জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন /পর্ব -২৯/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

ভাঙা আয়নার মন 

 পর্ব -২৯
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া 

|| আমার অনেকখানি কুয়াশা আর মেঘ...||


         বাঁধন হারা জলধারার কলরোলে...বর্ষার বিকেলে গানের দিদিমনির কাছে গান তুলছিল ঝিনি।সাইকেল ঠেঙিয়ে ধ্রুব রায় সেখানে হাজির।মীরাদিও হেসে বলল আয় ধ্রুব,বোস। বসব তো বটেই কিন্তু তোমার ছাত্রীর গান থেমে গেল যে। বোস দিকি তুই।মীরাদি ব্যস্ত হয়ে ধ্রুবদার চা বলতে ভেতরে গেল। সেদিন যে এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলো গাইছিলে ওটা একটু শোনাও তো ঝিনুক।
      আমার অংক স্যার আসবেন। হারমোনিয়ামের ডালাটা ঠাস করে বন্ধ করে ঝিনি উঠে দাঁড়ায়।ঝিনির দিকে তাকিয়ে ধ্রুবদা  আস্তে আস্তে বলে "আমার অনেকখানি কুয়াশা আর মেঘ/ অনেক বার সূর্য ডুবে যাওয়া/তোমার কাছ থেকে যাবার সময় তাই/ব্যথাকে বলি সঙ্গে চলো..." অন্য দিকে ফিরে  না শোনার ভান করে ঝিনি গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
       ওকি রে‌।এর মধ্যে উঠলি যে? মীরাদি ফিরে এসেছে ততক্ষণে।ভুলে গেছিলাম দিদি, অংকের জন্য পরেশবাবু স্যার আজ চারটেয় এসে যাবেন বলেছিলেন। কক্ষনো আর এরকম হবে না দিদি। আজকে তাইলে যাই দিদি,যাব? আচ্ছা যা। বিলম্বিত ভূপালি প্রাকটিস করবি আর পরের সপ্তায় তবলার সাথে বসতে হবে কিন্তু।আচ্ছা দিদি
 করব ঠিক করে বলতে বলতে তাড়াহুড়ো করে ঝিনি মীরাদিদের বারান্দা আর রোদ লাগা তিনটে সিঁড়ি পেরিয়ে বাড়িমুখো হলো।
       ওদিকে বাস ভাড়া বাড়ার দরুন তাদের  এস বি এস এর আন্দোলনে  গাঁ গেরাম এলাকায় ছাত্রদের সঙ্গে বড়দের মধ্যেও কিছু মানুষ সাড়া দিয়ে দুম করে একদিন বনধ আর একদিন  বাস বয়কটের ডাকে খানিক সাড়াও ফেলল সেবার। কাজেই ছাত্রদের জন্য ভাড়া বাড়ল না আর সাধারণ যাত্রীদের ভাড়া দশ পয়সা বাড়ানো হল। 
      এইটুকু সাফল্যেই তাদের মুকুল ক্লাবের দাদারা খুব উত্তেজিত দেখে ঝিনিরাও কম লাফালো না। মেডিকেল কলেজের পড়াশুনোর ফাঁকে এখনও রেগুলার সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরে দাদারা।তাদের মুকুল ক্লাবের জরুরি মিটিং বসে তখন। মিটিংয়েই একদিন তুমুল চেঁচামেচি সহযোগে এস বি এস এ সংগঠনের নতুন নাম হলো অল বেঙ্গল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন এবং সেই এ বি এস এ থেকে কিছু ছাত্র এসে তাদের মুকুল ক্লাবেও ঢুকল।   
