জ্বলদর্চি

লটকন /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৫২

লটকন

ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নয়ার পটুয়াপাড়ায় পটচিত্র অঙ্কনের সময় লাল বা কমলা রঙের জন্য এই লটকন গাছের ফলের বীজ ব্যবহার করে পটুয়ারা। বাহাদুর চিত্রকর, স্বর্ণ চিত্রকর, আনোয়ার চিত্রকররা তাঁদের মূল্যবান ছবি আঁকতে লটকন গাছের বীজ ব্যবহার করেন। তাই বাড়ির সামনেই লাগিয়েছেন এই গাছ। প্রাকৃতিক রঙ হিসেবে লটকন খুব জনপ্রিয় পটুয়াপাড়ায়। যদিও এর আদি নিবাস ছিল আমেরিকা। প্রায় তিন শতাব্দী আগে ভারতে এসেছে এই লটকন। তবে এখন দক্ষিণ ভারতে প্রচুর জন্মায়। 

বাংলায় লটকন বললেও সংস্কৃতে সিঁদুরপুষ্পি, সুকোমালা, রক্তবীজ, তৃষ্ণাপুষ্পি, করছন্দা, সিন্দুরি, মালয়লামে কুরান্নুমান্নাল, তামিলে সাপ্পিরাভিরাই, অসমীয়াতে হাতরঙ্গা, সেন্দুরি, খেন্দুর গছ, লটকন জোরাট, জোলান্ধর, মনিপুরীতে উরৈরোম, মারাঠিতে সেন্দুরি, ওড়িয়াতে লটকনস, গুজরাটিতে সিন্দুরি, হিন্দিতে লটকন, সিন্দুরি, কন্নড়ে রাঙ্গামালি, ইংরেজিতে Annato, Annatto tree, Annato dye plant, Lipstick Tree, Lipstick plant, Kesumba, Jarak Belanda, Achiote, Kunyit Jawa, Kesumba Keling, Sindoor plant, Bija, Roucou, Orellana, Urucum, Uruku, Urucu বলে। এছাড়াও এই গাছ পরিচিত কুমকুমাপুভু, কুঙ্গুমা পু, কুপ্পামঞ্জল, কেশরী, আন্নাট্টো, আর্নাট্টো, পিমেন্টাও ডোসি, সেন্থুরাম, সেন্দ্রি, সিন্দুরম, সেন্দারি, আপ্লোপ্পাস নামেও। Bixaceae পরিবারের অন্তর্গত লটকন গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম Bixa orellana। এই গাছের অন্যান্য প্রজাতিগুলি হল --
Bixa tinctaria Salisb.
Orellana orellana (L.) Kuntze
Bixa orleana Noronha
Bixa americana Poir.
Bixa purpurea Sweet
Bixa odorata Ruiz & Pav. ex G.Don
Bixa acuminata Bojer
Orellana americana (Poir.) Kuntze
Bixa upatensis Ram.Goyena
Bixa katangensis Delpierre
মাটিতে পড়ে আছে লটকনের পাকা ফলের খোলক

এটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। ৬ - ১০ মিটার লম্বা ঝোপ জাতীয় গাছ। এদের পাতাগুলি বড় আকারের হয়। পাতার শিরাগুলি বাঁকা। এই গাছের শাখার ডোগায় ২ ইঞ্চি মাপের উজ্জ্বল সাদা বা গোলাপী ফুলের থোকা ফোটে। ফুলে ৫ - ১০ টি দল থাকে। 

এর ফলগুলি গোলাকার এবং ডিম্বাকার। ফলগুলি গুচ্ছাকারে সাজানো থাকে। ফল পাকলে ফেটে যায়। ফলের মধ্যে বীজ বহু পরিমাণে থাকে। ফলের গায়ের ওপর নরম এবং কোমল কাঁটা দিয়ে ঢাকা থাকে। কাঁচা অবস্থায় ফলগুলির খোলক সবুজ হলেও পেকে গেলে লালচে বাদামী রঙের শুঁটির মতো দেখতে। প্রতিটি ক্যাপসুল বা শুঁটিতে ৩০ - ৪৫ টি শঙ্কু আকৃতির বীজ থাকে, যা একটি পাতলা মোমযুক্ত রক্ত লাল আরিল দিয়ে ঢাকা থাকে। এই বীজের গায়ে (aruatta, annatto) এক রকম লাল রং থাকে। রং কাঁচা। ফল পরিপক্ক হলে শুঁটি শুকিয়ে যায় এবং শক্ত হয়ে যায়। এরপর দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়ে বীজ বেরিয়ে পড়ে। 
গাছে ঝুলছে সবুজ লটকন ফল

বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লটকন বীজ রপ্তানি করে পেরু। এদেশ থেকে বছরে ৪০০০ টন রপ্তানি করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বার্ষিক ৫০০০ টন উৎপাদন করে ব্রাজিল। কেনিয়া রপ্তানি করে বার্ষিক ১৫০০ টন। এছাড়াও আইভরি কোষ্ট, ফিলিপাইন, অ্যাঙ্গোলা থেকেও এই বীজ রপ্তানি করা হয়। লাতিন আমেরিকার দেশ পেরু, ব্রাজিল এবং মেক্সিকোতে বিশ্বের মোট লটকন উৎপাদনের ৬০% মেলে। এছাড়াও আফ্রিকাতে মোট বিশ্ব উৎপাদনের ২৭% এবং এশিয়ায় মোট বিশ্ব উৎপাদনের ১২% উৎপাদিত হয়। ভারত ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, জাভাতে এই গাছের চাষ হচ্ছে রঞ্জক পাওয়ার জন্য। 
লটকনের পাতা

লটকনের রঞ্জক গুণের কথা বহুল চর্চিত। বহু প্রাচীন কাল থেকেই এজন্য এর ব্যবহার সর্বজনবিদিত।অ্যাজটেক সভ্যতায় ১৬ শতকে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি আঁকার জন্য লাল কালি হিসাবে এই অ্যানাট্টো পিগমেন্ট ব্যবহার করত। এছাড়াও ইনকাস ও মোচিকাসরাও ব্যবহার করতো অ্যানাট্টো। দেশ বিদেশের বিভিন্ন উপজাতীয় লোকজন তাঁদের শরীর, মুখ এবং চুলের অলংকরনের জন্য এবং অশুভ আত্মা ও দীর্ঘকালীন অসুস্থতা থেকে রক্ষা পেতে অ্যানাট্টো ব্যবহৃত করা হত। বিশেষ করে এই প্রথা লক্ষ্য করা গিয়েছে পুয়ের্তো রিকোর জনজাতি তাইনোস, ব্রাজিলের স্থানীয় উপজাতি, ইকুয়েডরের জনজাতি সাচিলা এবং আমাজন উপকূলের বিভিন্ন উপজাতীয় লোকজন এটি ব্যবহার করত। 
লটকন গাছের ফুল

লটকনের মধ্যে যেসব উপাদান থাকে, সেগুলি হল -- Acetic acid (Organic acid), 2 - Butanamine (Amine),  Pentanoic acid (Fatty acid), Phenol (Carbolic acid), Pantolactone (Lactone) এবং Benzoic acid (Organic acid)। উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীরা তাঁদের দেহ লাল রঙে রাঙাতে এবং লিপস্টিক হিসেবে ব্যবহার করে। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, মেক্সিকো, ক্যারাবিয়ান অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবারে লটকন ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন মশলা জাতীয় খাবারে কমলা রঙ যোগ করার জন্যেও এই লটকন ব্যবহৃত হয়। রক্তবর্ণ পাকা লটকন ফল।

লটকন তথা অ্যানাট্টোর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চাহিদা রয়েছে এর রঙ্গক গুণের জন্য। এটি প্রাকৃতিক রঞ্জক হিসেবে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন খাদ্য, প্রসাধনী এবং ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে রঙ করার জন্য। এটির ব্যবহারে ঐ পণ্যের কোনও ক্ষতিকারক দিক থাকেনা। আর যেসব খাদ্যে মেশানো হয়, সেগুলির রঙ কিংবা স্বাদ অপরিবর্তিত থাকে। মূলতঃ মার্জারিন, মাখন, মশলা, মাংস, আইসক্রিম এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য পনির রঙ করতে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া কসমেটিক পণ্যগুলিতেও অ্যানাট্টো ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে লিপস্টিক, নেইলপলিশ, সাবান, চুলের রঙ করতে লাগে। সিঁদুর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দেহে কোনও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেনা, তাই একে বলা হয় বায়ো সিঁদুর। এর মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক উপাদান Bixin দেহের ত্বককে রক্ষা করে ক্ষতিকর আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মির প্রভাব থেকে।

🍂

Post a Comment

0 Comments