। নখ দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে মাদুর বেয়ে উঠত তারা। ভারী মজার খেলা ছিল রে!

  • যাই বলো খোকনদা, সরকারদের পোড়ো বাড়ীটা এখনও টিকে আছে বলে পাগল ছাগলেরা রোদ বৃষ্টিতে এখনও জায়গা পায়। আগের পাগলীটাও তো ওখানেই ডেরা বেঁধেছিল।

  • নান্টু, দ্যাখ না রে ছবি বৌদি চপ টপ ভাজা শুরু করেছে কিনা! নান্টু একটু বাইরে বেরিয়ে উঁকি দিয়ে এসে বলল, পেঁয়াজি ছেড়েছে। চপ ভাজা হয়ে গেছে।

  • যা না, তিন জায়গায় মুড়ি দু টাকার আর একটা করে চপ আর পেঁয়াজি নিয়ে আয়!

  • আমার তোমারটা তো বুঝলাম! তিন নম্বরটা কে? জুঁইদির আসতে আসতে তো সেই সাড়ে সাতটা।

  • আছে, আছে। তুই নিয়ে আয়।

খানিক বাদে নান্টু একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে তিনটে মুড়ির প্যাকেট, চপ, পেঁয়াজি আর কাঁচা লঙ্কা নিয়ে উপস্থিত। খোকন বাইরে তাকিয়ে দেখলো, বৃষ্টিস্নাত উজ্জ্বল আকাশ। চারপাশের গাছপালা গুলো জলে স্নান করে একেবারে চক্‌ চক্‌ করছে। চারপাশে অকাল গোধূলি নেমে এসে কেমন যেন বিষন্ন হয়ে আছে সব। নান্টুর হাত থেকে একটা মুড়ির প্যাকেট বের করে তাতে একটা করে চপ আর পেঁয়াজি, আর লঙ্কা দিয়ে খোকন বলল, যা, ওই পাগলটাকে দিয়ে আয়।


  • 🍂

    এই জন্যই তিনটে আনালে?

  • হ্যাঁ।

  • কিন্তু ওর তো খুঁটে খেঁটে খাবার খুঁজে খাওয়ার অভ্যাস। আমি দিতে গেলে নেবে?

  • দিয়েই দ্যাখ না।

  • যদি তাড়া করে?

  • কী আবোল তাবোল বকছিস নান্টু? ওকে কি সেরকম পাগল মনে হয়? গত ক’দিন তো দেখছিস, কাউকে বিরক্ত করতে বা এটা ওটা ছুঁড়ে মারতে দেখেছিস?

  • তা দেখিনি। আচ্ছা তুমি যে এতবড় লঙ্কাটা দিয়ে দিলে, ও না বুঝে যদি এককামড়ে খেয়ে নেয়?

  • তুই ওদের কী ভাবিস, নান্টু? কথায় বলে শুনিস নি, পাগলেও নিজের ভালো বোঝে? ও কি লঙ্কা চেনে না – না কি আগে খায় নি- যে একেবারে মুখে পুরে দেবে?

  • কী জানি বাবা। খুব বেশী পাগল তো দেখিনি জীবনে!

  • তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর বকবক করিস না! যা। দিয়ে আয় গিয়ে।

নান্টু ঠোঁঙাটা হাতে নিয়ে রাস্তার ওপারে গিয়ে খানিকক্ষণ এদিক ওদিক চেয়ে ফিরে এল। খোকন বলল, কী হল রে?

  • নেই তো!

  • নেই মানে? এই তো ছিল। মাদুরের মধ্যে ঢুকে টুকি টুকি খেলছিল। দ্যাখ ভালো করে!

  • দেখছি দাদা। মাদুরের মধ্যেও নেই। মাদুরের ওপাশে আমাদের নেড়িটা শুয়ে আছে। 

  • তাহলে মনে হয় ইস্কুলবাড়ীর পুকুরটায় গেছে।

  • ও ওখানে যায় নাকি?

  • হ্যাঁ রে। সেদিন দেখলাম – খাটে বসে কী সব বিজবিজ করছিল!

  • মুড়িটা কী করব তাহলে?

  • দে আমাকে। একবার পুকুর পাড়টা ঘুরে আসি।

  • এই ভর সন্ধ্যাবেলা দোকানে ধূপধূনা না দিয়ে তুমি পাগল খুঁজতে বেরোবে?

  • দূর পাগল! আমি কিা ওকে খুঁজতে যাচ্ছি নাকি? এই এত বৃষ্টির পর দেখব পল্টন পল্টন ব্যাঙ বেরিয়ে ডাকতে শুরু করবে। ঘাটে বসে ওদের অর্কেস্ট্রা শুনব! আর যদি এই ফাঁকে পাগলটাকে দেখতে পাই তো মুড়িটা দিয়ে দেব।

  • তা তুমি মুড়িটা খেয়েই যাও না!

  • ওই খাটে বসে খাবো। তুই খেয়ে নে। আর এদিকটা সামলাস!

  • ধূপ টূপ তুমি এসে দেখাবে, না কি আমি দেখিয়ে দেব!

