দখলদারী
পর্ব ২
পনেরো দিন মীনাক্ষী বাড়ি আসেনি, রাত দখল করতে বেরিয়ে গিয়েছিল পাড়ার মেয়েরা মিলে।
হঠাৎ মীনু জিন্স আর টপ পরে দরজা খুলতে ও অবাক হয়ে গেল, কি ব্যাপার? এই জিন্সটা কেনা হয়েছিল বিয়ের পরে পরে জলদাপাড়া বেড়াতে গিয়ে। ওই বলেছিল জঙ্গলে ঘুরতে যাবো, শাড়ী পরে ম্যানেজ করার অনেক ঝামেলা, তার পর যদি বাঘে তাড়া করে? ও তখন আরো হাল্কা। দীপঙ্কর ওকে এক লহমায় কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল, এই বাঘটা আছে না, আর কোন বাঘ আসতেই পারবে না কাছে।
সেই জিন্স পরে এখন মীনুকে ঠিক চ্যানেলের রিপোরটারের মত দেখাচ্ছিল, চোখে মোটা চশমা আগেও ছিল, কিন্তু দৃষ্টিটা কেমন যেন অন্যরকম।
-কি ব্যাপার এই পোশাক?
-রাত দখল করতে যাচ্ছি, সবাই মিলে।
দীপঙ্করের মনে হোল একসরসিস্ট বা নাগিনের মত কোন সিনেমা দেখছে। হঠাৎ সাদা দিধে শান্ত বৌমানুষটির এমন অদ্ভুত পরিবর্তন?
-মাথা খারাপ না কি? কার সঙ্গে যাবে? কোথায় যাবে?
-সে সব তোমায় ভাবতে হবে না, আমরা অনেকে থাকব । সারা রাত আজ আমরা শহরের রাত দখল নেব এটাই জানি। সরমিলাদি, অর্পিতা বউদি সবাই যাচ্ছে। অর্পিতা বউদি আবার ঝিলমিল গুপ্তের কাজিনের সঙ্গে লিভ ইনে ছিল। এর একটা বিহিত করতেই হবে।
-কে ঝিলমিল গুপ্ত? কিসের বিহিত? করে কি লাভ? তোমাকেই বা করতে হবে কেন?
-তোমার ঐ কি লাভ কি লাভ এবার ছাড়ো তো, শুনে শুনে বোর হয়ে গেছি। আমাকে কিন্তু আটকাবার চেষ্টা করো না
-বাঃ আমি তোমার স্বামী, আমি কিছু বলতে পারব না? সারা রাত ধরে বাড়ীর বউ।।
মীনু আর কোন কথার জবাব দেয় নি। নটার সময় ডিনার হল চুপচাপ।
-তাহলে যাচ্ছই?
মাথা অল্প নাড়িয়ে বুঝিয়ে মীনাক্ষী বেরিয়ে গেল। বারান্দায় বসে উশখুশ করতে করতে দীপঙ্কর শুনলো একটা নদীর মত গর্জন গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে চলে যাচ্ছে।
পাড়ার সবাই ফিরে এল, মীনু ফিরল না।
🍂
কোন ফোন নয়, মেসেজ নয়, শুধু ফিরল না। রাত দখল করতে গিয়ে রাত ওকে দখল করে নিল।
অফিস ছুটি হয় না কিছুতেই, বউ পালালেও না। বিদেশি খদ্দের, দিশি চাকর এই সম্পর্ক আজো চলেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের আখের বাগানে যারা কুলি হয়ে গিয়েছিল, তারা আজ ক্রিকেট খেলতে আসে, লোকে অবাক হয়ে দেখে। আমেরিকায় তারাই আবার কোডার হয়ে খেপ খাটতে গেল, যখন ফিরে এসে রিক্সাওলাকে পরম গর্বে পঞ্চাশ টাকা টিপস দিল, সবাই অবাক হয়ে দেখল। আজকাল ওদেশের লোক একটু খিটকেল হয়ে যাচ্ছে, বেশী লোককে আর ঢুকতে দিতে চায় না, তাই খোপে খোপে একটা করে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে লক্ষ কম্পিউটার কুলি। খনির কুলিরা ঘরে ফিরত গাঁইতি কোদাল নামিয়ে। নতুন কুলিরা সারাক্ষণ পিঠে করে বয়ে নিয়ে বেড়ায় ল্যাপটপ, ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দেখা যায় লাইন দিয়ে চলেছে, পিঠে বেঢপ ল্যাপটপ ব্যাগ, তার খোপে আবার রাখা জলের বোতল, নতমস্তক, হাতে ধরা নিজের হৃৎপিণ্ডের মত মোবাইল, তাতে কখন যে সাহেব খদ্দেরের আদেশ আসবে বলা যায় না। এমনকি টয়লেটে বসেও তাই মোবাইলে স্থির চোখ।
