প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
বাহান্নতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
সে কি আজকের কথা রে! অনেক অনেক দিন আগে,তা ধর আজ থেকে তিনশো বছরেরও বেশী আগে,ঘাটালের পাশে দাসপুরে একঘর বামুন বাস করতো। যদিও তখন জায়গাটার নাম ঘাটাল বা দাসপুর ছিল না তখন।কারণ, ইংরেজ আসার আগে বাংলার গ্রামগঞ্জের তেমন নামকরণের চল ছিল না।তা যা হোক, বামুনের বিষয় সম্পত্তি ভালোই ছিল।গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু…ইত্যাদি যা যা থাকলে আমরা মানুষকে সম্পন্ন বলি,তার সবই ছিল বামুন গিন্নির।মনটিও ছিল উদার।তবে ভগবান তো কাউকে সর্বসুখী করেন না, তাঁদেরও ছিল এক গভীর আক্ষেপ।
বংশধর ছিল না তাঁদের।বাড়ির পাশেই প্রতিষ্ঠা করা মন্দিরে দিনরাত প্রার্থনা করতেন,দুঃখীজনে সাধ্যমত দান ধ্যান করতেন,ব্রত,মাদুলি, তাবিজ…কিচ্ছুটি বাদ দেননি।
সাক্ষাৎ লক্ষ্মীস্বরূপিনীর এমন কান্নায় পাথরেরও প্রাণ গলে, মানুষ তো দূর।তো এমনই এক গ্রীষ্মের দুপুরে তিনি বসে আছেন মন্দির দাওয়ায়,বেলা বাড়ছে,তাপও।কর্তার মধ্যাহ্নভোজনের সময় পেরিয়ে যায়, তবু পুরোহিত মশাই এসে পৌঁছন না,নিত্যসেবা না হলে, ঠাকুর উপোষী থাকবেন যে…পুরোহিত মশাই তো এমন অবিবেচক নন,কি হলো তবে?
কর্তাকে পাঠালেন গিন্নীমা তাঁর বাড়ি…সময় পেরিয়ে যায়, অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হয়,কেউ তো আসেনা।শেষে সন্ধ্যা যখন প্রায় হয় হয়, কর্তা ফিরে এসে জানালেন, ঠাকুর মশায়ের পত্নী আবার একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন গতরাতে, দারিদ্র্য ও অসুস্থতায় সদ্যজাত ও প্রসূতি প্রায় মরমর, অসহায় পিতা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেননি, কপর্দকহীন নিরুপায় তিনি বসেছিলেন ভাঙা দাওয়ায়,কিছু করার ছিল না তাঁর।শেষে কর্তা মশাই গিয়ে কবিরাজ নিয়ে গিয়ে সে যাত্রা উদ্ধার করেন, ভাগ্যিস গিয়েছিলেন…
হে ভগবান! এ কেমন বিচার তোমার!যাকে দাও,তার সাধ্য নেই,যে কাঁদে,তার কোল ভরেনা…
🍂
বিনিদ্র সারারাতের চিন্তা ভাবনার শেষে,পরের সকালে বেশ কিছু খাবার এবং অর্থ নিয়ে কর্তা-গিন্নী গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণীর কাছে এক অসম্ভব আশা নিয়ে।তাঁর তো আরও আছে,যদি নবোজাত পুত্রটি তাঁদের…
তখনকার দিনে এসব চলতো।হাতে চাঁদ পেলেন যেন ব্রাহ্মণী।
ঘরে আরও পাঁচটি ক্ষুধার্ত শিশুর পেট,ঘরে কণামাত্র খাদ্যের ব্যবস্থা নেই, নিশ্চয়তাও নেই।কিই বা করার ছিল তাঁর! তাঁদের!
গিয়েছিলেন শূন্য হাতে, ফিরলেন গোপাল কাঁখে।তারপর, কতোদিন,কতোরাত কেটেছে স্বপ্নের মতো… দুধের শিশু খাদ্য সন্ধানে আঁকড়ে ধরতো বন্ধ্যাস্তন,অমৃতধারা তো নেই তায়, মাড়িহীন কামড়ে ব্যথা পেতেন নারী,তাতেও যেন মাতৃত্ব সৌভাগ্য উথলে পড়তো মনে।
পুরোহিত মশাই পুজো করতে এলে লুকিয়ে রাখতেন খোকাকে, যদি স্নেহের ভাগীদার হতে চান তিনি!
ক্রমে বড়ো হয় খোকা, হাঁটি হাঁটি পা পা…
হঠাৎ এক সন্ধ্যায়, ঠাকুর ঘরে প্রদীপ জ্বেলে ঘরে ঢুকতে যাবেন,দূর থেকে শুনলেন গগনভেদী কান্না…
পুরোহিত মশায়ের ছোট ছেলেটি ভেদবমির শিকার হয়ে পুকুরপাড়ে চোখ উল্টে পড়ে রয়েছে। বাচ্চা ছেলে, সারাদিন কোথায় না কোথায় বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়,কি খেয়েছিল,কে জানে!