  • যদি দেরী করি, তুই দেখিয়ে দিস।

খোকন বেরিয়ে যেতে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নান্টু। এই মালিকের দোকান চলবে? বাপের আমলের ঘড়ির দোকান, এই আমলেই বোধহয় লাটে উঠবে। ও সেই চোদ্দ পনেরো বছর থেকে এই দোকানে আছে। আগে ওর কাকা এই দোকানে কাজ করত, ঘড়ির সারাই ফারাই করত! তখন ঘড়ির মিস্ত্রির আলাদা একটা দাম ছিল। এখন তো সবই ডিজিট্যাল। ঘড়ির ব্যাটারি আর ব্যান্ড বদলানো ছাড়া রিপেয়ারিং এর কাজ প্রায় উঠেই গেছে। বাজারে এত বড় বড় কোম্পানি সব উঠে গিয়ে দুটো মাত্র কোম্পানিই টিকে আছে। নিজেদের মধ্যেই চুক্তি তাদের – একজন শুধু হাত ঘড়ি। আরেক জন দেয়ালের। নিজেদের ক্ষেত্রে দুজনেরই মনোপলি – অতএব ওরা যে ভাবে মার্কেট চালাবে, মার্কেটও সেভাবে চলবে। প্রথম প্রথম কাকার থেকে যত্ন করে ঘড়ির সব কাজই শিখেছিল নান্টু। এখন সবই বেকার। কাকা আজ বহুদিন চোখে দেখে না। তখন থেকেই নান্টু – এই দোকানের অংশ হয়ে গেছে। এখন ওর সাতাশ আঠাশ বছর বয়স। ভাবনা হয়, অন্য কোনও কাজই তো সে শেখেনি। এই দোকান লাটে উঠলে ও যাবে কোথায়! মুড়ি চিবোতে চিবোতে হঠাৎ সে দেখল – একজন পুরোনো কাস্টমার ওদের দোকানেই আসছে। লোকটি এসেই বলল, ‘কী হে, খোকন গেল কোথায়? 

  • উনি একটু বেরিয়েছেন বিশেষ কাজে। আপনি আমাকে বলুন না! 

  • কাজ না হাতি! ওই তো বিশু ওদিন বলছিল খোকনের নাকি আজকাল ব্যাবসায় মন নেই! খালি আদারে বাদারে ঘোরে! 

  • আপনি তো আমাদের দোকান থেকেই ঘড়ি কেনেন। বিশুদার দোকানে কী করতে গেছিলেন?

  • আসলে বুঝলে না খোকা, জিনিস কেনার আগে দরটা যাচাই করে নেওয়া দরকার। এত দাম দিয়ে জিনিস কিনব – দেখে নেব না? 

  • এতদিন ধরে আমাদের দোকান থেকেই তো সব ঘড়ি কেনেন বা সারাই টারাই করান। আমাদের থেকে শস্তা কি কেউ আপনাকে কখনও দিতে পেরেছে?

  • না – সেটা নয়। খোকনের আবার এসব গুণ আছে। একটু হাত ফাত ধরে বললে বিশ-পঞ্চাশ টাকা ছেড়ে দেয়! 

  • কাকু, আজকাল তো মার্কেট জানেন না। পাব্লিক তো শস্তা খুঁজেই খালাস। এত বড় এস্টাব্লিশমেন্ট সামলে, কর্মচারীর বেতন দিয়ে মালিকদের চালানো বড় মুশকিল। পঞ্চাশ টাকা ছাড়লে – আর হাতে কিছু থাকে না।

  • খোকন কি তবে লস্‌ করে দিচ্ছে আমায়? তোমরা সব ভেতরের খবর জানো না বাপু! আজকাল কোম্পানি প্রচুর ষ্কীম দেয়! দোকানদাররা একটা দুহাজার টাকার ঘড়ি পাঁচশো টাকায় কেনে – জানো সেটা?

      নান্টু চুপ করে রইল। অকারণ কথা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। বলল, বলুন না কাকু,    কিছু দরকার ছিল? নতুন কিছু নেবেন?

  • গতবছর একটা ঘড়ি নিয়েছিলাম। ওর ব্যাটারির ওয়ারেন্টি ছিল একবছর। তা ঘড়িটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে।

  • দিন দেখি।

নান্টু একটু চেক টেক করে বলল, ব্যাটারি গেছে। ক্যাশমেমো দেখান – একবছর পেরিয়েছে কিনা দেখি।

  • ক্যাশমেমো টা আনিনি। মানে খুঁজে পাচ্ছিনা। তবে একবছর পেরোলেও দু-চার দিনই পেরিয়েছে, আমি নিশ্চিত।

  • তা বললে তো হবে না কাকু! কাগজ ছাড়া কোম্পানি মানবে কেন?

  • কোম্পানিতে পাঠানোর দরকার কী বাপু! তুমি একটা ব্যাটারি লাগিয়ে দাও না!

  • সত্তর টাকা দিন।

  • ত্রিশ টাকা দিচ্ছি, লাগিয়ে দাও। বলেই চোখ টিপে ভদ্রলোক ইশারা করলেন নান্টুকে। নান্টু দেখেও দেখল না। বলল, সত্তর টাকাই লাগবে। ত্রিশটাকার একটা ব্যাটারি আছে, তবে ওটা ভালো না। বেশী দিন চলবে না। নিলে ভালোটাই নিন।

  • এই জন্যই খোকন না থাকলে  দোকানে আসতে ইচ্ছে করে না। ও থাকলে নিশ্চই কমে কিছু একটা ব্যাবস্থা করতো!

