শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭৬ / সালেহা খাতুন
লিটল ম্যাগাজিনের সূত্রে যাঁদের সংস্পর্শে এসেছি, সেই সব মানুষদের কথা; বিশেষ করে যে সব পত্র-পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল; সেসব কথা মাথার মধ্যে ক্রমেই ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজের আনন্দের জন্যই লিখি, এতো চিরন্তন সত্যকথা। তবে একথা বিশেষ সত্য ছিল ১৯৯২-৯৩-এ। আর তা নির্বিশেষ সত্য হয়ে উঠেছে তার প্রায় দশ বছর পর থেকে। এখন যখন প্রায় কুড়িটি পত্র-পত্রিকায় নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখি, লেখা নামক ক্রিয়াটির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে পড়তে দেখি; আনন্দ হয়। বিখ্যাত লেখকরা হয়তো এমনধারা করেন না। তাঁদের অনেক আছে। তাই তাঁরা এরকম ক্ষুদ্র সুখের বড়াই করেন না।
লেখালেখির প্রসঙ্গে ছাত্রদের কথা যতই বলি না কেন, সে কথা অফুরান হয়ে যাবে। মেদিনীপুরে চব্বিশ বছরে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর সংস্পর্শে এসেছি আমি। ওরা আমাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে, তাতে আমি ওদের কাছে ঋণী হয়ে আছি। ওদের সবার কথা আমার এই ক্ষুদ্র জীবনকথায় ভরে দিতে পারছি না, আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তবে কয়েকজন জীবনের সঙ্গে এমন জড়িয়ে গেছে তাদের অতিক্রমণ সোজা নয়। এমনই একজন, শুভদীপ বসু। ওর সম্পাদনায় একটি পত্রিকা ‘দোসর’ প্রকাশিত হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। ২০১৫ তে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সব সংখ্যাতে লিখতে না পারলেও বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ও একবার একটি ছড়া প্রকাশ পেয়েছিল। দোসরের ‘ছড়াবাজি’ নামক সংখ্যাটি সংগ্রহ ক'রে বর্তমানে পঞ্চম পাঠপর্যায়ে পাঠরত ছাত্র সৌমেন ক্লাসে আমার ছড়াটির কথা উল্লেখ করে। বলে, ম্যাডাম আপনি ছড়াও লেখেন!এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার প্রাক্তন ছাত্র ও বর্তমান ছাত্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়ে গেল।
২০০৯-এ শুভদীপ মেদিনীপুর কলেজে পড়াশোনা শেষ করে ২০১১ তে আমার বিভাগেই আংশিক সময়ের অধ্যাপনায় যোগ দেয়। পরে ডেলহি পাবলিক স্কুল ও একলব্য মডেল স্কুলে পড়াতে যায়। এখন অন্যত্র শিক্ষকতার পেশাতেই আছে। তবে ওর প্যাশন আর নেশা আবৃত্তি। মেদিনীপুরের ‘স্বর-আবৃত্তি’র কর্ণধার ও। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরূপে পরিচিতি লাভ করেছে। আবৃত্তি বিষয়ক দুটি বই ‘আবৃত্তির পাঠশালা’ এবং ‘আবৃত্তির ডায়েরি’ প্রকাশিত হয়েছে। আবৃত্তির সিডিও আছে। নিজের দল নিয়ে কবিতাস্কোপ নামে নান্দনিক অনেক অনুষ্ঠানও করেছে । কবিতার অ্যালবাম আছে। ওর জনসংযোগ ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করে। ওর বিভিন্ন কাজ যখন যৌথ উদ্যোগে সম্পন্ন হতে দেখি তখন অবাক না হয়ে পারি না। ‘দোসর’ সম্পাদনা করে সৌম্যদীপের সঙ্গে, ‘চিরকুট’ নামক বই প্রকাশ করেছে সুমনদীপের সঙ্গে। সম্প্রতি কার্টুন চরিত্রে গলা দিয়েছে সুমনদীপের অ্যানিমেশন ‘বোকা পুলিশ ভার্সেস চালাক চোর’ এর পটাই চরিত্রে। ছাত্ররা সফল হলে নিজে সাফল্য পেয়েছি বলেই মনে হয়।
