জ্বলদর্চি

গীতা মুখোপাধ্যায় (রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তমলুক)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৩৪
গীতা মুখোপাধ্যায় (রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি

তিনি ছিলেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ। বিশেষ করে আর্ত মহিলাদের জন্য তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর মতো লড়াকু বামপন্থী নেত্রী খুব কমই আছে। ২০০০ সালের ৪ ঠা মার্চ হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মরত অবস্থায় যখন পাঁশকুড়ার সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়, তখন তাঁর মৃত্যুর পর তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে স্মরণ করে বলেছিলেন, "Mrs. Mukherjee embodied determination and dedication. She was a shining example of women's empowerment. Her life shall remain an inspiration for future generations, especially women"। 
বিভিন্ন সময়ে সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়

মেদিনীপুরের অন্যতম লড়াকু বামপন্থী নেত্রী গীতা মুখোপাধ্যায় কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৪ এর ৮ জানুয়ারি। সেই হিসেবে আজ থেকে শতবর্ষ আগে। মেদিনীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ না করেও মেদিনীপুরকে তিনি আত্মীকরণ করেছিলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। নিজের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে গিয়েছিলেন মেদিনীপুরের বাসিন্দাদের জন্য। প্রথমে বিধায়িকা হিসেবে, পরবর্তীতে সাংসদ হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ড ভোলেনি মেদিনীপুরের মানুষ। 

গীতা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম মেদিনীপুরের বুকে না হলেও আদ্যোপান্ত তিনি মেদিনীপুরের মানুষ। এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামী সুশীল কুমার ধাড়া উল্লেখ করেছেন, 'কলিকাতা তাঁর জন্মস্থান। তিনি তমলুকের বৌ। তাই হয়তো মেদিনীপুরের একটি অংশ যা তমলুকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁকে বারে বারে সাংসদ সদস্যা হিসাবে গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করেনি। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার শিক্ষা তাঁর রাজনৈতিক ধর্ম' হলেও তাঁর মতো একান্ত হতে পারেননি এমন বহু নেতার পরিচয় আমার জানা আছে। সেদিক থেকে গীতাদেবী ভিন্ন মানুষ। তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই বৃহৎ পরিবারের বহু সদস্য এবং কৃতি মানুষ, যাঁরা তাঁকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা ও স্নেহ করতেন'। 

রাজনীতির আবর্তে আবালবৃদ্ধবণিতার কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন 'গীতাদি' নামেই। সুশীল কুমার ধাড়া লিখেছেন, "কয়েক স্থানে লক্ষ্য করেছি একই পরিবারের ঠাকুরদা, বাবা এবং নাতি নাতনী সকলেই ডাকে 'গীতাদি' এই প্রিয় নামে। গীতার জনপ্রিয়তার এটা একটা উজ্জ্বল তারকা চিহ্ন"। আর এক বিখ্যাত ব্যক্তি হরশঙ্কর মণ্ডল গীতা মুখোপাধ্যায় তথা 'গীতাদি' সম্পর্ক নিয়ে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, "গীতাদি অল্পদিনে তমলুক মহকুমার অর্থাৎ এখন তমলুক ও হলদিয়া মহকুমার কেবল মেয়েদের কাজে নয় ছেলেদের কাছেও দিদি বলে পরিচত হন। তিনি মানুষের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আজকের সাথী হয়ে উঠলেন। পরে তিনি পাঁশকুড়া অঞ্চলের নেত্রী হয়ে এম এল এ, এম পি বহুবার হয়েছেন। সেদিকে আমি যাচ্ছি না। আমি সত্যই তাঁর কাছাকাছি হতে পেরেছি ১৯৬৬ সাল হতে। বিশ্বনাথদার কাছে যেমন আমরা পেরেছি আত্মত্যাগ, দৃঢ়তা, সংগ্রাম, সংগঠন, ভালবাসা, তেমনি গীতাদির কাছে পেয়েছি অফুরন্ত স্নেহ, দলের মধ্যে মেয়েদের স্থান, মেয়েদের সঙ্গে চলতে গেলে কি ভাবে তাঁদের সঙ্গে চলতে হয় তার পথনির্দেশ প্রভৃতি। অনেকের অনেক সমস্যা নিয়ে গীতাদিকে বলতে গিয়েছি, কাছে গিয়েও বলতে পারিনি। মনে হয়েছে এই সামান্য সমস্যার কথা না তোলাই ভাল। অনেক বড় বড় সমস্যা ও চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তাই বোধ হয় পারিনি। বিশ্বনাথদা ও গীতাদি এঁরা এতো লোকজনের নাম দীর্ঘদিন মনে রাখতেন কিভাবে, তা ভেবে উঠতে পারতাম না। মানুষ চিনতে এঁদের জোড় মিলতোনা। এঁরা সহজেই সঠিক মানুষ বেছে ফেলতে পারতেন"। 

