জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ৪২ /স্বপন কুমার দে

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ৪২


স্বপন কুমার দে

সময় এগিয়ে যায়। চলমান নদীর স্রোতের মতো। তার আদি নেই, অন্ত নেই, আক্ষেপ নেই। সে নিজের চালে, নিজের ছন্দে, নিজের মেজাজে বয়ে চলেছে। তাকে ধরে রাখবার ক্ষমতা কারও নেই, শুধু স্পর্শ করবার উপায়টুকুই আছে। সময়ের চাকায় ঘুরপাক খায় মানুষ।  জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মানুষ এই কালচক্রে ধাবমান। আজ যে শিশু, আগামীকাল সে যুবক, পরে বৃদ্ধ, অন্তিমে অন্তিম শয্যায় শায়িত।মানুষের কীর্তি তার চলার পথে, মানুষের জয় তার কর্মে। তাই তার সম্বল। চলার পথে হাজারও মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ, হাজারও কণ্ঠস্বর, দাবী, চাহিদা, প্রত্যাশা পূরণের লড়াই। সময় বয়ে যায়, থিতু হয় না। মানুষ চলে যায়, রয়ে যায় তার কর্ম।

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ পাল্টায় নিজেকে। তার ক্ষয় হয়, ব্যয় হয়, ব্যাপ্তি হয়, পুষ্টি হয়। পাল্টে যায় চেনা মানুষগুলো। পুরাতন চলে যায়, আসে কত নতুন অতিথি। বিস্মৃতির আড়ালে থাকা পুরাতনের সাথে তুলনা করি নতুনের। কত যুক্তি তর্ক, মান অভিমান পিছনে রয়ে যায়, সরে সরে যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে অভিজ্ঞতা। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ নিজেই তৈরি করে সুরক্ষা বলয়।

মন্টি এখন কলেজে পড়ে, কেমিস্ট্রি অনার্স। তার মায়ের কাজ কিছুটা হলেও কমেছে, কেননা, মন্টি এখন অনেকটাই আত্মসচেতন ও আত্মনির্ভরশীল। অমরেশবাবু ও মণিদীপার বয়সও তিন চার বছর বেড়ে গেছে। তাদের শরীরে রোগ জ্বালার প্রকোপ আরও কিছুটা বেড়েছে। সম্পূরক এখনও সেখানেই কর্মরত এবং অবিবাহিত। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে, তবে আগের তুলনায় কম। তার একক জীবনের অংশীদার হয়ে এখনও কারও প্রবেশ ঘটেনি। সম্পূরক সেটা চায়নি। বাবা মায়ের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সে চিরকাল একা থাকার সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছে। সমুর এই জেদের কাছে হার মেনেছে মা বাবার আবেগ।

রূপসার সংসার সুখের হয়নি। সে এখন তার একমাত্র  ছেলেকে নিয়ে অসীমের থেকে আলাদা থাকে। সম্পূরকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কিন্তু ঐ পর্যন্তই।  সম্পূরক তার কাছ থেকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে।