আর একটি পত্রিকার সঙ্গে নিজেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেটি ‘অঙ্গন’। ’‘অঙ্গন’’বিভাগের পত্রিকা। শিক্ষার্থীরাই সম্পাদনা করতো। কোয়ার্টারে থাকি বলে এমনও হয়েছে রাতে খেতে বসেছি, সে সময় ছাত্ররা প্রুফ দেখতে দিয়ে গেল। কেননা হাতে আর বেশি সময় নেই। অভীক, সিদ্ধান্বিতা, পার্থজিৎ, রঞ্জিত আরো অনেকে এক একবার এর দায়িত্ব পালন করেছে। ২০০৭, ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ পরপর কয়েকটি প্রবন্ধ সেখানে প্রকাশ পায়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমিও হাত পাকাতে থাকি। টানা দশ বছরেরও বেশি চলে পত্রিকা। পরে এম.এ. এর পঠনপাঠন শুরু হলে ‘বীক্ষণ’ নামে আর একটি পত্রিকা পরপর দুবছর প্রকাশিত হয়ে ‘অঙ্গন’ ‘বীক্ষণ’ মিলে গিয়ে হলো ‘বাংলা বিভাগীয় পত্রিকা’। দু’বার প্রকাশের পর করোনার গ্রাসে পড়ে সেও আর প্রকাশের মুখ দেখছে না। করোনা অনেক কিছুর ধারাবাহিকতা নষ্ট করেছে। ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহে ভাঁটা পড়ছে। তবুও পাঁচ বছর থেমে থাকা বিভাগীয় দেওয়াল পত্রিকা ‘প্রয়াস’ এম.এ.-এর ছাত্রী সহেলীর উদ্যোগে পুনরায় প্রকাশ পেয়েছে।
২০১২ থেকে ২০১৫ এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করা কালীন একটি পত্রিকা ‘শিক্ষণ’ প্রকাশে বিভাগের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করি। প্রথমবার প্রকাশের পর তাও যায় থেমে। প্রাতিষ্ঠানিক যে কোনো কাজে তিনটি জিনিস খুব জরুরি। অর্থের অনুমোদন, উদ্যোগ আর সময়। যে কোনো একটির অভাবে অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায় না।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নারায়ণ হালদার সম্পাদিত এবং প্রকাশিত পত্রিকা ‘পৌনঃপুনিক’ - এর জন্য আমার একটি লেখা নেয় ছাত্র শুভদীপ ত্রিপাঠী। অধ্যাপক নারায়ণ হালদারের সাথে আমার সরাসরি আলাপ এখনও হয় নি।
আমার কলেজের গার্লস হোস্টেলের ছাত্রীরা ‘পূরবী’ নামে একটি পত্রিকা করতো। নজরুল ছাত্রীনিবাস নামক সেই হোস্টেলে আমি মেদিনীপুর কলেজে জয়েন করে প্রথম মাস কাটিয়েছিলাম। জয়শ্রীদি যখন হোস্টেল সুপার ছিলেন এবং আমাদের ছাত্রী চিত্রা সেই হোস্টেলে থাকাকালীন আমার থেকে লেখা নেয়। প্রকাশ করে। পরে অন্যরাও নেয়।
🍂
আর এক ছাত্র সাগর মাহাতো নিজে প্রচুর লেখালেখি করে। আমার তত্ত্বাবধানে এম.এ.- তে ডিসার্টেশান পেপার তৈরি করে সমরেশ বসুর ‘সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা’ উপন্যাস নিয়ে। ওদের শালবনি থেকে প্রকাশিত ‘ময়ূখ’ পত্রিকার জন্য লেখা নেয় আমার থেকে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে এলো, সাতাশ বছর বয়সে আমি যখন প্রথম মেদিনীপুর কলেজে পড়াতে আসি; বলা ভালো কীভাবে পড়াশোনা করতে হয় তার ধরনধারন বোঝাতে আসি তখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বয়সের তফাত মাত্র চার পাঁচ বছর ছিল। হয়তো তাই তাদের সন্তান এবং আমার কন্যা একই ক্লাসে একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছে। আমার ছাত্রী বাসন্তীর ছেলে সাগ্নিক এবং আমার মেয়ে একই স্কুলে, একই সেকশনে পড়েছে।
আবার আমার সরাসরি ক্লাসরুমের ছাত্রীরা ছাত্রী রূপে তাদের ক্লাসরুমে পেয়েছে আমার মেয়েকে। নিবেদিতা,সঞ্চিতা অর্পিতার কথা এক্ষেত্রে বলতেই হয়। ওরা তিনজনেই এক সময়ে বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়িয়েছে। অর্পিতা এখনও পড়াচ্ছে। আর শুভদীপেরও আবৃত্তির প্রথম স্টুডেন্ট আমার মেয়ে। ২০০৯-২০১৬ টানা আটবছর শুভদীপ ওর আবৃত্তির মেন্টর ছিল। রঞ্জিতও আমার পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে মাস ছয়েক ওকে পড়িয়েছে। তেমনি একই পত্রিকায় আমার ছাত্রদের সঙ্গে আমার লেখা প্রকাশ পেয়েছে। বহুক্ষেত্রে বহুগুণে ছাত্ররা আমাকে অতিক্রম করে গেছে। আর এখানেই আমি প্রকৃত সুখ খুঁজে পেয়েছি।