  • তাহলে বসুন। একটু বাদেই উনি চলে আসবেন।

  • না যাই বরং। বিশুর দোকানে গিয়ে দেখি।

ভদ্রলোক চলে গেলেন। ঠিক সন্ধের মুখটায় খদ্দের ফিরে যেতে মনটা খিঁচিয়েই গেল নান্টুর। অথচ করার কিছু নেই। সে উঠে ধূপধূনো জ্বালানোর তোড়জোড় করতে লাগলো।


সকালে বাজারে আজকাল অনেকগুলো ভ্রাম্যমান চা-ওয়ালা হয়েছে। একটা বড় ফ্লাষ্কের মধ্যে চা নিয়ে তারা বাজারে কয়েক রাউন্ড ঘুরে বেড়ায়। দুধ-চা, লেমন চা – সবই পাওয়া যায়। বাজারে চা এখন পাঁচটাকা একটা ভাঁড় – কিন্তু দোকানদারদের জন্য এরা খুঁজে খুঁজে স্পেশাল প্লাস্টিকের কাপ জোগাড় করেছে। এর দাম এক টাকা আর দু-টাকা। এক টাকায় ঠিক এক চুমুক চা’ই ধরে। দু-টাকায় আড়াই  চুমুক খুব গরম থাকলে, নইলে দু-চুমুক। খোকন বলল, তিনটে দু-টাকায় চা দাও হে ভবেশ। বিস্কুট আছে?

  • না দাদা।

  • নান্টু যা তো রে, সর্বানী থেকে একটা পাঁচ টাকার বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে আয়।

নান্টু বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করলো। ফিরে এসে বলল, কী পাগলটাকে দিয়ে আসতে হবে?

  • হ্যাঁ। আর বিস্কুটটাও দিয়ে আসিস।

  • তা ভবেশকে বললেই তো ও পাগলটাকে চা টা দিয়ে আসতো! আমাকে আর উজিয়ে যেতে হত না! 

  • ভারী দু’ক্রোশ রাস্তা রে আমার! যাবি রাস্তার ওপারে – এত কথার কী আছে? খিঁচিয়ে উঠল খোকন।

  • আমি তো বুঝতে পারছি খোকন দা, পাগলটা যদ্দিন এখানে থাকবে, তুমি তার জন্য পার্মানেন্ট চা বিস্কুটের বন্দোবস্ত করবে। তা ভবেশ সেখানেই চা টা নিয়ম করে দিয়ে এলে বেচারা একটু গরম গরম খেতে পারতো!

খোকন নান্টুর শ্লেষটা গায়ে মাখলো না। বলল, ভবেশ এখন এই কথা রাষ্ট্র করবে, বুঝিস না?

  • আর আমি দিয়ে এলে বুঝি পাশের দোকানীরা চোখ বন্ধ করে থাকবে! দেখবে না!

  • ঠিক আছে, তুই দিয়ে আয় এখন!

কাজের এক ফাঁকে নান্টু বলল, দাদা, কাল ওকে পুকুর পাড়ে চপ মুড়ি দিতে পেরেছিলে।

খোকন অন্যমনষ্ক ভাবে বলল ‘হুঁ’।

  • খেল?

  • তুই যে চা দিয়ে এলি, খেল? খেঁকিয়ে উঠল খোকন।

  • দাদার কি সকাল থেকে মুডটা ঠিক নেই? তখন থেকেই দাঁত মুখ খিঁচোচ্ছ!

  • তুই নিজের চরকায় তেল দে নান্টু। সব ঘড়ি গুলো রিপেয়ারিং হয়ে গেছে?

  • সকাল থেকে তো তোমার কাজেই তাল দিচ্ছি। ওগুলোতে হাত দিতে পারলাম কই!

  • ওই দ্যাখ ওই ক্লাবের মন্টুদারা আসছে। গণ বিবাহের জন্য পনেরো জোড়া ঘড়ির অর্ডার ছিল। রেডি আছে তো?

  • হ্যাঁ।

  • আরে মন্টুদা, আসুন আসুন।

  • সব রেডি আছে তো?

  • সব রেডি করে রেখেছি।

  • কত বিল হয়েছে রে খোকন?

  • এই তো, বিয়াল্লিশ হাজার। তার উপর টেন পারসেন্ট ডিসিকাউন্ট করে পঁয়ত্রিশ হাজার আটশো।

  • পুরো পঁয়ত্রিশ রাখ। আবার আটশ কেন?

নান্টু মন থেকে বলল, আটশ মানে তো প্রায় একটা ঘড়ির দাম কাকু! 

  • তুই চুপ কর। ধমকে উঠল  মন্টু। খোকনের দিকে চেয়ে বলল, এত বড় একটা সমাজ সেবা মূলক প্রোগ্রাম, তোর তরফ থেকে একটা কন্ট্রিবিউশন তো থাকা উচিৎ।

নান্টু আবার ফোড়ন কাটলো, এতটা যে ডিসকাউন্ট করা হল, সেটা কি কিছু না?

খোকন চোখের ইশারায় নান্টুকে থামিয়ে দিল। ‘ঠিক আছে দাদা, পঁয়ত্রিশই দাও। আটশো টাকাটা লেশ করে দে নান্টু।‘

খানিক বাদে ওরা চলে যেতে নান্টু বলল, দাদা এভাবে কদিন চলবে?

  • কেন? চলছে না কি?

  • এভাবে চললে কুবেরের সম্পদও তো ফুরোবে! তোমার তো অঢেল নেই। তোমারও বৌ-বাচ্চা আছে। ছেলে মেয়ের জন্য ও তো কিছু রেখে যেতে হবে।

  • মানুষ বিয়ে করলেই কি স্বার্থবুদ্ধি সম্পন্ন হতে হয়? ছেলের জন্য রাখতে হবে, বৌ এর জন্য রাখতে হবে, ওর জন্য সঞ্চয়, মেয়ের বিয়ে – এসব ভাবতে গেলে মানুষ তার অন্তরের ডাকে সাড়া দেবে কী করে?