     বাড়ির পারমিশন নিয়ে রোববার দেখে একদিন বিকেলে বিকেল  ঝিনিদের বাড়ি এসে কণা আর কলি থেকে গেছিল একসাথে অংক প্রাকটিস দেবে বলে।  পড়াশুনা মাথায় থাক  থেকে থেকে তাদের হা হা হি হি টাই  চলছিল খুব।
         সাড়ে নটা নাগাদ মা তাদের খেতে ডাকল। ওরা এসেছে বলেই মা দু এক পদ ভালো রান্না করেছে আজ। কলা পাতায় পেঁয়াজ ,মুলো, কুমড়ো আলু ঝিরিঝিরি করে কেটে চুনো মাছ আর বাটা মশলা কাঁচা সর্ষের তেলে মেখে চচ্চড়ি আর চিংড়ি বেটে নারকেল দিয়ে কলাপাতায় মুড়ে নোনা চিংড়ি পিঠা বানিয়েছে মা।কলি আর কণা বরিশালের এসব রান্না খায়নি কোনোদিন তবু নারকেল কুচি দেওয়া মুগডালের সাথে এমন সুস্বাদের খাবার সত্ত্বেও ঘাড় গুঁজে ওরা হুঁ হাঁ করে কোনো রকমে খেয়ে উঠল কারণ বড়দিকে দুজনেই ওরা  বেজায় ভয় খায়।
         তা ভেবে দেখলে ভয় লাগার কথাও।ঝিনি খেয়াল করেছে ইস্কুলে মা 'র গলা দিয়ে সত্যিই কি র'ম যেন বেঘো আওয়াজ বেরোয়! চটপট খেয়ে আঁচিয়ে দোতলার ঘরে এসে বেচারারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আর কি।
        পরীক্ষা শুরু হয়েছে বলে দাদারাও আসতে পারছে না। একদিকে ভালোই হয়েছে একসাথে লেখাপড়ার জন্য ঝিনিরা আজ দাদাদের দোতলার নিরিবিলি ঘরখানার দখল নিয়েছে। রাত দুটো নাগাদ দুত্তোর!যথেষ্ট হয়েছে বলে ছাদে এসে দাঁড়ালো কণা আর ঝিনি। পেন কম্পাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে জ্যামিতির এক্সট্রা কষবার খাতায় মাথা রেখে কলি তখন ঘুমের সাত হাত তলে।
     একটা কথা বল দিকি ঝিনি,লেখাপড়া আগে না দাদাদের কথামতো এইসব আন্দোলন টন আগে? অবশ্যই  আন্দোলন! কণার প্রশ্নের তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল সে। ভুরু কুঁচকে বলল তোর কোনো সন্দেহ আছে নাকি?ভেবে দ্যাখ ওটা হলো দেশের জন্য কাজ, মানুষের ভালোর জন্য কাজ!ঝিনি বক্তৃতার ঢঙে দুহাত বুকে আড়াআড়ি করে রেখে যতটা সম্ভব গম্ভীর হয়ে বলছিল।তা তো ঠিক।কণাও সায় দেয়।
       আজকের গানটার কথাই ভাব দেখি।অশোকনগর থেকে আসা বাবুনিদার বিকেলে শেখানো ...আমার প্রতি নিঃশ্বাসের বিষে/বিশ্বের বঞ্চনার ভাষা/দারুণ বিস্ফোরণ যেন /ধ্বংসের গর্জনে হানে তীক্ষ্ণ  গলায় সে গেয়ে উঠলে উত্তেজিত কণা তক্ষুণি তার সঙ্গে গলা মেলায় আমারই রক্ত ঝরে দেশে দেশে বন্দরে /শত মরু কন্দরে গৌরী শিখায়/মিলনের তীর্থের সন্ধানে...!