ছাত্র আশিস করণ অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকার সম্পাদিত পত্রিকা ‘সৃজন’ – এ আমার লেখা পৌঁছে দিয়েছে। একবারই একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ ওখানে প্রকাশ পায়। লক্ষ্মণবাবু আমার কলেজে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল পড়িয়েছেন একসময়। তাঁর কর্মক্ষেত্র রবীন্দ্র শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়,ঘাটালেও এক সেমিনারে একবার গিয়েছিলাম।
ছাত্র অনিমেষ দত্ত খুব ভালো লেখে এবং ছবিও আঁকে। এখন প্রাক্তন হয়ে গেলেও যোগাযোগ অটুট আছে। আনন্দপুর থেকে প্রকাশিত ওর সম্পাদিত পত্রিকা ‘দুগ্গা-দুগ্গা’তেও আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ পায়।
পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক মাখনলাল নন্দগোস্বামী ‘রূপান্তর’ পত্রিকার জন্য একবার একটি লেখা নিয়েছিলেন। অধ্যাপক অরুন্ধতী সুর যখন ভট্টর কলেজে ছিলেন ‘এষণা’ নামে একটি সুন্দর জার্নাল প্রকাশ করতেন। বেশ কয়েকটি সংখ্যায় সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক অনেকগুলি প্রবন্ধ লিখি। সম্পাদকরূপে তাঁর পছন্দ অপছন্দ পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতেন। ওঁর একটি গবেষণা মূলক প্রবন্ধের বই ‘নারীর কলমে নারীর কণ্ঠ’ আমার সংগ্রহে আছে।
অধ্যাপক কপোতাক্ষী সুরের ‘আন্তর্জাতিক পাঠশালা’য় একবার লিখেছিলাম।। কপোতাক্ষীদির সাথে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পট ইভালুয়েশনে কত ভালো সময় কেটেছে। একটি রিফ্রেশার্স কোর্সে একসাথে পার্টিসিপেট করেছি। সেই সময় ওঁর সাথে ‘নন্দন’-এ একটি চলচ্চিত্রও দেখেছি। কপোতাক্ষীদি বড়ো আপন আমাদের। দীপঙ্কর মল্লিক সম্পাদিত ‘তবু একলব্য’তেও লিখেছি। দীপঙ্কর এম.এ.-তে আমারই সহাধ্যায়ী ছিল। পরে জেনেছি। মেদিনীপুর কলেজে ‘নাব্যস্রোত’- এর একটি অনুষ্ঠানে দীপঙ্কর এসেছিল। কিন্তু তখন জানতাম না ও আমারই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ।
যে সব পত্রিকায় লিখেছি, তার কয়েকটি...
বর্তমানে সেন্ট জেভিয়ার্সে অধ্যাপনা করে দেবাশিস ভট্টাচার্য। ও যখন মেদিনীপুর কলেজে ছিল তখন আমাকে দিয়ে ‘এবং মুশায়েরা’-য় বীতশোক ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখিয়ে নেয়। স্যারের জীবিতাবস্থায়। ফলে আমি কী লিখেছি সেটা বীতশোকবাবু দেখে যান। বলেন, ‘ ওর যা মন চেয়েছে লিখেছে, ঠিকই আছে’। দুঃখের বিষয় ঐ সংখ্যা প্রকাশের আগেই তিনি চলে গেলেন। পরে সম্পাদক সুবল সামন্ত নিজে ফোন করে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসের উপর আমায় লিখতে বলেন। সেটিও প্রকাশ পায় ‘এবং মুশায়েরা’য়।
মেদিনীপুরের ‘অমিত্রাক্ষর’ পত্রিকার সম্পাদক অচিন্ত মারিক পত্রিকার সপ্তম সংখ্যায় আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেন ‘মুসলিম মহিলাদের অন্দরমহলের মজলিশ’ শীর্ষক একটি লেখা। পিংলা কলেজের অধ্যাপক প্রণব মাইতির ‘প্রত্যুষা’তেও খুব সম্প্রতি লিখেছি। ‘জ্বলদর্চি’র সাথে যুক্ত হয়ে ‘তম্বুরা’, এবং ‘গঙ্গা আমার মা’র সঙ্গেও লেখালেখির সূত্রে জড়িয়ে গেছি।
লেখাপড়া একটা প্রবাহের মতো জীবনে বয়ে চলেছে। তবে এটা খুব মানি, বাড়ি থেকে দূরে আছি বলেই লিখতে পারি। মনোযোগী হতে পারি। বন্ধু চৈতালীর ‘এপার ওপার ইছামতী’ এবং অন্যান্য আরো কয়েকটি পত্রিকার কথা বারবার বললেও শেষ হবে না আমার লেখালিখির ক্ষেত্রে তাদের অপরিসীম ভূমিকার কথা। সর্বশেষ লিখেছি কবি সৌরভ আহমেদ সাকিব সম্পাদিত ‘প্রবাহ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। সৌরভ কবি। ওর ‘এবং সংঘমিত্রা’, ‘স্বগতোক্তি ও তুমি’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের কথা জেনে আনন্দিত হয়েছি। সোশ্যাল মিডিয়াই ওর সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে দিয়েছে।
(ক্রমশ)
0 Comments