  • অন্তরের ডাকে সাড়া দেওয়া মানে কি বিচার বুদ্ধিহীন হওয়া? 

  • তোর সাথে তর্ক করে কাজ নেই। খেয়ে নে গিয়ে যা। দেড়টা পার হয়ে গেল।

  • তুমি খাবে না?

  • আমার খাবারটা পাগলাটাকে দিয়ে আয়। আমার জন্য ছুটকুদার দোকান থেকে এক প্যাকেট ম্যাগি করে আন।

  • দাদা, আমি কিন্তু এবার বউদিকে বলে দেব! তুমি কি পাগলাটার খাওয়া দাওয়ার পুরো দায় নিয়ে নিলে?

  • নিলে তোর কি অসুবিধে?

  • আমার কথা ছাড়! পাগলটার কথা তো ভাবো? ও যদি তিনবেলা খাবার আর টাইমে টাইমে চা পেয়ে যায় – বসে বসে গতরশুঁকো হয়ে যাবে। পাগলামিটাও তো আর ঠিকঠাক করতে পারবে না!

  • তুই যা তো! আজকেও ওয়েদার ফোরকাষ্ট আছে, ঝড় বৃষ্টি হবে। তাড়াতাড়ি খাবারটা নিয়ে আয়, আর ওকে দিয়ে আয় আমার ভাতটা!

  • কী যে করো না! 

  • আরে গতকালও দেখেছিলাম, ও শুকনো রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। সাথে কিছু ছিল না। রাতে ও কী খেয়েছে কে জানে? বিকেলের ওই মুড়িটুকুতেই হয়তো এখনও চলছে। এবেলা একটু ভাতই খাক।

  • তাই খাক। তুমি বসো, আমি তোমার খাবারটা নিয়ে আসছি।

দুপুর থেকেই জোর মেঘ করেছে আকাশে। হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত এলো, বোধহয় কাছেপিঠে কোথাও বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। খোকন আজ সকাল থেকেই বড় অন্যমনষ্ক। ওর থেকে থেকে কেবলই পাগলাটার কথা মনে পড়ছে। সেদিন ও যখন চপমুড়ির ঠোঙাটা ওর হাতে তুলে দিল, কেমন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল পাগলটা! ও যখন জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কী?’ তখন কেমন অবলীলাক্রমে বলল, ‘পাগল’। তখন তার একমুখ দাড়ি গোঁফের আড়াল থেকে বেরিয়ে থাকা দাঁতের সারিগুলো কেমন যেন ঝকঝক করে উঠল। ও কি নিয়ম করে দাঁত মাজে? মাজে নিশ্চই – নইলে অন্যান্য আর দশটা পাগলগুলোর মতো হলুদ দাগের ছোপ থাকতো দাঁতে। ওর চোখগুলোও বড় মায়াদার, বড় দীঘল। চোখে গহন স্বপ্ন ছিল বলেই বোধহয় বাস্তবের চাপে মার খেয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে! বিকেল একটু গড়াতেই নান্টুকে দোকান দেখতে বলে দিয়ে বাইরে  বেরিয়ে গেল খোকন। নান্টু বলল, আজও কি ব্যাঙের ডাক শুনতে নাকি দাদা?

খোকন কোনও উত্তর করল না। আজ বিকেলেও ভারী একটা বর্ষা হল এখানে। খোকন যখন পুকুরের ঘাটে এল, তখন পাগলটাকে দেখতে পেল না। ও একমনে পুকুরের জলের দিকে চেয়ে রইল। জলের স্রোতে সব কচুরীপানাগুলো এখন পাড়ের কাছেই। ঘাটের ঠিক দুপাশ জুড়ে সুষনি শাকের যেন বন হয়ে রয়েছে। কয়েকটা জল ফড়িং একবার কচুরিপানার উপর বসছে, একবার গিয়ে চোঁ করে পুকুরের জল ছুঁয়ে আসছে। ব্যাঙের কালোয়াতিতে চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। পাগলটা গেল কোথায়? আজকে আর নান্টুকে না বলে সে নিজেই চপ আর মুড়ি কিনে এনেছে। আজ ভেবেছিল ওর সাথে একসাথে খাবে, কিন্তু ও কোথায় যেতে পারে? এত বড় সুন্দর একটা প্রকৃতির অর্কেস্ট্রা ছেড়ে কি ও অন্য কোনও সুন্দর জায়গায় সন্ধান পেয়েছে? নাকি সে আসে বলে পাগলটার মুগ্ধতায় ব্যাঘাত ঘটেছে!

অনেকক্ষণ সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খোকনকে এখনও ফিরতে না দেখে ধূপটা নিয়ে নান্টু লক্ষ্মী গণেশের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এমন সময় জুঁই এসে বলল, কী রে খোকন দা কোথায়?

  • ব্যাঙের গান শুনতে গেছে।

  • মানে?

  • আর বোলো না জুঁই দি, খোকনদা থাকে বলে অনেক কথা বলতে পারিনা; খুব শিগ্‌গিরি এ ব্যাবসা লাটে উঠবে।

  • কেন রে?

  • একটু বসো। ধূপধূনো টা দেখিয়ে বলছি।

একটু বাদে নান্টু বলল, আমার মনে হয় খোকনদাকে নতুন পাগলামিতে পেয়েছে।

  • মানে কী?