সারারাত খোকাকে প্রাণপন জড়িয়ে ছিলেন,কর্তা গিয়েছিলেন ওবাড়ি, তিনি গিয়ে দাঁড়াতে পারেননি। কিন্তু তারপরেই ঘটেছিল আর এক অঘটন। দিনরাত মাথা ব্যাথা,গা-বমি,খাবারে অরুচি,রাতে ঘুমুতে না পারা…
বাড়িতে কবিরাজ এলেন।কী লজ্জা,কি লজ্জা! চল্লিশ বছর বয়সে গর্ভাধান!’
-’বলেন কি পিসিমা! সেই যুগে এমনটা!’
-’কেন লা মেয়ে! সুখের ঘরে ঘি-আগুন পাশাপাশি থাকলে জ্বলবে না! তুই জানিস না!’
লন্ঠনের মৃদু আলোয় অস্বাভাবিক দীপ্ত লাগছিল বৃদ্ধার চোখ! লজ্জা পাচ্ছিল অহনা…সত্যিই তো! চল্লিশ বছর কী এমন বয়স?
পরক্ষণেই নিজেদের সামলে আবার গল্পে ফিরেছিল বক্তা ও স্রোতা।
কথিত হয়েছিল এক অভিনব এবং অলৌকিক করুণ কাহিনী,যার সত্যতা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই।লোকমুখে আজও আশেপাশের মানুষ এ গল্প বলে। গল্পটি এই:একটার পরে একটা পুত্র সন্তান পুরোহিত মশাইয়ের মারা গেছে, চক্রবর্তী গিন্নী গর্ভবতী হয়ে পুত্রের মা হয়েছেন।বারো বছর পরে, পুরোহিতের ভিটেতে ঘু ঘু চরেছে, চক্রবর্তী গিন্নী পাঁচটি ছেলের মা।
-’আহা গো পিসিমা! এতো দুঃখ পেয়েও ওনারা বেঁচেছিলেন কিভাবে? চক্রবর্তী গিন্নী তো তাঁদের ছেলেটিকে অন্তত ফিরিয়ে দিতে পারতেন!’
-’না। পারতেন না। প্রথমতঃ তাঁরা নিতেন না। তাঁদের মনে হয়েছিল,তাঁরা দুর্ভাগা বলেই এমন অঘটন…তখনকার দিনে দেশে ঘরে এমন তো হতো,জন্মাতো ঢের,মরতোও ঢের।
তাছাড়া ছেলেটি ততদিনে সাচ্ছন্দ্যে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল,সে কি আবার সেই দুর্দশার জীবনে ফিরতে চাইতো? সুখ যে বড়ো বালাই মা!’
প্রায়ান্ধাকার ঘরের এককোণে জ্বলা লন্ঠনের শিখাটি কবেকার হারিয়ে যাওয়া ব্যথায় যেন কাঁপতে লাগলো,কোলের ঘুমন্ত শিশুটির অস্ফুট নিঃশ্বাসের শব্দটিও যেন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল,নিজস্ব ভাবনা ও আবেগে আগল দেওয়ার চেষ্টায় আবার খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন স্রোতা ও কথক।
ইতিমধ্যে পড়ার ছুটি পেয়ে ঘরে এসে জুটেছে বাড়ির আরও দুটি বালক, সঙ্গে তাদের মা। এসেছেন শাশুড়ি মা,জ্যাঠাইমাও।রাত গড়াচ্ছে,শীত পড়েছে, খাওয়া দাওয়ার জোগাড় করতে হবে।
আজ রাতে অহনা রান্না করেছে মায়ের কাছে শিখে আসা ফুলকপির রোস্ট,সন্ধ্যে থেকেই বাচ্চাগুলো নাক ভরে তার সুঘ্রাণ নিচ্ছে। দ্রুত হাতে দুই জায়ে মিলে মা,জ্যাঠাইমা,পিসিমাকে দুধ রুটি দিয়ে বাকি সবাইকে খেতে দিয়ে অহনার চোখ পড়লো ভাসুরের সদ্যকৈশোরে পা দেওয়া বড়ো ছেলেটির দিকে।
আহা!কি তৃপ্তি করে খাচ্ছে গো!রসমাধুর্য শান্তি মাখা সারামুখে…
হঠাৎ মনে পড়লো একটু আগে বলা পিসিমার কথা!”সুখ যে বড়ো বালাই মা!”
পার্থিব স্বচ্ছলতার অমোঘ ইশারায় প্রাণের দায় কি এভাবেই অবহেলিত হয় যুগে যুগে!
0 Comments