        মানুষের সত্যিকার দুঃখকষ্ট জানাই হয়নি তবু দাদাদের শেখানো কবিতা ও গণসঙ্গীতের ভাষা তাদের কিশোর বুকে আকাশ গঙ্গার ঢেউ তোলে। মনে হয় বড়দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব অন্যায়ের নিকেশ করেই ছাড়বে তারা এবং পেয়েও যাবে একদিন বন্ধ কোনো দরোজার লুকোনো চাবি।
          গোপন মিটিং এ  ঝিনি শুনেছে দাদারা চায় খুব ছোট থেকেই যতজন ছেলেমেয়ে পাওয়া যায় তাদের ছড়া,নাচ, গান দিয়ে শুরু করে স্পষ্ট রাজনৈতিক চেতনা তৈরি করে দিতে।   
      তাদের বাবার চিনিয়ে দেওয়া তারা দেখিয়ে ঝিনি বলে,একটা কাজ করি চ'? ওই যে দ্যাখ ওইইই যে ওইটা হলো ধ্রুবতারা।আগের কালে ওকে দেখেই জাহাজের নাবিকরা সমুদ্রে দিক ঠিক করত।শুনিসনি নিয্যস সত্যি কথাকে লোকে ধ্রুব সত্যি বলে।চল আজ ওই তারাটা সাক্ষী মেনে আমরা বলি আগে মানুষের কাজ করব তারপর অন্য কিছু। কিভাবে কী কাজ তাদের করতে হবে তা জানে না এবং ধ্রুব শব্দের সঙ্গে ঝিনির অন্তরে অন্য কোনো আবেগ লেগে রইল কিনা  তাও তার ঠাওর হলো না  কেবল দাদাদের কথায়  না বুঝেই ভেতরে যে ছটফটানি তৈরি হচ্ছে তার একটা দিগদিশা অন্ধকার হাতড়ে তারা বের করে ফেলতে চায়। তারাভরা আকাশের তলায় রোগা দুই ক্লাস নাইন  গভীর  বিশ্বাসে সুর বেঁধে গাইছিল  আনে মুক্তি আলো আনে/আনে লক্ষ শত প্রাণে/শত লক্ষ কোটি প্রাণে...।
         কদিন আগেই কী ওরা করে তা জানতে ছোড়দার সাথে অনেক ঝুলোঝুলি করে অহনাদির বাড়িতে রাতে খাবার নেমন্তন্ন বলে টলে মা'র মত আদায় করে দুই দাদার সঙ্গে সেও ওদের স্টাডি সার্কেলে গেছিল  ; যদিও দ্বন্দমূলক দিয়ে কী হয় আর বস্তুবাদ কী জিনিস না বুঝেই ঝিনি হাঁ করে ওদের বই পড়া আর খটোমটো আলোচনা শুনে টুনে আলুভাতে আর ডিমভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত করে ফেলল। দানি বলল আজ কপালে দুঃখু আছে; বোঝার ওপর শাকের আঁটি এই অকম্মাটাকে কেন যে আনলি । মোটেও আমি শাকের আঁটি ফাটি না। খুব জোরে ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ঝিনি ফোঁস ফোঁস করলেও মা'র হাতে মার খেতে যে হবেই এ নিয়ে সন্দেহই নেই।ভয় নেই, দোতলার ছাদের গেটের চাবি নিয়েই বেরিয়েছি।
      মাস্টার পাড়ার ভেতর দিয়ে শর্টকাটে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ছোড়দা খিকখিক করে হাসল‌।ও দিয়ে কি আর মা'র বকুনি আটকানো যায় রে পাগলা। তাছাড়া নেংটি ইদুরটা তো মার খাবেই ওই সাথে আমাদের পিঠগুলোও কি ছাড় পাবে বলে মনে হয়? কলেজে পড়ি বলে মা রেয়াত করবে বলে তো মনে হয় না রে।নির্লিপ্ত হতাশায় দানি রেগুলার দার্শনিক হয়ে উঠছে যদিও তিনজনের কেউই দৌড় থামায়নি। এবং ততক্ষনে অবধারিত পাঁচিলের গেটেও তালা পড়ে গেছে।রাত ন'টার মধ্যে ফেরার কথা তাদের আর এখন বাজে এগারোটা দশ। পাঁচিল টপকানো তাদের কাছে আহামরি কিছু না কিন্তু বারান্দার গ্ৰিল গেটে দু'খানা তালা!
      ঘাবড়ানোর কিছু নেই।ওইজন্যই তো দোতলার গেটের চাবি নিয়ে গেছি। কিন্তু গোঁদের ওপর এই বিষফোঁড়াটা কি পাইপ বেয়ে ছাদে উঠতে পারে? আমায় বিষ ফোঁড়া বললি কেন? অন্ধকারেই খামচে দিল সে দানির হাতে। আহ্! চাদ্দিকে সমূহ বিপদ  এখন কি নিজেদের মধ্যে মারামারি করার সময় কমরেড? ছোড়দা খ্যাসখ্যাস করে হাসল। ঝিনি উঠে পড়‌। কোথায় উঠব? কেন পাইপ বেয়ে ছাদে। ছাদে একবার উঠে গেলেই তো ওয়া গুরুজী কি ফতে!
     আমি পাইপ বাইতে পারব না! সাফ জানিয়ে দিল ঝিনি।আহ্লাদ! পারব না বললেই হলো।খেজুর গাছ বাইতে পারে আর পাইপ বাইতে পারবেন না! ঢ্যাঁড়স কোথাকারে!রাত দুপুরে কে তোমার জন্য সদর খুলে রাখবে শুনি?সন্ধের ট্রেন থেকে নেমে ইস্তক অনেক হ্যাপা গেছে বড় বড় হাই তুলে ছোড়দা বলল,ঘুম পাচ্ছে খুব।ছাদে উঠে  চাবি দিয়ে গেট খুলে দোতলার ঘরে শুয়ে পড়ব কতক্ষণে তাই ভাবছি,মা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে তুই  মা'র খাটে আস্তে আস্তে গিয়ে শুয়ে পড়বি খবরদার  ঘুম না ভাঙে যেন! দানি আগে উঠে হাত বাড়ালো আর তলায় ছোড়দা তাকে ঠেলে দিয়ে  আধো অন্ধকারে হাত নেড়ে ফিসফিসিয়ে উৎসাহ দিতে লাগল। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে সে পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে  বলে উঠল ফতে!চোপ!পা টিপে টিপে গিয়ে শুয়ে পড় হতচ্ছাড়া। মা জাগলে ডাবল পিটুনি আছে তোর কপালে দানি চাপা গলায় হুঙ্কার দিল।
        করিম ভাইয়ের পা ফোলে প্রায়ই। দাদাদের কথা মতো সে গেছিল রক্ত পরীক্ষা করাতে হাসপাতালে। একটা লোক তাকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে আউটডোরের বদলে কাকে একটা দেখিয়ে বাইরে থেকে টেস্ট করিয়ে নিয়েছে। বাগানে কাজ করে করিম ভাই। ছাগল বেচে ক'টা টাকা নে গেলাম এই শীতির কালে একখান ল্যাপ বানাবো  ভেবিই বকরিডা বিককির করিলাম।তা টাকাগুন তো সব নে নেলে! পা'র ফোলাও তো কিছু কমতিছ না ঘাস নিড়োতে নিড়োতে দুঃখ করছিল করিমভাই।গেরামের সবাই বলে তাদের মহাকুমা শহরে হাসপাতালের অবস্থা খুব খারাপ। দালালরা গেরাম থেকে আসা হাড় হাভাতে রুগি আর তার বাড়ির লোকদের লুঙ্গি ঝেড়ে শেষ পয়সাটুকুও নিয়ে নেয় চিকিচ্ছের নামে।
       একদিন তাই এস বি এস এ- র ছেলে মেয়েরা হাসপাতালের সামনে হাতে লেখা পোস্টার আর ফেস্টুন নিয়ে বিক্ষোভ জানাতে গেলে চিমড়েপানা এক পুলিশ পুরনো বন্দুকখানা হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে  খৈনি ডলছিল। পকেট চাপড়ে আর একজন ফস করে বিড়ি ধরাতেই ঝিনি পাশে দাঁড়ানো তুষারদাকে ঠেলা দিয়ে বলল অ তুষারদা পুলিশ দ্যাখ না বিড়ি খায়!শ্রীনিবাসদা বলল, আবার খৈনিও নাকি ডলে!তারা গুজগুজ করে হাসাহাসি করছে দেখে কটমটিয়ে তাকালো পুলিশটা।কে আবার ফস করে বলল ওর বন্দুক ফোটে না।তিলকদা বলল আশ্চর্য!বন্দুক কি মিয়োনো কালি পটকা না দোদমা যে ফুটবে? গোলাপও হতে পারে। মিতুর গলা শোনা গেল ভিড়ের মধ্যে। হাসপাতালের সুপারকে ডেপুটেশনের  নামে একখানা কাগজ জমা দিল দাদারা।কিছুই হলো না তবু কী এক উৎসাহে টগবগিয়ে তারা মাটির খুরিতে বড়দের মতো চা খেয়ে বাড়ির জন্য বাসে চড়লো বিকেল পেরিয়ে।