  • এই রাস্তার ওপারে এক পাগল জুটেছে। দিনে দুবার তিনবার চা, জলখাবার – এমনকি নিজের দুপুরের খাওয়াটা পর্যন্ত তাকে দিয়ে দিচ্ছে। আর দোকানের রুটিন দান খয়রাত তো দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

  • এতদিন বলিস নি কেন?

  • কী বলব দিদি, কিছু বলতে গেলে আমাকে গালাগাল করে। তোমাকে কিছু বলতে বারণ করে দিয়েছে। কিন্তু এখন দেখছি না বললেই নয়। তোমার কথাটাই তো একটু শোনে দাদা। দ্যাখো কিছু বলে টলে।

  • খোকনদা ফিরবে কখন?

  • তুমি সাড়ে সাতটায় আসো বলে, খোকনদা কোনও কাজে কক্ষণো এই সময়  বাইরে থাকে না। তুমি আসার আগেই ঢুকে যায়। কিন্তু আজ তো দেখছি – সেই টানটাও গায়ে লাগছে না।

জুঁই কথাটা শুনলো, কিন্তু গায়ে মাখলো না। গত ছ-বছর ধরে ও প্রতিদিন সন্ধে সাড়ে সাতটায় খোকনের দোকানে আসে। বছর সাতেক আগে কী একটা রোগে ওর বর মারা যাওয়ার পর থেকে সে বাপের বাড়ীতেই থাকে। ওর বাবা প্রভাবশালী ও অবস্থা সম্পন্ন ছিলেন। বাবা গত হয়েছেন বছর তিনেক। তারপর থেকে ও মায়ের সাথেই পৈতৃক ভিটেতে থাকে। এক ভাই। দূরে থাকে – চাকরি সূত্রে। সেখানেই ঘরদোর বানিয়ে নিয়েছে সে। জুঁই এর বাবার যে দোকান ছিল – সেটি আপাতত লিজে দেওয়া আছে। সেই টাকা আর গচ্ছিত কিছু টাকায় ওদের সংসার চলে। জুঁই রোজ সন্ধেতে এসে টুকটাক বাজার করে, তারপর খোকনের দোকানে বসে এটা ওটা গল্প করে, ওর দোকানদারীতে হাত লাগায় মাঝে মাঝে। ঠিক ন’টা বাজলেই বাড়ী ফেরে সে। ওদের বাড়ী এই বাজারের মধ্যেই! লোকজন আগে আগে – নানান কানা ঘুঁষো করত, আজকাল সবারই গা-সওয়া হয়ে গেছে। ও এখন এই দোকানেরই একজন অংশ হয়ে গেছে। সে বলল ‘পাগলটা এখানে কদ্দিন এসেছে রে?’

  • দিন কুড়ি হল।

  • খোকনদা ওকে খাওয়া দাওয়া দিচ্ছে কবে থেকে?

  • দিন দশেক তো বটেই!

বলতে বলতে খোকন এসে ঢুকলো। জুঁইকে দেখে বলল, কীরে, কখন এলি?

  • আমার কি টাইমের নড়চড় হয়?

  • না।

  • তবে?

  • ওটা একটা কথার কথা!

  • তা তুমি এতক্ষণ কোথায় গেছিলে?

  • ওই তো ইস্কুল ঘাটে।

  • হঠাৎ? 

  • যাই তো মাঝে মাঝে!  তোকে তো আগেই বলেছি – ছোটবেলায় ওখানে গিয়ে আমরা ওই পুকুরে ডুব দিয়ে ঘাটটায় বসতাম। ওখানে একটা নৌকা বাঁধা ছিল।  সেই সব কথা মনে পড়ে। 

  • তুমি কি সেসব মনে করতে যাও নাকি খোকন দা? 

  • ওটাই একমাত্র নয়। এই ধর, আজ বৃষ্টি হলো। বৃষ্টির পর পুকুর ঘাটটা এত সুন্দর হয়ে যায় না জুঁই, তোকে কী বলব! কী সুন্দর কচুরিপানার ফুল ফুটেছে; ব্যাঙ ডাকছে – একেবেরে পাগল পাগল অবস্থা।

  • আমি তো তাই ভাবছি খোকনদা, তোমার এই পাগল পাগল দশাটা নাকি খুব বেড়ে যাচ্ছে! এটা তো খুব ছোঁয়াচে! এত পাগল সঙ্গ করছ!

খোকন কটমট করে নান্টুর দিকে তাকালো। নান্টু বিশেষ পাত্তা না দিয়ে একটা ঘড়ির রিপেয়ারিং এ মন দিল। জুঁই বলল, ‘কী হল, কিছু উত্তর দিচ্ছ না যে?

  • কী বলব?

  • তুমি আজকাল চা জলখাবার এমন কি নিজের দুপুরের খাবারটা পর্যন্ত নাকি পাগলটাকে দিয়ে দিচ্ছ?

একটুক্ষণ চুপ থেকে খোকন বলল, ‘জানিস তো জুঁই, এ পাগলটা ঠিক অন্য পাগলদের মতো নয়, বড্ড মায়াদার!’

  • যে পাগলের মায়াদারি নেই – তার বুঝি খিদে পায় না?

  • আমি তা বলতে চাই নি জুঁই!

