সাগরে অগ্নি
দ্বিতীয় পর্ব
সুদেব কুমার ঘোষ
পিতা উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয় তৎকালীন সময়ে ব্যাকরণে রাঢ় বঙ্গে অতি প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। নবদ্বীপের পণ্ডিত শঙ্কর তর্কবাগীশ দ্বারা তিনি প্রশংসায় ভূষিত হয়েছিলেন। দুর্গাদেবী ও তাঁর ছেলে - মেয়েরা পিতার নিকট আসার পর উমাপতি মহাশয় ও তাঁর পুত্র - পুত্রবধূ খুব সমাদরে তাঁদের আপ্যায়ন করেন। কিন্তু কিছুদিন পর শুরু হল গোলমাল। দুর্গাদেবীরা সাতজন। ভরণপোষণের খরচ বাড়ছে। দুর্গাদেবীর দাদা এবং বৌদির সাথে এ নিয়ে প্রায়ই গোল বাঁধে। তাঁরা কেউ চাননি দুর্গাদেবী ও তাঁর ছেলে - মেয়েরা তাঁদের পরিবারে থাকেন। তার উপর দুর্গাদেবীর স্বামী বেপাত্তা। উমাপতি মহাশয়ের বয়স হয়েছে। তিনি সংসারের দায় - দায়িত্ব ছেলের উপর ছেড়ে দিয়েছি লেন। ছেলের সিদ্ধান্তের উপর কথা বলতে পারতেন না। কাজেই দুর্গাদেবী খুবই অসহায় বোধ করতে লাগলেন। অনন্যোপায় দেখে বাবার সংসার থেকে আলাদা হয়ে বাবার দেওয়া জায়গায় ছোটো ঘর করে সাত জন কোনরকমে দিনাতিপাত করতে লাগলেন। তখন ওই অঞ্চলে একাকী বসবাসকারী কিছু স্ত্রীলোক টেকুয়া ও চরকায় সুতা কেটে , সেই সুতা বাজারে বিক্রি করে দিন গুজরান করতেন। অসহায় দুর্গাদেবী সেই বৃত্তি অবলম্বন করলেন। কিন্তু এই বৃত্তি দ্বারা একজনের সংসার ভালো করে চলত। কিন্তু তার দ্বারা সাত জনের ভরণপোষণ অসম্ভব ছিল। তাঁর পিতা সময়ে সময়ে যথাসম্ভব সাহায্য করতেন। কিন্তু তাতে অভাব আর দারিদ্র্য ঘুচত না।
🍂
অভাবের মধ্যেই মানুষ হতে হতে ঠাকুরদাসের বয়স চোদ্দ - পনের বছর হল। এই বয়সে তাঁর আরো পড়াশোনা করার কথা। কিন্তু অভাবের তাড়নায় তিনি মায়ের অনুমতি নিয়ে কাজের সন্ধানে কোলকাতায় গমন করলেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি এই এলাকার কিছু লোক কাজের সূত্রে কোলকাতায় বসবাস করতেন। ঠাকুরদাস মহাশয়দের এক সন্নিহিত জ্ঞাতি সভারাম বাচস্পতি কোলকাতায় বসবাস করতেন। তাঁর পুত্র জগন্মোহন ন্যায়ালঙ্কার ঠাকুরদাস মহাশয়কে আশ্রয় দিলেন। ঠিক হল তাঁর কাছে ঠাকুরদাস সংস্কৃত বিদ্যা অনুশীলন করবেন। বাল্যকালে ঠাকুরদাস কিছুটা ব্যাকরণ শিখেছিলেন। তাঁরও ইচ্ছা হল ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়ের কাছে ভালো করে সংস্কৃত শিখবেন। কিন্তু সেই সময় কেবল সংস্কৃত পাঠ করলে কোলকাতায় ইংরেজদের অফিসে চাকরী পাওয়া খুব দুঃসাধ্য ছিল। অথচ তাঁর চাকরী পাওয়া খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। মা ও ভাই - বোনেদের কথা চিন্তা করে চাকরির নিমিত্ত ইংরেজি পড়া অধিকতর শ্রেয় মনে করলেন। অতঃপর ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়ের পরিচিত এক ব্যক্তির নিকট ইংরেজী শিক্ষা আরম্ভ করলেন। দিবা ভাগে ইংরেজীর স্যার চাকরী করতেন। সান্ধ্যকালীন সময়ে ঠাকুরদাসকে ইংরেজী পড়াতে শুরু করলেন। কিন্তু এই কার্যক্রমে এক নতুন গোল বাধল। ঠাকুরদাস ইংরেজী পড়ে যখন ন্যায়ালঙ্কার মহাশয়ের বাড়িতে আসতেন তখন রাত্রের খাবার থাকতনা। কারণ সেখানে অনেকগুলি লোক খাওয়া - দাওয়া করত। ঠাকুরদাসকে আহার না করেই রাত্রি যাপন করতে হত। এতে শরীর আরো শীর্ণ ও কাহিল হয়ে পড়ল। ঠাকুর দাসের এহেন শরীর ইংরেজী স্যারের দৃষ্টি এড়াল না। তিনি শরীরের এই অবস্থার কারণ জানতে গেলে ঠাকুরদাস সবিশেষ বর্ণনা করলেন। তথায় এক শুদ্র জাতীয় ব্যক্তি ( নামের উল্লেখ নেই ) উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঠাকুর দাসের কাহিনী শুনে ন্যায়ালঙ্কারের বাড়িতে আর থাকা সমীচীন