        ক্লাব থেকে যে মনিমেলার আসর হয় প্রতি রোববার করে তার রেজিস্ট্রেশন করে এনেছে দানি। তার ওপর রুহুল আমিন ভাই আর কেউপুষ্প অশোক নগর থেকে সাতদিনের ট্রেনিং নিয়ে এসেছে মনিমেলার।এইট থেকে টেন অবধি কিছু মেয়ের সঙ্গে দল বেঁধে ঝিনিরাও ইস্কুলের গরমের ছুটিতে দশ দিনের ব্রতচারী ক্যাম্পে গেছিলো কাজেই সেসব মিলে জুলে মহা উৎসাহে তাদের মনিমেলা চলছে।
     রুহুল আমিন ভাই আর পুষু মিলে সেদিন  যারা খাবে বেগুনি/বসে পড়ো এখুনি বলে ছড়ার সঙ্গে হাত পা নাড়ানো শেখাচ্ছিল ছোটদের। বাচ্চাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দানি, ছোট বুলাদা ঝিনি বুলিরাও ওই ভঙ্গিতে হাত পা নাড়ছিল। 
দেখো এক কড়াই তেলে/কেমন বেগুনিটা দোলে বলতে বলতে কোমর দুলিয়ে দানি ফিসফিস করছিল বেজায় হাসি পাচ্ছে কিন্তু বুলা।দুলে দুলে বেগুনিটা লাল হলো ফুলে... মোটেও হাসবি না কিন্তু দানি;লাফিয়ে লাফিয়ে দুহাতে ফোলা বেগুনির মস্ত আকার দেখাতে দেখাতে ঝিনিও ফিসফিস করে। এখন পয়সা আমায় দিলে আমি বেগুনি দিই তুলে... পেটের ভেতর দিয়ে হাসি যে সোডা ওয়াটারের মতো ভসভসিয়ে উঠছে রে।       

🍂

       চেপেচুপে থাক দানি খবরদার হাসবি নে। ব্রতচারী,মণিমেলা সব হলো গে ডিসিপ্লিনের ব্যাপার। ঝিনি চাপা গলায় ধমকে উঠল। কিন্তু এরপর যখন তাদের  আহা ডাকে রে ডাকে জনম মাটি গানের কাঠি নাচ শুরু হলো দানি মাথার ওপর হ্যাণ্ডস আপের মতো হাত তুলে বললো আমি বরং আদগুড়ুলেবাচ্চাগুলোকে  ফ্রিসবি খেলা শেখাই। আমার বদলে তুষার কাঠি নাচে দাঁড়াক।ওর করুণ মুখ দেখে ছোট বুলাদা ওকে ফ্রিসবি হাতে ধরিয়ে দিয়ে মাঠের অন্য দিকে পাঠিয়ে দিল। 
       অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি... মেঠো পথে গুনগুন করে সাইকেল চালিয়ে ঝিনি  ফিরছিল। দিন পনেরো বাদে বাদে মিষ্টুদা বাবুনিদা অশোক নগর থেকে এসে গণসঙ্গীত আর তার সঙ্গে নাচ শিখিয়ে যায়। সত্যি তো আর তারা কেউ ক্লাসিক্যাল নাচ শেখেনি। তাদের গেরাম এলাকায় ওসব নেইও। শুধু জীবন বিজ্ঞানের বেনু দিদিমনির কাছে শিখেছে রবীন্দ্রনৃত্য নামে হাত পা নাড়ানো আর  কিছু মুদ্রা ও অভিনয়।তবু ধিতাং ধিতাং বোলে বা অবাক পৃথিবীর সঙ্গে হাত পা নেড়ে এক্সপ্রেশন দেওয়ার নাম নাকি ব্যালে! বাবুনিদাদের এইসব নাচ যদি ব্যালে হয় তো কলি,বুলি,কণা,ঝিনিদের ব্যালে নাচ খুবই পছন্দ।
      ঝিনিইই দাঁড়াও ...।নীলচে মটর ফুলের লতা ভর্তি খেতের ধার দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আনমনে গুনগুনিয়ে চলেছিল সে লাইব্রেরির রাস্তায় পিছু ডাক শুনে সাইকেল থামায় সে। 