মল্লিকা এখন একটি কলেজের লেকচারার। এক বছর হল, পুরুলিয়া জেলার এক মফঃস্বল শহরে একটি কলেজে অ্যাপয়েন্টেড। কলেজ সার্ভিস পরীক্ষায় কাউন্সেলিংয়ের সময় সে নিজে এই কলেজটি পছন্দ করেছিল। গ্রামীণ পরিবেশের এইরকম একটি কলেজই সে চেয়েছিল। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার যেদিন হাতে পেল সেদিন মল্লিকার দু'গাল বেয়ে অশ্রু গড়াতে লাগল। লেটার হাতে সোজা ঢুকে গেল বাড়ির ভেতর দু'হাত দিয়ে চেপে ধরল বাবা-মাকে। শক্ত করে ধরে রেখেছে বাবা মায়ের ফটো, সরাতে চাইল না। মনে হল, বাস্তবিক সে তার বাবা-মাকে ধরে আছে, আর তারা তাদের মেয়েকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ এইভাবে থেকে হাত দুটোকে বুকের কাছে এনে জোড় হাত করে বাবা মায়ের দিকে চেয়ে রইল, মনে মনে বলল," তোমরা যেখানেই থাকো আমাকে আশীর্বাদ করো, আমি যেন আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারি। প্রণাম করল তাদের। মনে পড়ল আর একজনের কথা, নিমাইকাকুকে। রক্তসম্পর্কহীন, অনাত্মীয় এই মানুষটি কয়েক বছরের জন্য তার বাবার স্থান দখল করেছিল। তার ভালোবাসা কোনোদিন ভোলার নয়। আজ যদি বেঁচে থাকত, তার কত আনন্দ হত। হয়তো চলে আসত মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। ভাবতে ভাবতে আর একবার কাঁদল মল্লিকা।
কিছুক্ষণ পর মনখারাপ সরিয়ে মল্লিকা ফোন করল প্রফেসর বি এন সিংহকে। তাঁরা খুবই আনন্দিত হয়েছেন মল্লিকার সাফল্যে। স্যারের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে স্যারের স্ত্রী কতক্ষণ কথা বলে গেলেন। বললেন," নতুন জায়গায় যাচ্ছিস, প্রথম প্রথম অনেক অসুবিধা হবে। সেগুলোকে মানিয়ে নিতে হবে। তুই তো এর আগে কোনদিন নতুন পরিবেশে যাসনি। অসুবিধায় পড়লে আমাদের বলবি। তুই কবে যাচ্ছিস? যাবার আগে একবার আমাদের বাড়িতে আয়। আমি তোকে সবকিছু শিখিয়ে দেবো।" মল্লিকা বলেছিল," ঠিক আছে কাকিমা আমি একটু পরে যাচ্ছি।" তারপরই মল্লিকা স্যারের বাড়িতে হাজির হল, প্রণাম করল ওঁদের। ততক্ষণে স্বামীকে দিয়ে আনিয়ে রেখেছেন মল্লিকার জন্য দু'সেট পোশাক,কিছু শুকনো খাবার এবং ব্যবহার করার কিছু জিনিসপত্র। সেগুলো দিয়ে কাকিমার কড়া হুকুম," আমাকে মা বলে ডেকেছিস, কাজেই মা যা বলবে তাই শুনতে হবে। বাইরে যাচ্ছিস, এগুলো দরকার, নিয়ে যাবি। কাল ক'টার ট্রেনে যাচ্ছিস বল, আমরা স্টেশনে থাকবো। তখন এগুলো আমরাই পৌঁছে দেবো।" মল্লিকা কখনও কারো কাছ থেকে কোনও দান নেয়নি কিন্তু এক্ষেত্রে সে 'না' বলার ক্ষমতাটুকু দেখাতে পারল না।

🍂

প্রথম মাসের বেতনের টাকায় পাড়ার ছোট বড় সবাইকে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করল। সকলের সে কী আনন্দ! মল্লিকাকে বিশেষ কিছু করতে হল না, ক্লাবের ছেলেরা বাজার করে আনল, মেয়েরা রান্না করল, বয়স্করা তদারকি করল আর ছোটরা সারাদিন উৎসবের মেজাজে আনন্দ করে গেল। মল্লিকা শুধু খরচটা সামাল দিল। স্যারের বাড়িতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে গেল। এইভাবে আনন্দে আয়োজনে সকলের মধ্যে নিজের খুশিকে ছড়িয়ে দিল মল্লিকা।

কলেজে মল্লিকা আরও বেশি সিনসেয়ার, আরও বেশি ডেডিকেটেড। স্বপ্ন পূরণ শুধুমাত্র চাকরি পাওয়ার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়নি বরং নতুন এক অধ্যায়ের সূচনায় সে উৎসাহী হল। শিক্ষকতা শুধুই একটা চাকরি নয়, এ হল মানুষ গড়ার শক্তিশালী ভরসাস্থল। এ নিয়ত পরিবর্তনশীল ও সংবেদনশীল গতিপথ। প্রতিনিয়ত নিজেকে আবিষ্কার করাই  হল এর ধর্ম। সর্বপ্রথম দরকার আত্মনিয়োগের মানসিকতা। মল্লিকা এখন সে সাধনায় ব্রতী।