নয় বলে মনে করলেন এবং ঠাকুর দাস যদি নিজ হস্তে রেঁধে খেতে পারেন তাহলে তিনি তাঁকে আশ্রয় দিতে পারেন। ঠাকুরদাস এই প্রস্তাবে রাজী হলেন। সেখানে ঠাকুর দাসের থাকা - খাওয়ার বন্দোবস্ত হল এবং ইংরেজী পড়া চলতে লাগল। কিন্তু এখানেও সমস্যার উদয় হল। ভদ্রলোক সদাশয় ও দয়ালু ব্যক্তি ছিলেন। দালালি ব্যবসা করে সামান্য উপার্জন করতেন। কিন্তু তাসত্ত্বেও ঠাকুর দাসকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বর্তমানে এই ধরনের ব্যক্তি পাওয়া খুব দুর্লভ। ভদ্রলোকের দালালি ব্যবসার ঘাটতি দেখা দিলে আবার ঠাকুরদাসকে অন্নাভাবের মুখে পড়তে হল। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছিল যে ঠাকুরদাস ভাত খাওয়ার থালা এবং জল খাবার ঘটি পর্যন্ত বিক্রি করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু পুরানো থালা ও ঘটি কেহই কিনতে সম্মত হলনা। কারণ চোরাই মালের ভয়। ঠাকুরদাস আবার সেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে লাগলেন। জল খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। এই সময় ঘটল সেই বিখ্যাত ঘটনা। যে ঘটনা থেকে নারী জাতির প্রতি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শ্রদ্ধা, ভক্তি , করুণা অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল যা তিনি নিজেই স্বীকার করে গেছেন। পরবর্তী কালে আমরা তাঁর কর্মকাণ্ডেও দেখতে পাই। বস্তুত ঠাকুর দাস এক দোকানে জল খেতে চাইলে , দোকানের মালকিন তাঁকে দই মুড়কি সহকারে ফলার করাইয়া ছিলেন। কেবল সেইদিন নয় যেদিন ঠাকুরদাসের খাওয়া জুটত না সেদিনও তাঁকে খাওয়াতেন। এই ঘটনা থেকে বিদ্যাসাগর মহাশয় মন্তব্য করেছিলেন " এই দোকানের মালিক , পুরুষ হইলে, ঠাকুরদাসের উপর কখনই , এরূপ দয়াপ্রকাশ ও বাৎসল্যপ্রদর্শন করিতেন না। "
কিছুদিন পরে ঠাকুর দাসের মাসিক দুই টাকা বেতনের চাকরী জুটল। পুরো টাকাই মায়ের নিকট পাঠাতেন। পরে তাঁর বেতন মাসিক পাঁচ টাকা হল। ঠাকুর দাসের মায়ের আনন্দ বেড়ে গেল। কারণ তাঁর সংসারের অভাব কিছুটা দুর হল। দীর্ঘ সাত - আট বৎসর পর এই সময় রামজয় তর্কভূষণ মহাশয় বীরসিংহ গ্রামে ফিরে এলেন। সংসারে আনন্দের মাত্রা আরো যোগ হল। পাঠককুলের মনে হতে পারে রামজয় তর্কভূষণ সংসারের সংকট কালে স্ত্রী - পুত্র - কন্যাদের ছেড়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় যিনি এই জীবন চরিত লিখেছিলেন তিনি কখনোই তাঁর দাদা মহাশয়কে দোষী সাব্যস্ত করেননি। বরং তাঁকে একজন সৎ , সাহসী , দৃঢ় , স্পষ্টভাষী , অমায়িক , ও নিরহঙ্কার ব্যক্তি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি , যাঁদের আচরণে ভদ্র ব্যবহার দেখতেন , তাঁদেরকে প্রকৃত ভদ্র বিবেচনা করতেন। যাঁদের আচরণ অভদ্র মনে করতেন তাঁরা শিক্ষিত বা পণ্ডিত হলেও তাঁদেরকে ভদ্র বলে মনে করতেন না। বীরসিংহ গ্রামে তাঁর শ্যালক রামসুন্দর বিদ্যাভূষণের সাথে বনিবনা হতনা। রামসুন্দর উদ্ধত , অহঙ্কারী , স্বার্থপর ও পরশ্রীকাতর ব্যক্তি ছিলেন। তিনি গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মনে করতেন তাঁর ভগ্নিপতি যেন তাঁর অনুগত হয়ে থাকেন। এজন্য তিনি রামজয়কে ভীতি প্রদর্শন করাইতেন তথাপি তাঁকে দমাতে পারতেন না। এইরূপ দৃঢ়চেতা ব্যক্তি তিনি ছিলেন। এই সব গুন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চরিত্রে প্রতিভাত হয়েছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মক্ষণে এই দাদামশাই কিন্তু নাতিকে এঁড়ে বাছুরের সাথে তুলনা করেছিলেন। যথার্থই তাঁর মূল্যায়ন। রতনেই রতন চেনে।
0 Comments