১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত গীতা মুখোপাধ্যায় ছিলেন পূর্ব পাঁশকুড়া বিধানসভা আসনের চার বারের বিধায়ক। ১৯৬৭ সালের পর ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে রজনীকান্ত প্রামাণিকের পর তিনি বিধায়ক হন। তাঁর পরে ১৯৭৭ সালে এখানে বিধায়ক হন স্বদেশ রঞ্জন মাজি। বিধায়কের পর সাংসদ হন এই লড়াকু নেত্রী। এরপর ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পাঁশকুড়া লোকসভা কেন্দ্রে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার সাতবারের টানা নির্বাচিত সাংসদ। তাঁর আগে ১৯৭৭ এ এই আসনে সাংসদ ছিলেন আভা মাইতি। তাঁর পরে ২০০০ সালে সাংসদ হন তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্রম সরকার। গীতা মুখোপাধ্যায় ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৮৯, ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হন পাঁশকুড়া লোকসভা কেন্দ্রে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পাঁশকুড়া লোকসভার সাংসদ ছিলেন তিনি। 

১৯৮০ সালে প্রথম তিনি সপ্তম লোকসভায় সাংসদ নির্বাচিত হন। এই পদের মেয়াদ ছিল ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। এসময় তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। তিনি কমিটি অন পাবলিক আন্ডারটেকিংসের সদস্য পদ লাভ করেন। কমিটি অন দ্য ওয়েলফেয়ার অফ সিডিউল্ড কাস্টস অ্যান্ড সিডিউল্ড ট্রাইবসের সদস্য ছিলেন। জয়েন্ট কমিটি অন ক্রিমিনাল ল (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ১৯৮০ এর সদস্য ছিলেন তিনি। 

হরশঙ্কর মণ্ডল গীতা মুখোপাধ্যায়ের বামপন্থী ঘরানার রাজনৈতিক জীবনের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, "১৯৬৭ সাল যুক্তফ্রন্ট প্রবল প্রতাপশালী শক্তিশালী মন্ত্রী সভা। বাম নেতারা যাঁরা মন্ত্রী ছিলেন তাঁরা সবাই এক এক এক জন দিকপাল সাধক। সেই জমানাতে গীতাদি তাঁর নিত্য কর্মসহ সমাজ বদলের লড়াই এর একজন অন্যতম যোদ্ধা হিসাবে জেলায় নয়, রাজ্যে নয়, সারা ভারতের বাম রাজনীতিতে একজন প্রতিষ্ঠিত নেত্রী হিসেবে স্থান করে নিয়েছিলেন। লক্ষ্যের বিষয়, উন্নতির শিখরে উঠেও তিনি নীচুতলার কথা, গরিব মানুষের কথা, মেয়েদের জ্বালা যন্ত্রনার কথা কোনোদিন ভুলে যাননি। এটাই গীতাদির মহত্ব বলে আমি মনে করি"। 
বিপ্লবের পথে গীতা মুখোপাধ্যায়

১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) বঙ্গ রাজ্য পরিষদের প্রথম সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি সি পি আই দলের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। গীতা মুখোপাধ্যায় একসময় সি পি আইয়ের ভারতীয় মহিলা জাতীয় ফেডারেশনের সভাপতিও ছিলেন। ভারতে সংসদীয় নির্বাচনে মহিলাদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের আইনের দাবিতে তাঁর আন্দোলন ছিল নজরকাড়া। সেসময় এই দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কমরেড গীতা মুখোপাধ্যায়। আজও তাঁর সেই লড়াইকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে সকলেই। 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ কলেজ থেকে তাঁর বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। ১৯৪২ সালের ৮ ই নভেম্বর বিয়ে করেন কমিউনিস্ট পার্টির বিখ্যাত নেতৃত্ব তমলুকের বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়কে। ৪৯ বছরের দীর্ঘ দাম্পত্য কাটিয়ে ১৯৯১ সালে মৃত্যু হয় কমরেড বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের। সেসময়েও শোকে দুঃখে মুহ্যমান না হয়ে নিজেকে সংযত রেখে তাঁর প্রিয় কমরেডদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

লেখিকা হিসেবেও গীতা মুখোপাধ্যায় ছিলেন অনন্য। তিনি শিশুদের জন্যে বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন বেশ কিছু ব ই। ছোটোদের রবীন্দ্রনাথ (শিশুদের জন্য রবীন্দ্রনাথ), ভারত উপকথা (ভারতের লোকগাথা) এবং হে অতীত কথা কও তাঁর লেখা অন্যতম বই। তিনি বাঙালি পাঠকদের কথা ভেবে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন ব্রুনো অ্যাপিৎজের বই 'নেকেড অ্যামং উলভস' (১৯৫৮)।

🍂

Post a Comment

0 Comments