  • আমি কিন্তু সেটাই বলতে চাইছি খোকন দা। সব পাগলের ঠিকে নেওয়া তোমার কর্ম নয়, তোমার দ্বারা সম্ভবও নয়। 

  • জানিস জুঁই, আমার কেন জানিনা মনে হয় পাগলদের সমস্ত রকমেরই সেন্স থাকে! আদর, ভালোবাসা, ছোটবড় বিচার – সব ওদের আমাদের মতোই থাকে। আমরা শুধু ওটাকে নিয়ন্ত্রন করি – ওরা নিয়ন্ত্রন করে না। এই পাগলটা যেভাবে বৃষ্টি দেখে – তুই ভাবতেও পারবি না। যেন বৃষ্টির প্রতিটি বিন্দুর পথ চলা ও তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চায়! পুকুরের জলে জলফড়িং এর স্নান সে চোখ মেলে দেখতে চায়। সেদিন বিকেলে যখন আমি ইস্কুল ঘাটে গেলাম, তখন কী দেখলাম- জানিস? ব্যাঙের ডাক শুনে সে হাত দুলিয়ে দুলিয়ে অমর পালের গান গাইছে – ব্যাঙ ব্যাঙ যতনের ব্যাঙ! 

  • তো?

  • তাই বলছি। এদের সব জ্ঞানই পরিষ্কার। খিদে তেষ্টা সব পায় আমাদেরই মতো! অথচ পথে ঘাটে ঘুরছে বলে সেই  সংস্থানটুকু নেই!

নান্টু পাশ থেকে ফোড়ন কাটলো, এই পাগলটাকে তুমি পুষ্যি নিয়ে নাও খোকন দা!

জুঁই তাড়া দিল নান্টুকে, ‘তুই আর পাগলকে সাঁকো দেখাস না নান্টু!’

খোকনের কিন্তু কথাটা শুনে চোখটা চকচক করে উঠল। ‘ঠিক বলেছিস নান্টু! সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল জুঁই এবং নান্টু। ‘কী বলছ কি?’

  • ঠিকই বলছি জুঁই। পাগলটাকে আমি বাড়ী নিয়ে যাবো। ওর দেখভাল করব। 

  • আর ঝামেলা বাড়িও না খোকন্দা। একটা পাগলকে বাড়ীর মধ্যে পোষা সম্ভব? বাড়ীর বাঁধন সইবে না বলেই তো ঘর ছেড়েছে সে!

  • বাড়ীর লোকের বাঁধনটা শাসন হয়ে যায় জুঁই! আমাদের বাড়ীতে তো তার মানসিক চাপ নেওয়ার কোনও কারণ ঘটবে না!

  • তাহলে লোকে আর পাগলা গারদে পাঠাতো না, খোকন দা। ঘরে ঘরেই পাগলখানা বানাতো। নান্টু বলে উঠল।

  • তুই কতটুকু খবর রাখিস নান্টু? আমি টিভিতে দেখেছি, কলকাতাতেই এক ভদ্রলোক আছেন, তিনি রাস্তায় পাগল দেখলে ওকে ধরে বাড়ীতে আনেন, ওর সেবা সুশ্রুষা করেন, চিকিৎসা করান। কত বড় মনের মানুষ আছে পৃথিবীতে। খালি আমি করতে গেলেই দোষ?

জুঁই বলল, ‘দোষ কেন হতে যাবে খোকন দা? শুভানুধ্যায়ীরা নিরাপদ চিন্তাগুলো বেশী করে। তুমি সারাদিন দোকানে থাকো, সকাল আটটা থেকে রাত দশটা। সে সময়টা একা তরুর পক্ষে এরকম একটা পাগল সামলানো সম্ভব? সর্বোপরি দুটো ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে!

  • সেরকম হলে ওকে দেখার জন্য একটা লোক রাখব!

  • লোকের দেখায় কি পাগল ঠিক হবে, খোকন দা? ওরা কাজের লোক! পাগলের প্রতি তাদের ভালোবাসা থাকবে তো তোমার মতো! 

  • তুই আমাকে নিরস্ত করার ফিকির খুঁজছিস জুঁই। আমার বিবেকের কাছে আমাকে ছোট হতে দিস না!

  • তোমার বিবেকের বোঝা তরুর ঘাড়ে ফেলছ কেন? তোমার মন্ত্রপড়া বউ বলে? সে রাজী আছে কিনা জিজ্ঞাসা কর! ওর ঘাড়ে তোমার ইচ্ছা চাপিয়ে দিও না।

 

তরু অনেকক্ষণ ধরেই উৎকন্ঠায় ছটফট করছে। নান্টুর হাত দিয়ে জুঁইকে ডেকে পাঠিয়েছে আজ ঘরে। বিকেল চারটেতে আসার কথা ছিল, প্রায় পাঁচটা বাজতে চললো, তবে কি আসবে না সে? খোকন কি বুঝতে পেরে ওকে আসতে না বলে দিয়ে থাকবে? খোকনের তো জানার কথা নয়! আজ দিন তিন চার হল তরু এবং খোকনের মধ্যে এক শীতল স্থৈর্য দাঁড়িয়ে আছে। তরু কখনোই খুব বলিয়ে কইয়ে দাবিয়ে রাখার মতো মেয়ে নয়। সারা জীবনই নিঃশব্দে খোকন এবং এই সংসারের সমস্ত দাবী সে মিটিয়ে আসছে। যখন শ্বশুর-শ্বাশুড়ী বেঁচে ছিলেন, কারও কোনও সেবাতেই সে ত্রুটি করেনি কখনও। তবে বেশ কিছু দিন ধরে খোকনের ভাব-গতিক ঠিক ভালো ঠেকছে না। কেমন যেন চিন্তাগ্রস্ত, যেন কোনও কিছু ঠিক ঠেকছে না ওর কিছুতেই। ও জানে জুঁই এর সাথে খোকনের এক নৈকট্যের সম্পর্ক। তাই আজ জরুরী ফরমান পাঠিয়েছে তাকে।

দেখতে দেখতে প্রায় পৌনে ছটায় জুঁই এল ওর বাড়ীতে। এসে বলল, ‘একটু দেরী হয়ে গেল গো তরু! আসলে একটা বিশেষ কাজে একটু শহর যেতে হয়েছিল!