মীনু আপত্তি করত, হাসত, বিরক্ত হত দীপঙ্করের এই অভ্যাস দেখে। শুতে গেলেও হাতে ফোন, অরগ্যাজম হতে হতে যদি ফোন আসে তাই একহাতে আদর আর একহাতে ফোন।
দীপঙ্কর জানে এটাই জীবন, কিছু করার নেই। এভাবেই চলছিল, মিনু যখন ফিরল না পনেরোটি দিন, তখন ওর মনের সবকটা কর্মচারী বেরিয়ে এসে আবার ওকে ঘেরাও করে দাঁড়ালো,
কি লাভ? দীপঙ্করের মনের বড়বাবু তাদের এক ধমক দিয়ে থামিয়ে ঠিক করল, এর একটা হেস্ত নেস্ত করতেই হবে।
হাসপাতাল, থানা কোর্ট এগুলো প্রথমবার যাবার সময় পেটের মধ্যে হাজার হাজার প্রজাপতি ওড়ে নি এমন কেউ নেই। দীপঙ্কর কোড করে, কবিতা লেখে, ছবি তুলে জুকারবারগের মেয়ে ধরার এলবাম ফেসবুকে সাঁটায়। কিছুতেই বুঝতে পারল না কি করা যায়। জিজ্ঞেস করার মত কেউ নেই ধারে কাছে। ওর নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, জ্ঞাতি গুষ্টি উঠে গেছে। ফ্ল্যাটবাড়ীর ঘরে ঘরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের পায়রাগুলি এসে পিজিতে থাকে, প্রতিবেশী বলে কেউ নেই। নো পাকিস্তান নো চায়না নো নেপাল ভূটান। সুস্থির শান্তি। কিন্তু খবর নেবার কেউ নেই। অগত্যা গুগল আর চ্যাটজিপিটির শরণ। ওরাই তো জানে সবার গোপন অসুখ ও ব্যথার খবর, রাত জেগে এন্টিবাওয়টিক পছন্দ করার গল্প, প্রেম কেন জমছে না এ নিয়ে পরামর্শ। সব।
আমার বউ পালিয়েছে। কি করা উচিত?
আরো একটু বিশদ জানতে যায় এ আই বন্ধু। কতদিন পালিয়েছে? সম্পর্ক কেমন ছিল, কোন বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা?
বিরক্ত হয়ে দীপঙ্কর খিঁচিয়ে ওঠে,
ইউ স্টুপিড, আমাকে বল কোথায় গিয়ে এখন খোঁজ করতে হবে, কমপ্লেন করলে কি লিখতে হবে, একটা চিঠি আমাকে তো লিখে দাও।
এক এ আই স্টুপিড শুনে গম্ভীর হয়ে জানিয়ে দেয় ওর ফ্রি কন্সাল্টেশান শেষ আজকের মত, এর পরে পয়সা লাগবে, নইলে আবার কাল। অগত্যা আর এক এ আই সুললিত ভাষায় চিঠি লিখে দেয় থানেদারকে।
পরের দিন অফিস কেটে, সেই চিঠি নিয়ে দুরু দুরু বুকে দীপঙ্কর হাজির এলাকার থানায়। অনেক লোকজন ঘুরছে গেটের বাইরে, অনেক গাড়ী, কিছু ভাঙা জং ধরা মারুতি পড়ে আছে, বোধহয় সিজ করা। অটো নেই একটাও। যারা ঘুরছে তারা চোর ডাকাত হতেই পারে, পকেটে ও’টি থাকতেও পারে। ভয়ে ভয়ে দীপঙ্কর ভেতরে ঢুকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। একপাশে লকআপ। সেখানে এক সুদর্শন যুবক, পাঞ্জাবী পাজামা পরা, পানের পিক না রক্ত ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, সে পায়চারি করছে আর মাঝে মাঝে গেটের কাছে উঁকি মারছে। এক পুলিশভাই তার দিকে লাঠি উঁচিয়ে ভেতরে যাবার ইঙ্গিত করতে সে খুব হাসি হাসি মুখে জানতে চায়, আমার উকিল কি এসেছে?
এলে ডাক পাবেন, এখন ঘোরাঘুরি করবেন না। বিরক্ত মুখে পুলিশ মুখ ফিরিয়ে দেখে দীপঙ্করকে, হাতে একটা ফোল্ড করা আবেদন, আর মুখে সেই ফ্যালফ্যালে হাসি। সে অযাচিত ভাবে বলে, ‘রেপ করে ধরা পড়েছে, বিরাট বড়লোক, ছাড়া পেয়ে যাবে।‘
পুলিশবাবুর আফসোসের কারণ ঠিক মাথায় ঢোকে না। দীপঙ্কর ফিস ফিস করে বলে, আমার বৌ হারিয়ে গেছে, কি করব?
