দূর দেশের লোক গল্প—২১৭
(দক্ষিণ আফ্রিকা, আফ্রিকা)
শেয়ালের কান্না
চিন্ময় দাশ
[আফ্রিকা দেশটির একেবারে দক্ষিণ এলাকায় সান উপজাতির বাস। কমপক্ষে ২০ হাজার বছর সেখানে বাস করে আছে এই জাতি। এই শিকারজীবি জাতির মধ্যে বহু গল্প প্রচলিত আছে। এই গল্পটি তাদেরই একটি।]
অনেক কাল আগের কথা। কতকাল আগের, সে হিসাব কারও জানা নাই। আকাশে চাঁদ ছিল না সেসময়। থাকবে কী করে? চাঁদের সৃষ্টিই হয়নি তখনও। আর, সূর্য?
সূর্য তখন অস্তই যেত না। সারাদিন থাকত আকাশে। সারা দিন ধরে আকাশের এদিক থেকে ওদিক হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। শিকারী প্রাণীদের ভারি মজা হয়েছিল তাতে। শিকার লুকিয়ে থাকতে পারত না। শিকার করা বেশ সহজ হোত।
এতে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল শেয়াল। যখন খুশি গর্ত ছেড়ে বেরোও। শিকার ধরো, আর নিজের ডেরায় ফিরে এসো। কোন ঝামেলা নাই।
সেজন্যই সূর্যের সাথে ভারি বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল শেয়ালের। কিছুদিন না যেতে, সে বন্ধুত্বটা আবার এতই গাঢ় হোল, সূর্যকে দু’দণ্ড দেখতে না পেলে, মন আকুলি-বিকুলি করে উঠত তার। তাই দেখা যেতো, আকাশে সূর্যদেব ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর শেয়ালও পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে তার তলায় তলায়।
একদিন একটা বেমক্কা ঘটনা ঘটল। নিজের ডেরা ছেড়ে বেরিয়েছে শেয়াল। বাইরে বেরিয়েই অবাক। ব্যাপারটা কী? বাইরে তেমন আলো নাই কেন? এমন মরা মরা আলো তো কোনদিন দেখা যায় না।
আকাশে তাকিয়ে তো তার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড তো কখনো ঘটেনি আগে। গেলেন কোথায় সূজ্জিঠাকুর? কোনও আপদ-বিপদ হোল না তো? শেয়ালের তো মাথায় কিছু ঢুকছে না।
এই বিপদের সময়, চুপ করে বসে থাকা যায় কী করে? ঠাকুরকে ভীষণ ভালবাসে শেয়াল। না দেখতে পেয়ে মন আনচান। দুশ্চিন্তাও চেপে বসেছে মনে। শেয়াল বেরিয়ে পড়ল সূর্যকে খুঁজতে।
সমস্যা হোল রাস্তায় বেরিয়ে। যাবে কোন দিকে? সারা দিনমান ঘুরেই বেড়ান ঠাকুর। ঠিক কোনখানে তাঁর কী বিপদ ঘটেছে, ঠাহর করবে কী করে? একবার এদিক পানে যায়। ফিরতি পথে ওদিক পানে। কোথাও তাঁর দেখা নাই।
🍂
ঘুরতে ঘুরতে প্রহর দুই কেটে গেল। উঁহু, কোন সন্ধান নাই। শেয়ালের তখন পাগল হবার জোগাড়। এত বড় একটা আগুনের গোলা। সে কি আর হারিয়ে যাবার জিনিষ? না কি, তাকে কেউ গায়েব করতে পারে?
শেয়াল পাগলের মতো ছেটে বেড়াচ্ছে চার দিকে। যত দেরি হচ্ছে, তত ভয়। মনে তত যত রাজ্যের দুশ্চিন্তা এসে জমা হচ্ছে। কী হয়েছে ঠাকুরের? বড়সড় কোন বিপদ হয়ে যায়নি তো?
ঘুরে ঘুরে হয়রাণ হয়ে গেছে। তখনই আলো হয়ে উঠল চোখমুখ। সূর্যদেবকে দেখতে পেয়ে গেল শেয়াল। সামনে বিশাল ঝাঁকড়া একটা আকাশিয়া গাছ। তার কাঁটা ঝোপে আটকে আছেন ঠাকুর।
--আমি এসে গেছি, ঠাকুর। কোন চিন্তা করবেন না। কাঁটাঝোপ থেকে আমি নামিয়ে আনব আপনাক।
সূর্যদেব চেঁচিয়ে উঠলেন—খবরদার, ভুলেও অমন কাজটি কোর না। আমার আগুনের তাত সইতে পারবে না তুমি। তাছাড়া, অতটা লম্বাও নও তুমি। এক কাজ করো বরং। পারলে, দৌড়ে গিয়ে হাতিকে ডেকে আনো। সে ঠিক তুলে নিতে পারবে আমাকে।
শেয়াল তাতে রাজি হয় কখনও? সূর্যকে প্রাণ দিয়ে ভালো বেসে ফেলেছে সে। হাতিকে তার গায়ে হাত দিতে দেয় কখনও? মরীয়া হয়ে উঠল শেয়াল।
তাছাড়া, এত প্রিয় একজনের বিপদের সময়, নিজের কথা ভাবা ঠিক নয়। এক লাফে গাছের মাথায় উঠে পড়েছে শেয়াল। টানা-হেঁচড়া করে, বের করে নিয়েও এসেছে তার প্রিয় ঠাকুরকে।
নীচে যখন নেমে এল দুজনে, নিদারুণ দশা শেয়ালের। জোড়া জোড়া শক্ত কাঁটা আকাশিয়া গাছের। তার খোঁচা খেয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড হয়েছে বেচারার।
সেসব গ্রাহ্য করল না সে। সূর্যকে সেই যে পিঠে তুলে নিয়েছে, নামাবার নামই নাই। সূর্যদেব বললেনও একবার-- এবার নামিয়ে দাও আমাকে পিঠ থেকে। আমি চলে যেতে পারব কোন রকমে।
কথাটা কানেই তুলল না শেয়াল। --চলুন, আমিই পৌঁছে দিয়ে আসছি। চুপ করে থাকুন আপনি।
সুজ্জিঠাকুরের বাড়ি তো এখানটিতে নয়। সেই কতো দূরে। দিগন্তপারের একেবারে কিনারাটিতে তাঁর ডেরা। সেখান পর্যন্ত পিঠে বয়ে নিয়ে গেল ঠাকুরকে। নামিয়ে দিল যখন, পিঠের সব লোম ঝলসে গিয়েছে তার। পায়ের থাবা চারটেও পুড়ে গিয়েছে, গাছের মাথায় চড়েছিল যখন।
সূর্য বললেন—হায় হায়! এ কী দশা হয়েছে তোমার?