  • ভাই এর কাছে-নাকি?

  • হ্যাঁ!

  • ব্যাপার কী! আবার কি কোনও কিছু বিক্রি-বাটার জন্য সই সাবুদ?

  • ঠিকই ধরেছো ভাই! বিষই বিষ! থাকলেও জ্বালা, না থাকলেও জ্বালা!  

  • তোমাকে একটা বিশেষ কারণে ডেকে পাঠালাম জুঁইদি। ওকে নিয়ে যে আর আমি পেরে উঠছি না!

  • কেন ! তোমাকে পাগল পোষার মতলব ফুসলিয়েছে নাকি?

  • আর বল কেন? তুমি বলো তো, সারাদিন আমি একা মেয়ে মানুষ – এরকম একটা পাগলের পরিচর্যা করতে পারি?

  • না বলে দাও! পরিষ্কার করে বলো, আমি পারবো না।

  • এভাবে তো আমি বলতে পারিনা জুঁইদি। নরম মনের মানুষ। আমি এমন করে বললে ব্যথা পাবে। এমনি তো দেখো কেমন বাউন্ডুলে চালচলন। এবার বাড়ী থেকে মনে চোট পেলে সেও না অন্য কিছু পাগলামি করে বসে!

  • এরকম ভয় পেয়ে জীবন চলবে বোন? তোমার কথা পরিষ্কার করে বলতে হবে।

  • তুমিই বল না লক্ষ্মী দিদি। ও তোমার সব কথা শোনে, আমি জানি।

  • তরু, প্রথম কথা – ও আমার কথা শুনবে না আর দ্বিতীয় কথা – তোমার অপারগতা তোমার নিজের মুখেই বলা দরকার। নইলে – এর থেকে আরও বড় অনর্থ ঘটবে পরে।

  • তুমি কি একবার বলে দেখতে পারতে না?

  • বোন, তোমার কি মনে হয় – আমি ইচ্ছা করে তোমাকে কষ্ট দিতে চাইছি? আমি ইতি মধ্যেই এই কথা ওকে বলেছি – এবং সাধ্যমতো মানা করেছি। ও শুনছে না।

  • তোমার কথা শুনছে না, মানে তো হয়েই গেল। ও আর শুনবে না।

  • তা নয় তরু। ও শুনছে না কেন – তার কারণ আছে। কিন্তু তোমাকে তোমার না পারাটা নিজের মুখেই স্পষ্ট ভাবে জানাতে হবে।

  • না শোনার কারণটা কি আমায় বলবে?

  • তরু, সারা বাজারের লোক যখন জানে, আশাকরি তুমিও জানো – খোকন দা’র সাথে আমার ছোটবেলায়  ভাব-ভালোবাসা ছিল।

  • হ্যাঁ! 

  • কে বলেছে? খোকন দা?

  • না, সেভাবে বলেনি, তবে বলেওছে। আমি কানাঘুষোয় শুনেছি। বিয়েটা তো আর কমদিনের হল না – প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেল।

  • বিয়েটা কেন হয়নি জানো কি?

  • না।

  • জানো তো, খোকনদা বারবারই ছিল এরকম  নরম মনের মানুষ! মানুষ জনের থেকে ওর জল কাদাতেই আগ্রহ ছিল বেশী। তবু এসব নিয়েই আমিও ছিলাম – ওদের ফাঁকে ফাঁকে। গাছ-পালা থেকে যখন মুখ তুলতো, তখন যেন অন্তত আমি থাকি – এই ভাবনা নিয়েই আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম। যখন আমাদের ঘুরে বেড়ানোর খবর দুই বাড়ীতে গেল তখন আমার বাবা ওর বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো। তুমি কি জানো, ওর বাবার তখন দু-তিনটে ব্যবসা ছিল?

  • ঠিক জানিনা।

  • এই যে ঘড়ির দোকানটা এখন আছে, এটা ছাড়াও একটা তেলের মিল আর দুটো কাপড়ের দোকান ছিল বাজারে। তখন খোকনদা দের বিরাট রমরমা ছিল।

  • তারপর কী হল?

  • বিয়ের মোটামুটি কথাবার্তাও হয়ে গেল। একটা মোটামুটি দিনও ধার্য হল বছরখানেক বাদে।

  • তাহলে হল না কেন?

  • খোকনদার একটা বোন ছিল জানিস?