       আচ্ছা ঝিনি,  ধ্রুবদা তার  গোব্দামতো সাইকেলকখানা নিয়ে হুড়মুড়িয়ে এসে থামল। শোনো,চন্দন পিঁড়ি নদী কবিতাটা তোমার কাছে আছে? দিতে পারবে?এবারের কম্পিটিশনে ওটা লাগবে তো। আমার কাছে তো নেই আর লাইব্রেরিতেও খুঁজে পেলাম না। হ্যাঁ দিতে পারব। আমার কাছে আছে। পরশুই কলির হাতে দিয়ে ছোড়দাকে আপনি পাঠিয়েছেন বলে সাইকেল চালিয়ে দেয় সে।
      কিন্তু এত করেও ক্লাস নাইন থেকে টেনে ওঠার রেজাল্ট খারাপ হলো তার। গতবারও সাতাশি পার্সেন্ট ছিল আর এবার মাত্র উনআশি? রেগে আগুন হয়ে বকুনি শুরু হলো মা'র।আহা বিনু,উঁচু ক্লাসে উঠলে নাম্বার একটু কমতে তো পারেই।থামো তুমি।তার পক্ষে বলতে গিয়ে মার ধমক খায় বাবা। অত নাচা গানা পদ্য করলে রেজাল্ট খারাপ তো হবেই।যত নষ্টের গোড়া তোমার ছোট ছেলে।মেয়েটার মাথা তো ওই খাচ্ছে ।রাতদিন বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে হৈচৈ করলে লেখাপড়া হয় কারো? মিতুই বাড়িটাকে আস্ত ক্লাবঘর বানিয়ে তুলেছে। ওইসব নাচা গানা আজ থেকে সব বন্ধ তোমার তর্জনী উঁচিয়ে রায় দিল মা।পড়াশুনো ছাড়া আর কিচ্ছু করতে হবে না। 
       হতভাগাদের নাক টিপলে সিকনি বেরোয় রাজনীতি করা ধরেছে। বাপের গুণে গুণী তো সব।এই অপোগণ্ডটা আবার কৌটো বাজিয়ে রাস্তায় ভিক্ষে করা ধরেছে এখন থেকে। সেদিন বলছে সে নাকি দুটো ফোরের বাচ্চাকে টিউশানি পড়াবে। তাদের সঙ্গে কথাও বলা সারা। সেই টাকা জমিয়ে সে ক্লাবের বই কেনার ফাণ্ডে দিতে চায়! এদিকে নিজের পড়ায় অষ্ট রম্ভা!বড় হয়ে ওই করেই তো খেতে হবে। থাপ্পড় মেরে তোমাদের দেশের কাজ ঘুচিয়ে দেব আমি।
       ছোড়দাও আড়ালে বকেছে তাকে।খারাপ রেজাল্ট তোর হবেই বা কেন? বড়রা এত কথা বলার সুযোগ কেন পাবে? রেজাল্ট ঠিক রেখেই তো সবকিছু করার কথা যাতে কেউ বাঁধা না দিতে পারে। নিজেকেই তৈরি করতে না পারলে অন্যদের কী বলবি তুই? মাথা নিচু করে শোনে আর গুম মেরে থাকে সে।
     এত চেষ্টাতেও কিছু হলো না? সত্যিই কি পাপ লাগল মা সরস্বতী?ঝিনির সব রাগ গিয়ে পড়ল ওই ছেলের ওপর। কলির ওই দাদাই যত নষ্টের গোড়া। ধ্রুব রায়ের ওপর অন্ধ আক্রোশ লাগল তার।
            একা পেতেই এক বিকেলে ছাদের ঘরে পাকড়াও করে তাকে। শুনুন আপনার সাথে কিছু কথা আছে।বলো। আপনি আমাদের বাড়িতে আর আসবেন না। ফর্সা মুখে ব্যথার কি নীলচে এক ছায়া পড়ল? দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ঝিনি তবু সোজাসুজি তাকাল তার দিকে। আমার সামনে মাধ্যমিক। আপনি এলে আমার পড়াশুনোর ক্ষতি হয়। আমি তো মানে ঠিক তোমার কাছে মানে কল্লোল ডাকে তাইই...।জানি ছোড়দাই ডাকে, আপনি আমার কাছে নয় মুকুল ক্লাবেই আসেন কিন্তু আমার অসুবিধে হয়, আপনি প্লিজ আসবেন না।

Post a Comment

0 Comments