--ও কিছু না, ঠাকুর। দু’দিন আপনার রোদ লাগালে, সব সেরে যাবে। ও নিয়ে ভাববেন না।
সূর্যদেব মুখে কিছু বললেন না। মুচকি হাসলেন একটু। ভালো করেই জানেন, সেরে তো যাবেই। কিন্তু পোড়া দাগ মুছে যাবে না। সারা জীবন রয়ে যাবে শেয়ালের চামড়ায়।
শেয়াল বলল—দেরি করে কাজ নাই আর। আপনি ঘরে চলে যান। ভালো করে জিরিয়ে নিন। খুব ধকল গিয়েছে। কষ্টও হয়েছে নিশ্চয়।
--তা তো হয়েছে হে। কী আর করা যাবে?
--আমি বলি কী, একটা কাজ করুন।
--কী কাজ করবো?
শেয়াল বলল—আজ আর বেরুবেন না ঘর থেকে। আকাশের মাথায় চড়ে, চক্কর কাটবার দরকার নাই। চার পহর আটকে ছিলেন। এবার চারটি প্রহর ধরে জিরিয়ে নিন।
সূর্যদেব বললেন—ভালোই বলেছ। শরীরটা যেন আর বইছে না। তুমি ফিরে যাও। অনেকটা পথ যেতে হবে তোমাকে।
সূর্যদেব নিজের ডেরায় চলে গেলেন। শেয়ালও চলল ফিরতি পথে।
তার পরেই ঘটেছিল ব্যাপারটা। সূজ্জিদেব বেশ কাহিল হয়েই পড়েছিলেন। সেই যে ডেরায় ফিরে বিশ্রামে গেলেন, তার পর আর কিছু খেয়াল নাই। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কিচ্ছুটি মনে নাই আর।
ঘুম টুটল যখন, পুরো চারটি প্রহর কেটে গিয়েছে। তবে, শরীর বেশ চাঙ্গা। মনও ফুরফুরে। আরাম বোধ হচ্ছে অনেক।
আকাশে চড়ে উঠলেন। চার-চাটি প্রহর অন্ধকারে আটকে ছিল পৃথিবী। এবার আলো হয়ে উঠল চার দিক একটু একটু করে। তিনি চেয়ে দেখলেন, এমন কিছু বদল হয়ে যায়নি কোথাও। যেমনটি ছিল, আছেও ঠিক তেমনটিই। মনে কোন চিন্তা রইল না তাঁর।
কয়েক বারই শেয়াল এসে দেখা করে গিয়েছে। গল্পগুজব হয়েছে দুজনের। কিন্তু শেয়ালের খটকা লাগল এক সময়। দিনের আলো নিভে আসছে মনে হোল। আলোর তেমন তেজ নাই আগের মতো। আকাশে মেঘও তো নাই কোন? ব্যাপারটা কী হোল? ভাবতে ভাবতে চেয়ে দেখল, সুজ্জিঠাকুর তাঁর বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছেন। এক সময় দেখাই গেল না আর তাঁকে। নিজের ডেরায় ঢুকে পড়েছেন নিশ্চয়।
সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে সূর্যের ডোবা আর ওঠা। চার প্রহর থাকেন আকাশে। চার প্রহর থাকেন না। বিশ্রামে চলে যান।
ঠাকুর যখন থাকেন না, চরাচর জুড়ে অন্ধকার। অবশ্য শেয়ালের কিছুটা সুবিধাই হয়েছে তাতে। শিকার করবার নতুন মওকা পাওয়া যায় তাতে। বেশি মেহনত করতে হয় না।
কিন্তু একটা ঝামেলাও হয়েছে। থেকে থেকেই মন খারাপ হয়ে যায় তার। চোখের দেখাটাও দেখতে পায় না প্রিয় ঠাকুরকে। ভারি কষ্ট হয়। কান্না ঠেলে আসে বুক থেকে। তখনই গলা ছেড়ে ডেকে ও্ঠে—হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া। হোয়ার আর ইউ। হোয়ার আর ইউ? (কোথায় তুমি, কোথায় তুমি?
রাতের আয়ু চার প্রহর বা বারো ঘন্টা। রাত্রি এক প্রহর হলেই, আমরা শেয়ালের ডাক শুনতে পাই-- হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া। হোয়ার আর ইউ, হোয়ার আর ইউ?
0 Comments