  • হ্যাঁ।

  • ওর নাম ছিল রূপা! যেমন ছিল ওর রূপ, তেমনি ছিল ওর স্বভাব। একবার ওর টাইফয়েড না কী  হয়েছিল – তার ভুল চিকিৎসায় হোক – বা অন্য কোনও কারণে ওর মাথা গেল বিগড়ে। খোকনদার বাবা – সারা ভারতের হেন কোনও ডাক্তার বদ্যি নেই যে তার কাছে নিয়ে গিয়ে ওর চিকিৎসা করান নি! খুব শান্ত ধরনের পাগল ছিল ও। চুপচাপ থাকতো-নিজের মনে। বাইরের লোক কেউ বুঝতেও পারতো না ওর পাগলামির কথা! পরে আমি খোকনদার মুখ থেকে শুনেছি বলে জানতে পেরেছি। হঠাৎ করে একদিন খবর এল যে রূপা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে।

  • পাগল যারা, তাদেরও কি মানসিক চাপ থাকে জুঁইদি?

  • মানে?

  • আমি বলতে চাইছি, একটা লোক পাগল হয় কেন? মানসিক চাপ সইতে না পেরেই তো?

  • হ্যাঁ। তার কেটে যায়!

  • তা সেই  লোক আবার আত্মহত্যা করে কী করে? তাহলে নিশ্চই সে পাগল ছিল না!

  • অত কি আর আমরা জানি? লোক বলাবলি করল, কেউ বিষ খাইয়ে মেরে দিয়েছে, কেউ বলল – যে সে আত্মহত্যা করেছে। কোনটা ঠিক, কে জানে?

  • সেই জন্যই কি বিল্টুর বাবার...?

  • কাহিনীটা এখনও শেষ হয়নি তরু। অপঘাতের মড়া। পোস্টমর্টাম হল। সব থেকে চাঞ্চল্যকর যে খবরটা পাওয়া গেল, রূপা চারমাসের পোয়াতি ছিল!

  • তাই নাকি?

  • হ্যাঁ! তারপর থানা-পুলিশের মুখ বন্ধ করতে কয়েক লাখ টাকা বেরিয়ে যায় খোকনদার বাবার। তেলকল, দুটো কাপড়ের দোকান – ওই কারণেই বিক্রি হয়ে যায়।   

  • আর তোমাদের বিয়েটা!

দীর্ঘশ্বাস ফেলল জুঁই। বাবা গোঁ ধরে বসলেন – ও বাড়ীতে বিয়ে দেব না। একে পাগলের বাড়ী, তায় অপঘাত মৃত্যু। রাতারাতি আমার বিয়ে ঠিক হল মসলন্দপুরে। সেও পোড়া কপালে সইল না। বিয়ের চার বছরের মাথায় ফিরে এলাম বাপের বাড়ী। 

  • বিল্টুর বাবা কি এজন্যই পাগলদের জন্য বেশী সহানুভূতিশীল?

  • হয়তো বা। আসলে রূপার সাথে খোকনদার খুব ভাব ছিল। খোকনদা কদিন আগেও বলছিল, ‘জানিস জুঁই, রূপা মরবার আগের দিনটাতে এসে আমার ঘরে বসেছিল।‘ মাথার  ব্যামোটা হবার পর থেকে বিশেষ কথা বলতো না। কিন্তু সেদিন নাকি এসে ওর খাটের উপর বসেছিল, ওর গা মাথায় সুড়সুড়ি দিয়ে দিচ্ছিল। একটু বাদে নাকি ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছিল কিছুক্ষণ। আমাদের সময় এই গ্রামদেশে তো শরীর খারাপ হবার পর থেকে মেয়েরা বড় দাদাদের গায়ে গায়ে জড়াতো না বিশেষ!

  • কে এই কুকর্ম করেছিল দিদি?

  • তা কি আর জানা গেছে ভাই! দ্যাখো সেই কারণেই বিষ টিষ কেউ খাইয়ে দিয়েছিল নাকি!

  • ব্যাপারটা তো বুঝলাম! কিন্তু আমার পক্ষে সারাদিন পাগল সামলানো অসম্ভব ব্যাপার। তুমি কিছু একটা কর, জুঁই দি! 

  • আমি আর কী করতে পারি বলো! দেখি আর একবার বলে।

দিন সাতেক অতিক্রম করেছে। খোকনের মনমেজাজ আজ একদম ভালো নেই। গতকাল থেকে পাগলটাকে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ও বারবার পুকুর ঘাটে, বাজারের বিভিন্ন সম্ভাব্য জায়গায় গিয়ে গিয়ে দেখে আসছে, দু-একবার নান্টুকেও পাঠিয়েছে - কেউ কোনও হদিস দিতে পারছে না। দু-একজন কাষ্টমার এসে বলছে আজ ভোর রাতে নাকি মোক্তারপুরে বাসের তলায় চাপা পড়ে একটা পাগল  মারা গেছে। উত্তর বাজারের মল্লিকদা আবার নতুন গল্প ফাঁদল – ‘জানিস তো, এই পাগলটা আসলে গোয়েন্দা। সেন্ট্রাল থেকে এসেছিল ইনভেস্টিগেশনে। কাল নাকি নিজের চোখে দেখেছে। জুঁই এসে বলল, পাগল ছাগলদের উপর কি কোনও ভরসা আছে খোকনদা। ওরা কি কোনও বাঁধন মানে! হয়ত এখানে শেকড় গাড়ছিল বলেই অন্য কোথাও ঠাঁই গেড়েছে। হয়তো কাছেই কোথাও, হয়তো বা দূরে! সব শুনেও খোকন কিছু বলল না। যদি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে কিছু, তবে বলার কিছু নেই! অন্য আর যাই কারণ ঘটুক, ও কি খোকন কে বলে যেতে পারতো না? তবে কি পাগল ভালোবাসা বোঝে না?

Post a Comment

0 Comments