এক ঘণ্টা তিরিশ মিনিট পরে দীপঙ্করের ডাক পড়ে। সুশ্রী শিক্ষিত গম্ভীর এক অফিসার ওকে বসতে বলে, বলে
-বলুন। কি ব্যাপার।
কতটা আবেগ দিয়ে বললে ইনি সিরিয়াসলি নেবেন, না হলে ভাগিয়ে দেবেন সেটা ওজন করে নিতে একটু সময় লাগে। তারপর ভেবে চিন্তে ও গম্ভীর হওয়াই ঠিক করে,
-আমার স্ত্রী একদিন ধরে খোঁজ নেই, সব জায়গায় ফোন করেছি, খোঁজ নিয়েছি, কোন খবর নেই। আপনারা যদি একটু…, শুনেছে পুলিশরা স্যার শুনলে খুসি হয়, তাই যোগ করে দেয়, স্যার কি করব এখন?
-আপনি একটা জেনেরাল ডায়েরী করে যান। আমাদের মিসিং স্কোয়াড খোঁজ শুরু করবে। চিন্তা করবেন না, আমরা দেখছি।
দীপঙ্করের সব আবেগ এক মুহূর্তে গলগল করে বেরিয়ে আসে, গলাটা হঠাৎ ভিজে যায় বিচ্ছিরি ভাবে,
-সেই রাত দখল করতে বেরিয়ে ছিল তারপর আর ফেরে নি, সবাই ফিরে এসেছে। ওই আসেনি। আগে কখনো এরকম একলা একলা কোথাও যায় নি। আমার খুব ভয় করছে, শহরে যা সব হচ্ছে
এক ধমক দিয়ে ওঠেন অফিসার,
-কি হচ্ছে? কলকাতা অন্য সব শহরের থেকে নিরাপদ জানেন তো? দেখুন উনি কারো সঙ্গে চলে গেছেন কিনা। কিছুদিন পরে খবর আসবে।
কাঁপা হাতে দীপঙ্কর ডায়েরী লেখে। সাদা কাগজ দিয়ে যায় সেই পুলিশবাবুটি। জমা দিয়ে উঠতে যাবে, অফিসার ওকে দাঁড় করায়,
-যাচ্ছেন কোথায়। আপনি কিন্তু নিজেও সন্দেহের বাইরে নয়। আমাদের সঙ্গে থাকুন, আপনার বাড়ীতে সার্চ হবে।
-আমি, আমার ওপর সন্দেহ? ও মানে, মানে আমিই ওকে… এটা কি করে ভাবতে পারলেন স্যার?
-ওটাই বেশি হয় তাই, চুপ করুন বেশি কান্নাকাটি করলে আপনার ওপর সাস্পিশান বাড়বে কিন্তু।
একটা জিপে তিনজন পুলিশ, দীপঙ্কর ও অন্য এক অফিসার, নমস্য স্বরাজ মুখারজীর মত আমুদে চেহারা গিয়ে হাজির হল ওদের ফ্ল্যাটে। এমনিতে কাউকে দেখা যায় না এই কমপ্লেক্সে, শুধু জোমাটো আর সুইগি আসে যায়। এখন দেখা গেল প্রতিটি বারান্দায় লোক।
ঘর দোর সার্চ হল। পিছন পিছন ঘুরল দীপঙ্কর। যখন বোঝা গেল কোন ডেড বডি বা মার্ডার ওয়েপন নেই, তখন আমুদেবাবুর নজর পড়ল ফ্রিজের দিকে। একবার লাঠি দিয়ে ঠুক ঠুক করলেন, নাক ফোস ফোস করে কি যেন শুঁকলেন, তার পর আদেশ দিলেন এক পুলিশকে।
ইস্কো খোলো, সাবধানী সে, কুছ গির না জায়ে।
-না না কিছু পড়বে না, সব গোছানোই আছে, ফ্রিজে কি আমি ছুরি বন্দুক লুকিয়ে রেখেছি? দীপঙ্করের আপত্তি শুনে আমুদেবাবু লাঠিটা একবার ওর নাকের সামনে এনে বলেন, জানেন এক বছরে কতগুলো ফ্রিজের থেকে কিমা করা বডি বেরিয়েছে? সরে যান, আমাদের কাজ করতে দিন।
-ক্রমশঃ-
1 Comments
htttps://www.gamble.com
ReplyDeleteViisit this sites viewes....