সে থাকে কলেজ লাগোয়া টিচার্স কোয়ার্টারে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বলতে একটা খাট, কিছু বইপত্র, দুটো চেয়ার, রান্নার সরঞ্জাম আর একটা টিভি। দু'বেলা নিজেই রান্না করে খায়। বাকি কাজ সে নিজেই করতে পারত কিন্তু সময়ের অভাবে করতে পারে না। একটি মেয়ে বাকি কাজগুলো করে দেয়। মাসিক বেতন ছাড়াও তাকে দু'বেলা না খাইয়ে ছাড়ে না মল্লিকা। মাঝারি উচ্চতার ছিপছিপে গড়ন, বয়স মধ্য চল্লিশ, শরীরে অপুষ্টির কালো ছায়া। নাম- দুখি সিং, ঘরে স্বামী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে। ঠিকে কাজ করে আরও তিনটে বাড়িতে। তাকে দেখে খুব মায়া হয় মল্লিকার। মাঝেমাঝে ছেলেমেয়েদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দেয়। দুখিও দিদিমণির সঙ্গে অল্প সময়ের মধ্যে ভাব জমিয়ে ফেলে। কাজ না থাকলে বসে বসে গল্প করে। কত কথা বলে--নিজের লালমাটির দেশের কথা, গরিব মানুষের কষ্টের কথা। মল্লিকাও কথায় কথায় দুখির ঘরের কথা জিজ্ঞেস করে। বলে," দুখিদি, তোমার ছেলেমেয়েরা কে কোথায় পড়ে? তারা পড়াশোনায় কেমন?" ইত্যাদি।
দুখি উত্তর দেয়। তার কথাতে আঞ্চলিক উপভাষার টান," দিদিমণি, আমাদের ছ্যানাদের আবার লেখাপড়া? ঐ কনও রকম একটু আধটু চলনসই হল্যেই হয়। আমার দুটা বিটি ছেল্যা এইট পর্যন্ত পইড়ে ছাড়্যে দিঁয়েছে। দুটারই বিয়া দিঁয়ে দিঁয়েছি। ছোট বিটি গাঁয়ের ইস্কুলে সিক্সে পড়ে, মিড ডে মিল খাঁইয়ে ঘর চল্যে আসে। ছেল্যাটা ফোরে পড়ে ইস্কুলে যায়।"
মল্লিকা বুঝতে পারল, এরা এখনও শিক্ষার আলো থেকে অনেক দূরে রয়েছে। কষ্ট হল নাবালক নাবালিকা ছেলেমেয়েদের জন্য। মেয়েদের অল্প  বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে আর ছেলেদের শিশু শ্রমিক বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এদের জন্য কিছু করবার আগ্রহে সে অস্থির হল। কিন্তু মল্লিকা বিচক্ষণ মেয়ে। সে জানে, তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। ভেবে চিন্তে পা ফেলতে হবে। মল্লিকা ভাবল, দুখিকে এমনিতে বলে কিছু হবে না, উপর উপর কিছু উপদেশ দিয়ে দায়িত্ব সেরে ফেললে কাজের কাজ কিছু হয় না। তাদের ঐ অবস্থা থেকে বার করতে হবে। ওদের গ্রাম যেতে হবে। তার আগে দুখির মুখ থেকে ওর পরিবার সম্পর্কে জেনে নেওয়া দরকার। একে একে তার ঘরের কথা, স্বামীর কথা,..সব জানতে লাগল।

দুখি আক্ষেপ করে বলতে থাকে," পোড়া মাটির দ্যাশ গো দিদিমণি, হামদের। জমি ত লয়, শুধুই আকাট শক্ত পাথর। সাত তল মাটি খুঁড়লেও এক ফঁটা জল বেরাবেক নাই। কনও বছর বিষ্টি ভাল হল্যে যা টুকু ধান চাষ হয়, বাকি ল্যা আর কিছু নাই। তখন জঙ্গলের কাঠ, পাতা, ফল, মূল কুড়্যাই আন্যে শহরে বিক্কি কইরে যাই হোক কইরে সংসার চলে। হামদের মরদ মানুষটা বিড়ি ফুঁকে আর আকাশের দিকে তাঁকাই বস্যে থাকে।"

মল্লিকা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে দুখির দিকে। এই মাটি, এই পরিবেশ তার অচেনা।
দুখি বলতে থাকে," আগে ত প্যাটই চইলত নি, এখন সরকারি অনুদানে যাই হক দুটা খাত্যে পাই। আমাদের ঘরের ছ্যানাপোনার আবার লেখাপড়া!"
" কেন, সরকারি সাহায্যে মিড ডে মিল খায়নি তোমাদের ছেলেমেয়েরা? বইপত্র তো বিনাপয়সায় দেয়। তাহলে?"
" তাইলে, তার কী দিদিমণি? আমরাই ত অদের শিঁখ্যাই দিছি, পড়াশুনা কইরে কিছু হবেক নাই। দুদিন পরে সেই ত গতর খাঁটাই খাত্যে হবেক। তার চাঁয়ে বরং জঙ্গলে কাঠ পাতা তুলুক, মালিকের জমি চাষ করুক, তাতে লাভ আছে।"

বড় দুঃখ হল মল্লিকার, দুখির কথা শুনে। তাদের বাচ্চাদের কথা ভেবে মনের মধ্যে বেদনার সাথে সাথে কিছু একটা করার ইচ্ছা প্রবল হল। মুখে বলল," দুখিদি, তোমাদের গ্রাম দেখবার আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। এখানকার গ্রাম, মাঠ, রকমারি গাছ, জঙ্গল, পাহাড় আমি দেখতে চাই। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?"
দুখি হেসে বলে," কী যে বল দিদিমণি? হামদের গাঁ কি আর তুমাদের শহরের মতন সুন্দর? ইখ্যানে আর দেখবার কী আছে?"
" তুমি আমাকে নিয়ে যাবে না?"
" নিশ্চই লিয়ে যাব গ দিদিমণি। তুমি যাত্যে চাইছ আর আমি লিয়ে যাত্যে পাইরব নাই? খুব পাইরব। কবে যাবে বল?"
" ঠিক আছে। সে তোমাকে আর একদিন বলবো। এখন তুমি এসো। সন্ধ্যে হয়ে গেল।"
সেদিনের মত দুখি বিদায় হল।

 আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments